You dont have javascript enabled! Please enable it!

মিঠাইওয়ালা আবুল কালাম অবৈধ পথে হাজার কোটি টাকার মালিক, এখন চট্টগ্রামের শীর্ষ ধনী।

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ মিঠাইওয়ালা রাজাকার আবুল কালাম এখন চট্টগ্রামের এক নম্বর ধনী। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এ রাজাকার চোরাপথে মাল আমদানি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে। ‘৭১-এ মুক্তিযােদ্ধা হত্যাকারী রাজাকার আবুল কালামকে পটিয়ার মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের দিন পরিয়েছিল মৃত মানুষের খুলি ও হাড়গােড়ের মালা। গুজব রয়েছে, আবুল কালাম এখন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন ডােনার। জামায়াতে ইসলামী সংগঠনটির পরিচালনার জন্য প্রতি বছর এ রাজাকার প্রদান করে মােটা অঙ্কের অর্থ। ‘৭১-এর স্বাধীনতাবিরােধী আবুল কালামের রয়েছে লােমহর্ষক কাহিনী । চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার রাজাকার, আলবদরপ্রধান আবুল কালাম লেখাপড়া করেছে মাদ্রাসায় । যুদ্ধের সময় তার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও আবুল কালাম সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। পটিয়াকে ঘিরে ছিল তার নেটওয়ার্ক। পাকি বাহিনীকে বিভিন্ন রসদ ও খবরাখবর সরবরাহ করত আবুল কালাম। তার বাহিনীতে লিডার কালাম বলে পরিচিত এ কালামকে মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেফতার করলে তার বড় ভাইয়ের সহযােগিতায়। সে ছাড়া পায়। জনশ্রুতি রয়েছে, যে মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ তাকে গ্রেফতার করে সে গ্রুপের দু’জন মুক্তিযােদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার মনসা গ্রামের এ রাজাকার সবাইকে পাকিস্তানের পক্ষে থাকতে বােঝাত। দেশ স্বাধীন হবে না এ কথা বুঝিয়ে গেলেও যখন দেশ স্বাধীন হয়ে যায় তখন রাতের আঁধারে রাজাকার গ্রুপ পালানাের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ভাের ৫টায় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ধরে ফেলেন। তাদের নিয়ে আসা হয়।

দোহাজারী রেলস্টেশনে। মুক্তিযােদ্ধারা লিডার কালামসহ অন্য রাজাকারদের জঙ্গল থেকে আনা বিভিন্ন হাড়গােড়ের মালা পরায়। মালা পরিয়ে তাদের পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরে নিয়ে চুবানাে হয়। পরবর্তীতে আবুল কালাম তার মুক্তিযােদ্ধা ভাইয়ের সহায়তায়। উদ্ধার পেলে চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুরে পালিয়ে যায়। দিনাজপুরে গিয়ে শুরু করে গুড়ের ব্যবসা। ঢাকায় এনে গুড় বা মিঠাই বিক্রি করে তার গােপন জায়গায় ফিরে যেত।’ চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলাে বলেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবুল কালাম প্রকাশ্যে চট্টগ্রাম ফিরে আসে। চট্টগ্রামের চাক্তাই, মৌলভীবাজার ও ঢাকা প্রভৃতি। স্থানে মিঠাইয়ের ব্যবসা শুরু করে। ‘৭৭-এর দিকে সে চাক্তাইয়ে বাহারি মালের দোকান। খােলে। আস্তে আস্তে সে ঝুঁকে পড়ে লাভজনক সয়াবিন তেলের ব্যবসার দিকে। ব্যাংক। থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তােলে একটি অয়েল রিফাইনারি মিল। বছরে ২০ হাজার টন। রিফাইন করার কথা থাকলেও শুরুর দিকে ভেজাল তেলে বাজারে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করে। তেল দেয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আগাম কোটি কোটি টাকা আদায় করে। অভিযােগ রয়েছে, সে এক সময় বছরে আমদানি করে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। ক্রুড অয়েল, এর ২০ হাজার টন রিফাইন করলেও ৫০ হাজার টন রিফাইন ছাড়াই বাজারে ছেড়ে দেয়। বেশিরভাগ তেল যায় উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গে এ তেল। সামাজিকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তেলের পর তার হাত যায় চিনির দিকে। জিয়া সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ চিনি। অবৈধ পথে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে এসে বহির্নোঙ্গরে খালাস করে। বহির্নোঙ্গর থেকেই এ চিনি চলে যায় নারায়ণগঞ্জ, সদর ঘাটে। এ সময় কালামের চিনিতে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। একই কায়দায় সে আমদানি করে নারকেল তেল। ৫০ কেজি বাণ্ডিলের ভিতরে ২শ’ কেজির বাণ্ডিল আমদানি করে এ রাজাকার বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাকি দেয়। আয়। করে কোটি কোটি টাকা।

