নারায়ণগঞ্জে হিন্দুর বাড়ি দখলকারী মুন্সী মনছুর কেরানী থেকে কোটিপতি
রুমন রেজা, নারায়ণগঞ্জ থেকে। ১৯৭১ সাল। চারদিকে পাকি হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব। নারায়ণগঞ্জ শহরের নগর খানপুর এলাকার একটি বাড়ি। নিমগাছঅলা বাড়ি বললেই খুব সহজে চিনত এলাকাবাসী। এই বাড়িতেই থাকত নিতাই দে তার মা আর ভাইকে নিয়ে। নিতাই দের স্টেশনারি দোকান ছিল শহরের কালীরবাজার এলাকায় নাম কমলা স্টোর। তখন চলছে দেশ জুড়ে পাকি বাহিনীর সীমাহীন অত্যাচার। মানুষ পালাচ্ছে বাড়িঘর ছেড়ে, ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু এই পরিবারটি ভয়-ভীতি উপেক্ষা। করে থেকে যায় তাদের বাড়িতেই । নিতাই দে’র বৃদ্ধা মা কিছুতেই ছাড়তে রাজি হয়নি তার স্বামীর ভিটা। এক রাতে পাকি-হানাদার বাহিনী হামলা চালায় এই বাড়িতে। এক কুখ্যাত রাজাকার পাকি বাহিনীকে দেখিয়ে দেয় এই বাড়িটি। নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় নিতাই দে’র মা ও ভাইকে। পাকি বাহিনী জ্বালিয়ে দেয় বাড়িটি। এ বাড়িটির দিকে চোখ ছিল পাকি বাহিনীকে সহায়তাকারী সেই রাজাকারের।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িটি দখল করে নেয় সেই কুখ্যাত রাজাকার। নিরুদ্দেশ হয়ে যায় নিতাই দে। এই নৃশংস ঘটনা এখনও আলােড়িত করে খানপুর এলাকার বয়স্ক মানুষকে। প্রতিবেশীকে নির্মমভাবে হত্যার দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়িত করে তাদের। নিতাই দে’র মা ভাইকে হত্যার ঘটনায় পাকি বাহিনীকে সহায়তাকারী সেই রাজাকার মুন্সী মুনছুর আহম্মদ এখন কোটিপতি ব্যবসায়ী। শহরের টানবাজারের বিশাল মার্কেট, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- দস্তগীর জুট বেলিং এবং ঢাকায় পােস্তগােলা দস্তগীর মার্কেটের মালিক । মক্কা-মদীনা হাজী কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনও বানিয়েছে এই ঘৃণ্য রাজাকার। একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সঙ্গেও জড়িত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে ভােল্ পাল্টেছে। একটি মৌলবাদী দৈনিকের মালিকের সঙ্গেও রয়েছে তার ঘনিষ্ঠতা। হালে বর্তমান সরকারের এক প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে দিব্যি চলছে তার দিনকাল।। ‘৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুখ্যাত রাজাকার মুন্সী মুনছুর আহম্মদ ছিল বর্তমান জনতা ব্যাংকের সামান্য ক্লার্ক। পােস্টিং ছিল শহরের কালীরবাজার কর্পোরেট শাখায় । পাকি বাহিনীর সহযােগিতা করে দ্রুত নিজের ভাগ্য পাল্টে ফেলে সে। আঙ্গুল ফুলে হয়ে ওঠে কলাগাছ। নারায়ণগঞ্জ শহরে ছলে বলে কৌশলে দখল করে নেয় কয়েকটি হিন্দু বাড়ি। অভিযােগ রয়েছে তার টানবাজারের বাড়িটিও হিন্দু সম্পত্তি। এক হিন্দু পরিবারকে ভয় দেখিয়ে উচ্ছেদ করে এই বাড়ি দখল করে নেয়া হয়েছে।
মুন্সী মুনছুর আহম্মদের বক্তব্য এ প্রতিনিধি মুন্সী মুনছুর আহম্মদের মুখােমুখি হয় তার শহরের টানবাজারের বাড়িতে। ‘৭১-এ তার ভূমিকা ও নিতাই দে’র মা ও ভাই হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলতেই প্রথমে সে কিছুটা বিব্রত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রসঙ্গ পাল্টে প্রায় আধাঘণ্টা অন্য বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। এক পর্যায়ে এ প্রতিনিধি সরাসরি প্রশ্ন করলে মুন্সী মুনছুর আহম্মদ নিতাই দে’র মা ও ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। তার বক্তব্য, নিতাই দের বাড়ির সামনের অংশ ছিল তার। ‘৭১-এ খানপুর এলাকার রাজাকার সিরাজ ড্রাইভার দেখিয়ে দিয়েছিল পাকি বাহিনীকে নিতাই দে’র বাড়ি। তবে মুন্সী মুনছুর স্বীকার করে এই হত্যাকাণ্ডের পর নিতাই দের বাড়িটিও তার দখলে আসে । মা ভাইকে হত্যার পর নিতাই দে নিরুদ্দেশ হয়, তবে কী ভাবে তাদের বাড়ির মালিক হলেন- প্রশ্ন। করা হলে নীরব থাকে মুন্সী মুনছুর আহম্মদ।
জনকণ্ঠ ॥ ১৬-০৪-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন