ময়মনসিংহের কুখ্যাত ঘাতক পরিবারের এক সদস্য টিএ্যান্ডটির চেয়ারম্যান ছিলেন
বাবুল হােসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ একাত্তরে বহু হত্যা, লুণ্ঠন আর অত্যাচারনির্যাতনসহ নানা কুকীর্তির জন্য ময়মনসিংহবাসী কুখ্যাত যে রাজাকার পরিবারটির কথা আজও মনে রেখেছে সেই রাজাকার পরিবারের এক সদস্য বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন। বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিল। পরিবারের অপর সদস্যরাও দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। রাজাকার পরিবারের ময়মনসিংহ শহরের গােলকিবাড়ী রােডের সেই অভিশপ্ত বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এখনও শহরবাসী থুথু ফেলে ঘৃণা প্রকাশ করে। একাত্তরে এই রাজাকার পরিবারের সদস্যরা ময়মনসিংহ শহরে থেকে বহু হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সেদিন ছিল ২৭ রমজান। ইফতারের একটু আগে আসছি বলে টুনু বেরিয়ে যায় রাস্তায় । মা তখন পরিবারের সবার জন্য ইফতার তৈরিতে ব্যস্ত। শহরের গােলকিবাড়ী রােডের মসজিদের সামনের রাস্তায় হাঁটছিল হাবিবুর রহমান টুনু। সঙ্গে ছিল প্রতিবেশী স্কুলবন্ধু কবীর। ইফতারের ঠিক আজানের সময়ই এই দু’জনকে ধরে নিয়ে যায় সেই রাজাকার পরিবারের সদস্য ময়মনসিংহের আলবদর প্রধান দিদার। প্রথমে এদের দু’জনকে ধরে নেয়া হয় শহরের বাঙালী টর্চার সেল বলে খ্যাত “ডাকবাংলােতে। সেখান থেকে পরে কবীরকে ছেড়ে দেয়া হলেও টুনুর আর কোন সন্ধান মেলেনি। শহীদের মা সেই ইফতার ও পরের ঈদসহ বহুদিন অপেক্ষা করে পথ চেয়ে ছিলেন টুনু আসবে বলে।
টুনুর ভাই মিজান (৬৫) জানান, মা দিদারের কাছে গিয়ে পুত্রের জন্য প্রাণভিক্ষাও চেয়েছিলেন। কবীরের কাছ থেকে খবর পেয়েই শহীদের মা সেখানে যান। মিজান গিয়েছিলেন ডাকবাংলােয় কর্নেলের কাছে। কিন্তু কাজ হয়নি কোন কিছুতেই । ঘাতকরা টুনুর লাশটিও ফেরত দেয়নি। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা জানান, টেলিফোন বাের্ডের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুল মতিনের বাড়ি ছিল জামালপুরের সরিষাবাড়ী এলাকায়। ময়মনসিংহ শহরের গােলকিবাড়ী রােডে ছিল তাদের পৈতৃক ভিটা। জামালপুরের বাসিন্দা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদরদের প্রধান সংগঠক, ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ঘাতক আশরাফের সঙ্গে এই মতিন পরিবারের ছিল একাত্তরে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। মতিনের বাবা ছিল পাকিদের তাবেদার ও লাইভস্টক অফিসার। এক ভাই দিদার ছিল। অস্ত্রধারী কুখ্যাত রাজাকার। স্টেনগান কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত শহরময়। রাজাকার হান্নান, সুরুজ উকিল, জবেদ আলী, খাদেম ঈ-মােমেন শাহী, মৌলানা ফয়জুর রহমান ছিল সহযােগী । শহরের ডাকবাংলাে, কাচিঝুলি ও বাঘমারা ছিল রাজাকারদের আস্তানা। আরও একটি বড় আস্তানা ছিল নতুন বাজারে হান্নানের বাসায়। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা জানান- দিদার, রেজা, শান্তু, ফেদো ও বাচ্চু ছিল এক পরিবারের সদস্য। খন্দকার আব্দুল মতিনের ডাক নাম বাচ্চু। একাত্তরে তাদের গােলকিবাড়ী রােডের বাসা ছিল মিনি। ক্যান্টনমেন্ট। এখানের নির্দেশ পেলেই শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হতাে। ২৭ রমজানের দিন টুনুর আগে মুসলিম গার্লস স্কুলের সামনে থেকে বিকালে ধরে নেয়া হয়েছিল সুরুজকে। পরদিন আকুয়া চোকাইতলার খালে এই শহীদের বুলেটবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। শহরের ফজলু এমপির পুকুরপাড় থেকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়েছিল মরহুম ইব্রাহীম খলিলের মুক্তিযােদ্ধাপুত্র মজিবুর রহমানকে। টানা ২৪ দিন হাজতে অমানুষিক নির্যাতনের পর ভাগ্যক্রমে মজিবুর ছাড়া পেয়েছিল সেদিন। দিদারের পরিবারের নির্দেশে সেদিন শহরের কাচিঝুলি এলাকায় ধরতে গিয়েছিল রাজাকাররা সিরাজুল ইসলাম সুজাকে। তাকে না পেয়ে তারা ধরে নেয় সুজার পিতা টেপা মিয়া ও অপর সহােদর দারাকে।
প্রথমে তাদের নেয়া হয় ডাকবাংলােয়। পরদিন ব্রহ্মপুত্রে ১১ জনকে গুলি করে লাশ ফেলে দেয়া হয় চরে । এদিনই এক সঙ্গে গুলিতে প্রাণ হারায় তারা। কিন্তু সেদিন নদীতে ঝাপ দিয়ে জীবন বাঁচান টেপা মিয়া। তাদের ধরে ফেলার পর কাচিঝুলি নিজ এলাকায় একটি রেইনট্রী গাছে এই পিতা-পুত্রকে সেদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল দেখার জন্য। এলাকাবাসী জানান, খন্দকার আব্দুল মতিনের পিতা খন্দকার মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। কাচিঝুলির জল্লাদ বলে খ্যাত জবেদ আলী, আতাউর রহমান মােক্তার, গােলাম কাদির। ও রিয়াজ উদ্দিন টিয়ার বাপের দহরম-মহরম ছিল। একাত্তরের সেই রাজাকার পরিবারের সবাই আজ দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। খন্দকার আব্দুল মতিন টিএ্যান্ডটির সাবেক চেয়ারম্যান, দিদার ও রেজা অপর দুই সহােদর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। শান্তু ও ফেদোও পিছিয়ে নেই। অথচ এই রাজাকার পরিবারটির প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ মদদে ময়মনসিংহে একাত্তরে বহু হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটেছে। একাত্তরের পর দেশ স্বাধীন হলে ময়মনসিংহ শহরের বিক্ষুব্ধ জনতা সেই রাজাকার পরিবারের গােলকিবাড়ীর বসতভিটায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর, অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজ চালিয়েছিল। অবস্থা আঁচ করতে পেরে অবশ্য রাজাকার পরিবারের সবাই গা-ঢাকা দিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। এর পরপরই দিদার প্রথমে লিবিয়া ও পরে অপর সহােদরসহ আমেরিকায় পাড়ি জমায়।
ময়মনসিংহ শহরের গােলকিবাড়ী রােডের অভিশপ্ত বাড়িটি এখন কালের (ঘৃণা) সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। তাদের অপর সহযােগী জবেদ আলী। একাত্তরের পর গ্রেফতার অবস্থায় হাজতে মারা যায়। অপর সহযােগীদের অনেকে আজ বেচে নেই। অনেকে বেঁচে আছে ধিক্কারের পাত্র হয়ে। খন্দকার মতিনের বক্তব্য ময়মনসিংহ শহরের সেই কুখ্যাত রাজাকার পরিবারের সদস্য টিএ্যান্ডটির সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মতিনের সঙ্গে মােবাইল টেলিফোনে গত ২০ মার্চ রাত ৮টায় যােগাযােগ করে তার বক্তব্য জানতে চাইলে সে একাত্তরে ময়মনসিংহ শহরে বহু কিলিং অপারেশনে নেতৃত্ব, নির্যাতন ও লুটতরাজের কথা অস্বীকার করে। সে জানায়, এসব ঘটনায় তার পরিবার সংশ্লিষ্ট ছিল না। তার বড় ভাই ডাঃ ওয়াদুদ ও দুলাভাই পাক আর্মিতে ছিল। একাত্তরে ময়মনসিংহের বাসায় ক্ষুব্ধ জনতার ভাংচুর ও লুটতরাজ নয়, চুরি হয়েছিল বলে সে জানায়।
জনকণ্ঠ ॥ ২২-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন