You dont have javascript enabled! Please enable it!

রূপগঞ্জে রাজাকারের সেক্রেটারি খ্যাত প্রিন্সিপাল হান্নান এখন প্রভাবশালী মাতব্বর

মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ থেকে ॥ রূপগঞ্জ উপজেলার রানীপুরা গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার ও পাকি বাহিনীর দোসর প্রিন্সিপাল হান্নান মাওলানা এখন এলাকার প্রভাবশালী মাতব্বর; গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি। ‘৭১-এর সেই কুখ্যাত রাজাকারের কাহিনী রূপগঞ্জের নতুন প্রজন্ম না জানলেও তকালীন সময়ের মানুষ আজও সেই কথা ভােলেনি। এলাকার মুক্তিযােদ্ধা, প্রবীণ ব্যক্তি ও নির্যাতিত মানুষদের সে সময়ের সকল ঘটনা আজও স্বপ্নে তাড়া করে ফিরে। যুদ্ধের ৯ মাস প্রিন্সিপাল হান্নান মাওলানা ছিল সমগ্র রূপগঞ্জের আতঙ্কের নাম। তখন তার ভয়ে গা ঘেঁষেও দাঁড়াত না কেউ। তাকে দেখলেই নিরীহ লােকজন ছুটে পালাত। যুদ্ধকালীন সময়ে এ ঘৃণ্য রাজাকার ছিল রূপগঞ্জ শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তার নেতৃত্বে সমগ্র রূপগঞ্জের ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটিও এ সময় পাকিদের সহযােগিতায় মাঠে নামে। আর সেই থেকে প্রিন্সিপাল হান্নান এলাকায় পরিচিতি লাভ করে রাজাকারের সেক্রেটারি হিসাবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই এই রাজাকার মুসলিম লীগ করার সুবাদে সরাসরি পাকিদের সাথে সখ্য গড়ে তােলে। রূপগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় শহীদ মুক্তিযােদ্ধা গােলাম রশীদ বকুল হত্যাসহ মুক্তিযােদ্ধা কাজী আব্দুল হাই, শহীদ উল্লাহ, সামসুল হক, আবু সায়েম সরকার, সামসুল আলম খান, হাবিবুর রহমান ও আলাউদ্দিন সিকদার হত্যার পিছনেও তার অলিখিত ইঙ্গিত ছিল বলে জানা যায়। এই রাজাকার যুদ্ধের সময় এলাকা ঘুরে ঘুরে মানুষকে বােঝাত পাকিস্তান বিভক্ত হলে আমাদের অমঙ্গল হবে। সে ‘৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের রূপগঞ্জে সংগঠিত করে। এর সুবাদে এই রাজাকার ছিল পাকিদের প্রিয়পাত্র। সব সময়ই সে তাদের পাশে পাশে থাকত।

পাক সেনাদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিত কিভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের খতম করা যায়। সে তার দোসরদের দিয়ে গ্রামের যুবতী ও গৃহবধূদের গােপনে পাকি সেনাদের হাতে তুলে দিত। যুদ্ধকালীন সময় সারাক্ষণই তার মাথায় থাকত জিন্নাহ টুপি। রূপগঞ্জে পাকিদের আক্রমণ যেখানেই হতাে তাতে থাকত হান্নান মাওলানার। ঘৃণ্য হাত। তার ইশারায় রূপগঞ্জের হাজার হাজার মুক্তিকামী নারী-পুরুষ শহীদ হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে বহু গৃহবধূ ও যুবতী। রূপগঞ্জের ক’জন মুক্তিযােদ্ধা জনকণ্ঠকে জানান, ‘৭১-এর এই রাজকার রূপগঞ্জের যে। সমস্ত জায়গায় মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাটি ছিল গুপ্তচরের মাধ্যমে তার খোঁজখবর নিয়ে পাকিদের জানিয়ে দিত। পরে পাকিরা সে ঘাটি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিত। তার মদদে স্থানীয় বহু হিন্দুর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এদিকে দেশ স্বাধীন হলে রাতের আঁধারে সে ও তার দলবল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। রাজাকার হান্নান মাওলানা সে সময় ঢাকার মােহাম্মদপুরের এক মাদ্রাসায় গিয়ে আত্মগােপন করে। এদিকে অত্যাচারিত হয়ে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ও জনতা যুদ্ধের পর তার বাড়িতে হামলা চালায়। তাকে না পেয়ে তার পিতা নজরুদ্দিন মুন্সীকে প্রথমে পিটিয়ে এবং পরে ব্রাশফায়ারে ঝাঝরা করে দেয়। যতদূর জানা যায়, এই নজরুদ্দিনও নাকি ছিল পাকিদের দোসর। মুক্তিযােদ্ধারা জানিয়েছেন, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয় কিন্তু সে প্রভাব খাটিয়ে সে সব মামলার নথি পর্যন্ত গায়েব করে দেয়। এদিকে এলাকার পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হতে থাকলে এই রাজাকার সাবেক সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। হান্নান মাওলানা আবার রূপগঞ্জে আসে। সেই থেকে একে একে নানা কৌশলে সে আজ প্রতিষ্ঠিত। এর পর দীর্ঘদিন বেলদী মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। শুধু তাই নয়, তার সক্রিয় সহযােগিতায় রূপগঞ্জে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি চাঙ্গা হয়। এদিকে জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধি ১১ এপ্রিল হান্নান মাওলানার বাড়ি রানীপুরায় যান তার বক্তব্য গ্রহণের জন্য। শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে সে এ সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি।

জনকণ্ঠ ॥ ২৩-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!