You dont have javascript enabled! Please enable it!

কী ঘটেছিলো ৩ থেকে ৭ নভেম্বর?

নভেম্বর মাস চলছে, আর এই মাস এলে আমি বেশ দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ এর তিন মাস পূর্বে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের প্রত্যুষে; যখন কতিপয় মানুষ্যরূপী পশু ও নর ঘাতক স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে।……..এই ঘটনায় আমার দুঃখে ও মানসিক আচমকা আঘাতে স্তম্ভিত হয়ে বরফের ন্যায় জমে গিয়েছিলাম বিশেষ আমরা কয়েকজন মেজর ও ক্যাপ্টেন লেভেলের মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র অফিসার এই দুঃখজনক ঘটনা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই আমাদের সঙ্গে সে সময়ে ক্যাপ্টেন ইকবাল 1st E Bengal Regiment এবং আমারই 2nd E Bengal এর তখনকার সময়ে ক্যাপ্টেন জাহেদ ফারুক (বর্তমানে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী)।
“উল্লেখ্য সেই সময় অভাবনীয় ভাবে বেশকিছু অমুক্তিযোদ্ধা আফিসারেরাও সহযোগিতার হাত বাড়াতে কুন্ঠাবোধ করেননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় তাদের মাঝথেকে বেশকিছু অফিসার আমাদের সাথে সমভাবে ব্যথিত ছিলেন।”
বতিক্রম ছিল বেশকিছু অতি সিনিয়র এবং বেশ কিছু জুনিয়র অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার গন। তারা বাংলাদেশের সবকটি ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্যের ভুমিকা রাখেন‌।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে খুনি অফিসাররা খোলামেলা বাংলাদেশ বিরোধী এবং পাকিস্তানের প্রেতাত্মারাই উপস্থিতি দৃশ্যমান করে তুলছিল, তদুপরি ঘাতকদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিনাশী বিপরীতমুখী পদক্ষেপও আমাদের পছন্দ হয়নি। তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার উদ্যোগ গ্রহন করি এবং সুযোগ, সুবিধা আর নেতৃত্বের অপেক্ষা করতে থাকি। অতঃপর সি.জি.এস. ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভিযান শুরু হলে তাতে যোগদান করি।

এভাবেই একজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হিসাবে ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত বিয়োগান্তক ঘটনাব নিজেকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হই। বঙ্গভবনে ট্রুপস নিয়ে আমার সদর্প অবস্থান করার সুবাদে সেই সময়ের ক্রান্তিকালীন ঘটানাপ্রবাহ খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি তখন এটাও অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, তিন মাস আগে ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড জনিত এক ভয়ঙ্কর এবং হৃদয় বিদারক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩ নভেম্বরের ঘটনা অবশ্যাম্ভাবী ছিল।
বিশেষ করে সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের নায়কেরা বঙ্গভবনে বসে তাদের নাটের গুরু খন্দকার মোশতাকের সাথে শলা পরামর্শ করে যে ভাবে দেশে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটাতে মত্ত ছিলেন এবং দেশ, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছিলেন- তাতে এমন কিছু একটা যে ঘটবে তা আমরা আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং তার অব্যবহিত পরে ফারুক, রশীদ, ডালিম গং-এর একের পর এক ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডে সেনবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন; বিশেষ করে আমাদের ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল সহ আমরা সকলেই উদ্ভুত পরিস্থিতি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এই কারণে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমাণ্ড ফিরিয়ে আনতে আমরা নানামুখী তৎপরতা শুরু করি। এমত অবস্থায় ৩রা নভেম্বরে পর্যন্ত রাজনৈতিক কোন বিকল্প নেতা খুঁজে না পেয়ে অগত্যা সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের ব্রিগেড নিয়ে ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দিনের নির্দেশনায় খুনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সক্ষম হই। (আমাদের দুর্ভাগ্য যে বর্তমানে মেজর হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রম রাজনৈতিক ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন)
যেহেতু তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া ছিলেন অনেকটা নিস্পৃহ। চতুর ও বুদ্ধিমান এই সেনানায়ক দূরে দাঁড়িয়ে উদ্ভুত সকল বিষয় এবং চলমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাই পেশাগত দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার ঘোষণা করে খালেদ মোশাররফ ১৫ আগষ্টের কথিত “সূর্য সন্তান”দের উচ্ছেদ করতে এক ঐতিহাসিক অভিযানে এগিয়ে আসতে হয়।

আপতদৃষ্টিতে এটিকে একটা সাধরণ ব্যাপার বলে ভ্রম হলেও খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভিযানের পিছনে বিরাজ করছে এক সুগভীর তাৎপর্য এবং এটি এমন একটি ত্রিমুখী আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সব অর্জনকে ক্ষত বিক্ষত, কখনো সফল কখনো ব্যর্থ করে চলেছে। এই জনপদের মানুষের কথিত “বাঙালিত্ব” ও “মুসলমানিত্ব” পরিচয় এবং এই দু’য়ের বহু কেন্দ্রিক ভাবনা সমূহ সমন্বয় সাধন করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বার বারবার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এর দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাস। লড়াইয়ের এমন সমীকরণ আরো ‍ঘনীভূত হয়েছে মুলত বৃটিশের শাসনাধীন থাকার কারণে যখন আমরা যুগপৎ ইউরোপের উনিশ শতকের শতকের রেনেসাসঁ এর ছোঁয়া পেয়েছি, অন্যদিকে মুসলমান হিসাবে হাজী শরীয়তউল্লাহর ধর্মমত কেন্দ্রিক সংস্কার ও শুদ্ধাচারী আন্দোলনে সমানভাবে আলোড়িত হয়েছি।
যাইহোক, আমি এখানে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, জাসদ ও তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থান, জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে তাহেরের বাজিমাৎ করার কৌশলে জিয়ার ওভারট্রাম করে ক্ষমতাসীন হওয়ার কাহিনীর পক্ষে বিপক্ষের খুটিনাটি বিষয়ে যাব না। এগুলো বহুল চর্চিত বিষয় এবং তা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। এখানে যেমনটি আগে বলেছি আমি এর আদর্শগত দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
তবে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভুলুণ্ঠিত মর্যাদা সমুন্নত করে তুলে ধরার খালেদের প্রচেষ্টায় বিমানবাহিনীর যে কয়েকজন অকুতোভয় সাহসী পাইলট তাদের বিমান নিয়ে সামিল হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, বিশেষ করে আমার বন্ধু ও সুহৃদ ফ্লাঃ লেঃ ইকবাল রশীদের, ফ্লাঃ লেঃ জামাল, স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকত দের কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। অনেক লেখা রয়েছে নভেম্বরের ঘটনা নিয়ে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তাদের ইতিহাস অনুচ্চারিত রয়ে গেছে।
তাই আমি এ বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখার আশা রাখি।
( প্রথম পর্ব)
– Written by Dost Mohammad Sikder

কী ঘটেছিলো ৩ থেকে ৭ নভেম্বর? (২য় পর্ব)

আমার পূর্বের এই ঘটনার বিবরণে যা লিখেছি তারই ধারাবাহিক বর্ণনা। এই ঘটনা উপরে বহু লেখালেখি হয়েছে এবং যখনি প্রতিবছর নভেম্বর মাস আসে তখনই লক্ষ্যকরি বেশকিছু লোক টিভির পর্দায় দেখা যায়, যে তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

যেহেতু সেই সময় আমার ব্যক্তিগত অবস্থান ঢাকায় ছিল। তাই ঐ সকল আলোচকরা আমার দেখা ও জানা মতে ঢাকার বাইরে ছিলেন। খন্দকার মোশতাক ও তার খুনি গংদের বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঢাকাসহ সমগ্ৰ বাংলাদেশে তাদের নির্লজ্জ উপস্থিতি এবং আইনকে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে নৈরাজ্যের হোলি খেলায় মেতে থাকেন। ঐসময়ে জেনারেল জিয়া যদিও সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগ প্রাপ্ত, কিন্তু খুনিরা তাকে ডিঙ্গিয়ে সেনাবাহিনীর সকল (যতটুকু মনে পড়ে তিনি ২৮ সে আগষ্ট CAS নিয়োগ পান তাও খুনী ফারুক গংদের মাধ্যমে)
কর্মের কর্তিত্ব বঙ্গভবনে বসে বেআইনী ছড়ি ঘুরতে থাকেন। আর জেনারেল জিয়া কোন এক অদৃশ্য কারণে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ছিলেন। আমাদের পক্ষ্য থেকে জেনালের জিয়াকে শক্তহাতে তাদের আইনের আওতায় আনার এবং সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনতে বলাহয়। কারণ দেশ প্রায় আইন হীন মগের মুল্লুকে পরিনত হয়ে চলছিল।
আমাদের একমাত্র অবশীষ্ঠ আইনের নেতৃত্বে ছিল আমার ব্রিগেড কমান্ডার- তাই এমতবস্থায় সেনাবাহিনীর সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়েত জামিল আমাদের ন্যায় বেশকিছু অফিসারের সমর্থন ও সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিকে পুনঃউদ্ধারের চেষ্টায় খুনিদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন।

এই পাল্টা আঘাত করার পূর্ণ প্লানটির আমাদের নিকট মূল কার্যক্রমে পরিনত করতে আমাদের ন্যায় ফ্লিল্ড অফিসারদের নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের তখনকার ব্রিগেড মেজর মেজর হাফিজুদ্দীন BB (বর্তমানে BNP র শীর্ষ নেতা)

Brigadier খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফয়েত জামিল– তাদের অবস্থানের বিবরণ- বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে এই দুই ব্যক্তি বেশকিছু ভুল কর্মকাণ্ড করেন।

১. CGS – ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তিনি Tank এর গোলাবারুদ দিয়ে দেন – সেসময় এরিয়া Central Ammunition Depot ছিল আমাদের বেটালিয়নটির নিকটে- এবং তার তখনকার অবস্থান ছিল কুর্মিটোলা পুরানো রেলষ্টেশন এর নিকট (বর্তমানে যেটিকে জিয়া Gate বলা হয় তার পূর্ব দিকে) এতে আমাদের মনোবলের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ে।

২. কর্নেল শাফায়েত জামিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার পড়ে খুনিদের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার স্বক্রিয় ব্যবস্থা না নিয়ে জেনারেল জিয়ার বাসায় যান তার সঙ্গে পরামর্শ করতে। যখন তাকে পূর্বেই সেনাপ্রধান টেলিফোনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার ব্যপারে অবহিত করায় অর্থই তাকে এব্যাপারে কিছুএকটা করার নির্দেশ দেয়া। তা তিনি পালন করেননি।

তাদের উভয়ের টনক নড়ে যখন খুনিরা তাদের হুকুম না মেনে উল্টো হুকুদিতে থাকেন।

যাহোক এরপর খুনীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তাঁরা দুজনেই অগ্রনী ভুমিকায় অবতীর্ণ হন।

তাই ৩রা নভেম্বরের খুনিদের বিরুদ্ধে পাল্টা ঘটনার মূল নায়কের ভুমিকায় এই দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নেতৃত্বে দেন।

তাই পর্বর্তী ঘটনায় যারা ছিলেন তাদের মাঝথেকে ঐ সময়ে ৭ই নভেম্বরে তাহেরের হঠকারী ও তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের ফলে যাদের প্রাণনাশ হয় তারা পরপারে চলে গেছেন। তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

কিন্তু, যারা সেদিন ঠান্ডা মাথায় হত্যার ন্যায় জঘন্য অপরাধ করে। তারা আজো স্বদর্পে সমাজে জীবিত এবং কখনো কখনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়ে থাকেন। এতে আমরা অত্যন্ত অবাক হই, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং তাঁর দল যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।

১৯৭৫ সালে বিশ্বের কৌশল গত অবস্থান ছিল ভিন্নতর। সেই সময়ের আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীন কোন পরিস্থিতিই তার অনুকূলে ছিল না। তখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সূচিত ”কোল্ড ওয়ার ডকট্রিন” ফর্মূলার কৌশলী নীতি অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক বিশ্ব তাদের ’দোরখোলা’ মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান দুশমন ভারতের বিশ্বস্ত মিত্র সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং তার “ওয়ারশ্-প্যাক্ট” ভূক্ত তাবেদার পূর্ব ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট দেশগুলিকে পরাজিত করার প্রয়াসে এই অভূতপূর্ব ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা করে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে এবং সাম্যবাদী নীতিমালার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে মতানৈক্যের কারণে চিন রাশিয়াকে সংশোধনবাদী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দিয়ে, এক আদর্শিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আর তখন এই দ্বন্দ্বের ফায়দা তুলতে দারুন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আমেরিকা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দুই জায়ান্ট কম্যুনিস্ট শক্তির সম্পর্ক তখন শুধুমাত্র ভিয়েতকং গেরিলাদের সাহায্যে প্রেরিত রুশ অস্ত্র-সম্ভার চিনের ভূখণ্ড ব্যবহার করা মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

১৯৭১ সালে তার পরাজয়কে পাকিস্তান ইসলাম-এর পরাজয় হিসাবে মুসলিম বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। তাই দুই একটি দেশ ব্যতিরেকে স্বাধীনভাব ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়কে মেনে নিতে বাদবাকি মুসলিম বিশ্ব অস্বীকার করে। ১৯৭৩ সালের আরব- ইসরায়েলি যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি তেলের মূল্য তিনগুন বৃদ্ধি করার দরুন তখন তারা পেট্রোডলারে ভাসছে! ব্যাপক বিনিয়োগ জনিত কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আরব ভূমিতে আকর্ষণীয় চাকরি-বাকরি অবারিত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যবিত্ত সমাজ যারা ইতিহাস সৃষ্টি করে, তাদের কিন্তু আবার পছন্দ স্থিতিবস্থা আর নির্ভার জীবন-জীবিকা। তারা এই ইতিবাচক সম্ভাবনাকে স্বাগত জানায়।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেই সময় যৌক্তিক কারণে সংখ্যাধিক্য মুসলিম মানসে যুগপৎভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদার মানবিক, অসম্প্রদায়িক ও ইহজাতিক চিন্তা-চেতনার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চিরচরিত মুসলিম ভাবদর্শনের উন্মেষ ঘটে। এবং অনুকূল পরিবেশের বাতাবরণে, অপ্রতিহত এবং অনবরত প্রচার ও প্রসারে তা এক শক্তিমান পক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হয়।

এই সময় সর্বজনীন ‘বাঙালিত্ব’ ধারণাটি পিছনে চলে যায় এবং ‘মুসলমানিত্ব’ পরিচয়টি সামনে চলে আসে। বর্তমান সময়ে ‘বাঙালি বনাম ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদ’-এর গ্রহনযোগ্য নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, তার বিকাশের ধারায় এই দ্বন্দ্বটির জন্ম। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় দেশবাসীর মানসিক বুদ্ধিবৃত্তির এমন পরিবর্তন আপত দৃষ্টিতে বিষ্ময়কর মনে হলেও এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়।……….
……….

আমাদের এই অঞ্চলে পরস্পর বিরোধী এমন দুইটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার প্রথম বীজ রোপিত হয়েছিল :তুর্কি-আরব-পারসিক-মোগল-আফগান প্রমুখ মুসলিম শাসকদের পাঁচশত বছরের অধিককালের মুসলিম শাসনামল থেকে। এই সময়ে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আমাদের চিন্তার অনড়তা, পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কারের তেমন কোন হেরফের হয়নি। ……..

…আমরা যদি এই ধর্মাশ্রিত শাসনকালকে মধ্যযুগের এক হাজার বছর ব্যাপী অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের ধর্মযাজক ও খ্রিস্টীয় ধর্মসংঘ প্রভাবিত চরম রক্ষণশীল সামান্তবাদী শাসনের সাথে তূলনা করি, তবে এই দুটির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাব না। অতঃপর ভারতবর্ষে পরবর্তী দুইশত বছরের বৃটিশ শাসন তথা ইউরোপের রেনেসাঁস, রিফরেমশন এবং এনলাইটেনমেন্ট এর বৌদ্ধিক দর্শনে আলোকিত পাশ্চাত্যের বিশ্বজয় বা প্রাচ্যজয় এক নতুন যুগের সূচনা করে।

প্রথম শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, স্টীম ইঞ্জিন ও উন্নত ফায়ার পাওয়ারের আবিস্কার ছিল, এসব সর্বগ্রাসী কর্মকাণ্ডের সহায়ক শক্তি। পুরানো পৃথিবী বদলানো সম্পূর্ণ এক নতুন বিশ্ববীক্ষার অধিকারী এই ক্রমবর্ধমান সভ্যতার মূল সুর ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিবাদ, মানবতাবোধ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নারীমুক্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা। সর্বোপরি তা ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত করে সাম্প্রদায়িক ও ইহজাতিক ধারণাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করেছে। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছে পরস্পর বিরোধী মুসলিম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে চলেছে। মিলিট্যান্সির ব্যপকতার মধ্যে দেখা মেলে যার বহিঃপ্রকাশ।

সেই সাথে এগিয়ে চলে ইসলামের শুদ্ধচারী সংগ্রাম। বৃটিশ আমলে আঠারো উনিশ শতকে ওহাবী ও ফারায়েজী আন্দোলন, ক্যালকাটা মাদ্রাসা, নবাব আবদুল লতিফের মুসলিম লিটারারী সোসাইটি এবং পরবর্তীতে জামালউদ্দিন আফগানীর প্যান-ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে আমরা তা প্রত্যক্ষ্য করেছি । কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড যখন বাঙালী মুসলমানকে নিজ ভূমি থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্ট করে- তখন সেখানে এক বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়, মানুষের ভাবনা বদলে যায়। তবু অন্তহীন সংঘর্ষ চলতেই থাকে।

যাইহোক, এই পুঁথিগত বিশ্লেষণে আর দীর্ঘায়িত করব না। এবার মূল বিষয়ে ফিরে আসব আগামী পর্বে।

(খালেদ মোশাররফের “সামরিক ক্যূ” সফল হওয়ার চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণ ছিল, অনেক বেশী। এই প্রসংগে আমার ব্যক্তিগত মতামত পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং বিশদভাবে আমার শেষ পর্বে লেখার আশা রাখছি)

3rd November ৩য় পর্বঃ পূর্ব পোষ্টের চলমান/

I am in the quest of truth revealing. I have noticed with great apathy that most of my Erudite and Sage friends are not participating in enriching the Post’s through their valuable comments. I therefore appeal to the Conscious of My valued friends to please do substantiate with your valuable comments so the mistakes of our yester year’s could be taken as lessons and warning to the present and future generations. Thus make visible to us and yourselves notable truth revealing people. History will indeed Record All of You and Your Depositions in true GOLDEN WORD’S. Thanking you All.

কবি গুরু বহুকাল পূর্বেই আমাদের Narcissist চরিত্রের যথার্থ চিত্র সুন্দর করে এঁকে গেছেন।

“রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুম ধাম
ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী ।”

এই যে আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশ।
এর স্থপতি কে?
তা নিয়ে প্রতিনিয়ত বিতর্ক চলছে।

কে, কখন থেকে এ দেশটা লুন্ঠন করেছে?
তা নিয়েও প্রচুর নুতন নুতন তথ্য উত্থাপিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ও বঙ্গবন্ধু কত অযুত ভূল করেছেন, তা নিয়েও অনেক থিসিস ও সমীক্ষার অন্ত নাই। অনেকের বাসায় আজো জিন্নার ফটো ঝুলছে। কারণ, তাঁরা আজো জিন্নাকেই কায়েদ বা বাংলাদেশের মূল আর্কিটেক্ট মনে করেন।

আর কিছু লোক মনে করেন শ্রদ্ধেয় মাওলানা ভাসানীই এদেশের প্রকৃত স্থপতি।
(যদিও এই প্রবীণ, প্রায়ত নেতা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন, বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের কষ্টের কথাগুলো গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছে দেবার এক বিশাল মাপের জনদরদী এবং তাদের মুক্তির এক মজলুম নেতা ছিলেন অবশ্যই।) কিন্তু বহুবাম রাজনীতিবিদরা তাকে সময় সময় পন্যের ন্যায় ব্যবহার করেছেন। এমনকি সামরিক জান্তারাও।

কিন্তু যখন এক শ্রেণীর লোক এরপর ভাষা সৈনিক গোলাম আযমের অবদান কম কিসে? এটা নিয়ে আবার মাঠে নামে, তখন আমাদের বেদনার অত্যন্ত তীব্রতর হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আর জে. জিয়া ঘোষণা না দিলে সকল বাংলাদেশীদের ঘরে বসে থাকত এরকমই একশ্রেণীর লোকজনের প্রচার।
এইদেশ থিসিস আর ডক্ট্রিনের জগৎ বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ।

হায়রে আমার ধর্ষিতা বাংলা মা।
তোমাকে এত এত নেতারা মুক্ত করলো।
তুমি এত ঋণ কি করে শোধ করবে?

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। অনেক অনেক স্মৃতি, আমার ন্যায় ক্ষুদ্র মানুষের মনে বাসা বেঁধে বোঝা হয়ে আছে। এবোঝা অত্যন্ত ভারী, একে বয়ে বেড়ানো খুবই কষ্টকর।

আজ তাই এই ক্ষণে কিছু বোঝা ছেড়ে দেই তাতে হয়ত কিছুটা হাল্কা হতে পারব। আর ইতিহাসের স্বার্থে হয়ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কিছুটা উপকার হবে।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রচারের মাধ্যমে প্রায় দুই যুগের অধিক সময়ে সামরিক সৈরাচার ও স্বাধীনতার বিরোধীদের বহুকষ্টে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরাজিত করে ১৯৯৬ উত্তর বাংলাদেশ। সবে অনেক সংগ্রামের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো। তাও অত্যন্ত নড়বড়ে অবস্থা, কারণ আর্মি ও সিভিল প্রশাসন পূর্বের সরকারের ঢেলে সাজানো। আমার সমর সঙ্গী এবং যুদ্ধের দীক্ষা গুরু জে: নাসিম তখন অন্তরীণ ও বিপদে। তাঁর কোন ক্ষতি না হয় সে কারণে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তৎকালীন সংসদের উপনেত্রীর রাজা বাজারের বাসায় যাই, তাঁর থেকে সাহায্য চাইতে। উনি সব শুনে আমায় অন্য প্রসঙ্গে কথা বললেন।
আমার স্ত্রীর দিক থেকে আমি উনাকে মামী সম্বোধন করি।
উনি আমায় সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলেন, “১৯৭৫’এ যখন তোমরা খুনী ঘাতক মোস্তাককে বঙ্গভবনে অন্তরীণ করলা, ঐ পাপীটাকে বাঁচায়ে রাখলা কেন? ওকে খুন করে ফেলতে পারতা। তা করনি কেন?”
উত্তরে আমি বললাম, “মামী যতটুকু করেছি তা কি কম কিছু বা কম সাহসিকতার কাজ করেছি? মোস্তাককে খুন করলে আপনারা আমাদের কি বাঁচাতে পারতেন?”

বহুদিন থেকে বহু কথা, বহু প্রশ্ন মনের ভিতর কবর দিয়ে রেখেছি। আজ তার থেকে কিছু ভেন্টিলেট করব। মনটা হাল্কা করব।
কারণ, আজো অনেকেই মুখোশ পরে আছে। সত্যের মুখোমুখি কেউ হতে চায় না। উল্টো স্রোতে কেউ যেতে চায় না। তাতে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যে ভাটা পড়তে পারে! ৩’রা নভেম্বর, ৭৫’এর আগে ও ৩’থেকে ৬/৭ নভেম্বর, ৭৫’এ বহু ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা আমি সম্ভব হলে পরে দেব। তবে সময় এসেগেছে অল্পকিছু মনোব্যথা এই টাইমলাইনের মাধ্যমে জানাতে।

****তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল একটা পাল্টা অভুত্থানে যখন পা-ই বাড়িয়েছিলা তখন তো আমরা জীবনবাজি রাখা কাজে পা দিয়েছি। এবং তা ছিল অসাংবিধানিক ভাবে খুনিরা মোস্তাক আহমেদ কে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এবং বঙ্গবন্ধুকে তাঁকে সহ সকলকে হত্যা করেছে, তাই আমাদের পাল্টা ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ ছিল সম্পূর্ণ সশস্ত্র ব্যবস্থা নেয়া বা ততোধিক ক্ষিপ্র ও গোলাগুলির মাধ্যমে যেখানে আমাদের সহযোগী ছিল প্রস্তুত বি.এ.এফ. এর বিমান ও হেলিকপ্টার। এবং টেংক ও কমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যবস্থা ও মারাত্মক এবং অব্যর্থ অস্ত্র। এইটা ছিল আমাদের ঐদিনের সফলতার প্রথম ও পূর্ব শর্ত। যা আমরা করতে পারিনি, আমাদের নেতৃত্বের অজানা ব্যর্থতার জন্য।

অত্যন্ত তিক্ত হলেও সত্য আমাদের আর্মি অফিসারেরা যে কত হীন-মনের, আর ব্যাক্তি স্বার্থের জন্য তাঁরা কি না করতে পারে।

আমি হালকা আবছা ভাবে অল্প কিছু বলছি। ১৯৭২ সালে আমাদের ঢাকার প্রথম ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার লে: ক: জিয়াউদ্দিন, দেশরক্ষার সবচেয়ে ভাইটাল পোস্টে থেকে অতি উচ্চাভিলাষী হয়ে হলিডে পত্রিকায় তিনি দেশবিরোধী আর্টিক্যাল লিখলেন। তাতে তার অনেক কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সদয় হয়ে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তাকে অবসরে পাঠালেন।
এই সকল অফিসারেরা আমাদের চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেবার কথা, ডিসিপ্লিন শিখানোর কথা।

কিন্তু, এই কি চরিত্র ও ডিসিপ্লিনের অধিকারী তারা?
হায়, আমার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও তাদের চরিত্র!
তাদের ডিসিপ্লিন!?

এরপরের ঘটনা আরোও বেদনাদায়ক; আরো ঘেন্নায় ভরা। বঙ্গবন্ধু হত্যা হওয়ার আগে ডি.এম.আই. লে: ক: সালাউদ্দিন, তার সাধ্যমত আর্মি চীফ মে: জে: সফিউল্লাহর তৎকালীন সেনাপ্রধানের বাসভবনে শেষ রাতের অন্ধকারে দেয়াল টপকিয়ে তাঁকে টেংক মুভমেন্টের কথা বলতে যান।

তাতে জে: সফিউল্লা তার ব্রিগেড কমান্ডার ক: সাফায়েত জামিলকে আশু ব্যাবস্থা নিতে অর্ডার করলো; কিন্তু তাঁরা অনড়।

কিসের যেন অপেক্ষায় কালক্ষেপণ। তিনি গেলেন জে: জিয়ার বাসায় পরামর্শ করতে। তাঁদের টনক ঠিকই নড়লো তাদের নিজেদের আঁতে যখন ঘা পড়ল। যখন খুনী ডালীম- ফারুক- রশিদ গং আর্মির বা ব্রিগেড কমান্ডের ডিসিপ্লিনে আসতে অস্বীকৃতি জানালো। এ অবস্থার টানাপোড়েন গিয়ে গড়ালো ব্যক্তিগত শত্রুতায় এরই ফলে ০৩ নভেম্বর, ৭৫’এর পালটা “ক্যু” এবং বঙ্গভবন থেকে খুনীদের উৎক্ষাত করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরায়ে আনার জন্য পাল্টা অভুথ্যান। কিন্তু বস্তুত কি হলো?

আমি এই অপারেশনের খুবই ভাইটাল রোলে ছিলাম। আমরা জীবনের বাজী রেখে বঙ্গভবনে পৌঁছে খন্দকার মোস্তাককে অন্তরীণ করি। নভেম্বর মাসের ৩ থেকে ৬/৭ নভেম্বর কোন কংক্রিট কিছু হলনা। অস্বস্থিকর সিদ্ধান্তহীনতার lul period চলছিল। আমি অত্যন্ত তরুণ ও জুনিয়র অফিসার ছিলাম। তিন দিন কাটালো নুতন প্রেসিডেন্ট কাকে বানাবে তা নিয়ে। অন্যদিকে খুনিরা ২’তারিখ শেষ রাতে আমাদের জাতীয় চার নেতাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে হত্যা করে এবং খুনিদের সকলকে ঐ দিন দেশ ছেড়ে যেতে দেয়া হলো। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পাড়ছিলামনা যেখানে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে ঐ নরপিশাচগন নির্বিচারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। তাদের সঙ্গে আবার কিসের আপোষ? আমরাতো সর্বোতভাবে প্রস্তুত ছিলাম আকাশে যুদ্ধবিমান নিচে আমরা চারটি ইনফন্ট্রি বেট্যালিয়ন। আমাদের তখন হুকুম নয় শুধু অনুমতি দিলে আধঘণ্টার মধ্যে সবগুলো ট্যাংক এবং আর্মড ও আর্টিলারি রেজিমেন্ট কোনপ্রকার বাধা দিতে চেষ্টা করলে মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারতাম। আমাদের চারটি ইনফেন্ট্রি বেট্যালিয়নই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে গঠিত।

বঙ্গভবনের নাটক ছিল আরও হাস্যকর। কেনইবা আমরা খন্দকার মোশতাক সহ সকলকে হত্যা করতে পারবো না উপরন্তু তাদের তোষামোদ করতে হবে সাচ্ছন্দে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে?

পরে জাস্টিজ আবু সায়েমকে শপথের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বানানো হ’লো। আর ৬ই নভেম্বর খালেদ মোশাররফ জেনারেল হ’ল, আর আর্মি চীফ হ’লো। আমি অল্প বয়সী জুনিয়র কমান্ড অফিসার হিসেবে বস্তুত কোন পরিবর্তন দেখলাম না।
মনে হ’ল জি.এইচ.কিউ. রাওয়াল পিন্ডিতে আছি। আর্মি থেকে আর্মির হাতেই ক্ষমতার হাত বদল হলো। ফলে, ৭ই নভেম্বরে পাল্টা অভ্যুত্থান বা সিপাহী-জনতার বিশৃঙ্খল মিউটিনী। তাতে দেশের ও সাধারন মানুষের অপরিসীম ক্ষতি হলো।

যে কাজগুলো করলে দেশও বাঁচত, পাল্টা সিপাহী বিদ্রোহও হতোনা বলে, আমি মনে করি:-

সবচেয়ে বড় ভুল তাঁরা অভুত্থানের প্রথম দিনেই করে তা হচ্ছে যখন আমাদের বি এ এফ এর বন্ধুরা পাকিস্তানের ISI এর এবং CIA এর স্বীকৃত এ ভি এম তোয়াবকে বন্দী করে ৪র্থ ইষ্ট ব্যঙ্গলে উপস্থিত করেন। কারণ বন্দী রাখার একাজটি একান্তই সেনাবাহিনীর আমাদের নেতৃত্ব সেদিন অবস্থার পূর্ণ মেরিট না বুঝেই উঠে দাঁড়িয়ে সেলুট করে তাদের সঙ্গে একীভূত করেন এবং এখানেই শেষ নয়। তাদেরকে নিজেদের গাড়ি করে বঙ্গভবনে নিয়ে যান তাতে তাঁদের ঐসময়ের প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী ও কূটবুদ্ধি দেয়ার বিরাট যোগান দিন। ফলে জেনারেল ওসমানী + জেনারেল খলিল+ এ ভি এম তোয়াব গংদের শক্তিশালী করতে সাহায্য করেন। এর ফলে যা হবার তাই হয়েছে। আমি যেহেতু তখন বঙ্গভবনে ছিলাম তাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের নেতৃবৃন্দ থেকে তাদের প্রতিপক্ষ অনেক বেশি জোড়দার ও কৌশলী ছিল!
বাকি বিষয় গুলো ক্রমান্বয়ে নিচে দিলাম;-

১. তিন দিন যাবত রেডিও ও টেলিভিশন বন্ধ না রেখে , দেশবশীকে বিভ্রান্তিতে না রেখে বরং সঠিকভাবে পরিস্থিতিটা দেশবাসীকে জানিয়ে এনাউন্স করা উচিত ছিল,

২. সংসদ পূনর্জীবিত করে জরুরী অধিবেশন ডাকা, যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে,

৩. মিডিয়ার মাধ্যমে এনাউন্স করে অন্তত এক ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল ট্রুপ্স দিয়ে সংসদ এলাকা ও সাংসদদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,

৪. অতি সল্প সময়ের ভিতর প্রেসিডেন্ট ও নুতন প্রাইম মিনিস্টার ও পূর্ন কেবিনেট তৈরী করা,

৫. আমরা সৈনিক তাই আমাদের কাজ শেষে আমরা তাদের হুকুম মেনে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়া।

সময় সময় মনে হয় আমাদের ঐসময়ের নেতৃত্বের বিচক্ষণতার এবং সময়ের প্রয়োজন বোঝার মানদণ্ড অত্যন্ত দুর্বলতায় ভরা ছিল। তাদের নিকট আমাদের ন্যায় যোদ্ধা এবং দেশের জন্য প্রান উৎসর্গ কারার জন্য হাতের মুঠোয় বেশকিছু প্রাণ সবসময়ই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা সময়ের ঘোরপাকে ক্ষমতার জন্য অন্ধ হয়ে পরে। এটা আমাদের এবং দেশের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য !

হায়রে আমার অভাগা দেশের এক উশৃঙ্খল বিপদগামী কর্নেল তাহের। তিনি যদি দেশটির ভালো আদৌও চাইতেন এবং হঠকারী সিপাহী বিদ্রোহী নামের “চর দখল” নামের ক্ষমতা দখলের নাটক না করতেন। দেশটিকে যদি সত্যিকারের ভালোবাসতেন। তবে এই সোনার দেশের অবস্থা সত্যি বহুপূর্বেই আধুনিকতার পথে এগুতে পারতো। দুর্ভাগ্য আমাদের তথাকথিত সমাজ পরিবর্তন করার নামে দেশে অরাজকতা ও মানুষ হত্যা ছাড়া আর কিছুই হয়নি সেদিন।

*****যদিও এটা আমার উইসফুল থিংকিং।
কিন্তু যদি এটা হত আমাদের দেশ সত্যিকারে সোনার বাংলা হতো। আমাদের সকলের সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, আমরা হতাম এ দেশের সোনার ছেলে।
আমাদের মাঝে কোন ভেদাভেদ থাকতনা। প্রত্যাগত বন্ধুরা আর আমরা যোদ্ধারা এক হয়ে যেতাম সত্যিকারে ভাই- ভাই হয়ে যেতাম।
আমরা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা দেশবাসীর আকুন্ঠ ভালবাসা পেতাম।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!