You dont have javascript enabled! Please enable it!

সরাইলের চুন্টায় ২২ জনকে খুনের হােত টাক্কাব আলী দখল করেছে এসি একাডেমীর ৩০ বিঘা জমি

রিয়াজ উদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ সন্তোষের বুকফাটা কান্নায় আজও সরাইলের বাতাস ভারি হয়। বৃদ্ধ সন্তোষের কান্না যেন এখনও থামছে না। মহান একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গেলেই সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ভৎসনা করে কুখ্যাত রাজাকার এমদাদুল হক টাক্কাব আলী ও তার দোসরদের। সন্তোষ কুমার ভদ্রের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভগ্নিপতি রমণী কান্ত সরকার ও ভাগিনা রনদা সরকারকে ভাত খাওয়া অবস্থায় ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। রনদার মা মুক্তিযােদ্ধাদের খাবারদাবার রান্না করত। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এ অভিযােগেই এ দু’জনকে ধরে নিয়ে যায় সেই রাজাকার টাক্কাব আলী ও তার দলবল। ঘাতক দল যখন তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে। যাচ্ছিল তখনও টাক্কাব আলী হুমকি দিয়ে বলে, তাের মা মুক্তিফৌজের ভাত রান্না করে সারা রাত। আহন খাওয়াইছ। এ কথা বলেই সন্তোষ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তার চোখের সামনেই সেদিন তাদের ধরে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে দুর্ধর্ষ রাজাকার টাক্কাব আলী ও তার নেতৃত্বে গঠিত অত্যাচারী গ্রুপটির কাছে জিম্মি ছিল এ অঞ্চলের মানুষ। ঘাতক দালাল রাজাকার টাক্কাব আলীর সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে অবরুদ্ধ ছিল চুন্টা ও সরাইলের বাসিন্দারা। সরাইলের লােকজন আজও সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যায়নি। ভােলেনি রাজাকার নামক সন্ত্রাসী গােষ্ঠীর নৃশংসতার কথা। প্রবীণ জনরা ঘৃণাভরে। উচ্চারণ করে তার নাম। একাত্তরে তার ছিল প্রচণ্ড দাপট।

লােকে বলে এ ঘাতকের নাম। শুনলে তখন বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খেত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামের মৃত হাজী মমতাজ মুন্সীর পুত্র হলাে রাজাকার এমদাদুল হক টাক্কাব আলী । ভয়ঙ্কর অত্যাচারী এ ঘাতক চুন্টা ইউপি পিস কমিটির কনভেনর ছিল। দেশবিরােধী এমন কোন কাজ নেই যা সে করেনি। মানুষের জায়গা সম্পত্তির প্রতি তার লােভ ছিল দুর্দমনীয়। কত অসহায় লােকের ভূসম্পত্তি যে সে কেড়ে নিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। দখলের পর সেসব সম্পত্তি বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি অর্থ লুটেছে। চুন্টা। দক্ষিণেশ্বরী কালি মন্দিরের দেবােত্তর ১০/১২ বিঘা সম্পত্তি প্রথমে দখল করে। পরে অন্য। জায়গায় বিক্রি করে দেয় । চুন্টা এসি একাডেমীর ৩০ বিঘা বাড়ি, পুকুর, জমিও দখল করে রেখেছে এখন পর্যন্ত, যার মূল্য কোটি টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামের মৃত হাজী মমতাজ মুন্সীর পুত্র হলাে কুখ্যাত রাজাকার এমদাদুল হক টাক্কাব আলী। যুদ্ধের ৯টি মাস তাে বটেই, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তার ক্ষমতা ছিল অসীম। এ ঘাতকের কথায় প্রশাসন উঠবস করত । চুন্টা অঞ্চলে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। পাকিস্তান রক্ষার এমন কোন চেষ্টা সে বাদ রাখেনি। চুন্টা গ্রামে রাজাকার ক্যাম্প করে। সে ক্যাম্পের হর্তাকর্তা ছিল। প্রথম খানসেনারা সরাইলচুন্টায় আসে তার পৃষ্ঠপােষকতায় ।

