You dont have javascript enabled! Please enable it! মনছুরের হুমকি-একাত্তরে আমার গুলি থেকে বেঁচে গেছ, এবার বাঁচাবে কে - সংগ্রামের নোটবুক

রাজাকার মনছুরের হুমকি-“একাত্তরে আমার গুলি থেকে বেঁচে গেছ, এবার বাঁচাবে কে?”

জনকণ্ঠ রিপাের্ট, ২০০০ সাল॥ প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের ৯ জানুয়ারি। এই প্রতিবেদনটি ছিল নােয়াখালীর খুন, ধর্ষণের নায়ক কমান্ডার কালাম এখন সাভারের কোটিপতি “মনছুর সাহেব”। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নােয়াখালী এবং সাভারে ঘটে যায় তুলকালাম কাণ্ড। ৯ তারিখের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বর্ণচোরা সেই মনছুরের সাভারের বিশাল সাম্রাজ্যে প্রচণ্ড আঘাত হানে সাভারের শত সহস্র বীর মুক্তিযােদ্ধা। এমনকি সাভারের গৃহবধূরাও বসে থাকেনি। তারা এই রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে ঝাড় হাতে। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে রাজাকার কমান্ডার মনছুর আত্মগােপন করে। সে চলে আসে নােয়াখালার এওজবালিয়া নিজের বাড়িতে। দেয়ালঘেরা পাকা বাড়িতে ডজনখানেক সন্ত্রাসীকে জায়গা দেয়া হয়েছে। এদের হাতে রয়েছে বােমার বড় স্টক আর আগ্নেয়াস্ত্র। সারা এলাকাকে আতঙ্কিত করেছে বােমা ফাটিয়ে। এর পর নেমেছে একাত্তরের সহরাজাকারদের সন্ধানে। মালদার মনছুর দুই হাতে মাল খরচ করে একাত্তরের দোস্তদের স্থান দিয়েছে নিজ বাড়িতে। এখানেই শেষ নয়। এরপর খুঁজতে বেরিয়েছে কে এই সাংবাদিক যে মনছুর সম্পর্কে কলম ধরে তার সাভারের আলিশান দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদে হামলা চালাতে সাহায্য করল? এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করতে হবে। টাকার জোরে বাংলাদেশে অনেক কিছুই সম্ভব। এই প্রতিবেদককেও কেনা এমন অসাধ্য কি? আর জনকণ্ঠে এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ ছাপানাে নিশ্চয়ই সহজসাধ্য, প্রয়ােজনে জনকণ্ঠ অফিস কিনে ফেলা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এর কোনটাই সম্ভব নয়। অবশেষে “মনছুর সাহেব” কোমর বেঁধে নামল ১০/২০ লাখ টাকা যা-ই যাক যাবে একখানা মুক্তিযােদ্ধার সার্টিফিকেট কিনতে হবে। যে কথা সেই কাজ।

নামল মুক্তিযােদ্ধার সার্টিফিকেট কেনার চেষ্টায় । বিত্তবান ঘাতক। দালালের দোস্তর অভাব হয়নি। এবার তারা এসে হাজির হলাে নােয়াখালীর মুক্তিযােদ্ধা অফিসে। এখানে পেল থানা কমান্ডার কামাল উদ্দিনকে। এই কমান্ডারকে কেনার জন্য মােটা অঙ্কের অফার দেয়া হলাে। ব্রিফকেস ভর্তি ৫শ’ টাকার বান্ডিল নিয়ে এসে সদর থানা কমান্ডার কামাল সাহেবকে তাে কেনা যায়ইনি, তদুপরি দালাল প্রস্তাবকদের পুলিশে দেয়ার হুমকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক দালালরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় । এদিকে ৯ জানুয়ারি “নােয়াখালীর খুন, ধর্ষণের নায়ক কমান্ডার কালাম এখন সাভারের কোটিপতি মনছুর সাহেব” প্রকাশিত হওয়ার পর ১৫ জানুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত আইজি, গােপন শাখা থেকে নােয়াখালী পুলিশ সুপারকে লিখিত নির্দেশ দেয়া হয় “মনছুর সাহেব” সংক্রান্ত জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলােকে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপাের্ট ঢাকায় পাঠানাের জন্য। এই নির্দেশ ২৫ জানুয়ারি নােয়াখালীর এসপি সুধারাম থানায় তদন্তের জন্য পাঠান। যথারীতি এই নির্দেশনামায় সুধারাম থানার এসআই নাজমুল আলম চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই ঘটনা ২৫ জানুয়ারির। ইতােমধ্যে তিন মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে। দারােগা নাজমুল আলম চৌধুরী এই গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে যােগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একাধিকবার ঘটনাস্থল রামহরি তালুক স্কুল প্রাঙ্গণে সরেজমিনে তদন্ত করার দিন তারিখ দিয়েছেন। কিন্তু পাকা সড়কে ১৫ কি.মি, দূরত্ব অতিক্রম করে দারােগা চৌধুরী ঘটনাস্থলে যাননি। তিনি সময় করতে পারেননি। তবে আবুল কালাম মনছুর সাহেবের লােকজন যথাসময়ে উপযুক্ত সম্মানীসহ জেলার পুলিশপ্রধান ও দারােগা নাজমুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করেছে। এ ব্যাপারে প্রতিবেদকের হাতে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।

তবে এর ভিতরে একটি ঘটনা ঘটেছে। ৭ নং এওজবালিয়া ইউনিয়নের নয়নপুর গ্রামে মৃত ছায়দুল হকের পুত্র মােঃ নুরনবী, যিনি একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর সােমবার রামহরি তালুকে মুক্তিযােদ্ধা আলি আহম্মদ, মুক্তিযােদ্ধা আবুল কালামসহ বহু লােককে হত্যা করার প্রত্যক্ষদর্শী এবং এই মােঃ নুরনবীকেও আবুল কালাম কমান্ডার গুলি করেছিল অলৌকিকভাবে ১৩ সেপ্টেম্বর রামহরি তালুকে অপর ৯ জন শহীদ হলেও মােঃ নুরনবী প্রাণে বেঁচে যায়। তিনি জনকণ্ঠকে আবুল কালাম মনছুরের খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগের মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন, যা জনকণ্ঠে ৯ জানুয়ারি ছাপা হয়। কেন মােঃ নুরনবী জনকণ্ঠকে তথ্য দিয়ে একাত্তরের রাজাকারকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, এই অপরাধে নুরনবীকে হত্যা করার হুমকি দেয় আবুল কালাম মনছুর। মােঃ নুরনবী ২৫ জানুয়ারি সুধারাম থানার ওসি বরাবর ১০৪৫ নং জিডিতে উল্লেখ করেন- আবুল কালাম মনছুর, এরশাদ সিকদার ষড়যন্ত্রকারী ও খুনী । মােঃ নুরনবী এই জিডি, রেকর্ড করে নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন। ২৫ জানুয়ারি থেকে এই প্রতিবেদন পাঠানাের তারিখ ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের অধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সুধারাম থানার কোন দারােগা এই ঘটনার। তদন্তে যায়নি। তবে সুধারাম থানার এক দারােগা নয়নপুরে গিয়ে মােঃ নুরনবীর বাড়িতে হুমকি দিয়ে এসেছে- মােঃ নুরনবীর বিরুদ্ধে সমাজবিরােধী বহু অভিযােগ রয়েছে। অবিলম্বে তাকে থানায় হাজিরা দিতে হবে। এখন নােয়াখালীর এসপি আনােয়ার হােসেন নােয়াখালী থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। দারােগা নাজমুল আলম চৌধুরীও প্রশিক্ষণের জন্য রাজশাহী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে চলে গেছেন। বর্তমানে আবুল কালাম মনছুর অন্যদের সঙ্গে মােঃ নুরনবীকে হুমকি দিচ্ছে একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর আমার গুলি থেকে বেচে গেছ, কিন্তু এবার তােমাকে আমার হাত থেকে কে বাচাবে?

জনকণ্ঠ। ৩০-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন