You dont have javascript enabled! Please enable it!

চট্টগ্রাম-এবার ফকা সাকা চৌধুরী কাহিনী

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ ‘৬২ সালের ১৪ জুলাই, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে। দেশে ফিরেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। কিন্তু চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে যখন তিনি নামেন তখন তার সামনে পড়তে থাকে পচা ডিম, স্যান্ডেল, জুতা। তার জন্য লালদীঘিতে আয়ােজন করা হয়েছিল সংবর্ধনা সভার । সংবর্ধনা হয়ে ওঠেনি। জনগণের পচা ডিম, টমেটোর বর্ষণে ক্ষিপ্ত হয় ওঠেন তিনি। ‘৬২ সালের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তানীদের প্রতি কৃতজ্ঞ ফকা চৌধুরী এবং তাঁর সন্তান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ওরফে সাকা চৌধুরী ‘৭১-এ আবির্ভূত হন রাজাকার হিসাবে। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ফকা চৌধুরী এবং তার পরিবারবর্গ চট্টগ্রাম জুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন বুদ্ধিজীরী, মুক্তিযােদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ। বেশিরভাগ নিহত হয় রাউজানে। মুক্তিযােদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান তার ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থের ৪৬৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, রাউজানে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাহিনী ব্যাপকহারে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পােড়ায়। নতুন সিংহসহ অসংখ্য লােককে হত্যা করে। রাউজানের শহীদদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবদুল মান্নান, পঙ্কজ বড় য়া, জাফর আলম চৌধুরী, বিকাশ বড় য়া, শামসুল আলম, মুসা খান, শফিকুল আলম, রুহুল আমিন, সুবেদার আবুল কাসেম সুবেদার, বাদশা মিয়া, সুবেদার নুরুল আমিন, সুবেদার আবুল বশর, এজাহার মিয়া প্রমুখ। ফকা চৌধুরীর সন্তান এবং রাজাকার গ্রুপের অন্যতম হােতা হিসাবে সালাউদ্দিন কাদের। চৌধুরীর নাম সর্বজনবিদিত। চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের মতে, নগরী এবং রাউজানে সাকা চৌধুরী ১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের সংগঠিত করেন।

নিজে অংশগ্রহণ করেন কিলার হিসাবে। তিনি এখন বিএনপি’র প্রভাবশালী নেতা। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অংশ নিয়েও তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। ৪টি জাহাজের মালিক এবং ‘। শিপং ব্যবসাসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার মালিক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রামের রাউজানে বুদ্ধিজীবী হত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুটপাটসহ নানা অভিযােগে অভিযুক্ত বর্তমান এ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের। চৌধুরী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কৃতকর্মের জন্য তার বিরুদ্ধে ৪টি মামলা দায়ের হয়। তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে এ মামলার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অভিযােগ রয়েছে, সাকা চৌধুরীর হস্তক্ষেপে অনেক মামলার নথি গায়েব হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান, দানবীর, বুদ্ধিজীবী কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নতুন চন্দ্র সিংহ নগর আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মােজাফফর আহমদ, ব্যবসায়ী ফজলুল হক সওদাগর, মুক্তিযােদ্ধা ওমর ফারুক, ছাত্র দয়াল হরি বিশ্বাস প্রমুখকে হত্যার বিষয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে। ‘৭১ সালে বুদ্ধিজীবী নতুন চন্দ্ৰসিংহ হত্যা এ সময় বেশ আলােড়ন সৃষ্টি করে। যুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যসহ ৪৭ জন অধ্যাপক পরিবার-পরিজন

নিয়ে নতুন চন্দ্ৰসিংহের রাউজানস্থ কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হাটহাজারী হতে রাউজানের দিকে অভিযান শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাদের পরিবারবর্গ ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশ্যে কুন্ডেশ্বরী ভবন ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তারা নতুন চন্দ্র সিংহকে তাদের সাথে নিরাপদ স্থানে চলে যাবার জন্য অনুরােধ করে। কিন্তু তিনি তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় তিনি একা হয়ে গেলে ‘৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ৪টি আর্মড ট্রাক ও দুটি জীপে করে একদল পাকিস্তানী সৈন্যকে পথ প্রদর্শন করে কুণ্ডেশ্বরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। নতুন চন্দ্ৰসিংহ তার স্বভাবসুলভ অমায়িক ব্যবহার করে পাকিস্তানী সেনাদলকে অভ্যর্থনা জানান। তাদের সামনে তিনি কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়, স্কুল, কলেজের বিস্তারিত বিবরণ দেন। নতুন চন্দ্ৰসিংহের কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হয়ে পাকিস্তানী বালুচ ক্যাপ্টেন নাকি তার সঙ্গী সেনাদলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়। এ সময় নতুন চন্দ্ৰসিংহ মন্দিরে প্রবেশ করে প্রার্থনারত হন। এ সময় বালুচ ক্যাপ্টেনকে নাকি পরামর্শ দেয়া হয় নতুন সিংহকে মেরে ফেলার জন্য। ক্যাপ্টেন ইতস্তত করেন। অভিযােগ রয়েছে, এক পর্যায়ে মন্দিরে প্রবেশ করে নতুন চন্দ্র সিংহকে টেনে হিচড়ে বের করে গুলি করা হয়। ‘৭২ সালের জানুয়ারি। মাসে নতুন সিংহের পুত্র সত্য রঞ্জন সিংহ পিতৃ হত্যার বিরুদ্ধে ফকা চৌধুরী ও সাকা। চৌধুরীকে প্রধান আসামী করে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং ৪১(১)৭২ ধারা ৩০২/১২০/১৯৮ বিপিসি)। একই দিন ১৩ এপ্রিল ‘৭১-এ রাউজান থানার গহিরার নিজের বাড়ির সামনে অবস্থিত হিন্দুপাড়ায় সাকা চৌধুরী অভিযান চালান। চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের কলেজ পড় য়া ছেলে দয়াল হরি বিশ্বাসকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে পরে হত্যা করা হয়।

‘৭১-এর ১৭ এপ্রিল সাকা চৌধুরী ২০ বালুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম হতে রাউজান যাওয়ার সময় হালদা নদীর ওপর স্থাপিত সাগরঘাট ব্রিজ এলাকা হতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি শেখ মুজাফফর আহমদকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বলে অভিযােগ রয়েছে। পরে তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়। ‘৭১-এর জুলাই মাসের শেষের দিকে একদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট কাগজ ব্যবসায়ী রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়নের লেলেঙ্গরা গ্রামের সম্রান্ত পরিবারের সন্তান আলহাজ ফজলুল হক সওদাগরকে তার জেল রােডস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হতে তুলে নিয়ে গুডস হিলে নির্যাতন চালানাে হয়। দেশ মুক্ত হবার পর সাকা চৌধুরীকে আসামী করে রাউজান থানায় মামলা হয়। ফজলুল হক সাকা চৌধুরীর জল্লাদখানায় ১ মাস বন্দী ছিলেন বলে এক সময় উল্লেখ করেন।

এভাবে রাজাকার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযােগ। চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি থানায় স্বাধীনতার পর হতে তার বিরুদ্ধে অর্ধ-শতাধিক মামলা হয়। তবে মামলায় তিনি এ পর্যন্ত গ্রেফতার হননি বা আদালতে হাজির হননি। বিএনপি সরকারের আমলেই তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে এক ডজনেরও অধিক মামলা। এর মধ্যে রাউজান থানায় দায়ের করা মামলাসমূহ হচ্ছে ২৩-২-৯১ ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৪২৭/৪৩৫ ও ৩০২ দণ্ডবিধি, মামলা নং ৭(৯)৯১ ধারা ১৪৩/৪৩৫/৪২৭ ও ৩০৭ দণ্ডবিধি মামলা নং ২২(৩-৩-৯১) ধারা ৩৬৪/৩২৩/১১৪ দণ্ডবিধি। এ মামলাসমূহের প্রাথমিক অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে যার নম্বর ৬৪ তাং ৮-৬-৯১ চার্জশিট ৫৫(১৯-৫-৯১) চার্জশীট ৮৮(৩১-৭৯১)। এত ‘কীর্তি’ সত্ত্বেও তিনি এরশাদ সরকারের আমলে হয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী হয়েছেন পূর্তমন্ত্রী। ‘৭১ সালে সাকা চৌধুরীর পরিচিতি ছিল ‘খােকন নামে। এ ‘খােকন’ নাম শুনলে তখন। সবাই হতাে আতঙ্কিত। ‘৭১-এর পর ‘৭৫ পর্যন্ত সাকা চৌধুরী লন্ডনে আত্মগােপন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে সাকা খন্দকার মােশতাকের কৃপায় বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযােগ পান।

জনকণ্ঠ : ২৫-১২-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!