You dont have javascript enabled! Please enable it!

নোয়াখালীর খুন ধর্ষণ লুট অগ্নিসংযােগের আর এক নায়ক এ কে আজাদ

কামালউদদীন আহমদ, নােয়াখালী থেকে ॥ একাত্তরে নােয়াখালীর খুন, ধর্ষণ, লুট ও বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার অন্যতম হােতা রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ এখন ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার বিত্তবান আদম ব্যবসায়ী। সে সময়ের কুখ্যাত। রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ নাম আড়াল করার জন্য কৌশলে “এ কে আজাদ” ছদ্মনাম ব্যবহার করে। তার আজকের দামী পােশাক খুললে পাওয়া যাবে মুক্তিযােদ্ধাদের বেত্রাঘাতের অসংখ্য দাগ। তাকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেদিনের এফএফ কমান্ডার শফি । কিন্তু একই এলাকা নােয়ান্নয়ী ইউনিয়ন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার হাকিম আবদুল বারী বহু জঘন্য অপরাধের হােতা সেই রাজাকার কমান্ডারের জীবন এক গুলিতে শেষ করতে রাজি হননি। একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর নােয়াখালী মুক্ত হওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর আজাদকে তার মামার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের দিতপুর থেকে দাদপুরের মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেফতার করে নােয়াখালী জেলা স্কুল। মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে এনে বন্দী করে রাখে। হাজার হাজার লােক প্রথমে তাকে থু থু দেয় এবং পরে ঘৃণার প্রকাশ ঘটাতে জুতাপেটা করে। এক পর্যায়ে এই রাজাকার কমান্ডারের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লে অন্যান্যের সঙ্গে তাকেও নােয়াখালী কারাগারে আটক করা হয়। রাজাকার আজাদকে এরপর প্রতিদিন কারাগার থেকে বের করে এনে মুক্তিযােদ্ধারা রাস্তাঘাট পরিষ্কার করিয়েছে। এমনকি তাকে ঝাড় হাতে কোমরে রশি বাঁধা অবস্থায় সুইপারের কাজ করতে হয়েছে। আর রাস্তা ও খালের মাটি কাটানাে হয় অন্যান্য রাজাকারের সঙ্গে একই মােটা দড়িতে বাঁধা অবস্থায়।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিতে হয়েছে সেদিনের রাজাকার কমান্ডার পাকি সেনাদের প্রিয়জন আবুল কালাম আজাদ আর আজকের বনানীর কোটি টাকার মালিক এ কে আজাদ’কে। নােয়াখালী সদরের দাদপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের এবং দাদপুর বাজারের পাশে পাকি গােলাম, শান্তি কমিটির সদস্য আরক আলী মুন্সীর তিন কু-পুত্র আবুল কালাম আজাদ, রফিকউল্লাহ ও আতিকউল্লাহ। এরা সবাই ছিল ঘৃণ্য রাজাকার। আজাদ সবসময় থাকত পাকি সেনাদের সঙ্গে। কামুক পাকি দোসরদের সব ধরনের চাহিদা পূরণ করে ধূর্ত আজাদ। সাধারণ রাজাকার থেকে কমান্ডারে উন্নীত হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাই রফিকউল্লাহ রাজাকার কিছুদিন ইমামতি করেছে চট্টগ্রামের একটি মসজিদে। সেখানে সে কাপড়ের ব্যবসা করছে। তৃতীয় রাজাকার ভাই প্রাণ বাঁচানাের জন্য চলে গেছে রংপুরে। দীর্ঘদিন ধরে আজাদের তিন সহােদর তিন শহরে ব্যবসা করছে। পুঁজি সংগ্রহ করেছে একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনে মুক্তিযােদ্ধা ও নৌকায় ভােট দেয়া শত শত লােকজনের বাড়ির সােনাদানা টপাট আর নগদ টাকা হাতিয়ে নিয়ে । নােয়াখালী শহর থেকে ১২ কিঃ মিঃ পশ্চিমে লা বাজার দাদপুরের সংলগ্ন এ রাজাকারদের বাড়ি। এই বাড়িতে এখন পাঁচিল উঠেছে, তৈরি হয়েছে পাকা ভবন। নােয়াখালী সদরের কালাদোরােপ, এয়াজবালিয়া, দাদপুর ও নোয়ান্নয়ী ইউনিয়নের এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার যেখানে রাজাকারদের ঘৃণ্য হামলা হয়নি। তবে এই এলাকায় সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিল এয়াজবালিয়া ইউনিয়নের জাকার কমান্ডার আবুল কালাম । আজকের সাভারের কোটিপতি ‘মনছুর’ এবং দাদপুর ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ আজকের বনানীর অপর কোটিপতি ব্যবসায়ী এ কে আজাদ। “সেই রাজাকার নােয়াখালীতে খুন, ধর্ষণের নায়ক কমান্ডার *লাম এখন সাভারের কোটিপতি মনছুর সাহেব শীর্ষক খবরটি ৯ জানুয়ারি প্রকাশের পর দাদপুর ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম আজাদের নৃশংসতার ঘটনা ওনানাের জন্য শুধু পুরুষ নয়, সেই এলাকার স্বামীহারা, সন্তানহারা এবং নির্যাতিত অনেকে নােয়াখালী মুক্তিযােদ্ধা জেলা ইউনিট কমান্ডারের কাছে এসে ধরনা দিচ্ছে। জানা গেছে, সে সময় এরা কৃষকদের ৩৬টি তাজা গরু জবাই করে খেয়েছে।

২২ আগস্ট রবিবার আজাদ রাজাকারের নেতৃত্বে গােপনে একদল রাজাকার রাতের আঁধারে আত্মগােপন করে দাদপুর এলাকার রামভল্লবপুর হাইস্কুলে। স্লোগান দেয় “জয় বাংলা” বলে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রিয় রণহুঙ্কার জয় বাংলা শুনে কিছু লােক আবেগে আপ্লুত হয়ে স্কুল মাঠে এলে তারা তাদের আটক করে পাকিদের উপহার দেয়। হত্যার পর এদের অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। রাজাকার আর পাকি সেনারা সেদিন হত্যা করে দাদপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর গ্রামের জীবনকৃষ্ণ দেবনাথ, মদন মােহন গােস্বামী, ভক্ত কুমার কাহার, মহেন্দ্র পাল, রবিচন্দ্র পালসহ অপর ৫ জনকে। এরা বহু ঘরে আগুন দিয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধা মােহসীন ও ওসমান আলীর হালের বলদ জবাই করে মাংস নিয়ে গাওয়ার সময় সব বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। রাজাকার কমান্ডার কালাম বাহিনীর সঙ্গে শাজাকার কমান্ডার আজাদ বাহিনী যৌথভাবে অপারেশন চালিয়ে পাকিদের হাতে তুলে দিয়েছে মমিনউল্লা, নুরুদ্দীন, সাহাবুদ্দীন, শফিউল্লাহ, হেমিয়া, জহরুল হক, আনামিয়া, মজিবল হক, রমজান আলী, রুহুল আমিন (মুক্তিযােদ্ধা), আলী আহমদ (মুক্তিযােদ্ধা), মাওউল্লাহসহ অনেককে। পাকিরা একজন মুক্তিযােদ্ধা বা স্বাধীনতার পক্ষের লােকদের বাড়িঘর চিনত না। মানুষ চেনার প্রশ্নই ওঠে না। সারা দেশের অনান্য রাজাকার কমান্ডারের মত নােয়াখালীর পশ্চিমে ৬ ইউনিয়নের খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও লুটের •য়ক দুই রাজাকার কমান্ডার মনছুর আর এ কে আজাদ।

জনকণ্ঠ ॥ ২০-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!