You dont have javascript enabled! Please enable it! মাগুরায় নৃশংসতার হােতা রেজাউল করিম রিজু, এখন চবি'র শিক্ষক - সংগ্রামের নোটবুক

মাগুরায় নৃশংসতার হােতা রেজাউল করিম রিজু, এখন চবি’র শিক্ষক

এম সাইফুল মাবুদ/ কাজী আবুল মনসুর ॥ একাত্তরে মাগুরায় নারী ধর্ষণ, লুটপাট, নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অন্যতম হােতা রাজাকার কমান্ডার রেজাউল করিম রিজু এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষ স্কুলশিক্ষিকা লুৎফুল নাহার হেলেনার মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা আজও মাগুরাবাসী ভােলেনি। হেলেনার ওপর রাজাকারদের অমানবিক নির্মম নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজও মানুষ শিউরে ওঠে। পাকিদের সঙ্গে নিয়ে সেই রাজাকাররা মুক্তিকামী মানুষের ওপর হায়েনার ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ত। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, অট্টহাসির মধ্য দিয়ে অসহায় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সেই কুখ্যাত রাজাকার রেজাউল করিম রিজু আজ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষাগুরু হিসাবে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছে। ‘৭১-এর ৫ অক্টোবর, সেই ভয়াল দিন। এই দিনে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার রিজুর নেতৃত্বে স্কুলশিক্ষিকা হেলেনাকে অমানবিক নির্মম নির্যাতন শেষে আধমরা অবস্থায় প্রকাশ্যে চলন্ত জীপের পিছনে বেঁধে মাগুরার সমস্ত রাস্তায় টেনেহিচড়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হেলেনার রক্তমাখা মাগুরার রাস্তার প্রতিটি ইট, পাথর আজও নীরব সাক্ষী। এ সময় এই কুখ্যাত। রাজাকার কমান্ডার রিজুর প্রধান সহকারী ছিল রাজাকার হাসান কবির। এই দুই রাজাকার তখন এলাকায় পরিচিত ছিল রিজু-কবির বলে। তখন রিজু-কবির মানেই ছিল মাগুরার আতঙ্ক। দেশ স্বাধীনের পর জেলার অনেক রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। মারা পড়লেও কুখ্যাত রাজাকার রিজু ও কবির মুক্তিযােদ্ধাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আত্মগােপন করে।

সেই কুখ্যাত রাজাকার রিজু-কবিরকে আজও মাগুরাবাসী খুঁজছে। মাগুরায় রাজাকার পাকিদের ঘাঁটি ছিল শহরের দত্ত বিল্ডিং ও গােল্ডেন ফার্মেসি ভবন। খুন, ধর্ষণসহ রাজাকারদের নৃশংসতার নীরব সাক্ষী হিসাবে আজও মাগুরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাড়িয়ে আছে ভবন দু’টি। ‘৭১-এর ৪ অক্টোবর দুপুরের দিকে মাগুরা জেলার সুলতানশস্বী গ্রামে রাজাকারদের সহযােগিতায় পাকিসেনারা হায়েনার মতাে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গ্রামটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই গ্রাম থেকে স্কুলশিক্ষিকা হেলেনা ও তার দুই বছরের শিশুপুত্র দিলীরকে ধরে আনে রাজাকাররা। হেলেনাকে নিয়ে যায় পাকিদের। ঘাটি দত্ত বিল্ডিং-এ। হেলেনার শিশুপুত্রকে পাঠিয়ে দেয় হেলেনার পিতার বাড়ি। হেলেনাদের বাড়ি ছিল শহরের কলেজ পাড়ায় । পিতা মরহুম ফজলুল হক। এরপর দত্ত বিল্ডিংয়ে শুরু হয় হেলেনার ওপর নির্যাতন। পরদিন ৫ অক্টোবর হেলেনাকে আধমরা অবস্থায় চলন্ত জীপের পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রকাশ্যে সারা শহর টেনে নিয়ে বেড়ানাে হয়। রাস্তার ইট, পাথরের আঘাতে আঘাতে হেলেনার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এক সময় হেলেনার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে রাজাকাররা তার মৃতদেহ টানতে টানতে নিয়ে যায় মাগুরা শহরের অদূরে নবগঙ্গা নদীর ডাইভারশন ক্যানেলে। ওই ক্যানেলের পানিতে ফেলে দেয়া হয় হেলেনার মৃতদেহ। হেলেনা তার মুক্তিযােদ্ধা স্বামী এ্যাডভােকেট আলী কদরকে বিভিন্ন খবর পৌছে দিয়ে। সহযােগিতা করতেন। এটাই ছিল ঘাতকদের কাছে হেলেনার অপরাধ। হেলেনা কলেজ জীবনে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি মাগুরা কলেজের ছাত্রসংসদের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের মাগুরা মহকুমা শাখার সহসভানেত্রীর ভূমিকায় থেকে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মাগুরা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।

এছাড়াও সেই সময় রাজাকার রেজাউল করিম রিজুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন শহরের মােল্লা পাড়ার ডাঃ লুৎফর রহমানের একমাত্র ছেলে গােলাম কবির, পারনান্দুয়ালী গ্রামের তৎকালীন মাগুরার বিশিষ্ট ফুটবলার লুৎফর রহমান লুতু, আলুকদিয়া গ্রামের বাকু, হাজীপুর গ্রামের মুজিবর মুন্সী, শহরের খাঁ পাড়ার কাদের খা ও মীর পাড়ার হামেদ মীর। কুখ্যাত এই রাজাকার রেজাউল করিম রিজুর বাড়ি মাগুরা শহরের কাউন্সিল পাড়ায় । ‘৭১ সালে সে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘের মাগুরার সাধারণ সম্পাদক ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে সে মাগুরা জেলার রাজাকার কমান্ডার হয়। এই রাজাকার রেজাউল করিম রিজু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যায়। চট্টগ্রামে এসে নাম ধারণ করে রেজাউল করিম মামুন। এ সময় জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের লােকেরা তাকে নগরীর মুরাদপুর ও পাঁচলাইশের বিভিন্ন বাসায়, মসজিদে লুকিয়ে রাখে। তখন তার নাম হয় কালা মামুন। ১৯৭৫ সালে কালা মামুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়। নিজেকে একজন মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছাত্র হিসাবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা চালায়। ছাত্র শিবিরের গােপন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কাজ শুরু করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাবিরােধী শিক্ষকরা তাকে সার্বিকভাবে। সহযােগিতা করে। অত্যন্ত চতুর কালা মামুন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলকে সংগঠিত করার কাজে লিপ্ত হয়। ছাত্র শিবিরের কিছু নেতা, কর্মী, সমর্থককে সুকৌশলে ছাত্রদলে নিয়ে যেতে সক্ষম হলে সংগঠনের নেতারা তাকে জাতীয়তাবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে মান্য করতে থাকে। কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর কালা মামুন এরশাদের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

এ ক্ষেত্রে সে তৎকালীন চট্টগ্রামস্থ ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা কর্নেল লস্করের সঙ্গে বরাবর যােগাযােগ রক্ষা করত বলে জনশ্রুতি আছে। বর্ণচোরা কালা মামুনের সঙ্গে শিবির ও ছাত্রদলের দ্বন্দ্ব হলে এক পর্যায়ে সে সুন্নী ছাত্রসংগঠনের তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে কাজকর্ম শুরু করে। জামায়াত শিবির তাকে মােনাফেক আখ্যায়িত করে তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। কালা মামুন অত্যন্ত সুকৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যােগদান করতে সক্ষম হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যােগদানের সুযােগ পাওয়ার জন্য সে এমএ ক্লাসে থিসিস গ্রুপ নেয়। তার থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি নেতা অধ্যাপক এনামুল হক। অভিযােগ রয়েছে, তিনি তাকে সর্বোচ্চ ৭৮ ভাগ নম্বর দিয়ে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দেন। মাগুরার মানুষ এখনও রিজু-কবিরের নৃশংসতার কথা ভােলেনি। রাজাকার হাসান কবির। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাগুরা থেকে পালিয়ে যায়। এরপর তাকে আর কখনও মাগুরায় দেখা যায়নি। সবার ধারণা, অন্য কোন জেলায় সে ছদ্ম নাম দিয়ে আত্মগােপন করে। ঘাপটি মেরে আছে। ‘৮০ সালের দিকে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার রেজাউল করিম রিজু মাগুরায় এসেছিল। তার আসার খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে মাগুরাবাসী দা, বঁটি, লাঠি নিয়ে ধাওয়া করে তাকে ধরার জন্য। সে দফায় সে কোন রকম প্রাণ বাঁচিয়ে মাগুরা। ত্যাগ করে। হেলেনার বৃদ্ধ মা মােছাম্মত ছফুরা খাতুন আজও বেঁচে আছেন মেয়ের খুনীদের বিচারের। অপেক্ষায়। হেলেনার স্বামী মাগুরার বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা এ্যাডভােকেট আলী কদর তার স্ত্রী হত্যাকারী রাজাকার কমান্ডার রেজাউল করিম রিজুর দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি করেছেন। রেজাউল করিমের বক্তব্য

“একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এসএসসি সাটিফিকেট অনুযায়ী আমার বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। আমার এক ভগ্নিপতি তখন একটি ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত খুলনার একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি তখন ঐ সংগঠনের একজন বুদ্ধিজীবী নেতা ছিলেন। তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রায়ই আমার অনেক তর্ক-বিতর্ক হতাে। এক পর্যায়ে। আমি আমার অপ্রাপ্ত বয়স্কতার কারণে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মৌলবাদী একটি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। উক্ত মৌলবাদী সংগঠনটিই আমাকে রাজাকার বানায়। কিন্তু মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই রাজাকারদের হাতে আমার ঘনিষ্ঠতম দু’জন আত্মীয়ের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড অচিরেই আমার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। আমার ছােটমামা রুস্তম আলী- যার কোলেপিঠে আমি মানুষ হয়েছি-মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় একদল রাজাকার তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমার মেজো মামা যশাের ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম হাইস্কুলের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের বড় ছেলে আকতার-বয়সের একই জুড়ি হিসাবে যার সঙ্গে আমি বাল্যকাল, শৈশব ও কৈশরে একত্রে খেলা। করেছি-তাকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। আমার বড় বােনের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী, মাগুরা নতুন বাজারে বসবাসকারী অমূল্য ডাক্তারের স্ত্রী লক্ষ্মীর বাড়িতে রাজাকাররা ডাকাতি করে ও তার ওপর নির্যাতন চালায়।

বিবেকের দংশনে আমি রাজাকার বাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দেড় মাস আগে ফরিদপুরের বােয়ালমারী উপজেলা গেরিলা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার (দেরাদুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) জাহাঙ্গীর হােসেনের সহযােগিতায় সীমান্তের ওপারে ২৪ পরগনায় গিয়ে আশ্রয় নেই।” একাত্তরের ভূমিকায় অনুশােচনায় দগ্ধ রেজাউল করিম রিজু ওরফে মামুনকে মাগুরার বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কোন স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি নেত্রী হেলেনাকে কেন নির্মমভাবে হত্যা করা হলাে-এ প্রশ্নে রিজু বলল, হেলেনা নকশালপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। সম্পর্কে আমার আত্মীয়া, তাকে মিলিটারিরা মেরেছে, আমি মারলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হতাে। পঁচিশ বছর ধরে মাগুরায় যাওয়া তার জন্য কেন নিষিদ্ধ, এ প্রশ্নে রিজু বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, কেন, গত মাসেও তাে মাগুরায় গিয়েছি। ওখানকার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল।

জনকণ্ঠ ॥ ১১-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন