You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তাগাছার চান-সুরুজ ভ্রাতৃদ্বয় আজও মূর্তিমান আতঙ্ক  এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী

বাবুল হােসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ একাত্তরে অসংখ্য হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ ও অত্যাচার-নির্যাতনের নেতৃত্বদানকারী ও পাকিদের বিশ্বস্ত দালাল মুক্তাগাছার চান-সুরুজ ভ্রাতৃদ্বয় আজও মানুষজনের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সাধারণ মানুষজন এখনও অনেকে ভয়ে এদের নাম মুখে উচ্চারণ করে না। একাত্তরে [এই ঘৃণিত দুই সহােদর ও পাকি দালাল রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে মুক্তাগাছা শহর ও গ্রামাঞ্চলে গড়ে তুলেছিল এক দুর্ধর্ষ জল্লাদ বাহিনী। পাকি সেনাদের সাহায্য নিয়ে | এরা মুক্তাগাছা শহরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ চালিয়ে পুরাে এলাকাকে পরিণত করেছিল এক ধ্বংসস্তুপে। হিন্দুদের ৩টি পরিত্যক্ত বাড়ি ও একটি সমিতির ঘর জবরদখল করে এরা বানিয়েছিল সেখানে টর্চার সেল । চান ছিল তখন রাজাকার কমান্ডার ও লেডি কিলার। তার সহােদর সুরুজ ছিল আলবদর কমান্ডার। লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ চালিয়ে সে তখন অল্পদিনেই নাম ফাটায় ও পাকিদের আস্থা অর্জন করে। এদের গডফাদার ছিল সাবেক এমপি মরহুম কেরামত আলী তালুকদার। পিস কমিটির সভাপতি ছিল তখন এই তালুকদার। তার সেক্রেটারি ছিল রামকিশাের উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান। শিক্ষক ইজহারুল হক। এদের সহযােগী ছিল মৌলভী মনিরুজ্জামান, দানেছ আলী, মান্নান তালুকদার, হেকিম চেয়ারম্যান, মৌলানা মােহাম্মদ আলী, সুরত চেয়ারম্যান, বিহারী আইয়ুব, আড়ু, আলতাফ, এছহাক আলী, রাজ্জাক চেয়ারম্যান, রাজ্জাক মাস্টার, আব্বাছ আলী চেয়ারম্যান, দর্জি বিজ্ঞান কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুল কুদ্স, কুদরত মন্ডল, শামছুল আলম মাস্টার, সামাদ ও জবেদ মুন্সিসহ আরও অনেকে।

একাত্তরের সেই কুখ্যাত খুনী রাজাকার সহােদরদের একজন এখন মুক্তাগাছা শহরের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী। অপরজনও ব্যবসায়ী। প্রচার রয়েছে, একাত্তরে লুষ্ঠিত অর্থ ও সােনাদানা দিয়ে এই দুই রাজাকার নিজেদের সমাজে নামীদামী ব্যক্তি হিসাবে আজ। প্রতিষ্ঠিত করেছে। সহযােগীদের অনেকে বেঁচে নেই। অনেকের নেই কোন হদিস। শহীদ পরিবারের অনেক সদস্য আজও এই মূর্তিমান আতঙ্ক রাজাকারদের দেখলে আঁতকে ওঠে। একাত্তরে মুক্তাগাছা শহরে ৪টি টর্চার সেল ছিল। আলবদরদের আস্তানা ছিল শহরের সূর্যকান্ত রােডের বড় মসজিদ সংলগ্ন দোতলায় সাবেক তাঁতি সমিতির অফিসে। মুক্তিকামী জনতা, সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের ধরে এনে এখানে। নির্যাতন চালানাে হতাে। রাজাকারদের আস্তানা ছিল পৌরসভার মহাবীর আগরওয়ালা মাড়ােয়ারী, সালাম চান্দ আগরওয়ালা মাড়ােয়ারী ও সুরুজমল আগরওয়ালা মাড়ােয়ারীদের ৩টি পরিত্যক্ত বাড়িতে। এসব বাড়ি ছিল মুক্তিপাগল বাঙালীদের নির্যাতন সেল। ধরে আনা বাঙালীদের অত্যাচার নির্যাতনের পর হত্যা করে এদের লাশ ফেলে দেয়া হতাে বর্তমানে মুক্তাগাছায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান অফিসের ভিতরে অবস্থিত জমিদারদের একটি কূয়ায়।

এ রকম বহু হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে অনেক বীভৎস কাহিনীর বিবরণ। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ভয়ে নাম গােপন রাখার অনুরােধ করেছে। বেঁচে থাকা ও নির্যাতিত অনেক নারী নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বর্ণনা করেছেন। নারকীয় ও লােমহর্ষক কাহিনী। পাকিদের নির্দেশে রাজাকার-আলবদর কমান্ডাররা হিন্দু অধুষিত মুক্তাগাছা পৌর এলাকার সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের কুমারী মেয়েদের তাদের আস্তানায় ভােগের জন্য তুলে দিত। এসব নির্যাতিত মেয়ে যাতে পালিয়ে যেতে পারে সেজন্য এসব আস্তানায় এদের রাখা হতাে উলঙ্গ করে। হতভাগ্য অনেক মেয়ের পরে আর হদিস মেলেনি। এদের অনেকে আত্মহত্যা করেছে। কাউকে ভােগের পর হত্যা। করে লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে কুপে। মুক্তাগাছা শহরের এক পাগলী এখনও রাজাকারআলবদর দেখলে তাড়া করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয়। মুক্তাগাছার স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা জানিয়েছেন, একাত্তরের পর থেকেই ‘পাগলী’র মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। তার এক ল্যাংড়া ভাই ছিল। নাম মনছুর। একাত্তরে রাজাকার-আলবদর নেতা চান-সুরুজ তাকে ধরে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এর পর থেকে আর মনছুরের হদিস নেই।

নন্দীবাড়ি এলাকার আবদুল কুদুস খলিফা (৬৫) একদিন দুপুরে গােসল করছিলেন। পুকুরে। এ সময় ৮ রাজাকার তাকে ধরে নিয়ে যায় তাঁতি সমিতির আস্তানায়। একদিন আটকে তাঁর ওপর চালানাে হয় বর্বর নির্যাতন। চান-সুরুজের নির্দেশে তাঁর দাত ভেঙ্গে দেয়া হয়। ভেঙ্গে দেয়া হয় হাত-পা। তার সামনেই হত্যা করা হয় কলমােহনার আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ উদ্দিনসহ আরও ৪ জনকে। মুসলিম লীগের এক আত্মীয় তাঁকে উদ্ধার করে। বর্বর নির্যাতনের কারণে তিনি ৪ মাস ছিলেন শয্যাশায়ী। এ সময়ে তিনি বসে পায়খানা করতে পারেননি। চান-সুরুজ তারাটি গ্রামের কৃষক আইন উদ্দিন, নন্দীপাড়ার স্কুল মাস্টার আবুল কাশেমকে ধরে তাঁতি সমিতিতে নিয়ে আসার পর গুলি । করে হত্যা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারাটি ঈদগাহ মাঠের পাশে জবাই করে হত্যা করা হয় বনবিহারী মাস্টারকে। এ সময় তিনি রাজাকারদের পায়ে জড়িয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। পাশেই এক দিনমজুর দা দিয়ে পাট কাটছিলেন। চান-সুরুজের নির্দেশে রাজাকাররা এই দা দিয়ে তার গলা কাটে। পথে কুমােদরঞ্জনকে হত্যা করা হয় গুলি করে। তারাটি পূর্বপাড়ার কৃষক কাজিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছিল মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে। রাজাকার জীলু তাকে হত্যা করে। বাশাটির নশিরপুর গ্রামের গােপাল পণ্ডিতের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল বিড়ালশাহ থেকে গােপালচন্দ্র দে। চান গ্রুপ খবর পেয়ে এই বাড়িতে প্রথমে আগুন দেয় ও পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে। পাক আর্মি মুক্তাগাছায় প্রবেশ করে ২৩ এপ্রিল। নন্দীবাড়ির প্রত্যক্ষদর্শী সােহরাব আলী (৬০) জানান, ফরেস্ট অফিসের মােড়ে বটতলার সাহেব বাজারে প্রথম দিনেই পাকিরা গুলি করে হত্যা করে পানের দোকানি বৈরাগী ও পরেশ রক্ষিতকে। আহত হয় ৫/৭ জন।

পাকিদের মুক্তাগাছায় স্বাগত জানায় চান-সুরুজ ও কেরামত আলী তালুকদার । মুক্তাগাছার মধু শাহ, বেনিসাহা, নারায়ণ, নরেশ, সুরেশ, পল্টন, দেবেন্দ্র, হেরম্ব, সুনীলচন্দ্র, শচীন্দ্র পাল, পৃথ্বিশচন্দ্র পাল, শম্ভুচন্ডি, ইন্দ্রভূষণসহ অনেক সংখ্যালঘু হিন্দুর বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজ চালিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়। সারা শহরে, শহরের বাইরে দরিকৃষ্ণপুর, মানকোন, বাজেমানকোন, বাশাটি, বড়গ্রাম, বিলসিংনা, নশিরপুর, মােজাটি, জয়দা, শার্শা, যত্রাসিয়া, গাবতলী, কালীবাড়ি এলাকায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে পুরাে মুক্তাগাছাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়। কেরামত আলী তালুকদারের নেতৃত্বে স্বপন ধরের পিতা সন্তোষচন্দ্র ধরকে গুলি করে হত্যার আগে বর্বর নির্যাতন চালানাে হয়। পাকি সেনা ও রাজাকার আলবদরদের হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের ফলে মুক্তাগাছা শহরসহ গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়। এক বিরানভূমিতে। মুক্তাগাছার শেষ জমিদার বকুল বাবু দেহরক্ষী অমর বাহাদুর ও পৌরসভার সচিব ত্রৈলােক্য সরকারকে সঙ্গে নিয়ে পাথালিয়া থেকে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে পাকিরা তাদের ধরে নিয়ে যায়। আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। ‘ – শ্রাবণ মাসের ১৫ তারিখ ছিল সােমবার। দরিকৃষ্ণপুর গ্রামের নুর বানু (৬৫) সেদিন সকালে আড়াই মাসের কোলের শিশুকে নিয়ে কোরান পড়ছিলেন। রাজাকার ও পাকিরা বাড়িতে ঢুকেই গুলি করে হত্যা করে বানুর স্বামী ও দেবরকে। রাজাকার জবেদ মুন্সি টেনেহেঁচড়ে তাকে বাড়ির উঠানে এনে আরও ৫/৭ মহিলার সঙ্গে লাইনে দাঁড় করায়। কিন্তু গুলির শব্দেই নূর বানু জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। তারপরও তার ডান পায়ের পিছনে গুলি লাগে। আজও সে দাগ দৃশ্যমান। পাশের বাড়ির মজিবুর রহমান (৫২) জানান, পাকিরা একদিনেই এই গ্রামে হত্যা করে ৬৭ জনকে। বাইশা বিলের ধারে লাইন করে হত্যা করার সময় তিনি বিলের পানিতে পড়ে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে আত্মরক্ষার সময় এসব হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। অনিলবন্ধু দাশ জানান, শার্শায় একদিনে হত্যা করা হয়েছিল ১৩ জনকে।

একাত্তরে বহু হিন্দুকে পাকিরা জোর করে মুসলমান বানায়। হত্যার পর তাদের লাশ পােড়াতে না দিয়ে এক কবরে ৫/৭ জনের। লাশ ফেলে দেয়া হয়। মুক্তাগাছা হানাদারমুক্ত হওয়ার পর শহরের আস্তানা থেকে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ‘ মুক্তাগাছা মুক্ত হওয়ার দিন পাকিদের সঙ্গে যেতে গাড়িতে উঠতে চেয়েছিল রাজাকার জবেদ মুন্সি। পাকিরা লাথি দিয়ে তাকে ফেলে দেয়ার পর ক্ষুব্ধ জনতা জবাই করে তাকে। হত্যার পর ছিন্ন মুণ্ড দিয়ে ফুটবল খেলে। রাজাকার দানেস ও তার পুত্রকে হত্যার পর তার বাড়িঘরে আগুন দেয় জনতা। স্বাধীনতার পর গ্রেফতার হয় চান-সুরুজের পিতা মৌলভী জামান। প্রাণভয়ে নিখোঁজ হয় দুই সহােদর চান-সুরুজ। চট্টগ্রাম ও রংপুরে। আত্মগােপন করে থাকার পর ‘৭৫-এর পর তারা মুক্তাগাছায় আসে ও স্বাধীনতাবিরােধীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা পায়। চান-সুরুজের বক্তব্য মুক্তাগাছায় পৌর এলাকার বাসার সামনে চান-সুরুজ একাত্তরের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানায়, ধর্মীয় চেতনায় তারা তখন এসব করেছে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতন ও অত্যাচারের কথা স্বীকার না করলেও এজন্য তারা অনুতপ্ত বলে জানিয়েছে। তাদের ভুলের জন্য জনকণ্ঠের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তারা ক্ষমা চেয়েছে।

জনকণ্ঠ ॥ ৩১-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!