You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঘাতক বইজ্যার নামে তিতাস তীরের টানমান্দাইলের মানুষ আজও আঁতকে ওঠে

রিয়াজ উদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে: একাত্তরে বইজ্যা ওরফে বজু মিয়া। রাজাকারের অত্যাচারের বীভৎস চিত্র বর্ণনা করে আজও মানুষজন কেঁদে ওঠে। কুখ্যাত এ রাজাকারের লুটপাট নির্যাতন কাহিনী শুধু মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গেই তুলনা করা চলে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে, পতাকা থাকবে এটা সে মেনে নিতে চায়নি। এ জন্যই সে পাকি ঘাতকদের সার্বিক সহায়তা করেছে। পিতাহারা পুত্র, পুত্রহারা পিতা যখন বইজ্যা রাজাকারের নির্মম পৈশাচিকতা বর্ণনা করে। তখন পথিকের পথ চলা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ হয়ে উঠে ভারি। অসংখ্য লুটপাট নির্যাতন আর হত্যার মদদদাতা বইজ্যা রাজাকারের নাম শুনলে এখনও মানুষ রাগে চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে আজও মূর্তিমান আতঙ্ক। এ ঘাতকের কাল হাতের ছোঁয়ায় কত যে মানুষ মরেছে তার কোন হিসাব নেই । কত শত মূল্যবান প্রাণ, সংসার, সহায়-সম্পদ তছনছ হয়ে গেছে স্বাধীনবাংলার ইতিহাসে তা লেখা নেই। তিতাস তীরের ক্ষুদ্র জনপদের বাসিন্দারা সেই ৩০ বছর আগের কথা এখনও ভুলেনি। স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষজনের স্মৃতির মণিকোঠায় ভয়ানক অত্যাচারী বইজ্যা রাজাকারের রুদ্র মূর্তি ভেসে বেড়ায়। হারিয়ে যাওয়া স্বজনরা সে রাজাকারের নাম শুনলেই খুন চড়া হয়। বইজ্যা ও মােক্তার রাজাকারের মদদে সে দিন ইতিহাসের লােমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার টানমান্দাইলে। বইজ্যার বাড়ি আখাউড়ার মােগড়া গ্রামে। দুরুইল গ্রামে হলাে মােক্তারের বাড়ি। ধনে জনে কমতি নেই বইজ্যার। সহায় সম্পদও যথেষ্ট। সে এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। টানমান্দাইল গ্রাম থেকে বেশ কিছু লােক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।

এটা তার সহ্য হয়নি। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় পাকিদের এ দোসর। কারা কারা যুদ্ধে গেছে এ তালিকা তৈরি করে পাকি হায়নাদের প্রদান করে। এ জন্য শুধু এ গ্রামেরই ৩৩ নিরীহ নিরপরাধ ব্যক্তিকে অমানবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। এ অঞ্চলে যাবতীয় এ্যাকশন প্লন হতাে তার আদেশ-নির্দেশে। সেদিন ছিল ২২ আগস্ট, বাংলা ৭ ভাদ্র। পড়ন্ত বেলা। পাক মেজর সিকান্দর আলীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য টানমান্দাইল গ্রামের পূর্ব পশ্চিম দু’দিক। দিয়ে আসতে থাকে। তাদের পথ নির্দেশক হিসাবে ঘাতক বইজ্যা ওরফে বজু মিয়া ও মােক্তার মিয়া ছিল। বিরাট আকৃতির নৌকা বােঝাই খান সেনাদের আগমন টের পেয়ে মানুষজন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। যে যার মতাে করে পালানাের চেষ্টা করে। তখন গ্রামের। পশ্চিমদিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে পাক ঘাতকরা। আহত হয় বেশ কিছু লােক। সে। সময় পাকদের দোসর রাজাকার বইজ্যা গ্রামবাসীদের অভয় দেয়। ডাকাডাকি করে বলে, আপনাদের কোন কিছুই হবে না। আমি আছি। আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না। বইজ্যার আত্মীয়স্বজনও ছিল এ গ্রামে। ফলে সম্পর্কে সে যা লাগে তাই বলে ডাকা ডাকি করে। বলে পাক আর্মি আপনাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিটিং করতে এসেছে। ওরা ক্ষতি। করতে আসেনি। আপনারা ফিরে আসুন, কেউ যাবেন না। গ্রামে যাতে শান্তি বিরাজ করে সে জন্য শান্তি কমিটি গঠন করা হবে। এ কথা বলে গ্রামবাসীদের জড়াে করে। এ গ্রামের হাজীনূর বক্সের বাড়িতে জড়াে হয় বিপুল সংখ্যক লােক। এরপর কার ভাই, কার পিতা বা আত্মীয়স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গেছে সে তালিকা বের করে। নাম ধরে ডাকতে থাকে পাক মেজর। গ্রামবাসীদের ওপর তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। জড়াে হওয়া। গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে ১৩৫ জনকে বাছাই করে। দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে তাদের। পরে ১৩৫ জনকে নিয়ে যায় গঙ্গাসাগর বট গাছের নিচে। তখনও বইজ্যা রাজাকার বলতে থাকে, তাদের কোন ক্ষতি হবে না।

সেখানে তাদের নিয়ে রাতে প্রচণ্ড নির্যাতন। করা হয়। হাঁটুর নিচ দিয়ে হাত দিয়ে কান ধরিয়ে পিঠে আঘাত করে। এরপর রাজাকার গ্রামবাসীদের জানিয়ে দেয়, এ গ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী বনজ গ্রামে যারা পালিয়ে গেছে। টাকা দিয়ে যাতে তাদের আত্মীয়স্বজনদের মুক্তি করে নেয়। এ ভাবে কয়েকজনের কাছ থেকে মুক্তিপণের ৩৬শ’ টাকা হাতিয়ে নেয় বইজ্যা। আটককৃতদের মারধর করবে না, এ জন্য হাতিয়ে নেয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু তারপরও আটককৃতদের ওপর নির্যাতন। মাত্রা কমেনি। নির্যাতনের পর ছােট একটি টিনের ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়। পর। দিন সকালে তাদের বের করে ফের হাটুর নিচ দিয়ে হাত দিয়ে কান ধরিয়ে পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় । কান ধরে উঠবস করায়। বইজ্যা রাজাকার সে সময় সারাক্ষণ পাক। সেনাদের সঙ্গে থাকত আর বলত, ‘স্যার বাঙালী বড় খারাপ হে’। সে দিনের নির্যাতনের। পর তাদের মধ্যে থেকে ৩৩ জনকে বাছাই করে । পৃথক করে রাখে তাদের। বাকিদের। দীঘির উত্তর পাড়ে রাখে। গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে সিদ্দিক মেম্বারের বাড়িতে দুটি গর্ত করে। পরে তাদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। লাশ মাটি চাপা দেয়। অন্যদের। নির্যাতনের পর রাজাকাররা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর বইজ্যা রাজাকার আত্মগােপন করে। দীর্ঘ ১৪/১৫ বছর যাবত সে পালিয়েছিল। এখানে সেখানে ঘােরাফেরা করেছে। টানমান্দাইল গণহত্যার পর এখন পর্যন্ত সে এ গ্রামে আর যায়নি। এমনকি দরখার-আখাউড়া রুট দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

আখাউড়ায় কাকে ধরতে হবে আর মারতে হবে সবকিছুতেই তার ইঙ্গিত থাকত। তার হুকুম ছাড়া পাক সেনারা এক কদমও এগুতাে না। অত্যাচারী এ রাজাকারের কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। ৩৩ হত্যার নায়ক বইজ্যার নাম শুনলে মানুষ এখনও থু থু ফেলে। সে দিন যাদের হত্যা করা হয়–সারজুল হক মুন্সী (২০) পিতা তদবিল হুসেন মুন্সী, তারা চান মােল্লা (১৮) পিতা আবদুল খালেক মােল্লা, গােলাম কাদির মেম্বার (৬০) পিতা সাবােদ আলী মােল্লা, ডাঃ আবু তাহের (৮০) পিতা হাজী নূর হােসেন মুন্সী, তােতা মিয়া (৬১) পিতা আলতাব আলী সরকার, তারা মুন্সী (৪০) পিতা হাজী মন্তাজ আলী মুন্সী, আবুল ফয়েজ (৪৬) পিতা মফিজ উদ্দিন, আবদুল গনি (৮২) পিতা চাইন উদ্দিন, মালুমিয়া মুন্সী (৫৫) পিতা জব্বর আলী, আবুল হাশেম মােল্লা (৫৮) পিতা রুসমস আলী, আবুল ফয়েজ (৫০) পিতা মফিজ উদ্দিন, গােলাম মাওলা (৬১) পিতা মাইজুদ্দি, আবদুল মন্নাফ মিয়া (৭০) পিতা মরফত আলী, ছােবাহান মিয়া (৬২) পিতা বােছত আলী, রাজুমিয়া (৫০) পিতা আবদুস সােবাহান, আবুল বাশার (হাবিলদার) (৪১) পিতা হাজী নূরহােসেন মুন্সী, রিয়াজ উদ্দিন (৪৫) পিতা কিতাব আলী, আব্দুল হান্নান (৩৮) পিতা আঃ গফুর, খেলু মিয়া (২২) পিতা আব্দুস সাত্তার, কাতুমিয়া (৮৫) পিতা হাজী নূর বাদশা মুন্সী, বাবরুমিয়া (২২) পিতা শের আলী, শামসু মিয়া সরকার (৭৮) পিতা বাবু সরকার, সাজাউল হক সরকার (৬০) পিতা মােকসুদ আলী, জজ মিয়া (৩২) পিতা অজ্ঞাত, মালুমিয়া (২৭) পিতা মইদর আলী, সাধন মিয়া (৮০) পিতা হাফিজ উদ্দিন, ডেঙ্গুমিয়া (২৫) পিতা ওয়াহেদ আলী, মােসলেম মিয়া (২২) পিতা ঝানু মিয়া, ওমর আলী (৭০) পিতা জমশের আলী, সবল মিয়া (১৮) পিতা আমীর হােসেন, আবু মিয়া (৭০) পিতা তাজউদ্দিন, আব্দুল আলীম (৪৫) পিতা ঐ। বইজ্যা রাজাকার যা বলেছে। দৈনিক জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বইজ্যার কথা হয় তার বর্তমান বাসস্থান মােগড়া গ্রামে। এক কালের দুর্দান্ত প্রতাবশালী বইজ্যা এখন চলচ্ছক্তিহীন। কপালের। বলি রেখায় ভঁাজ পড়েছে। রােগ বালাইয়ে কাবু হয়ে পড়েছে। রাজাকার হয়ে বহু অন্যায় অবিচার করার অভিযােগের জবাবে সে বলে, মােটেও সঠিক নয়। আমি হলাম মুসলিম লীগের লােক। টানমান্দাইল গণহত্যায় তার মদদ থাকার কথা সে অস্বীকার। করে। সে প্রশ্ন রাখে, এ সর সঠিক হলে আমাকে ছাড়ল কেন? জেলে দিল না কেন। সে বলে, ‘মুক্তিবাহিনীকে আমি সহায়তা করেছি। ১/২ মাস খাইয়েছি। আমি কোন হত্যার সঙ্গে জড়িত নই। মুক্তিরা আমাকে বেঁধে ইন্ডিয়া নিয়ে যায়। নির্মমভাবে নির্যাতন।

জনকণ্ঠ ॥ ১৯-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!