You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভৈরবে শত শত খুন ধর্ষণ লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের হােতা মমতাজ পাগলার নাম শুনলে মানুষ এখনও আতকে ওঠে

কাজী ইসফাক আহমেদ বাবু, ভৈরব থেকে ॥ একাত্তরে ভৈরবসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার অন্যতম হােতা পাকিবাহিনীর দোসর রাজাকার কমান্ডার মমতাজ পাগলা ও তার ছেলেদের অত্যাচারের কথা মনে করে সাধারণ মানুষ এখনও শিউরে ওঠে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে মুক্তিযােদ্ধারা ভৈরব বাজারে তাকে হত্যা করে। আর তার সন্তানেরা এখন রয়েছে নিরুদ্দেশ, হয়েছে। পাকি নাগরিক। কুখ্যাত এই রাজাকারের বাড়ি ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের আদর্শপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম লুদাই মিয়া। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭০ সালে মাত্র ১৭ হাজার টাকার জন্য মমতাজ পাগলা ও তার ছেলেরা খুন করে দ্বিতীয় ছেলে সাকীর কথিত শ্যালক ও ব্যবসার পার্টনার আশুগঞ্জ সােহাগপুর পল্লীর সিকদার বাড়ির হাবিব সিকদারকে। তাকে হত্যা করে বাড়ির পিছনে পুঁতে রাখা হয়। ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তকালীন ভৈরব থানার ওসি কুতুবুর রহমান মমতাজসহ তার ছেলে সাকী, বাক্কী, সাফি ও গাউসকে গ্রেফতার করে। ‘৭১ সালে যুদ্ধের সময় দেশের সকল জেলখানার তালা খুলে দেয়া হলে মমতাজ ও তার ছেলেরা, বাড়িতে এসে পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেয়। একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাক। হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণে ভৈরব বাজার দখল করে। সেদিন পাকিবাহিনীর নৃশংসতায় ভৈরব থেকে ৫ কিলােমিটার দূরে আলগড়া নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদ পারাপারের জন্য অপেক্ষারত ৩/৪শ’ গ্রামবাসীর মৃত্যু ঘটে। পাকি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সেদিন মানুষের রক্তে লাল করেছিল ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। পাকি বাহিনীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে কুখ্যাত রাজাকার মমতাজ পাগলা ও তার ছেলেরা পাকিস্তানের পক্ষে কথা বললে কালিকাপ্রসাদ গ্রামের লােকজন তাদের গ্রামছাড়া . করার জন্য উঠেপড়ে লাগে এবং তাদের ঘেরাও করে রাখে। এ সময় মমতাজ পাপলার তৃতীয় ছেলে বাক্কী প্রাণ বাঁচাতে মিরারচরের দিকে দৌড়াতে থাকলে গণধােলাইয়ে তার। মৃত্যু ঘটে। কুখ্যাত রাজাকার মমতাজ পাগলার বড় ছেলে খােকার কাছে ছিল অবৈধ অস্ত্র।

জনতার রােষানল থেকে বাঁচার জন্য সেদিন ফাকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে খােকা, সাকী, হাদী, সাফি ও গাউস গজারিয়ার দিকে দৌড়াতে থাকে। জনতাও তাদের পিছু নেয়। পরে প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে জনতা তাদের ক্ষমা করে বাড়িতে আসার সুযােগ করে দেয়। কিন্তু পাষণ্ড এই ঘাতক পরিবার ঐদিন সন্ধ্যায় কালিকাপ্রসাদ থেকে ভৈরবপুর। দক্ষিণপাড়া মধু মিয়ার বাড়িতে চলে আসে। কারণ মধু মিয়ার মেয়েকে মমতাজের বড় ছেলে বিয়ে করেছিল। পরে পাকি বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে গঠন করে রাজাকার, আলবদর ও পিস কমিটি। একাত্তরের একুশে এপ্রিল মমতাজ পাগলা ও তার ছেলেরা গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেয়ার উদ্দেশ্যে রেলুযােগে পাক বাহিনীসহ কালিকাপ্রসাদ রেলওয়ে স্টেশনে নামে। আদর্শপাড়াটি হিন্দু বসতি বলে পাকি বাহিনীদের কাছে মিথ্যা প্রচার করে। ফলে পাকি বাহিনী আদর্শপাড়া গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। মমতাজ পাগলা ও তার ছেলেরা পাকি বাহিনীর অন্যতম সহচর হিসাবে কাজ করেছে।

তার ছেলে হাদী আল । হাদী গ্রুপ গঠন করে। সৃষ্টি করে রাজাকার। তার গ্রুপে রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৮/১০ জন। তারাই মূলত ভৈরব বাজারে চালিয়েছে হত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজ । রাজাকার হাদীর নির্দেশে মানিকদী পল্লীর একটি মসজিদে নামাজ পড়ার সময় ২২ মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। ভৈরব বাজার ছবিঘর সিনেমা হল রােডে অবস্থিত ভৈরবপুরের মমতাজ উদ্দিনের পিয়াজের গদি ঘরে মমতাজ পাগলাসহ পিস কমিটির সদস্যরা মিটিং করত। ভৈরবের সমস্ত হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন পরিচালিত হতাে এই গদি ঘর থেকে। এই গদি ঘরের মালিক ছিল আলবদরপ্রধান। পাকি বাহিনী যতটুকু না নির্যাতন করেছে তার। চেয়ে বেশি নির্যাতন চালিয়েছে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী। রাজাকার হাদী ও মমতাজ পাগলার অত্যাচারে ‘৭১ সালে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে রয়েছে আড়াই বেপারীর বাড়ির মমতাজ মিয়ার ছেলে খুরশেদ মিয়া, সুলতান মিয়ার ছেলে লােকমান। আবু মিয়ার ছেলে মস্তু মিয়াকে পাকি বাহিনীর টর্চার সেলে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের পাশ আর পাওয়া যায়নি। ভৈরবপুর কাদির বেপারীর বাড়ির আবু মিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আলিম সরকার বাড়ির নােয়জ মিয়া, আক্তার মিয়া, আসাদ মিয়াকে লাজাকারদের ইঙ্গিতে পাকি বাহিনী হত্যা করে। ভৈরবপুর রমজান মিয়ার বাড়ির সাবেক পৌরসভার কমিশনার সুরুজ মিয়াকে পাকি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি।

কালীপুরের আজর মিয়া ও তার ভাই চান মিয়াসহ সামছুল হককে। মমতাজ পাগলার ছেলে হাদীর নেতৃত্বে হত্যা করা হয়। কুখ্যাত রাজাকার মমতাজ পাগলার বিচার স্বাধীনতা সগ্রামের সময়ে হয়েছিল।’ মুক্তিযােদ্ধা আতিক ও নূরু নিজ হাতে ভৈরববাজার ছবিঘর সিনেমা হল রােডে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে মমতাজ পাগলাকে হত্যা করেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন আতিক ও নূরুও শহীদ হন। কুখ্যাত রাজাকার মমতাজের চার ভাই, এক ছেলে, এক ভাতিজা নিহত হয় গণধােলাইয়ে। মমতাজ পাগলাকে হত্যার পর রাজাকারদের মনে বিরাজ করত মুক্তিযােদ্ধা আতঙ্ক। ফলে হাদী গ্রুপ. অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রকাশ্যে চলাচল করত। পাকি। | বাহিনীর টর্চার সেল ছিল ভৈরব রেলস্টেশন, ভৈরববাজার, রেলওয়ে কলােনি ও আশুগঞ্জ [ এলাক। আর রাজাকার হাদী গ্রুপের টর্চার সেল ছিল ভৈরবপুর, হাজী আম্বর আলীর বাড়ি। এখানে চলত রাজাকারদের নারী নিয়ে ফুর্তি, লুটতরাজের ভাগবাটোয়ারা ও। হত্যার কার্যক্রম। দেশ স্বাধীনের পর ৯৬ হাজার পাকি সৈন্যের সাথে মমতাজ পাগলার ছেলেরাও পাকিস্তান চলে যায়। হাদী, খােকা, সাকী স্ত্রী, বাচ্চা, ভাতিজাদের নিয়ে পাকিস্তানী নাগরিক হয়। গােলাম গাউস হয় নিরুদ্দেশ। ‘৭২ সালে চট্টগ্রামে গােলাম গাউসের সন্ধান পাওয়া গেলে ‘৭১-এর অপকর্মের অভিযােগ এনে তার বিরুদ্ধে আদর্শপাড়া গ্রামের নায়েব আলী ও জগন্নাথপুরের আঙ্গুর মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। পুলিশ। গােলাম গাউসকে গ্রেফতার করে। তাকে ভৈরব থানায় আনার পর জনতা থানা ঘেরাও’ করে গাউসকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে থানা-পুলিশ সেদিন অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। গাউসকে ভৈরব কুলিয়ারচর এলাকা দিয়ে নেয়া সম্ভব হওয়ায় জনতার চোখকে ফাকি দিয়ে নৌপথে কিশােরগঞ্জের কারাগারে পাঠানাে হয়। ‘৭৬ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গাউসও পাকিস্তানী নাগরিক দাবি করে সে দেশে চলে যায়। একাত্তরের এই ঘৃণিত রাজাকারের কেউ আর দেশে নেই। শূন্য ভিটায় মানুষ এখন মলমূত্র ত্যাগ করে। রাস্তা দিয়ে চলার পথে পথিক একটু থেমে কুখ্যাত রাজাকারের নাম উল্লেখ করে থু থু ছিটিয়ে যায়।

জনকণ্ঠ ॥ ০৮-০৪-২০০০ ময়মনসিংহ

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!