You dont have javascript enabled! Please enable it!

দক্ষিণ চট্টগ্রামের মূর্তিমান আতঙ্ক আহমদ সৈয়দ চোরাচালান করে কোটিপতি, ঝুলছে ২২ মামলা

কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম অফিস ॥ একাত্তরে খুন, নারী ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযােগকারী, নারী নির্যাতনের অন্যতম হােতা রাজাকার কমান্ডার আহমদ সৈয়দ এখনও দক্ষিণ চট্টগ্রামের মূর্তিমান আতঙ্ক। চন্দনাইশ, সাতকানিয়া পটিয়াতে এ রাজাকারের নাম শুনলে মানুষ শিউরে উঠে। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে এ রাজাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থেকে কোটিপতি বনেছে। স্বাধীনতার পর থেকে পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলা দায়ের হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন গােয়েন্দা বিভাগ তার বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের এ রাজাকারের আজিজুর রহমান ছিল একাত্তরে পিস কমিটির চেয়ারম্যান। আজিজের পুত্র মােহাম্মদ বাদশা মিয়া আহম্মদ সৈয়দ, মােহাম্মদ সৈয়দ সবাই মিলে ‘৭১-এ চন্দনাইশে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকার কমান্ডার আহমদ সৈয়দ তার রাজাকার বাহিনী ও পাকি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে হত্যা করে সাতকানিয়া থানার কাঞ্চনা ইউনিয়নের বুদ্ধিজীবী রায় বাহাদুর কামিনী ঘােষকে। নির্মমভাবে এ্যাসিড ঢেলে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে হারালা ইউনিয়নের মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন তথ্য সরবরাহকারী মুক্তিযােদ্ধা কামাল আহমদকে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের মুক্তিযােদ্ধা সবুজ। মিয়া, মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার আবদুস সবুর খান, বেলতলী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ।

নেতা আবদুস সালাম সওদাগরকে যুদ্ধকালীন সময়ে এ রাজাকারের বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এ রাজাকারের হাত থামেনি। তার বাহিনী বরমা ইউনিয়নের আশিষ সেন, বৈলতলী গ্রামের আবদুল আলিম ভূইয়া, মইনউদ্দিন, জাফরাবাদ গ্রামের নবাব মল্লপাড়ার ওমদা মিয়ার ছেলে আবদুস শুকুর, হারালা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা সুদর্শন বড় মাকে হত্যা করে। এ রাজাকার এলাকায় কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানী, অবৈধ অস্ত্রধারী বলে পরিচিত। ডাকাতি, জবরদখলকারী ও নানাবিধ অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযােগে রাজাকার আহমদ সৈয়দ ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে চন্দনাইশ থানায় ১৮টি, সাতকানিয়া থানায় ৩টি, পটিয়া থানায় ১টি মামলা রয়েছে। ইতােমধ্যে ২টি মামলায় সে কারাদণ্ড ভােগ করে। সাতকানিয়া থানায় এ রাজাকার ও তার দলীয় লােকের বিরুদ্ধে বেআইনী অস্ত্র ও চোরাচালানের অভিযােগে সম্প্রতি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এলাকার মানুষের মুখে মুখে রয়েছে এ রাজাকারের নারী ধর্ষণের করুণ কাহিনী, ব্রিটিশ আমলে রায় বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত কামিনী ঘােষকে যেদিন গুলি করে হত্যা করা হয় ঐ একই দিনে ৪শ’ বাড়িতে তার বাহিনী লুটতরাজ ও অগ্নিসংযােগ করে। অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজের হাত থেকে রেহাই পায়নি সাতকানিয়া থানার আওয়ামী লীগ নেতা বজল। আহমদ চেয়ারম্যান, ফয়েজুর রহমান, বৈলতলির মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার এমএ মজিদ ও পটিয়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভােকেট মােস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি।

একাত্তরে এ রাজাকার পরিবারের বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে জনতা রাজাকার আহমদ সৈয়দের পিতা পিস কমিটির চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ রাজাকার এক সময় মুক্তিযােদ্ধা ডা. এবিএম ফয়েজের হাতে ধরা পড়লে তাকে বন্দী করে রাখার একপর্যায়ে দারােয়ানের সহযােগিতায় পালাতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধা আবদুস সবুর খান রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। রাজাকাররা শহীদ মুক্তিযােদ্ধা সবুরের লাশ হাত-পা বেঁধে শংখ নদীতে ফেলে দেয়। ৩ মাইল দূরে। ৫ দিন পর এ শহীদের লাশটি খুঁজে পাওয়া যায়। ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এ রাজাকার গা-ঢাকা দেয়। ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর। তার স্বরূপ উন্মােচিত হতে থাকে। আত্মগােপন করে রাজাকার কমান্ডার আহমদ সৈয়দ নিজস্ব বেআইনী অস্ত্রধারী বাহিনী গঠন করে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। শুরু হয় হাট দখল, ঘাট দখল, হিন্দুদের জায়গা দখল, খাস জায়গার নামে গােটা চরদখল, গরিব মানুষের জায়গা-জমি জোর-জুলুমের মাধ্যমে দখল করে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ‘৭৫-পরবর্তী সময়ে ভােট ডাকাতি করে রাজাকার আহমদ সৈয়দ বৈলতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়। এ সময় সে নিজের নামে এবং পরিবার-পরিজনের নামে আইনসিদ্ধ ক’টি অস্ত্রের মালিক হয়। এ অস্ত্র দিয়ে শুরু হয় তার চোরাচালান কার্যক্রম। এ সময় এ রাজাকার চন্দনাইশকে চোরাচালানীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে। ‘৮৯ সালে ১৬ এপ্রিল রাজাকার কমান্ডার আহমদ সৈয়দসহ দলের কয়েকজন হােতা সাতকানিয়ার কেরানিহাটে ১২টি বেআইনী অস্ত্র ও চোরাচালানী মালামালসমেত একটি মাইক্রোবাসে। ধরা পড়ে। সাতকানিয়া থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও চোরাচালান মামলা (১০(৪)৮৯) রুজু হলে পরবর্তীতে কোন প্রকার সাজা ছাড়াই রহস্যজনকভাবে সে ছাড়া পেয়ে যায়।

অথচ তার দলের অন্যান্য সবাই এ মামলায় ৫ বছর জেল খাটে। গুঞ্জন রয়েছে এ মামলা থেকে রেহাই পেতে সে খরচ করেছে ৫০ লাখ টাকা। তবে আশ্চর্যজনক যে বিষয়টি তা হলাে, ঐ অস্ত্র মামলায় জব্দকৃত ১২টি আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে তার ও তার নিজের পরিবারের নামে বর্তমানে যে অস্ত্র রয়েছে তার নম্বর একই! এ রাজাকারের বিরুদ্ধে ‘৮২ সালে বৈলতলী ইউনিয়নের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী। প্রকল্পের গম আত্মসাতের মামলাও (২(৪)৮২) রয়েছে। ঐ মামলায় এ রাজাকারের ১ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিএনপির শাসনামলে এ রাজাকারের উত্থান পাকাপােক্ত হয়। জাতীয় পার্টি করার পর সে বিএনপিতে যােগ দেয়। কিন্তু কর্নেল অলির ২টি আসনের একটিতে সে মনােনয়ন পেলে অলির সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়। সে কৌশলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। সম্পর্ক গড়ে তােলে। চন্দনাইশের সর্বত্র গুঞ্জন রয়েছে রাজাকার কমান্ডার আহমদ সৈয়দ। আওয়ামী লীগে যােগ দিচ্ছে। রাজাকার আহমদ সৈয়দ জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলবে না এ মত তার পরিবারের। সম্ভবত জনকণ্ঠে তার কুকীতির কথা প্রকাশ হবে এ আভাস বুঝে সে পরিবারের কাউকে মুখ খুলতে নিষেধ করে। নগরীর বিলাসবহুল সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় বার বার গিয়ে এ প্রতিবেদক তাকে পাননি। তার টেলিফোন নম্বর ৬৫০৩৮৫-এ বার বার ডায়াল করেও কোন লাভ হয়নি। জনকণ্ঠ ॥ ১৮-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!