ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩০ ঘাতক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেজেছে। সমাজসেবক কেউ আওয়ামী লীগার
রিয়াজ উদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলির নাটাই বিরাসা ভাটপাড়া গ্রাম রাজাকারদের দুর্গ। অন্তত ৩০ স্বাধীনতাবিরােধী এ এলাকায় এখনও মাথা উচু করে বিচরণ করছে। তারা সমাজের হােমরাচোমরা হয়ে বসে আছে। সেজেছে তথাকথিত সমাজসেবক। অথচ এ প্রজন্মসহ অনেকেই জানে না মুখােশধারী ঘাতকদের পিছনের নৃশংস ইতিহাস। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রামগুলাে ছিল আলবদরতথাকথিত শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের অন্যতম ঘাটি। ৪০/৫০ রাজাকার গােটা গ্রামের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। যুদ্ধের নটি মাস আতঙ্কিত জনপদ ছিল এসব গ্রাম। এ রাজাকার শান্তি কমিটির সদস্যদের নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী এখানকার কসােভাে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নিপীড়নকেও হার মানায়। তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়- ইতিহাসের অমােঘ বিধানে এদের অন্তত ১০ জন নির্মমভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তার মধ্যে ঘাতক সালাম সিকদার ও মতি মিয়ার নাম অন্যতম। এদের বর্বরােচিত নির্যাতন কাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর মনে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, সে কাহিনী বর্ণনা করে এখনও মানুষজন। কেদে ওঠে। নারী নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠনে তারা ছিল পটু। এদের অন্তত ৩০ সহকর্মী ঘাতক আজও বেঁচে আছে। এসব ঘাতক এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বছরের পর বছর সরকার ও বিভিন্ন মহলের পৃষ্ঠপােষকতায় এরা ফুলেফেঁপে উঠেছে।
মানুষরূপী পশুরা গণহত্যার ইতিহাস মুছে ফেলার ফন্দিফিকির করছে এখনও। বেশিরভাগ ঘাতক বীরদর্পে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই স্বাধীনতার সময় থেকে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত তাদের হুঙ্কার দখল সন্ত্রাস অব্যাহত ছিল। এসব ঘাতকের কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগার। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতাবিরােধী ঘাতক শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ওয়ালিওর রহমান আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে সভাপতিত্ব পর্যন্ত করে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের কাছে জিম্মি। অবস্থাটা এমন যে, এসব ঘাতকই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক। অবশ্য এখনও এসব ঘাতক গােপনে স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডে মদদ যােগাচ্ছে। নাটাই গ্রামের এ ঘাতকের রয়েছে শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী। সে এখন সমাজসেবক সেজেছে। ইতােপূর্বে সে একবার ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিল। আরেক ঘাতক কমান্ডার ভাটপাড়ার কালাচান, থেকে চুন খসলেই ঝাকে ঝাকে গুলি ছুড়ত। মারত মানুষকে। লুটপাট আর কত যে অত্যাচার এরা করেছে তার কোন হিসাব নেই। বটতলী বাজারে এসব রাজাকার দিনমান আডডা মারত। দূরবর্তী স্থান থেকে আগত ক্রেতা-বিক্রেতাদের পণ্যসামগ্রী লুটপাট করত। রাজাকারদের কথার অবাধ্য হলে মুক্তিফৌজ বলে হাত-পা বেঁধে তাদের টর্চার সেলে নিয়ে যেত। বর্তমান নাটাই গ্রামের চান মার্কেট সংলগ্ন স্থানে ছিল তাদের টর্চার সেল। এখানেই লুটপাট করা পণ্যসামগ্রী রাজাকাররা ভাগবাটোয়ারা করে নিত। এঅঞ্চলে যেসব রাজাকার রয়েছে, তার মধ্যে নাটাই গ্রামের তথাকথিত শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ওয়ালিওর রহমান, ইউসুফ মিয়া, তারা মিয়া, বসু মিয়া, ফযলু মিয়া, মীর্যা আলী, জাহের মিয়া, হুমায়ুন, তাজুল ইসলাম, ফজলু মিয়া, ইসমাইল প্রমুখ। বিরাসার মামের সুরুজ মিয়া, দুলাল, মােরাদ, সেলামত, কালা গাজী, খােরশেদ মিয়া প্রমুখ। ভাটপাড়া গ্রামের জালাল, আদম আলী, নুর মিয়া প্রমুখ।
এসব রাজাকার ও দালাল মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, বহু মানুষকে হত্যা করে। তাদের অত্যাচারে কোন মানুষ মুক্তিযুদ্ধের নাম মুখে আনতেই সাহস পায়নি। তাদের সভাব-প্রতাপ এতই বেশি ছিল যে, কোন মুক্তিযােদ্ধা এ গ্রামে ঢােকেনি, ঢুকতে পারেনি। বিহাইর গ্রামের কাওয়ালীপাড়া ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল। পাকিদের সহায়তায় বাড়িঘর থেকে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ধরে এনে প্রকাশ্যে জবাই করে ভােজের আয়ােজন করত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘােরাফেরা করত। ১৯৭১ সালের ১৭ আগষ্ট মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঘাতকরা পাকিদের সহায়তায় রাইফেল, স্টেনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নাটাই, ভাটপাড়া, রাজগর, থলিয়ারা, বিরাসার গ্রাম ঘেরাও করে মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালায়; না পেয়ে নিরীহ-নিরপরাধ আদম সন্তানদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে। সেদিন ২৩ জনকে এসব এলাকা থেকে আটক করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ওয়াপদাস্থ পাকবাহিনীর রাজাকার ক্যাম্পসংলগ্ন স্থানে পাখির মতাে হত্যা করা হয় তাদের। সেদিন যাদের ধরে নিয়ে যায়। আবদুর রহমান, পিতা-মৃত বরকত উল্লাহ, গ্রাম-নাটাই; বুদু মিয়া, সাং-নাটাই, আবুল | কলাম, পিতা হাজী মন্নর আলী, নাটাই; জব্বর আলী, পিতা-মৃত আলীমদ্দিন, নাটাই; লাল মিয়া, পিতা-মৃত আলীমদ্দিন, নাটাই; সৌকত আলী, পিতা-মৃত মছলন্দ আলী, ভাটপাড়া; সমীর চন্দ্র দেব, পিতা মৃত ডাঃ কুমুদবন্ধু দেব, মােঃ ইসমাইল, পিতা মৃত ওহুর আলী, সাং-রাজঘর; দারুগ আলী, পিতা-মৃত আবদুর রহমান, গােকর্ণ ঘাট; আবদুল হাই, পিতা-মৃত উমেজ আলী, গােকর্ণ ঘাট; আবদুল আজিজ, পিতা-আছু মিয়া, আমিনপুর; আবদুল জব্বার মুন্সী, পিতা-মৃত আসরুত আলী, চর গােসাইপুর; সুরুজ মিয়া, পিতা-জব্বার আলী, চর গােসাইপুর; নাজির হােসেন, পিতা-কাছম আলী, ভাটপাড়া; মালু মিয়া, পিতা-মছলন্দ আলী, ভাটপাড়া; মিজ্জালী, পিতা-মছলন্দ আলী, ভাটপাড়া; শাহাজাহান, পিতা-মৃত আবদুল হালীম ও তার ভাই, সিদ্দিক মিয়া, পিতাআবদুল হক, আবদুল মান্নান, পিতা-আবদুর রহমান; আবদুর রশিদ, পিতা-মৃত হাজী। কুরবান আলী; আবরু খান, পিতা-আব্দুল মালেক, নাটাই। তবে সৌভাগ্যক্রমে আবরু খান বেঁচে যান ঘাতকদের বুলেট থেকে।
জনকণ্ঠ ॥ ১১-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন