You dont have javascript enabled! Please enable it!

আবু তালেব বিশ্বাস এখন ইউপি চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়াবাসীর কাছে আজও মূর্তিমান আতঙ্ক

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ একাত্তরে কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুর এলাকার রাজাকার কমান্ডার আবু তালেব বিশ্বাস (৬৪) এখন জনপ্রতিনিধি, ইউপি চেয়ারম্যান। ‘৭১-এ লুণ্ঠন ও পরবর্তকিালে দু’ দফা চেয়ারম্যান হবার বদৌলতে সে এখন প্রচুর অর্থ-সম্পত্তির মালিক। স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পরেও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির এই মানুষটি এলাকাবাসীর কাছে হয়ে রয়েছে মূর্তিমান এক আতঙ্ক। চরমপন্থী কানেকশন থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ টুশব্দটিও করতে সাহস পায় না। ছেলে আওয়ামী লীগার (!) তাই তার পুরাে পরিবারটিই এখন হয়ে গেছে আওয়ামী । শাসকদলীয় সুযােগ সুবিধাও ভােগ করছে। তারা। এসব নিয়ে এলাকায় স্বাধীনতার সপক্ষের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে প্রচণ্ড। আবু তালেব বিশ্বাস বর্তমানে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিনারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান। কুখ্যাত এই রাজাকারের প্রসঙ্গটি এলাকায় ওপেন সিক্রেট’। মুক্তিযােদ্ধাসহ এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা আজও তার কথা স্মরণ করে আঁতকে ওঠেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বিভিন্ন সূত্র জানায়, ‘৭১-এ স্বাধীনতাকামীদের দাবিয়ে রাখতে অন্যান্য স্থানের মতাে হরিনারায়ণপুরেও গঠিত হয়েছিল পাকি হানাদারদের দোসর রাজাকার বাহিনী’। কুষ্টিয়া পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও পাকি মেজরের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় ওই সময় এলাকায় রাজাকার কমান্ডারের দায়িত্ব পায় বেড়বাড়াদি গ্রামের আবু তালেব বিশ্বাস। এ সময় এলাকার স্বাধীনতাবিরােধীদের নিয়ে সে গড়ে তােলে দুর্ধর্ষ এক রাজাকার বাহিনী এবং সে নিজে বন্দুক উচিয়ে বীরদর্পে এলাকায় ঘােরাফেরা শুরু করে।

তার দাপটে গ্রামবাসীরা থাকত ভীতসন্ত্রস্ত। ওই সময় তার ঘনিষ্ঠ সহচর রাজাকারদের মধ্যে অন্যতম ছিল-কীর্তিনগর গ্রামের বারু, মজিবর (মৃত), গােলাম মওলা (মৃত), সেরাজ (মৃত), জলিল (মৃত), মালেক, ভরত, বদর, সেকেন্দার (মৃত), বেড়বাড়াদি গ্রামের জামাল এবং হরিনারায়ণপুর গ্রামের করিম ও বিত্তিপাড়া রাজাকার ক্যাম্প’-এর জল্লাদ কোরবান আলী (মৃত)। একাত্তরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হরিনারায়ণপুর এলাকাটিতে বহু হিন্দু ও মাড়ােয়ারি পরিবারের বসবাস ছিল। এ ছাড়াও এলাকাটি ছিল জেলার অন্যতম একটি ব্যবসাকেন্দ্র। আবু তালেবের নেতৃত্বে এখানে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠার পর তারা এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনে মেতে ওঠে। বেড়বাড়াদি ছাড়াও পার্শ্ববর্তী পদ্মনগর, কীর্তিনগর, হরিনারায়ণপুর, ধলনগর, শিবপুর ও শান্তিডাঙ্গা গ্রামগুলােতে চলত তাদের নিয়মিত অপারেশন। এসব অপারেশনকালে তারা মুক্তিযােদ্ধাসহ বহু নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে খুন করে। তালেবের নেতৃত্বে রাজাকার-বিহারীদের যৌথ অভিযান চালানাে হয় শান্তিডাঙ্গা গ্রামের বিত্তশালী ও বিশিষ্ট হিন্দু ডাঃ রবীন্দ্রনাথ ভৌমিকের বাড়িতে। তারা ওই বাড়িতে ঢুকে লুটতরাজে মেতে ওঠে এবং মেয়েদের ওপর চালায় নির্যাতন। সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধকালে ফরিদপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহু হিন্দু পরিবার কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে থাকে।

