You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভুয়াপুরের ছাব্বিশা গ্রামে ৩৮ জনকে হত্যা করা হয় আশরাফের নেতৃত্বে

ফিরােজ মান্ন, ভুয়াপুর থেকে ফিরে ॥ কুখ্যাত রাজাকার আশরাফ মওলানা এখন জামায়াত নেতা। ‘৭১ সালে ভুয়াপুরের ছাব্বিশা গ্রামে আশরাফের নেতৃত্বে ৩৮ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আশরাফের সহযােগী শহীদ মওলানা সেদিন ঐ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের দিনটি ছিল ‘৭১ সালের ১৭ অক্টোবর। এখনও ছাব্বিশা গ্রামের সেদিনের শহীদ পরিবারগুলাে ১৭ অক্টোবর এলেই চোখের পানি ফেলে। সরকারীভাবে এই পরিবারগুলাের কোন খোজখবর আজ পর্যন্তও নেয়া হয়নি। অথচ দেশে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন। আব্দুল গফুর, ইউসুফ আলী, ইয়াকুব আলী, বাহাজ উদ্দিন, শুকুর মাহমুদ, বিশা মণ্ডলসহ ৩৮ জন। এই ৩৮ জনের বাইরেও আশরাফ মওলানা বহু নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে। অসহায় নারীদের তুলে দিয়েছিল পাকি আর্মিদের হাতে। লুটপাট করেছে বহু মুক্তিযােদ্ধা এবং হিন্দুবাড়ি। জোরপূর্বক মুসলমান বানিয়েছিল অনেক হিন্দুকে। কুখ্যাত এই রাজাকারের বাড়ি ভুয়াপুর থানার নিকরাইল গ্রামে। নিকরাইল হাই স্কুলের শিক্ষক হিসাবে দীর্ঘকাল চাকরিও করেছে এই মওলানা। সম্প্রতি এই রাজাকার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে।

সেদিন নিকরাইলের রাজাকার গুরু পাকি দালাল আফাজ ফকিরের জল্লাদ হিসাবে আশরাফ মওলানা দায়িত্ব পালন করেছে। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার ‘স্বাধীনতা ‘৭১’ গ্রন্থে আফাজ ফকিরের নাম রাজাকার তালিকায় ৩ নম্বরে উল্লেখ করেছেন। এই কুখ্যাত ঘাতক আফাজ ফকিরের শিষ্য হিসাবে আশরাফ মওলানা মানুষ খুনে বাহবা কুড়িয়েছে। তখন আশরাফের আরেক সহযােগী ছিল ভুয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজাকার রফিকুল ইসলাম। ছাব্বিশা গ্রামের হত্যাকাণ্ডে রফিকুলও একই সঙ্গে মানুষ মেরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলেছে। নিরীহ নিরপরাধ। বাঙালীর রক্ত দুই হাতে মেখে সেদিন তারা উল্লাস করেছিল। পাকি আর্মিদের খুশি করার জন্য মানুষকে গুলি করে হত্যার দায়িত্ব পালনসহ আরও অসংখ্য কাজে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউল হক জানান, মুক্তি শেষে আশরাফ মওলানা এবং শহীদ মওলানাকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কোম্পানি কমান্ডার লুৎফর রহমান। গুলি করার দায়িত্ব পড়ে তােফাজ্জল হােসেন নামের এক মুক্তিযােদ্ধার ওপর। আশরাফকে বেঁধে রেখে শহীদ মওলানাকে যমুনা নদীর ধারে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধা তােফাজ্জল আর শহীদ মওলানার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ার কারণে তােফাজ্জল সেদিন তিনটি ফাঁকা গুলি করে চলে আসে এবং শহীদকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এভাবে সেদিন প্রাণ রক্ষা করে দীর্ঘদিন শহীদ মওলানা পালিয়ে ছিল। ‘৭৫ পরবর্তী শহীদ আবার ভুয়াপুরে চলে আসে। ভুয়াপুরে এসে নতুন করে প্রকাশ্যে পাকিস্তানী আদর্শের কথা প্রচার করতে থাকে। শহীদ মওলানা বর্তমানে ভুয়াপুর সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক হিসাবে কর্মরত রয়েছে।

একই সঙ্গে সে ভুয়াপুর নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) অফিসে হােমিওপ্যাথিক ডাক্তার হিসাবে চেম্বার খুলে বসেছে। অন্যদিকে রাজাকার আশরাফ মওলানা চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর টাঙ্গাইলের সাবালিয়া এলাকায় বসবাস করছে। বর্তমানে সন্তোষ কলেজের অধ্যাপক রহিজ উদ্দিন ইসলাহীর বাড়িতে আশরাফ মওলানার আস্তানা। রহিজ উদ্দিন ইসলাহীও কুখ্যাত রাজাকার। এই রহিজ উদ্দিন ইসলাহীর বাড়ি আশরাফের বাড়ির পাশের গ্রামে। দু’জনেই জামায়াতের নেতা। এ ছাড়া আশরাফের ছেলে টাঙ্গাইল জেলা সদরের মসজিদের মওলানা আব্দুল হামিদ। হামিদ ছিল শিবিরকর্মী, এখন জামায়াতের কর্মী। আশরাফ ছেলের কাছেও মাঝে মধ্যে থাকে। জেলা প্রশাসনের এই মসজিদে কি করে একজন জামায়াতকর্মী ইমামতি করতে পারে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন? জামায়াতীদের বিভিন্ন কর্মসূচীতে হামিদ মওলানা মুসল্লিদের যােগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে থাকে। মসজিদে নামাজের আগে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য দিয়ে থাকে এই হামিদ। আশরাফ রহিজ উদ্দিন ইসলাহীর বাড়িতে অবস্থান করে জামায়াতের যত প্রকাশনা রয়েছে সেগুলাে ঘুরে ঘুরে জামায়াত নেতাকর্মীদের হাতে পৌছে দেয়। এসব প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে দৈনিক সংগ্রাম, মাসিক মদিনা, কলম পত্রিকা, মহিলা জুগত। এসব পত্রিকা বিক্রি করে দলের অর্থ সংগ্রহ করে আশরাফ মওলানা।

জামায়াতীর্দের একটি স্কুলেও কাজ করে থাকে আশরাফ। আশরাফ মওলানা ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে দাড়িপাল্লা মার্কায় গােপালপুরভুয়াপুর থেকে নির্বাচন করেছিল। ভুয়াপুর এলাকার বহু মানুষ জানান, আশরাফ মওলানা ‘৭১ সালে ভুয়াপুরের হিন্দু এলাকায় লুটপাট এবং নারী নির্যাতনের শিরােমণি। ছিল। আশরাফের এক মেয়ে-জামাই রবিউল আলম বর্তমানে ভুয়াপুর থানা জামায়াতের সেক্রেটারি । নিকরাইল ইউনিয়ন নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) পদে দীর্ঘ ৩৫ বছর ছিল এই আশরাফ মওলানা। বর্তমানে এ পদটি তার মেয়ে-জামাই আব্দুস সালামকে উপহার দিয়েছে। ‘৭১-এর এই কুখ্যাত ঘাতক আশরাফ মওলানা দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সম্মান পেয়ে আসছে। আশরাফের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার নিকরাইলের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার ছেলে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। রফিকুল জানায়, আমার পিতা রাজাকার ছিল কিনা জানি না। তবে সে জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন সে দৈনিক সংগ্রাম, মাসিক মদিনা, কলম এবং মহিলা জগত পত্রিকা বিক্রি করে থাকে। আমার পিতা তার বন্ধু রহিজ উদ্দিন ইসলাহীর টাঙ্গাইলের সাবালিয়ার বাসায় থাকে। শহীদ মওলানা রাজাকারে ছিল তা অকপটে জনকণ্ঠের কাছে স্বীকার করেছে। সে জানায়, আমি রাজাকারে থাকলেও মানুষের উপকারই করেছি।

জনকণ্ঠ ॥ ২৪-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!