You dont have javascript enabled! Please enable it!

ময়মনসিংহের কুখ্যাত রাজাকার জব্বার এখন একটি মাদ্রাসার কর্ণধার

বাবুল হােসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ শতায়ুপর আলিম উদ্দিন স্মৃতির পাতাগুলাে। হাতড়ানাের সময় তার ছলছল চোখ দুটো থেকে গণ্ড বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। মনের অজান্তেই। ঝাপসা চোখ মুছতে মুছতেই স্মৃতিচারণ করে চলেন একাত্তরের সেসব বীভৎস কাহিনীর। পাকি সেনারা তাদের এদেশের দোসর রাজাকার, আলবদরদের মদদে ময়মনসিংহ সদরের বিসকার ছাবেদ আলী (৭৫) ও তালেব হােসেন (৭০)কে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলায় সে গ্রামেই। এর মধ্যে বন্দুকের নল ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সারা শরীর রক্তাক্ত জখম করে। বুট দিয়ে চেপে ধরে বুকের পাঁজর। ভাগ্যিস গুলি করার আগেই আলিম উদ্দিন সেখানে হাজির হয়েছিলেন খবর পেয়ে। পাকা চুল-দাড়ি ছিল বলে পাকিরা আলিমকে চাচা ডাকত। সেদিন আলিমের অনুরােধেই ছাড়া পায় তালেব আর ছাবেদ। একাত্তরে রাজাকার, আলবদর ও পাকিরা মিলে পুরাে বিসা, বাথুয়াদি ও শালিহর। এলাকার অগনিত বাঙালীকে হত্যা করে। বহু নারীর সম্ভ্রম লুট করে। হিন্দু অধ্যুষিত এসব এলাকার বহু বাড়িঘর লুটের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক হিন্দু পরিবারকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। বিসকা রেল স্টেশনের কাছে আইরার বিলের পাশে ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। এ অঞ্চলের কুখ্যাত রাজাকার ছিল আবদুল জব্বার। তার বাবা জয়নাল ছিল আলবদর কমান্ডার । স্টেশন মাস্টার ছলিম, কমর উদ্দিন ডাকাত, জয়নাল ছিল আবদুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ সহযােগী। সে রাজাকার আবদুল জব্বার এখন সৌদি অর্থে পরিচালিত একটি মাদ্রাসার কর্ণধার । প্রচার রয়েছে, ডাক্তার আবদুল্লাহ ওমর নাসিব দাখিল নামের এই মাদ্রাসাটিতে এখন চলছে ইসলামী শিক্ষার নামে প্রতারণা ব্যবসা। জব্বার একাধারে এই মাদ্রাসার সুপার ও সভাপতি এখন।

একাত্তরের ৫ ভাদ্র ছিল সেদিন। স্থানীয় রাজাকারদের অনুরােধে পাকি সেনারা ট্রেনে চেপে বিসকা স্টেশনে নামে। তখন সকাল ৯টা। খবর পেয়ে গ্রামের পর গ্রামের লােকজন এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে। শালিহর গ্রামের শ্রী গীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (৪০) জানান, “পাকিরা বাবা রায়মােহন চন্দ্র সরকারকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় একই এলাকার সচীন্দ্র, শত্রুঘ্ন, রামেন্দ্র, কামিনী কান্ত বিশ্বাস, তাড়িনী কান্ত বিশ্বাস, ক্ষীরদা। রানী বিশ্বাস, কৈলাশচন্দ্রসহ আরও অনেককেই ধরে নিয়ে যায় রশি দিয়ে হাত বেঁধে গরুর পালের মতাে। প্রায় দু’ঘণ্টা পর গুলির শব্দ শােনা যায়। গীরেন্দ্র ও তার বড় ভাই ‘ রবীন্দ্র সেদিন লাশের স্তুপ থেকে শনাক্ত করে তার বাবা রায়মােহনের লাশ। ভয়ে সেই লাশ দাহ করতে না পেরে পুত্ররা মাটি খুঁড়ে তাতে চাপা দিয়েছিল বাবার লাশ। রবীন্দ্র জানালেন, সেদিন কামিনীকান্ত, তাড়িনীকান্ত ও ক্ষীরদা রানীর লাশও পুঁতে ফেলতে হয়েছিল একই গর্তে। এরা ছিলেন একই পরিবারের। পাকিরা এসব শহীদের পিছন থেকে গুলি চালিয়েছিল। পাকিরা এদের হত্যার আগে এদের বাড়িঘর লুট করে তাতে অগ্নিসংযােগ করে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা গাজী আবদুল কুদ্দুস জনকণ্ঠকে জানান, রাজাকার কমান্ডার আবদুল জব্বারের পরামর্শে ও মদদে সেদিন পাকিরা একদিনেই বিসকা, বাথুয়াদি ও শালিহর এই ৩টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। শালিহরেই পাকিরা গুলি করে একদিনে হত্যা করে’ ১৭ জনকে।

স্থানীয় লােকজন জানিয়েছে, আবদুল জব্বার ছিল একজন সশস্ত্র রাজাকার। তার বাবা ছিল সশস্ত্র আলবদর। আবদুল জব্বার একাত্তরে ময়মনসিংহ শহরে থাকলেও বিসকা অঞ্চলের নানা অপারেশনে পিতার সঙ্গে পাকিদের সহায়তা দিত। জয়নাল বিসকা স্টেশনের ব্রিজের কাছে পাকিদের তাবেদারী। করত। এলাকার হিন্দু-বাঙালীদের গরু, ছাগল, হাঁস ধরে ক্যাম্পে তুলে দিত । চান্দপুরের মরহুম চেয়ারম্যান শামছ উদ্দিন সরকারকে সেদিন জব্বারের পিতা জয়নাল পাকিদের হাতে তুলে দেয়। পরে অবশ্য মােটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল সেই চেয়ারম্যান। পাকিরা জব্বার রাজাকারের পরামর্শে শালিহরের মধুধর, ছাবেদ বেপারী ও বাথুয়াদির অধর সরকারকে ধরে প্রথমে বিসকা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পরে আর তাদের হদিস মেলেনি। প্রচার রয়েছে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের কংস নদীর ধারে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পাকিরা একাত্তরে বিসকা, বাথুয়াদি ও শালিহরের অনেক হিন্দু পরিবারের যুবতী কন্যাদের ধরে বিসকা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। সে মেয়েদেরও পরে আর হদিস মেলেনি। তাদের কোন লাশও পাওয়া যায়নি। প্রচার রয়েছে যুদ্ধের পর বিসকার আইরার বিলের ব্রিজ ক্যাম্পে পরে অনেক শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট পাওয়া গিয়েছিল। একাত্তরের পর সেই রাজাকার আবদুল জব্বার ও পিতা আলবদর কমান্ডার জয়নাল গ্রেফতার হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে এসে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়েছিল। পরে ভারতীয় মাদ্রাসার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কিছুদিন নেত্রকোনার ঝারিয়া মাদ্রাসায় চাকরি করে রাজাকার জব্বার। এখন সে নিজ এলাকায় সৌদি অর্থে পরিচালিত ডাক্তার আবদুল্লাহ ওমর নাসিব দাখিল মাদ্রাসার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

জনকণ্ঠ ॥ ০৬-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!