এ এলাকায় ইতিহাসের বর্বর হত্যাকাণ্ডটি হয় তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২২ জনকে প্রচণ্ড নির্যাতন করে হত্যা করে। সরাইলের চুন্টা এলাকাটি মূলত ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এমদাদুল হক টাক্কাব আলী রাজাকার ও তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী গােষ্ঠীর কার্যক্রম চালু করে। উৎপীড়ন করতে থাকে সাধারণ মানুষদের। এ গ্রামেরই অমরেশ চন্দ্র সেন ও তার পরিবার শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে । শুধুমাত্র মাটির মায়ার টানে। থেকে যায় অমরেশের বয়ােবৃদ্ধ পিতা যােগেশ চন্দ্র সেন। তার বাড়িটি দখল করে রাজাকার ক্যাম্প বানানাে হয়। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, হায়নাদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি যােগেশ চন্দ্র সেন। বাড়িটি নিজে গ্রাস করার জন্য নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাকেও। লােপাড়া গ্রামের ৫/৬টি ঘরবাড়ি আগুনে ভস্ম করে এ ঘাতকের পরিচালিত রাজাকার বাহিনী। লুটতরাজ করে ঘরের আসবাবপত্র। সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের অত্যাচারী এ রাজাকার দেশ স্বাধীনের পর সমাজসেবক বনে যায়। চুন্টা ৩ নং ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় একাধিকবার। বিশেষ কায়দায় বার বার সে বিজয়ী হতাে। যুদ্ধের সময়ও এ ঘাতক ইউপি চেয়ারম্যান ছিল। সে সুবাদেই মূলত অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তার আদেশ-নির্দেশ ছাড়া কোন কাজই হতাে না। তারই তত্ত্বাবধানে মার্চ করা রাজাকাররা সে গ্রামের নিরীহ নিরপরাধ গ্রামবাসীকে অমানবিকভাবে হত্যা করে। ব্রাশ ফায়ারে শরীর ঝাঝরা করে ক্ষতবিক্ষত করে। সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রামবাসীরা আজও শিহরিত হয়। সেদিন ছিল ১৬ অক্টোবর ১৯৭১ সাল।

ঘড়ির কাঁটা ঘুরে দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। চুন্টা গ্রামের লােকজন কেউ গােসল, কেউ খাবার ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত। ঠিক তখনই রাজাকার টাকাব আলীর নেতৃত্বে চিহ্নিত রাজাকাররা চুন্টার প্রধান সড়কে মার্চ করে। অথচ পূর্ব থেকেই ঘাতক টাক্কাব আলী গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করে জানায় কারও কোন ক্ষতি হবে না। অসুবিধা নেই। ফলে লােকজন গ্রামেই অবস্থান করছিল। ঠিক দুপুর নাগাদ পাকবাহিনী ও রাজাকাররা যৌথ অপারেশন শুরু করে। গ্রামের লােকজন তখন ভয়ে পালাতে থাকে। কেউ পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে, কেউ দৌড়ে, কেউ বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। এরপর অন্তত ২৫ জন নিরপরাধ হিন্দু গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। প্রচণ্ড নির্যাতনও করে। তার পর খবর পাঠায় তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। আটক গ্রামবাসীদের ছেড়ে দেয়ার কথা বলে বহু টাকা-পয়সাও হাতিয়ে নিয়েছে। খাবার ও কাপড় সরবরাহের জন্য নিয়েছে টাকা-পয়সা। সেদিনের ঘটনায় ৩০/৪০ রাজাকার অংশ নেয়। বীরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস বললেন, রাজাকার বাহিনী মার্চ করেই গ্রামবাসীদের ধরতে থাকে। তখন প্রতিবাদ করার সাহস কারও ছিল না। ১৮ অক্টোবর সােমবার রাতের আঁধারে ধর্ম তীর্থ হাওর এলাকায় ২২ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাক ঘাতকরা সেই রাজাকার টাক্কাব আলী ও তার দোসরদের সহায়তায় মানবতাবিরােধী হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করে। নিহতদের সবাই ছিল হিন্দু। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও যাদের অত্যাচারে অত্যাচারিত ছিল এ এলাকার লােকজন। কেউ কেউ মারা গেলেও বেশির ভাগই চলছে দাপটের সঙ্গে।

এরা হলাে এমদাদুল হক টাক্কাব আলী, সিরাজ মিয়া, কুদুস মিয়া, মাফুজ মিয়া, মারফত আলী, জবান আলী, জিন্নত আলী, ছিপত খা, আবুল কাশেম, রহিম বক্স, এমাদ আলী, মতি মিয়া, আবু শামা, মহবত আলী, মােঃ আলী, কাতু মিয়া, বুধাই মিয়া, গােল মােহাম্মদ, রহমত আলী, রেহমান, শাফি মিয়া, তাজ মিয়া, মােতালিব, সুরুজ মিয়া, শাহজাহান মিয়া, উরন আলী, নুর মিয়া, সাত্তার ও ছায়েদ আলী । চুন্টা আওয়ামী লীগ অফিসে এসব ঘাতকের নাম আজও সংরক্ষিত আছে। সেই। দুর্ধর্ষ ঘাতক রাজাকার ঢাকার ইব্রাহীমপুরে বসবাস করছে। সে এখন কোটিপতি। সহায়সম্পদ আর অর্থে প্রতিষ্ঠিত। একবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছিল। সেদিন যাদের হত্যা করা হয়। যােগেশ চন্দ্র সেন, পিতা ভগবান চন্দ্র সেন, রমণী কান্ত সরকার, পিতা রজনী কান্ত সরকার, রনধীর সরকার, পিতা রমণী কান্ত সরকার, তরণী ভট্টাচার্য, পিতা সুদর্শন ভট্টাচার্য, পরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, পিতা পিতাম্বর ভট্টাচার্য, ননী ভূষণ বিশ্বাস, পিতা মরণ চন্দ্র বিশ্বাস, পরেশ চন্দ্র বিশ্বাস, পিতা ননী ভূষণ বিশ্বাস, ধীরেশ চন্দ্র বিশ্বাস, পিতা ননী চন্দ্র বিশ্বাস, সুকুমার বিশ্বাস, পিতা ভগবান চন্দ্র বিশ্বাস, রূপচান বিশ্বাস, পিতা লালচান। বিশ্বাস, সােনার চান বিশ্বাস, পিতা লালচান বিশ্বাস, লালচান বিশ্বাস, পিতা সুকুমার বিশ্বাস, গােপাল চন্দ্র বিশ্বাস, পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, গােপাল চন্দ্র পাল, পিতা ধনীরাম পাল, অধীর চন্দ্র পাল, পিতা অজ্ঞাত, প্রফুল্ল চন্দ্র ভদ্র, পিতা নবীন চন্দ্র ভদ্র, মরণ চন্দ্র পাল, পিতা গােপাল চন্দ্র পাল, কালাচান দেবনাথ, পিতা বলরাম দেবনাথ, সুধীর চন্দ্র পাল, পিতা রণেশ চন্দ্র পাল, ধীরেন্দ্র চন্দ্র পাল, পিতা গুরুধন চন্দ্র পাল, গােবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস, পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, দুর্গধন নমঃ, পিতা যােগেশ চন্দ্র নমঃ। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল এ গণহত্যার বিষয়ে মুখ খুলেছিল গনেশ ঠাকুর। তখন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। টাক্কাব আলী যা বলল দৈনিক জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাতকারে এমদাদুল হক টাক্কাব আলী বলে, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ একদম মিথ্যা, এ কথাই চির সত্য। একাত্তরে তার ভূমিকার কথা জানতে চাইলে সে বলে স্বাধীনতার পক্ষেই শুধু ছিল আমার ভূমিকা।

সে বলে, আমি রাজাকার ছিলাম না, আমি নিজে হাজার হাজার কার্ড দিয়েছি ভারতে যাওয়ার জন্য। পিস কমিটিতে ছিলাম না। পাক আর্মিদের সঙ্গে আমার কোন যােগাযােগ ছিল না। টাক্কাব আলী বলল, রাজাকাররা আমার বাড়িতে হামলা করেছিল। তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। রাজাকার ক্যাম্পে যাইনি। গর্ব করে সে বলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। এসডিপিও, সরাইল থানার ওসিসহ অন্য স্টাফরা তখন আমার বাড়িতে ২৭ দিন ছিল । আমি তাদের খাইয়েছি। ২৭ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলাম । মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছি। তবে দেশের স্বার্থে পাকবাহিনীকেও সহায়তা করতে হয়েছে। গ্রামের লােকদের কথা চিন্তা করেই তা করতে হয়েছে। ধরন্ডি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা প্রসঙ্গে সে বলে, আমি জানিই না। সে সময় আমি ভাগন্তি (পলাতক) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিন্নত আলী স্যারের বাসায় ছিলাম। ডরে রাজাকারদের কাছেই যাইনি। সে চুন্টার এক আওয়ামী লীগ। নেতার নাম উল্লেখ করে বলে, সে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

জনকণ্ঠ ॥ ০৬-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!