সয়াবিন তেল তার জীবনে আশীর্বাদ হলে ‘৯৩-এর দিকে আবারও তেল কেলেঙ্কারি। করে সে। সরকারের গােয়েন্দা সংস্থা এ সময় ব্যাপক তদন্ত করলে প্রমাণ মিলে তার সরবরাহকৃত তেলে যে পরিমাণ বিশুদ্ধতা থাকা দরকার তা নেই। ভেজাল প্রমাণের পর তার বিরুদ্ধে মামলা হলে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি হয়। কিন্তু টাকা ঢেলে কালাম তৎকালীন কয়েক মন্ত্রীর পৃষ্ঠপােষকতায় রক্ষা পেয়ে যায়। ‘৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারিতে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর আগে কালাম দেশের অপর এক শীর্ষ ব্যবসায়ীর সাথে যৌথভাবে কিনে নেয় চিটাগাংয়ের বৃহৎ একটি সিমেন্ট মিলের ৫১ ভাগ সরকারী শেয়ার। পরবর্তীতে বিদেশী কোম্পানি এলএনটির সাথে।  শেয়ার বিক্রির একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তির পর ঘটে শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা। জনশ্রুতি রয়েছে, তার কোম্পানির বিপুল পরিমাণ জাল নকল শেয়ার বাজারে বিক্রি হয়। এমনও গুজব আছে, বর্তমানে বাজারে তার কোম্পানি হতে সাপ্লাইকৃত একই ধরনের একাধিক শেয়ার রয়েছে! শেয়ারের উত্থানের সময় জনৈকা “খালেদা বেগমের শেয়ার সার্টিফিকেটে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কার্ব মার্কেট ভরে যায়। এ শেয়ার কেলেঙ্কারিতে রাজাকার আবুল কালামের নাম শীর্ষে রয়েছে। দেশের বৃহৎ এ সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ার নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে সম্প্রতি ২৬ ভাগ শেয়ার বিক্রি হয় বিদেশী একটি কোম্পানির কাছে। প্রতিটি ১০০ টাকার শেয়ার ১৬০০ টাকা করে বিক্রি করা। হয়। এ বিক্রির ঘটনায় কালাম টাকার কুমির বনে যায়। দেশের বৃহত্তম কাগজকল “কর্ণফুলী পেপার মিল” পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কারণসমূহের মধ্যে কালামের তৎপরতা অন্যতম। পেপার মিলে বিশ্বখ্যাত সাদা পেপার (২৬-৩২) সে। কৌশলে হাইজ্যাক করে। কালাম কাগজকল বসানাের পর কর্ণফুলী পেপার মিলের। জনৈক উর্ধতন কর্মকর্তাকে বিপুল টাকা দিয়ে সাদা কাগজ উৎপাদন ১ বছরের জন্য কৌশলে বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়।

এই ১ বছরে তার পেপার বাজার দখল করলে বন্ধ হয়ে যায় কর্ণফুলী কাগজকল। এভাবে তার কুকীর্তির শেষ নেই। রাজাকার আবুল কালাম অবৈধ পথে ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ২০টিসহ সারা দেশে তার অসংখ্য বাসা, অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকার কাওরান বাজারে তার গ্রুপের ৪০ তলা বিল্ডিং উঠছে, হাতিরপুল বাজারে তার কোম্পানির আলীশান বাড়িসহ রয়েছে। বিশাল শােরুম। পাশেই রয়েছে তার অত্যাধুনিক এ্যাপার্টমেন্ট। রাজাকার আবুল কালাম খাতুনগঞ্জের অফিসে বসে বেশির ভাগ সময় নিয়ন্ত্রণ করে তার। ব্যবসা। ছােট বড় ৫২টি শিল্প কারখানার মালিক রাজাকার আবুল কালাম কিভাবে, কোন্ পথে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনেছে তা নিয়ে কোন সরকারের আমলে তদন্ত হয়নি। অথচ চিনি কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়ে এ রাজাকার কাস্টমকে প্রায় ১ কোটি টাকা। জরিমানা দিয়েছে। কাস্টম বিভাগ ও বেনাপােলে রয়েছে তার নিজস্ব লােক। সীমান্ত পথে তার কয়েকটি অফিস রয়েছে। রাজাকার আবুল কালাম ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক। তার টাকার স্রোত থেমে থাকে না। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন কালাম তাল মিলিয়ে নেয়। সরকারের মন্ত্রী-আমলারা থাকেন। তার হাতের মুঠোয়। এত কুকীর্তির পরও তার বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন নেয়া হয়নি। চট্টগ্রামের জামায়াতের শীর্ষনেতা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে জামায়াত টিকে থাকার। পিছনে কালামের অবদান শীর্ষে। এ কালামের সাথে জামায়াতের শীর্ষনেতাসহ শিবির। ক্যাডারদের সুসম্পর্ক রয়েছে। চট্টগ্রাম জামায়াতের জন্য প্রতি বছর সে মােটা অঙ্কের টাকা গত দশ বছর ধরে প্রদান করে আসছে। এ রাজাকারের অর্থের উৎস খতিয়ে দেখা প্রয়ােজন বলে সংশ্লিষ্ট মহল মত ব্যক্ত করেছে। তার মুক্তিযােদ্ধা বড় ভাইয়ের সহায়তায় রাজাকার কালাম রক্ষা পেয়ে যায় বার বার । তার ভাবিও চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামী লীগের শীর্ষনেত্রী। স্বাধীনতাবিরােধী আবুল কালামের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তার অফিসে সশরীরে গিয়ে এবং টেলিফোনে বার বার চেষ্টা করলেও সে সাড়া দেয়নি। তার অফিসের এক কর্মকর্তা শেষ পর্যন্ত বলেন, ‘স্যার পত্রিকার লােককে সাক্ষাত দেন না!

জনকণ্ঠ ॥ ১৪-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!