হরিনারায়ণপুর, লক্ষ্মীপুর ও বিত্তিপাড়া এলাকায় তালেব বিশ্বাস ও তার রাজাকার বাহিনী। সুযােগ বুঝে পলায়নরত এসব সংখ্যালঘুর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা-পয়সাসহ সর্বস্ব লুটে নিত। পাকি দোসর রাজাকারদের অত্যাচার, নির্যাতন ও প্রাণের ভয়ে বহু হিন্দু পরিবার ওই সময় রাতের আঁধারে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের আগমুহূর্তে (ডিসেম্বরের প্রথম দিক) রাজাকার কমান্ডার আবু তালেব বিশ্বাস মুক্তিযােদ্ধাসহ বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ধরা পড়ে। পরে এলাকার মুক্তিযােদ্ধা *মান্ডার খায়রুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হরিনারায়ণপুরের। পার্শ্ববতী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার উজানগ্রাম ইউনিয়নের দূর্বাচারা মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে। অপকর্মের শাস্তি হিসাবে সেখানে মুক্তিযােদ্ধা-জনতা তার ওপর চালায় শারীরিক নির্যাতন। এবং পিটিয়ে তাকে আধমরা করে ফেলে। খবর পেয়ে তার বৃদ্ধা মা গ্রামের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে দূর্বাচারা ক্যাম্পে হাজির হয় এবং তালেবের জীবন ভিক্ষা চায়। এ পরিস্থিতিতে তাকে প্রাণে না মেরে শুধু মানবিক কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তার। মায়ের আবেদনে সাড়া দেয়। ক্ষুব্ধ জনতার পিটুনি ও নির্যাতন এমন পর্যায়ে চলেছিল। যে তালেব এ সময় হাঁটার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে সেখান থেকে তাকে টিয়ায় চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ‘সাপ মেরে সাপের নেঙ্গুড় রাখতে নেই’ গ্রাম্য এই প্রবাদবাক্যটির মতােই তালেবের প্রাণ ভিক্ষা দেয়াটাও পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধা ও এলাকাবাসীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

সে একাত্তরের ওই নির্যাতনের প্রতিশােধ নিতে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে গােপনে ফন্দি-ফিকির আঁটতে থাকে এবং এলাকার অপরাধীচক্রের সঙ্গে হাত মেলায়। চার ছেলে তিন মেয়ের জনক আবু তালেব বিশ্বাস। বর্তমানে হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এরশাদ আমলেও ওই ইউনিয়নের একদফা চেয়ারম্যান ছিল সে। তার এক ছেলে লিয়াকত আলী (৩৮)। বর্তমানে দ্বিখণ্ডিত কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের উপজেলা পর্যায়ের নেতা। এলাকাবাসীর মতে, রাজাকার বাবার অপকর্মগুলাে আড়াল করতেই সে আওয়ামী লীগে যােগ দিয়েছে। একাত্তরের রাজাকার আবু তালেব বিশ্বাস বর্তমানে হরিনারায়ণপুর এলাকায় সন্ত্রাসীদের। গডফাদার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। চরমপন্থী কানেকশন থাকারও অভিযােগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি জবরদখল ছাড়াও এলাকার হাটবাজারসহ আর্থিক উৎসের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সে, তার ছেলে ও সহচররা। তাদের অত্যাচার, নির্যাতনে এলাকাবাসী এখন অতিষ্ঠ। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। গত ইউপি নির্বাচনেও সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে এবং ভয়ভীতির মাধ্যমে ভােটারদের সমর্থন পক্ষে নেয়ার অভিযােগ রয়েছে তালেবের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বীর মুক্তিযােদ্ধা দূর্বাচারা এলাকার কমান্ডার ও জাসদ নেতা খায়রুল ইসলাম বাবু খুন হবার নেপথ্যেও রাজাকার আবু তালেবের হাত ছিল বলে এলাকাবাসীর ধারণা। খায়রুল ইসলাম খুন হয় ১৯৮৫ সালের ২০ মে রাতে। বিত্তিপাড়া-লক্ষ্মীপুরের মাঝামাঝি মহিষডাঙ্গা এলাকায় দুর্বত্তরা তাকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। বাবু ছিল ভারতের বিহারের চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা এবং সে পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে বেশ কটি সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেয়। দেশ স্বাধীনের আগমুহূর্তে ধরা পড়ার পর তার নেতৃত্বেই রাজাকার তালেবকে দূর্বাচারা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তার ওপর চালানাে হয়। শারীরিক নির্যাতন।

অনেকের মতে, খায়রুল ইসলাম বাবুকে খুনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালে তার ওপর চালানাে ওই নির্যাতনের প্রতিশােধ নিয়েছে তালেব। নিহত খায়রুল ইসলামের মেজ ভাই মুক্তিযােদ্ধা মােঃ সাবুবিন ইসলাম সাবু বর্তমানে উজানগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান। হরিনারায়ণপুর এলাকাবাসীর কাছে এখন আবু তালেব বিশ্বাস মানেই মুর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।আবু তালেব বিশ্বাসের বক্তব্য এদিকে কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবু তালেব বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, একাত্তরে তিনি রাজাকার ছিলেন না। হিন্দুদের ওপর কোন অত্যাচারও করেননি। এমন কি স্বাধীনতার বিপক্ষেও তার কোন প্রকার ভূমিকা ছিল না। তাই যুদ্ধকালে লুটপাটের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে দাবি করেন। ‘৭১-এ মুজাহিদরা (বিহারীরা) তার ছােট দু ভাই আবদুস সাত্তার ও আবদুল গফুরকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই বলেও তিনি জানান। চেয়ারম্যান তালেব আরও বলেন, তার ভয়ে এলাকাবাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত নয়। একটি কুচক্রীমহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। মুক্তিযােদ্ধা-জনতার হাতে গণপিটুনি খেয়েছে এ কথাও মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেছেন।

জনকণ্ঠ : ০৯-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!