You dont have javascript enabled! Please enable it!

নবীনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আতঙ্ক পিয়ারা মিয়া একদিনে দখল করেছিল মহাদেবপট্টি এলাকা

রিয়াজউদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরাক্রমশালী এক ঘাতকের নাম আলী আজাহার পিয়ারা মিয়া। তার চোখ এখনও রক্তজবার মতাে লাল। ৭০ বছর বয়সী এ ঘাতকের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলােতে তার ছিল রুদ্র মূর্তি। কত যে অত্যাচার করেছে, মেরেছে মানুষ তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশজুড়ে যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ চলছিল, হিংস্র এ রাজাকার তখন দখল তাণ্ডবে মেতে উঠেছিল। নারকীয় দখল উন্মাদনায় কত যে মানুষকে গৃহহীন করেছে তার কোন হিসাব ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই। মানুষের জমিজিরাত, বাড়িঘর দখল ছিল পিয়ারা মিয়ার একমাত্র পেশা আর নেশা। যুদ্ধের ন’টি মাস নবীনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আতঙ্কিত নাম ছিল তখন পিয়ারা মিয়া। পাকি সেনাদের বন্ধু হিসাবে সে সময় যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিল সে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সে। লােকে বলে পিয়ারা মিয়া যেদিকে যেত, মানুষজন রাস্তাঘাট ছেড়ে পালিয়ে যেত। একাত্তরের সেই কুখ্যাত রাজাকার পিয়ারা মিয়ার অত্যাচারের কাহিনী নতুন প্রজন্ম না জানলেও নবীনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ আজও তা ভােলেনি। মুক্তিযােদ্ধা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের স্মৃতিতে সেদিনের নৃশংস ঘটনাগুলাে আজও জ্বলজ্বল করে, স্বপ্নে তাড়া করে পিয়ারা মিয়ার দুঃসহ অত্যাচার। এ ঘাতকের নাম শুনলে এখনও থুতু ফেলে লােকজন। বয়স আর রােগবালাই এখন তাকে পরাস্ত করলেও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা। বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা তার ভূমিকা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও কেঁদে ওঠেন। কতশত লােককে যে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে তার কোন হিসাব নেই। স্বামীহারা করেছে অনেক গৃহবধূকে।

‘৭১-এ সে দখল-সন্ত্রাস চালাত। তার পছন্দ হলে যে কোন জমিজিরাত চোখের পলকে দখল করে নিত। মাত্র একদিনে সে দখল করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মহাদেবপট্টি এলাকা। বিস্তীর্ণ এলাকা দখলের মাধ্যমে অসংখ্য লােককে উচ্ছেদ করে। নবীনগর শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল কুখ্যাত। এই রাজাকার। ‘৭১-এর আগে সে থাকত করাচীতে। নবীনগরে প্রথম পাকি ঘাতকরা তার নেতৃত্বেই আসে। ইব্রাহিমপুর গ্রাম ধ্বংসের হােতা পিয়ারা মিয়া। পাকিবাহিনীর সহায়তায় গ্রামটিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় । ৩শ’ ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়। শত শত লােক গৃহহারা হয়ে পড়ে তখন। কিন্তু তার পরও হিংস্র এই ঘাতকের হৃদয় কাপেনি। মুক্তিযুদ্ধে যাবার অভিযােগে এক কলেজ ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইব্রাহিমপুরের দক্ষিণপাড়ার নরেন্দ্র মাস্টারকে অমানবিকভাবে দেশছাড়া করে। তার শত। আকুতি-মিনতি অগ্রাহ্য করে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেয় ভারতে। মুক্তিযুদ্ধ যখন জোরালাে হচ্ছিল তখন এই ঘাতক নবীনগর ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে চলে আসে। এখানে তার এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেয়। এখান থেকে শুরু করে মুক্তিযােদ্ধাদের ধ্বংস করার নীলনক্সা। পাকি ঘাতকদের সহচর হিসাবে আস্থা অর্জন করায় টর্চার সেলের শক্তিমান কর্মকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয় এ ঘাতক। দেশবিরােধী এমন কোন কাজ নেই যা তার দ্বারা হয়নি। শহরে অবস্থানকালে কান্দিপাড়ার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানচিত্র দেখিয়ে বলল-কোন্ জায়গা তােমার দরকার বলাে, আমি তােমাকে তা দিয়ে দেব।

স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে সেই রাজাকার মহাদেবপট্টির দখল ছেড়ে দেয়। আত্মগােপন করে। এর পর রাজাকারীর অভিযােগে গ্রেফতার হয়। আবার জামিন পায়। এর পর সমাজসেবক সাজে। দু’দু’বার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এই ঘাতক। অর্থে-বিত্তে সে এখন প্রতিষ্ঠিত। অভিযােগ রয়েছে, পিয়ারা মিয়া যে বাড়িতে বসবাস করে সেটিও জোর-জবরদস্তি করে নেয়া। বিশাল আলিশান এই বাড়িটি এক হিন্দু রমণীর ছিল। এই রমণীর কাছ থেকে বাড়িটি প্রথমে জোরপূর্বক রাখে। ক্রয়ের ভান করে কিছু টাকাও দেয়। নির্বিঘ্নে দেশান্তরী করার কথা বলে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগরতলা সীমান্ত এলাকায় গিয়ে জোরপূর্বক টাকাগুলাে কেড়ে রেখে দেয়। দৈনিক জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধি সরেজমিন ইব্রাহিমপুর গিয়ে সেই রাজাকার সম্বন্ধে জানতে চাইলে পিয়ারা মিয়ার কন্যা কামেরা সুলতানা বলেন, আমার পিতা অসুস্থ। কথা বলতে পারেন না। গত এপ্রিলে স্ট্রোক করেছে, কথা বােঝা যায় না। একপর্যায়ে রাজাকার পিয়ারা মিয়া হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এ প্রতিবেদকের নানা প্রশ্নের উত্তরে  সে নীরব থাকে। আপনি রাজাকার ছিলেন, মানুষ হত্যা লুটপাট সন্ত্রাস আর দখল তাণ্ডব চালিয়েছিলেন-জনকণ্ঠ প্রতিবেদকের এ প্রশ্নের জবাবে পিয়ারা মিয়া বলে, বেইজলেস-ভিত্তি নেই, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আজ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানাে হচ্ছে। আমাকে দাবানাের জন্য, যেহেতু আমি মুসলিম লীগ করতাম। কিছুক্ষণ বলার পরই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে এ রাজাকার। মুসলিম লীগের অফিসে এখনও আমার নাম আছে, সেখান থেকে এখনও চিঠিপত্র আসে। স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডে আপনি মদদ দিয়েছেন-এ প্রশ্নের জবাবে কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলে, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আদেশ-নির্দেশ আসত, আমি তা মানতাম। মুসলিম লীগ করতাম এটাই আমার অপরাধ। তবে দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজ করিনি। তবুও ১৮ মাস জেল খেটেছি। প্রকাশ, রাজাকার পিয়ারা মিয়ার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা তার বাড়িতে অভিযান চালায়। তার বাড়ির ১১ সদস্যকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।

জনকণ্ঠ। ১২-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!