কুষ্টিয়ার কসাই মজিদ বিহারী শত বাঙালীর রক্তে রাঙিয়েছিল হাত, এখন নিরুদ্দেশ
এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ একাত্তরে মুক্তিযােদ্ধাসহ স্বাধীনতাকামী, নিরীহ, নিরপরাধ শত বাঙালীর রক্তে হাত রাঙ্গানাে এবং বহু মা-বােনকে ধরে নিয়ে পাকি সেনাদের হাতে তুলে দেয়াই ছিল যার কর্ম, কুষ্টিয়ার পিস কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সেই জল্লাদপ্রধান কুখ্যাত মজিদ বিহারী’ এখন নিরুদ্দেশ। কুষ্টিয়া শহরের একই পাড়ায় পৃথকভাবে সংঘটিত বৃহৎ দুটি পরিবারে হত্যাকাণ্ডেরও হােতা ছিল সে। এর প্রথমটি ঘটে আড় য়াপাড়ার বাহাদুর বিশ্বাস লেনে। এখানে দিরাজ শেখসহ তার পরিবার-পরিজনের ৮ জনকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি ছিল যেমন বৃহত্তম, তেমনই লােমহর্ষক ও নৃশংস। এ ঘটনায় একই রাতে ‘কোহিনুর মিলকো ব্রেড এ্যান্ড বেকারির মালিক পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১৬, জনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। আড়য়াপাড়ার রজব আলী ও খান স্ট্রীটের ‘কোহিনুর ভিলা’ নামের সেই বাড়িটি আজও তার নিমর্ম সাক্ষী হয়ে রয়েছে। নৃশংসতার প্রথম চিত্র। ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলাের কথা আজও ভুলতে পারেননি আসমা বেগম (৪৬)। সেদিন। বিয়ের মেহেদির রং না মুছতেই তাকে হতে হয়েছে বিধবা। হারাতে হয়েছে বাবা ও বড় ভাইসহ আরও ৭ স্বজনকে। মনে পড়ে তার ফুটফুটে সেই জ্যোৎস্না রাতের কথা, বড় ভাইয়ের কথা। যে রাতে স্বামী-স্বজনদের সাথে বড় ভাইকেও তুলে দিতে হয়েছিল জল্লাদ মজিদ বিহারীর হাতে। একাত্তরের সেই বীভৎস দিনগুলাের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আসমা বেগমের কণ্ঠ বার বার রুদ্ধ হয়ে আসে। বীর মুক্তিযােদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা বদরউদ্দিন বদুর (৫২) ছােট বােন আসমা বেগম। শহরের আড়ুয়াপাড়ার বাহাদুর বিশ্বাস লেনে তাদের বাড়ি। ‘৭১-এ তাদের পরিবার ও পরিজনের ৮ সদস্য হানাদার পাকি সেনা ও রাজাকারদের হাতে শহীদ। হয়েছেন। এঁরা হলেন তাদের মেজ মামা বারু প্রামাণিক (৬৫), বাবা দিরাজ শেখ।
(৬০), বড় মামাত ভাই শাহাদত আলী (২৫), ছােট মামা কফিলউদ্দিন প্রামাণিক (৬০), মেজ মামাত ভাই আতিয়ার রহমান (২২), বড় ভাই শামসুদ্দিন (৩৫), আসমা বেগমের থামী ওহিউদ্দিন আহমেদ (২১) ও মামাত বােনের ছেলে সেলিম (১৪)। এছাড়া ঐ সময় খুনীদের হাত থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন মামাত ভগ্নিপতি তােফাজ্জেল হােসেন চান্দু (৪০)। তাদের অপরাধ ছিল বদরউদ্দিন বদু ও ওহিউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে অংশ। নিয়েছে এবং বহু পাকি সেনাকে হত্যা করেছে। এছাড়া কফিলউদ্দিন প্রামাণিকের প্রভাবের কারণে এলাকায় বিহারীরা লুটপাটে সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। প্রথমদিকেই তারা ডাবলু শেখ (১৮) নামে এলাকার এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা একদিন আসমা বেগমের মেজ মামা বারু প্রামাণিককে রাস্তার ওপর। গুলি করে হত্যা করে। এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের আগেই দিরাজ শেখ (আসমার বাবা) সপরিবারে এলাকা ছেড়ে কমলাপুর ইছাখালী’ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বারু প্রামাণিক নিহত হবার কদিন পর দিরাজ শেখ ঘরবাড়ির অবস্থা জানতে ও জামাতা ওহিউদ্দিনের খোঁজ নিতে সেখান থেকে শহরে আসেন।
এ সময় হঠাৎ করেই তিনি। মজিদ বিহারীর নজরে পড়ে যান। রাজাকাররা দিরাজ শেখকে রাজারহাট মোড়ে বর্তমান। মাসুদ বিড়ি কারখানার কাছে ধরে নিয়ে যায় এবং সেখানে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে। আসমা বেগম বলেন, সেদিন ছিল ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত । তারিখ ‘৭১-এর ৫ মে। ছােট মামা কফিলউদ্দিন প্রামাণিক, মেজ মামাত ভাই আতিয়ার রহমান, বড় ভাই শামসুদ্দিন, স্বামী ওহিউদ্দিন আহমেদ, মামাত ভগ্নিপতি তােফাজ্জেল হােসেন চান্দু ও মামাত বােনের ছেলে সেলিম- এই ৬ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মজিদ বিহারীর লােকেরা ধরে নিয়ে যায়। পরে তােফাজ্জেল হােসেন চান্দু মৃত্যুর হাত থেকে। ফিরে আসতে সক্ষম হলেও অপর ৫ জন আর ফিরে আসেননি। মজিদ বিহারীর তখনকার শারীরিক বর্ণনা দিতে গিয়ে বদরউদ্দিন বদু ক্ষোভের সাথে বলেন, মানুষরূপী এই পিশাচের বয়স একাত্তর সালেই ছিল পঁয়ত্রিশের উর্ধে। দেখতে লম্বা। এবং গায়ের রং ছিল শ্যামলা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় নৃশংসতা
এদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে কুষ্টিয়া শহরের পূর্বপ্রান্তে এবং পাকি সেনা ক্যাম্প ওয়্যারলেস। অফিসের নিকটবর্তী আড়ুয়াপাড়ার রজব আলী খান স্ট্রীটের ‘কোহিনুর ভিলা’ নামে এক বাড়িতে ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরােচিত ও লােমহর্ষক এক হত্যাযজ্ঞ। সে সময় ওই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন কোহিনুর মিলকো ব্রেড এ্যান্ড বেকারীর মালিক রবিউল হক (৫৫) ও তাঁর ছােট ভাই আরশেদ আলী (৪৫)সহ তাদের পরিবার। তারা নিজ বাড়ি ছেড়ে ওই সময় কোথাও যেতে চাননি। তাঁদের বাড়ির পাশেই বসেছিল পিস। কমিটির কার্যালয়। ‘৭১-এর ১৮ সেপ্টেম্বরের রাতে বিহারী রাজাকাররা বাঙালী এ দু’টি পরিবারের মােট ১৬ জনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে পরিবার দু’টির নারী ও শিশুসহ কেউই রেহাই পায়নি। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডেরও। নেতৃত্বে ছিল কসাই মজিদ বিহারী’। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে কথা হয়। বিভিন্নজনের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শেখ মােশারফ হােসেন ফনি (৭৬), সুফিয়া বেওয়া (৬৫), তৎকালীন কোহিনুর বেকারীর কর্মচারী আবু বক্কর (৭৬), কামরুজ্জামান (৪৯) ও ‘একাত্তরে আমির লেখিকা বেগম নূরজাহান প্রমুখ।
জনকণ্ঠ ॥ ১৪-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন