You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিবাহিনীর একটি হাসপাতালে

* চড়াই-উত্রাই ভাঙা পথটা ত্রিপুরা সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে বাঙলাদেশে। রণাঙ্গন থেকে বেশ কিছুটা পেছনে মুক্তিবাহিনীর হাসপাতাল। গােলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়, আঁচ লাগে না।
আমাদের গাড়ি আউট পােস্টের কাছে এসে দাঁড়াতে বাঙলাদেশ রক্ষীরা পরিচয় জানতে চাইলেন এটাই নিয়ম। পরিচয় পেয়ে পথ ছেড়ে দিলেন। আর একটু এগােতে বন্ধু বললেন এসে গেছি। গুটিকয় চালাঘর, আর কয়েকটি তাঁবু। চার দিকে জঙ্গল। কাজু বাদামের আবাদ।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। অল্প অল্প কাদা হয়েছে। আমাদের গাড়ি এসে থামতেই কৌতূহী দু-একটি চোখ উঁকিঝুকি মারছিল। গাড়ি থেকে নামতে দেখে এবার তারা এগিয়ে এলেন। বন্ধু এদের পরিচিত। এদের জন্যে সাহায্য নিয়ে অনেকবার এসেছেন।
এদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সাংবাদিক শুনে ওঁরা খুশি। বললে, আসুন দেখবেন, কেমন করে আমরা হাসপাতাল চালাচ্ছি।
বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন ড. নাজিম কোথায়? কোয়ার্টারে গেছেন, এখুনি এসে পড়বেন—একটা অপারেশন আছে।
সামনেই সার্জিক্যাল ওয়ার্ড। প্ল্যাস্টিকের চাদর আর খড়ে ছাওয়া একটা ঘর। ছাদ থেকে কোনাে কোনাে জায়গায় জল চুইয়ে পড়ছে। বাঁশের মাচায় সারি সারি শয্যা। সন্ধ্যা হয় একটু একটু করে অন্ধকার এসে জমছে। একটা শস্তা দামের ট্রানজিস্টার বাজছে ঈষৎ বিকৃত স্বরে।
বন্ধু বললেন, এদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন লেখার অনেক খােরাক পাবেন।
সামনের শয্যায় বসেছিলেন বাহারুদ্দিন রেজ্জাক। বাড়ি কুমিল্লা। শক্ত সমর্থ চেহারা। পাকিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে পায়ে গুলি লেগেছে গত ১৫ জুলাই। সেই থেকে হাসপাতালে। এখন প্রায় ভালাে হয়ে গেছেন। কিন্তু একটু খুঁড়িয়ে চলতে হবে তাতে অবশ্য দমেননি রেজ্জাক। হাঁটতে না পারলেও তবু সাঁতার কেটে গিয়ে শত্রুর জাহাজ ডুবিয়ে দিতে তাে পারবেন।
সুশীলচন্দ্র সাহার কাপড়ের দোকান ছিল ঢাকায়। সলজ্জভাবে বললেন, ছেলেদের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। ২৬ মার্চ খান সেনারা দোকান-পাট সব পুড়িয়ে দিল। তারপর ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ভারতে। সেখানে মুক্তিসেনায় নাম লিখিয়েছেন। আহত হয়েছেন হােমনা থানায় আক্রমণ চালাতে গিয়ে। তাতে দুঃখ নেই। ১৭জন রাজাকারকে বন্দি করে এনেছে তার দল।
ল্যান্স নায়েক আবদুল মােমিন ছিলেন ই. পি. আর. এ। দেশ কুমিল্লা। তারা রেস্টে ছিলেন, এমন সময় খানসেনারা আক্রমণ করে। কোন রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন। দেশের মধ্যেই শত্রুর চোখে ধুলাে দিয়ে।
এদিক-ওদিক ঘুরছিলেন। তখন তাে জানতেন না ভারত তাদের বন্ধু, ভারতে আশ্রয় পাওয়া যাবে। ভারতে এসে যােগ দিয়েছেন মুক্তিবাহিনীতে। আহত হয়েছেন কসবার লড়াইয়ে। এখন দিন শুনছেন কবে ভালাে হয়ে আবার লড়াইয়ে যেতে পারবেন।
এমন ধারা কথা বলছি রােগীদের সঙ্গে, ড. নাজিম এসে পড়লেন। আমি তাে অবাক। এই নাকি ডাক্তার। এষে একেবারে ছেলে-মানুষ ! বয়েস জিজ্ঞাসা করতে বললেন ২৯। আমি বললাম, দেখে কিন্তু মনে হয় না কুড়ির বেশি। ডাক্তার সলজ্জ একটু হাসলেন।
নাজিম ছিলেন ময়মনসিংহ হাসপাতালের ডাক্তার।
দেখুন কী অবস্থার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ওষুধ-পত্র নেই, এমনকি বিছানাও নেই। খড়ের চট বিছিয়ে শােয়ানাে হয়েছে রােগীদের। এই তাে দেখুন ফ্রাকচারকেস। আমাদের একস-রে জন্য। কিন্তু তারা প্লেট দেয় না। আন্দাজে চিকিৎসা করতে হচ্ছে। তবু সাজসরঞ্জামের অভাবে আমরা ভালােবাসা দিয়ে পূরণ করছি। রােগিদের জিঞ্জাসা করে দেখুন, কেউ এ হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না।
ডাক্তারের চারজন সহকারী মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এখানে এসে হাসপাতালে কাজ করছেন। তাঁদের একজন মুরশেদ চৌধুরীর বললেন, তাঁবুতে থেকে পাকা বাড়িতে থাকার স্বাদ ভুলে গেছি।
যেমন ডাক্তার তেমন রােগী, তেমন নার্স। অনুপমা সাহা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী। ২৫ মার্চের পর কোন রকম পালিয়ে চলে এসেছিলেন ভারতে তারপর সেখান থেকে এই হাসপাতালে।
ফিরে আসব ভাবছিলাম। ওরা বললেন মেডিকেল ওয়ার্ডটা একবার দেখে যান। মেডিক্যাল ওয়ার্ডের রােগীরাও মুক্তিবাহিনীরই লােক। তবে আহত নন, রােগের শিকার।
এখানে আলাপ হলাে ক্যাপটেন সিতারার সঙ্গে। বাঙলাদেশের একটি শ্যামলা মেয়ে। কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস। ছিলেন কুমিল্লার মিলিটারি হাসপাতালে। সেখান থেকে পালিয়ে এসে যােগ দিয়েছেন এই হাসপাতালে।
আলাপ হলাে বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ের সঙ্গে। সুলতানা আর সাইদা কামাল। বেগম সাহেবা স্বামীকে ছেড়ে আসতে পারেননি, দুই মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফিরছিলাম। দেখি ডা. নাজিম হাত-পা ধুয়ে তৈরি হচ্ছেন অপরেশনের জন্য। একজনের ঘা শুকোচ্ছে
ন গ্রাফটিং করতে হবে। ওয়ার্ডের মধ্যেই কাজ চালাবার মতাে একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছেন রােগী।
ড. নাজিম বললেন, সামনেই আমাদের অপারেশন থিয়েটার তৈরি হচ্ছে। প্ল্যাস্টিক চাদর দিয়ে তৈরি ঘরটাও দেখলাম।
ক্যাপটেন সিতারা কিছুতেই ছাড়লেন না। চা খেয়ে যেতে হলাে। চা, পেঁপে, রােজা ভাঙার তেলেভাজা, কাজু বাদাম ।
এটা খান, ওটা খান। সে আতিথেয়তা ভুলবার নয়।
সন্ধা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছেল। ইচ্ছে করছিল না, তবু উঠতেই হলাে। দূরে তখন শেলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
বিদায় নিতে গিয়ে গলায় একটা পিণ্ড উঠে আসছিল। আমার হৃদয়ের একটা খণ্ড ঐ হাসপাতালেই পড়ে রইল। সত্যি অসাধ্য সাধন করছেন ওঁরা।
—পুরন্দর

সূত্র: সপ্তাহ, 12.11.1971

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!