You dont have javascript enabled! Please enable it!

পশ্চিম বাংলার আহ্বান

নয়াদিল্লীর কাছে দাবী জানিয়েছেন পশ্চিমবাংলা বিধানসভা। অবিলম্বে দিতে হবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্র সাহায্য। রক্তস্তাত বাঙলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবাংলা। তার উপর পড়েছে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপ। ত্রিপুরা, আসাম এবং মেঘালয় হাড়ে হাড়ে ইয়াহিয়র মারণযজ্ঞের মর্মদাহ। শরণার্থীর চাপ তাদের উপরও কম নয়। পশ্চিম বাংলার অবস্থা কিছুটা আলাদা। পূবের বাঙালীদের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক। ইয়াহিয়ার সৈন্যদলের প্রতিটি আঘাত লাগছে এপারের গায়ে। পশ্চিম বাংলার আর্থিক কাঠামাে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। শরণার্থীর সেবায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছেন সত্য, কিন্তু তা সমস্যা সমাধানের চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়। আসল সমস্যা সামনে। যতদিন যাবে রাজনৈতিক জটিলতা তত বাড়বে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পশ্চিমবাংলা বিধানসভা বাঙলাদেশের সংগ্রামের ত্বরিত ফয়সালায় উৎসুক। মানবত, গণতন্ত্র এবং জাতীয় স্বার্থ মিশে গেছে বাঙলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে। দিল্লী এবং অন্যান্য রাজ্য বহুদূরে। তাদের গায় লাগছে না কোন আঁচড়। এদের উপলব্ধি পশ্চিম বাংলার মত তীব্র নয়। ওদের অপেক্ষা পশ্চিম বাংলার মৃত্যুশেল। স্থানীয় বিধানসভা অবস্থার যে মূল্যায়ন করেছেন তা পুরােপুরি বাস্তবমুখী। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নীতি নির্ধারণ করা উচিত ছিল নয়াদিল্লীর। ওরা এ পথে পা দেন নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কালাে ধুয়া আচ্ছন্ন করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি। দুনিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলােকে যদি সঙ্গে না পাওয়া যায় তবে একথা চলতে পারবে না ভারত। এ মনােভাব দুর্বলের, সবলের নয়।
স্বাধীনতার পর বহু ঠকেছেন নয়াদিল্লী। যাদের মুখে চেয়ে তারা বসে থাকতে অভ্যস্ত সঙ্কটকালে তারা কেউ মুখ তুলাে চায় নি। সাজ্যবাদী পর্তুগালের হাত থেকে গােয়ার মুক্তিতে খুশী হয় নি অনেক ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ রাষ্ট্র। পাকিস্তান চাপিয়েছিল ভারতের উপর সম্প্রসারণশীলতার অপবাদ। ১৯৬৫ সালে ভারত আক্রমণ করেছিলেন আয়ুব খান। তার সৈন্যদলের হাতে ছিল মার্কিন অস্ত্র। বিবেক দংশনে ভােগে নি আমেরিকা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মি: উইলসন করেছিলেন ভারত-বিরােধী উগার। সােভিয়েট রাশিয়া নিজে উদ্যোগী হয়ে স্বাক্ষর করিয়েছিল তাসখন্দ চুক্তি। এই চুক্তিভঙ্গের প্রমাণ হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও মস্কো দিয়েছিল পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য। ইসলামাবাদকে যারা এত পেঁয়াজ করেছেন তাদের কাছে বেশী কিছু প্রত্যাশা সম্ভব নয়। চীনের বিশ্বসঘাতকতা কারও অজানা নয়। ১৯৬৫ সালে পাকবাহিনী যখন প্রায় পর্যুদস্ত তখন পিছন থেকে ভারত আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন পিকিং। এবারও ইয়াহিয়ার সমর্থনে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে চীন। তার মতিগতি কেন্দ্র করেই ঘুরছে আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার বাঙলাদেশ নীতি। পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক দোস্তী। তারা সবাই একাধিক সামরিক জোটের শরিক। তুরস্ক, ইরান এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রনায়কেরা ইয়াহিয়ার ধর্মভাই। বাঙলাদেশ ধ্বংসে সৌদি আরব জোগাচ্ছে টাকা এবং ইরান দিচ্ছে গানবােট। অন্যান্য আরব রাষ্ট্র ডুবে আছে অজ্ঞতার অন্ধকারে। সেখানে ইয়াহিয়ার প্রচারযন্ত্র উত্তাল। মােল্লাতন্ত্রীরা হয়ে উঠেছে সক্রিয়। বাঙলাদেশের খবর পৌছাচ্ছে না সেখানে। এ অবস্থায় কাউকে সঙ্গে পাবেন না নয়াদিল্লী। তাদের যদি কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে তা নিতে হবে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনার উপর নির্ভর করে। এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত। তার সঙ্গে রয়েছে গণতন্ত্রের ছাপ। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইরান, তুরস্ক এবং সৌদি আরব প্রকাশ্যে দিচ্ছে পাকিস্তানকে অস্ত্র এবং অর্থের মদৎ। আর ভারত অনুরূপ সাহায্য দিতে পারছে। না কেন বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের? গণতন্ত্র এবং মুক্ত দুনিয়ার জন্য আমেরিকার দরদের অন্ত নেই। মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে কমিউনিষ্ট চীন এতদিন ছিল বিশ্বের শান্তিভঙ্গকারী। এই চীনের সঙ্গে এখন চলছে। তাদের ভাবের আদান প্রদান এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের সলাপরামর্শ। একদিকে আমেরিকা বলছে, বাঙলাদেশের গণহত্যায় সে উদ্বিগ্ন। অপরদিকে এই গণহত্যার সমর্থনকারী পিকিং-এর সঙ্গে বাঁধতে চাইছে গটিছড়া। সােভিয়েট রাশিয়া এক পা এগুচ্ছে। পরক্ষণেই আবার পিছুচ্ছে। চীনকে নিয়ে তার মাথাব্যাথার অন্ত নেই। পরের জন্য কোন ঝুকি নিতে কেউ রাজী নয়। আদর্শের চেয়ে সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থই তাদের কাছে বড়। ভারতের সঙ্কট তার নিজস্ব। বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যের সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ জড়িত। আন্ত র্জাতিক খয়রাতিতে কখনই সমাধান হতে পারে না শরণার্থীর সমস্যা। প্যালেস্টাইনের আরব শরণার্থীরা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ওটা এখন পশ্চিম এশিয়ার গলার কাঁটা। খােলাও যায় না এবং হজম করাও চলে না। এই ধরনের একটা অবস্থার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার চূড়ান্ত পরাজয় ছাড়া সমস্যার কোন সমাধান নেই। এই পরাজয়কে ত্বরান্বিত করাই নয়াদিল্লীর প্রধান কর্তব্য। অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্র তাদের সহযােগী যদি না হয় তবে নিজের পথ অবশ্যই বেছে নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। ঘােচাতে হবে পরমুখাপেক্ষিতার অপবাদ। পশ্চিমবাংলার আহ্বান শুধুমাত্র বাঙালীর কোন আহ্বান নয়, ভারতের কোটি কোটি মানুষের আহ্বান। কোন গণতন্ত্রী সরকার তা উপেক্ষা করতে পারেন না। করলে গণতন্ত্রের মৌল নীতিতেই আঘাত আসবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!