পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ : অতঃকিম (৪)
অসিত ভট্টাচার্য
অথাতাে চীন জিজ্ঞাসা
আমি ইচ্ছা করেই মহাশক্তিবর্গ কী করতে পারেন সেই প্রসঙ্গে উদীয়মান মহাশক্তি মহাচীনের বিষয় উল্লেখ করিনি। কারণ লােকায়ত্ত চীন সরকার (Peoples Republic of China) উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য বা বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনসাধারণের দুর্দশা মােচনের জন্যে এগিয়ে এসে এখন কিছু করবেন এমন আশা বিশেষ কেউ করেনি। ভারত সরকারও নিশ্চয় তা করেননি। কারণ চীন সরকার বরাবর প্রথমে আয়ুব এবং পরে ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন পাক জঙ্গীশাহীকে অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থন যােগান দিয়ে চলেছেন। আমেরিকার সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপনের দালাল হিসেবে হয়তাে তাঁদের এই জঙ্গীশাহীকে দরকার। হয়তাে ভারতে পার্লামেন্ট পদ্ধতিতে কোনাে আর্থিক বিকাশ হােক এটা তাদের অভিপ্রেত নয়। হয়তাে দীর্ঘ সামরিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসার ফলে তারা মনে করেন যে তাদের দক্ষিণ পার্শ্বদেশ বা right flank (প্রশান্ত মহাসাগর তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মুখ ভাগ বা front ধরলে, ভারত right flank হয়)। ভারতকে নড়বড়ে ও অসহায় অবস্থায় রাখা দরকার এবং সে কাজে পাক জঙ্গীশাহী সবচেয়ে মজবুত হাতিয়ার। মার্কিনকে ফ্রন্ট না ভেবে যদি সাইবেরিয়া তথা সােভিয়েত ইউনিয়নকে ফ্রন্ট বিবেচনা করা হয়, তাহলে, ভারতের সামরিক অবস্থানগত গুরুত্ব আরাে বৃদ্ধি পায়। ভারত তখন হয় পশ্চাদভাগ বা rear। সে ক্ষেত্রেও পূর্বোক্ত সামরিক প্রয়ােজন অক্ষুন্ন থাকে। চীন সরকারের চিন্তাধারা আমার জানা নেই। তবে মনে হয় উপরােক্ত কোননা কোনাে কারণ তাদের নীতি নির্ধারণের উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকবে, নাহলে তাসখন্দ চুক্তির বিরােধিতা করা বা দিল্লীতে গােরক্ষা আন্দোলন নিয়ে নাগা সাধুদের অদ্ভুত কার্যকলাপ সমর্থন করার আর কোনাে যুক্তি সঙ্গত কারণ দেখা যায় না।
তবু মনে হয়, কারণ যা-ই থাক চীন সরকারের বর্তমান নীতি শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষেও সুফল দেবে। কারণ মার্কিন সরকারের চেয়েও চীন সরকার আরােই ভালাে জানেন যে পাকিস্তান একটি lost cause (এবং চীন সরকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে home of all lost causes হয়ে বসে থাকবেন)। তাঁদের প্রয়ােজন শেষ হলে পাক জঙ্গীশাহী তাঁদের কাছে কী রকম সম্বর্ধনা পাবে তা অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। তবে ভারত সম্পর্কে যদি তাঁদের কোনাে দীর্ঘমেয়াদী বিরােধিতার নীতি থাকে তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানকে ব্যবহারের প্রয়ােজন তাদের অনেকদিন থাকবে- যদিও সেই প্রয়ােজনে জঙ্গীশাহীকে সমর্থনের প্রকৃতি বর্তমানের মতাে প্রায় সর্বাঙ্গীন হবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীন সরকার পাক জঙ্গীশাহীকে সাহায্য ও সমর্থন করে গেলেও এই প্রশ্ন ভারতের বিরুদ্ধে মােটেই তীব্র বিরােধিতার নীতি গ্রহণ করেননি। (দ্রষ্টব্য Options on Bangladesh শীর্ষক স্টেটসম্যান রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র ১১ জুলাই ১৯৭১এ G. D. Deshingkar-এর The Chinese Riddle’ শীর্ষক প্রবন্ধ)। কিন্তু এই সমর্থন এদেশে চীন সরকারের সমর্থকদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি করছে ও করবে।
ইতিহাসের গতি: পূর্ববঙ্গ কি নতুন ভিয়েনাম?
যাই হােক, চীন সরকার বা সােভিয়েত কি মার্কিন সরকার শেষ পর্যন্ত যাই করুন ইতিহাস কারুর জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকে না। এক্ষেত্রে ইতিহাস বসে নেই। গত ১৬ই জুলাই কোলকাতার একাধিক সংবাদ পত্রে প্রকাশিত সংবাদসূত্র থেকে জানা যায় যে পূর্ববঙ্গে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৯টি ছছাটবড় দল-উপদল পাক হানাদার বাহিনীর একটানা হামলা থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্য গেরিলা বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই দল উপদলগুলাের অনেকগুলােই চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে যে হরিনাম সংকীর্তনের মতাে কেবল চীনের নাম গান না করে বা ওপর থেকে কী নির্দেশ আসে তার জন্যে অপেক্ষা না করে তারা চীন বিপ্লবের নীতি স্বদেশে প্রয়ােগের পক্ষপাতী। (এই সব দল-উপদলের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যাবে ১৯ জুলাই আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী হাতেম আলীর সুদীর্ঘ পত্রে)। উক্ত চিঠিতে আরাে উল্লিখিত হয় যে পূর্ববঙ্গে সবচেয়ে খ্যাতনামা মাও পন্থী মহম্মদ তােয়াহার দলের অনেক সদস্য, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তার নীতিকে উপেক্ষা করে হানাদার বাহিনীকে রােখার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছেন। মনে হয় না যে তােয়াহাও বেশিদিন নিষ্ক্রিয় থাকবেন। বস্তুত সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হানাদাররা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা প্রভৃতি শহরের শ্রমিক বস্তিগুলােতে একেবারে আগুন লাগিয়ে শেষ করে দিয়েছে এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে খাক করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে শ্রমিক ও কৃষকদের যারা সাথী ও সহযােদ্ধা তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারেন না। তাদের আন্তরিক ও আভ্যন্তরীণ প্রয়ােজন-ই তাঁদের নীতি ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য কোনাে হুকুমনামা এই অবস্থায় কার্যকরী হতে পারে না।
দেখা যাচ্ছে যে, এতদিন পরে ভাসানী সঠিকতার ঘােষিত সমাজতান্ত্রিক নীতির দিক থেকে সঠিক কার্যক্রম অনুসরণের পথে পা বাড়িয়েছেন। দেখা যাচ্ছে যে তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মৌখিক আক্রমণও করেননি বরং সমর্থন জানিয়েছেন। এতে তার কোনাে ক্ষতি হচ্ছে না বরং যে সরকারকে আজো কেউ স্বীকৃতি দেয়নি, তার একটি হেঁড়া মন্ত্রিত্বের গদী নিয়ে লাভ কী। বরং হানাদারদের বিরুদ্ধে মিলিত অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করায় তারা নিজেদের সমগ্র জাতি ও দেশভিত্তিক জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র তৈরি করছেন। ত্রিশের দশকে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের ক্যুনিস্ট দলও ঠিক এই নীতিই গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া প্রথমে চীনের এবং পরে ভিয়েনামের অভিজ্ঞতা থেকেই এটা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জাতীয় সগ্রাম যখন সশস্ত্র গণসংগ্রামের রূপ নেয়, তখন যদি সমাজতন্ত্রীরা এগিয়ে এসে সেই সগ্রামে অংশ নেয় তাহলে জাতীয়তার সংগ্রাম অচিরে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে পরিণত হয়। কারণ সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম যাদের জন্য সেই ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক এবং শ্রমিক ও নিঃস্ব নাগরিকরাই নিপীড়িত জাতির মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকেন। আর এই জন্যেই বােঝা যায় যে জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে কেবল তার সমালােচনা করে নিয়মিত আহার করে গেলে, ইতিহাসে শিকড় গাড়া যায় না। ভারতবর্ষে বামপন্থী রাজনীতির ইতিহাস-ই এর প্রমাণ। ভাসানী এতদিনে (বা ১৯৭০ এর শেষ থেকে) সেই সত্য বুঝেছেন মনে হয়। এর আগে তাঁরা যে নীতি অনুসরণ করে এসেছিলেন তা তাঁর দলকে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এমন কি জনসাধারণ তাদের আয়বের বি টিম’ এই উপহাসে ভূষিত করেছিল।
আমি ইতিপূর্বেই (Pakistan Elections শীর্ষক পুস্তিকায়) উল্লেখ করেছি যে পূর্ববঙ্গে একটি ভিয়েনাম ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। সেটা যে অবশেষে সত্য হতে চলেছে পূর্বোক্ত ১৬ই জুলাইয়ের সংবাদ তার একটি বড় প্রমাণ। জঙ্গী শাহীর লক্ষ্যহীন নৃশংসতা, ভারতের নিষ্ক্রিয়তা এবং বৃহৎ শক্তিগুলাের নিজ নিজ স্বার্থনির্ভর খণ্ডদৃষ্টি এই পরিস্থিতিকে অনিবার্য করে তুলেছে এবং এই অবস্থা চলতে থাকলে আরাে দুর্বার করে তুলবে। সেই নতুন বিপ্লবী বাংলাদেশ কোনাে মহাশক্তির মুখ চেয়ে বসে থাকবে না।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পতন
প্রসঙ্গ ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা আরাে আশা করেছিলেন যে ক্রমাগত যুদ্ধ চালানাের জন্যে পাক-অর্থনীতির উপর এমন চাপ পড়বে যে জঙ্গী শাহীর পক্ষে হানাদারি চালিয়ে যাওয়া শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হবে। পাকিস্তানে জঙ্গী সর্দারদের পক্ষে পূর্ববঙ্গে দিনের পর দিন সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়া যে অসম্ভব এমন কথা জুলাইয়ের গােড়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি মিশনও পাকিস্তান ঘুরে ভারতে এসে আমাদের জানান। এই যুক্তিকে অসার বলা যায় না। বিশেষতঃ জাতীয় নীতি নির্ধারকরা কতকগুলাে ঘটনায় আশান্বিত হন মনে হয়।
১. ৭ই জুন ইসলামাবাদ সরকার আইন জারি করে পাকিস্তানে উচ্চমানের (৫০০ ও ১০০) টাকার
কারেন্সি নােটের মুদ্রামূল্য লােপ করেন। ৮ই জুন ইসলামাবাদে ও পশ্চিম পাকিস্তানের বড়াে বড়াে শহরে ব্যাঙ্কের ওপর টাকা তােলার হিড়িক বা rush হয়। এই সময় জানা যায় যে পাকিস্তানের মুদ্রার ওপর আস্থা হারানাের ফলে বড়াে বড়াে পাক ধনপতিরা ইতিমধ্যেই অন্তত ৬০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়েছে (সম্ভবত সােনা বা বৈদেশিক মুদ্রায় সে টাকা রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে) [স্টেটসম্যান ৯ জুন ‘৭১]।
২. মার্কিন সাপ্তাহিক News-week পত্রিকা উদ্ধৃত করে ১৯শে জুন স্টেটসম্যান পত্রিকা জানান যে হংকং-এর খােলা বাজারে ২৬শে মার্চের আগের তুলনায় মার্কিন ডলারের সঙ্গে পাকিস্তানি টাকার বিনিময় হার বহুগুণ কমে গেছে। তাদের প্রদত্ত হিসেব অনুযায়ী পাক মুদ্রার বিনিময় মূল্য হ্রাসের নিম্নলিখিত তালিকাটি প্রণীত হয়েছে।
পাক মুদ্রায় (টাকার) একটি মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ১৯৭১
২৬শে মার্চের পূর্বে = ৪.৭৬
২৬শে মার্চের পরে = ১০.৭৫
৪ঠা জুন = ১১.০০
১১ই জুন = ২০.০০
এর ফলে ঐদিনে স্টেটসম্যান পত্রিকা জানান যে, Pak Economy on the verge of break down -পাক অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েছে।
৩. কিন্তু ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের আশাবাদ আরাে জোরদার হয় পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধান না করলে বৈদেশিক সাহায্য পাবেন না, নানাসূত্রে এইরকম কথাবার্তা ও প্রতিশ্রুতি থেকে। যেমন ৭ই জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বি. বি, সি-র Panorama অনুষ্ঠানে বলেন, ‘If they [Pakistan] want assistance from the western world who by and large supplies the aid they (Pakistan) must provide a political frame work within which to apply the aid so that it can go, a great deal of it, to East Pakistan.
সংক্ষেপে পশ্চিমী সাহায্য পেতে হলে ইসলামাবাদকে পূর্ববঙ্গে এমন একটা রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তুলতে হবে যাতে সাহায্যের অনেকটাই পূর্ববঙ্গে পৌছয়। সেই কাঠামাের বিষয় স্পষ্ট কিছু বলা না হলেও এমন ধারণা করা স্বাভাবিক যে বক্তা পূর্ববঙ্গের জনপ্রিতিনিধিদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক বােঝাপড়ায় আসার কথা তিনি বলেছিলেন।
এই ধরনের বিবিধ উক্তির সূত্র অবশেষে ২১শে জুন প্যারিসে Aid Pak consortium-এর প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে দেওয়া হলাে। তখনও সেই একই কারণ উল্লেখ করা হয় পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধান হলে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া অর্থহীন। জানা যায় যে, গত মে মাসের শেষের থেকে ১১জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাঙ্কের কারগিল মিশন পাকিস্তান সফর করে যে, রিপাের্ট পেশ করেন, তার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বলা বাহুল্য, ঘটনার এই ক্রমিক পরিণতি ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের ক্রমেই আশান্বিত করে তােলে। কিন্তু অস্ত্র সাহায্যের ক্ষেত্রে যেমন আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও তেমনি জুনের শেষ সপ্তাহে মার্কিন সূত্র থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলা হতে থাকে। Aid Pakistan consortium-এর meeting বা বৈঠকে নাকি অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ করা হয়নি, ওটা সাময়িক ব্যাপার মাত্র, পাকিস্তানকে যে অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে-ই না, এমন কোনাে কথাই নেই ইত্যাদি (স্টে, ২৮ জুন ‘১৯৭১ WASHINGTON NOT STOPPING AID TO PAKISTAN, শীর্ষক সংবাদ)। অবশেষে বিশ্বসফর শেষে ভারত প্রত্যাগত জয়প্রকাশ নারায়ণ জানালেন (স্টে. ৯জুলাই’-১) যে পেন্টাগনের ভেতরে ভেতরে একটা বােঝাপড়া আছে। (একথাও নতুন নয়। Friends not Masters (1967) বইটিতে আয়ুব স্পষ্টই বলেছেন পেন্টাগনের সঙ্গে তাঁদের দিলের মিলের কথা, পৃ-৮৫-৯)। তিনি আরাে বললেন যে, জঙ্গীশাহীকে বহুপাক্ষিক (multilateral) সাহায্য যদি বন্ধও করা হয় দ্বিপাক্ষিক (Bilateral) সাহায্য চলতেই থাকবে।
রাজনৈতিক প্রয়ােজন-ই আসল প্রয়ােজন
আসলে, এক্ষেত্রেও মার্কিনের রাজনৈতিক প্রয়ােজন-ই তাদের অর্থনৈতিক সাহায্যকে নিয়ন্ত্রিত করছে। পাকিস্তানকে, বিশেষত তার সামরিক বাহিনীকে যতদিন তাদের দরকার আছে, ততদিন পাক জঙ্গীশাহীকে তারা কোনাে না কোনাে ভাবে সাহায্য পাঠাবেই। ১৬ই জুলাই স্টে, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা যায় যে নিক্সন সরকার নাকি পাক জঙ্গীশাহীকে ৮৮৫ কোটি টাকা ১৯৭১-৭২ (জুলাই-জুন) এর জন্যে সাহায্য দিতে চাইছে কিন্তু মার্কিন House of Representatives তার বিরােধিতা করছে। মার্কিন সিনেটের একাংশের মধ্যে তার মধ্যে এডােয়ার্ড কেনেডি সৰ্বাধিক মুখর অনুরূপ বিরােধিতার সংবাদ আগে প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু ঘটনা এই যে, পাক জঙ্গীশাহীকে মার্কিন সরকারের এখনও দরকার আছে। গুরুতর দরকার। দরকারটা কি, সেটা ১৬ জুলাইতে লস এঞ্জেলস থেকে প্রচারিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভাবী চীন সমেন সংবাদ প্রচারের পর, এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্সের বিমানে-ই নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিংগারের চীন যাত্রার পর, সারা দুনিয়ার মানুষ জেনেছে। মার্কিন জনসাধারণকেও এই সামান্য কথাটা বােঝাতে নিক্সন সরকারের এখন খুব অসুবিধে হবে না। চীনের সঙ্গে মিটমাটের ওপর ভিয়েত্নামের দীর্ঘ যুদ্ধের সমাধান নির্ভর করে বলে মার্কিন সরকার ও জনসাধারণ জানেন ও বিশ্বাস করেন। আর চীন সবকারের সঙ্গে যােগসূত্র হিসেবেই ইসলামাবাদ সরকারকে তাদের দরকার। সুতরাং এই সরকারকে জিইয়ে রাখার মতাে সাহায্যের প্রস্তাব উত্থাণিত হলে, মার্কিন জন প্রতিনিধিরা (বিবেকের দংশন ইত্যাদির প্রসঙ্গ মুলতুবী রেখে), তা কিছু কালের জন্যে অন্তত মেনে নেবেন বলে মনে হয়। (প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য অস্ত্রবাহী পাক জাহাজ ‘পদ্মা’তে কোনাে মাল তােলা হবে না বলে মার্কিন বন্দর শ্রমিকরা (longshoremen) প্রথমে বলেন। কিন্তু, নিক্সনের চীন সফর ঘােষিত হবার পরেই তারা বলেন যে, ‘পদ্মা’তে মাল তােলা হবে। ওতে নাকি কোনাে অস্ত্রই যাচ্ছে না) সুতরাং এদিক থেকেও ভারত সরকারের সামনে সক্রিয় হওয়া ছাড়া আর কোনাে পথ বা Option থাকছে না।
ইয়াহিয়ার হুমকী : স্বাগত সূচনা
এই অবস্থায় গত ১৯ শে জুলাই ভারতের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া যে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন সেটা ভালােই হয়েছে বলতে হবে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের তথা সমগ্র বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রাথমিক সমস্যা ধামাচাপা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। হয়তাে পা জঙ্গীচক্রেরও এখন একটা বিরাট ধ্বংসের পরিকল্পনা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। গত তিনমাসে তারা যেমন পূর্ববঙ্গে একটি বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা খাড়া করতে পারেনি, তেমনি একটা যােগাযােগ ব্যবস্থাও চালু রাখতে পারেনি।
চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার আখাউড়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের Life line বা প্রাণসূত্রস্বরূপ যে রেলপথ তা আজও অচল। মােটর পথে অজস্র ভগ্ন সেতু এবং বর্ষায় তা সামরিক যানের চলাচলের অগম্য হয়ে উঠবেই। জলপথেও সামরিক যান ছাড়া অন্য যান নেই, কিন্তু বড়ােবড়াে নদী ছাড়া অন্যত্র সেগুলাের প্রবেশ তাদের পক্ষেই বিপজ্জনক। টেলিফোন পােস্টগুলাে বহু স্থলে উড়ে গেছে। পাক সামরিক বাহিনী যে, পূর্ববঙ্গের মুক্তি ফৌজের হাতে ক্রমাগত মার খাচ্ছে, এটা এখন বৈদেশিক সূত্রেই জানা যায়। (দ্র: স্টে, ১৪ জুলাই ৭১ এ প্রকাশিত, লন্ডন Times এর সংবাদদাতা’র প্রদত্ত রিপাের্ট Pakistan Army faces continuing Threat। জুলাই-এর তৃতীয় সপ্তাহে কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধি পূর্ববঙ্গ ও পাকিস্তান ঘুরে এসে জানান যে, ঢাকা চট্টগ্রাম প্রভৃতি বড়ােবড়াে শহরেও নিত্য গ্রেনেড আক্রমণ চলেছে। প্রসঙ্গত News week পত্রিকার ১৯শে জুলাই সংখ্যা Guerilla warfare in East Pakistan উল্লেখযােগ্য।)।
এই অবস্থায় জঙ্গীশাহী পূর্ববঙ্গে তাদের অধিকার কায়েম রাখতে যত চেষ্টা বাড়াবে, তাতে তাদের ক্ষতিই দিনে দিনে বাড়বে শুধু। পাকিস্তানের এ বছরের বাজেটকে তাই একটি মিথ্যার মালা রূপে গড়া হয়েছে। (এ বিষয়ে জ্বলায়ের স্টেটসম্যানে সারওয়ার লতীফের আলােচনা দ্রষ্টব্য।)
পশ্চিম পাকিস্তানেও ক্রমেই অসন্তোষ বৃদ্ধির ফলে সেখানে বিশেষত পাখতুন-বালােচ ও সিন্ধি এলাকায় সমস্ত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলােকে জুনের মাঝামাঝি বাতিল করা হয়েছে। (স্টে, ১৭ জুন ১৯৭১) সুতরাং পাক জঙ্গীচক্র যেমন কোনঠাসা হয়ে পূর্ববঙ্গে সামরিক হামলা শুরু করেছিল তেমনি কোনঠাসা হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করাও তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তানভুক্ত পূর্ববঙ্গ এক নয়—ভারতের একটা সমর বাহিনী আছে। সে কথা মনে রেখেই সম্ভবত ইয়াহিয়া হুঁশিয়ারী দিয়েছেন তিনি একা লড়বেন না। (ড়াে লড়ে খুঁটির জোরেই)। পরের দিন এ কথার উত্তর দিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী। যাই হােক ইয়াহিয়ার কথাটা খুবই ভালাে কথা। তাঁর সহযােগী বা সহযােগীবৃন্দ তাঁর সঙ্গে কি ভাবে, অর্থাৎ শুধু কথা দিয়ে, না তার ওপর অস্ত্র দিয়ে নাকি তার ওপর সৈন্য দিয়েও লড়বেন এবং কতদিন তাঁর সঙ্গে থাকবেন (অর্থাৎ কোনাে বৃহৎ শক্তি অবস্থাগতিকে আসরে নামার পরেও থাকবেন কিনা) সেইসব প্রশ্ন থেকেই যায়।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এই যে, ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য কাজের ফলে তথাকথিত বৃহৎ শক্তিগুলাে তাদের নিরপেক্ষতার আড়ম্বর ছেড়েও সদুপদেশ দানের ভূমিকা ত্যাগ করে, আসরে নামতে বাধ্য হবে। (যে ধরনের চিন্তা কানাডা সরকার করছেন)। বর্তমান অবস্থায় কেবল আমাদের মৃত্যু-ই অবধারিত। বিকল্প ব্যবস্থায় হয় সকলে বাঁচবে নয় সকলে মরবে। আমি বাঙালির একক মৃত্যুর স্বপক্ষে নই। তাই বলি, ইয়াহিয়া যতাে শীঘ্র তার হুমকি কাজে পরিণত করতে এগিয়ে আসেন, ততই মঙ্গল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি (স্টে, ১৫ ও ১৬ জুলাই ‘৭১) থেকে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তা থেকে জানা যায় যে পূর্ববঙ্গে স্থানে স্থানে এখন খাদ্যাভাব তীব্র এবং আগস্ট মাসে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে। যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবার ফলে খাদ্য আমদানি করেও পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে দুর্ভিক্ষ এড়ানাে যাবে না বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দুর্ভিক্ষ এড়ানাের জন্যে পাক জঙ্গীশাহীর যে বিশেষ গরজ নাই তাও তারা লক্ষ্য করেছেন। কেনই বা থাকবে? জঙ্গীশাহী তাে পূর্ববঙ্গে Biafra solution-ই চাইছে। তাছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে ইংরেজের Denials policy থেকেও তারা উপযুক্ত শিক্ষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে নিশ্চয়।) এসব সত্ত্বেও ইয়াহিয়া চক্রকে সক্রিয়ভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে অগ্রসর হবার জন্যে মার্কিন সরকারের চাপ দেবার কোনাে চেষ্টাই নেই। বরং দুর্ভিক্ষের কথা বলে তারা ইয়াহিয়া চক্রের হাতে আরাে খাদ্য সম্পদ তুলে দিতে চায় যাতে পূর্ববাংলার সেই খাদ্য বিলিয়ে পাক বাহিনী জনতাকে বশে আনতে পারে। এক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষে বাংলার কোটি কোটি মানুষের তিলে তিলে long and lingering death-এর চেয়ে, খাদ্যের আশায় দেশত্যাগ ও শক্রর পায়ে অসহায় আত্মসমর্পণের চেয়ে সুপ্রস্তুত দুটি সমরবাহিনীর প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ অনেক বেশি বাঞ্ছনীয় মনে করি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এক সময়ে বলেছিলেন যে আমাদের নরকের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই নরকাগ্নির মধ্য দিয়ে গিয়েও আমরা জীবনের ছাড়পত্র পাই কিনা, সেটাই যাচাই করে দেখতে জাতি আজ উৎসুক। বস্তুত তাছাড়া আমাদের বাঁচার অন্য কোনাে পথও নেই।
পর্যবেক্ষক প্রসঙ্গে
এই রচনা সমাপ্ত হবার (২০শে জুলাই ১৯৭১) পর পূর্ববঙ্গ প্রসঙ্গে যে সব রাজনৈতিক development ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলাে পূর্ববঙ্গে ও ভারতে পঞ্চাশ জন তথাকথিত U.N. observer বসাবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও তদীয় অনুচরদের জেদাজেদি। যখন পাক দস্যুবাহিনীর অত্যাচারে ৭০ লক্ষেরও বেশি লােক সর্বস্বহারা হয়ে এদেশে চলে এসেছে তখন সীমান্তের এদিকে ওদিকে পঞ্চাশ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক’ বসে থেকে (গুপ্তচর বৃত্তি করা ছাড়া) আর কোনও উপকারে লাগবেন? মূল রাজনৈতিক সমাধানের বিষয় যখন কিছুই করা হলাে না, তখন এই কজন বিদেশির কথায় কি সত্তর লক্ষেরও বেশি লােক স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন? বিশেষত হানাদার বাহিনীর কার্যকলাপ যখন এখনও অব্যাহত।
লক্ষ্যণীয় যে এই প্রস্তাবটি এসেছে দেশ বিভাগের নেপথ্য নায়ক আগাখার পুত্র তথাকথিত ‘প্রিন্স সদরুদ্দীনের কাছ থেকে। U.N.O. এর বাস্তুহারা সংক্রান্ত সংস্থার হাই কমিশনার পদাভিষিক্ত এই ব্যক্তিটি গত জুনেই (১৫ জুনে বনগাঁতে) এদেশে এসে বলেন যে, উদ্বাস্তুরা যে কেন দেশে ফিরে যাবেন না, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। অথচ সেইখানেই সাংবাদিকরা যখন তাকে বলেন যে দেশে ফিরে গেলে তিনি বা তার সংস্থা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা। তখন তিনি জানান যে, সে গ্যারান্টি তারা দিতে পারেন না। স্টে, ৬ জুন ৭১)। পৃথিবীর সবাই যখন পূর্ববঙ্গের দারুণ দুরবস্থায় চিন্তিত তখন তিনি অম্লানবদনে পাক বাহিনীর দোহার সেজে বলেন পূর্ববঙ্গে অবস্থা স্বাভাবিক। তারপর জেরার উত্তরে বলতে বাধ্য হন, আমাকে পূর্ববঙ্গের] যেসব জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় (অর্থাৎ টিক্কা খানের বৈঠকখানায়?] সেখানে অবস্থা স্বাভাবিক দেখেছি’। (স্টে, ঐ) এই দ্রলােকের সম্বন্ধে এবং এঁকে যে পদে রাখা হয়েছে, সেই কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জাতিপুঞ্জের ভূমিকা সম্বন্ধে Times এর Nigel Lawson বলেন :
It is still harder to have faith in an organization whose visiting representative in East Bengal, Prince Sadruddin Agakhan, brings back a report that contradicts with those of all independent observers, and agrees only with the official line of the Pakistan military govt.
(Bangladesh: The silent voice of U. Thant). স্টেটসম্যান, ২৫ জুন, ‘৭১।
উপরােক্ত পঞ্চাশজন পর্যবেক্ষক এই তথাকথিত প্রিন্স’ আগা খা তনয় সদরুদ্দীনের অধীনে কাজ করবে। এই হলাে পরিকল্পনা। জানা যায় যে, প্রিন্স সদরুদ্দীনের এই প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছ থেকে পাওয়া মাত্র ভারত সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। উ খা আর এ বিষয়ে কথা বাড়াননি। তখন মুখােশের অন্তরাল থেকে আসল মুখ বেরিয়ে পড়েছে। মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগ বা State Department এই নিয়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ দিতে ও জেদাজেদি করতে শুরু করে। উথা সম্ভবত তাদের চাপেই (জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে প্রেরিত এক চিঠিতে) নিরাপত্তা পরিষদের এক ঘরােয়া অধিবেশন ডেকেছেন। সেখানেও বৈঠকের Agenda বা আলােচ্যসূচি বাংলাদেশের সমস্যা নয়, আলােচ্য হলাে সদরুদ্দীন কর্তৃক পর্যবেক্ষক নিয়ােগ। অন্তত এ দেশের সংবাদ সূত্রে তাই প্রকাশ পেয়েছে। যদি এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর গুরু দায়িত্ব বর্তাবে। মার্কিন সরকারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের দাঁড়াতে হবে এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বর্তমান নীরবতার অবসান ঘটাতে হবে। (একথাতাে জানা গেছে যে দ. ভিয়েত্নামে দিয়েম সরকারকে জোরদার করার জন্যে মার্কিন সরকার যে পুলিশ expert পাঠিয়েছিলেন আজ তাঁকেই পূর্ববঙ্গে পাঠানাে হচ্ছে। (Statesman 25. 7.71. এবং তার পূর্বে আনন্দবাজার ২৪ জুলাই ৭১)।
ভারত সরকার এই পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব সম্পর্কে প্রথমে যে কঠিন বিরােধিতা করেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বিরােধিতা থাকলেও তার কাঠিন্য বেশ কিছুটা কমে এসেছে মনে হয়। স্টেটসম্যান ২২ জুলাইয়ের অনুযায়ী (শিরােনাম India decries move to send observers) ভারত এই চেষ্টাকে unfriendly act’ মনে করে। (কথাটি কঠিন, উনিশ শতকে যুদ্ধ ঘােষণার পূর্বে ব্যবহৃত হতাে)। ২৬শে জুলাইতে উক্ত দৈনিকের সংবাদ : পূর্ববঙ্গে পর্যবেক্ষক প্রেরণ সম্বন্ধে ভারত উদাসীন (indifferent)। তবে তাতেও বলা হয় India determined not to allow U. N. observers in its territory। পরে ৩১ জুলাই স্টেটসম্যান আমাদের জানান যে এ বিষয়ে ভারতের নীতি বদলাবার জন্যে মার্কিনের চেষ্টা সফল হবে মনে হয় না’ (Posting of UN observers U. S. Bid To change India’s Stand not likely succeed)। ১লা আগস্টের সংবাদ অনুযায়ী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্বীয় দলের এক গণসমাবেশে (massrally) বলেছেন যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত কারুর হুকুম (dictate) মানবে না বা কারুর কাছে কেনা হয়ে যাবে না। আশা করি তার এই দৃঢ়তা অপরিবর্তিত থাকবে, না থাকলে, ভারতের নিজের ভবিষ্যৎ-ই অন্ধকার। পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হবেই। সেক্ষেত্রে ভারতের অবশিষ্ট অংশও বাঁচবে না। বাংলার কোটি কোটি মানুষের মুণ্ড নিয়ে যারা পিংপং খেলার আয়ােজন করেছে-U.S. নামের S অক্ষর মুছে N অক্ষর বসিয়ে যারা কোরিয়ার যুদ্ধের আমল থেকেই নােংরা কাজে হাত পাকিয়েছে, এবং মুখে ‘চীন চীন’ বলে চেঁচিয়ে যারা মার্কিনের স্বার্থসিদ্ধি করছে তাদের মিলিত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্যে একটা দৃঢ় প্রতিরােধ তাদের গড়ে তুলতেই হবে। আমরা আশা করব যে, এ কাজে সােভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযােগিতাও তারা পাবেন।
পূর্ববঙ্গের বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য এই পর্যবেক্ষক’ প্রেরণ ইত্যাদির নিজস্ব মূল্য বেশি নয়। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের দ্যোতক হিসেবেই এইসব অপচেষ্টা গুরুত্ব অর্জন করে। কিন্তু অচলাবস্থার অবসান ওপথে আসবে না। নিরাপত্তা পরিষদ’-এর বৈঠকও তা আনতে পারে না, যদি ভারত সরকার সক্রিয় না হন অর্থাৎ এখনকার মতাে নিষ্ক্রিয় থাকেন। অপর পক্ষে পূর্ববঙ্গের অচলাবস্থার অবসান ত্বরান্বিত হতে পারে যদি পশ্চিম পাকিস্তানে পাখতুন, বালুচ প্রভৃতি অসন্তুষ্ট জাতিগােষ্ঠীর আন্দোলন আরাে সক্রিয় রূপ নেয়। ওয়ালী খানের বর্তমান অসন্তোষ তার কোনাে ইঙ্গিতবহ কিনা আমরা জানি না। তবে, বিদেশী সূত্রে প্রাপ্ত কোনাে সংবাদ থেকে মনে হয় যে ঐসব এলাকায় অসন্তোষ দিনে দিনে বাড়ছে বই কমছে না। যদি ঐ অসন্তোষ বাড়তেই থাকে, তাহলে পিংপং খেলার মূল টেবিলটি অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান-ই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। যাই হােক অচলাবস্থার অবসান কোন্ পথে আসবে তা এখনও অজানা। কিন্তু stalemate কখনােই স্থায়ী হতে পারে না।
সূত্র: কম্পাস, ১লা আগস্ট ১৯৭১