ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমি তখন স্ত্রীর অসুস্থা উপলক্ষে কলকাতায়।একবার বিখ্যাত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গান ঘরোয়া জলসায় শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেবব্রত বিশ্বাস বুড়ো হয়েছেন। হাঁপানীর স্পষ্ট টান তার কণ্ঠে। বলেছিলাম, জর্জদা, একটা গান শোনান।
ঃ কি গান?
বলেছিলামঃ ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু।’ এবার লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে কেন জানিনা দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের এই গানের রেকর্ডই বারে বার শুনতে ভালো লাগছে। এটাই এখন আমার নিঃসঙ্গ জীবনের অবসরের সঙ্গী। রেকর্ড যখন বাজে না, তখন মনে মনে গাই—
ক্লান্তি কর প্রভু আমার ক্ষমা
পথে যদি পিছিয়ে
পড়ি কভু
এই যে হিয়া থরো থরো
কাঁপে আজি এমনতরো
এই দীনতা ক্ষমা কর
ক্ষমা কর প্রভু।
রিপভ্যান উইঙ্কল যেদিন একটানা বিশ বছর ঘুমিয়ে জেগে উঠে দেখেছিলেন, তার স্বদেশ স্বকাল সব পরিবর্তিত; তাকে কেউ চেনেনা, তিনি কাউকে চেনেন না; তখন এই গানটি জানা থাকলে তিনি হয়তো উচ্চকণ্ঠে না হোক, নীরবে গাইতেন, ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু।
আমরা যারা এককালে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেছি; বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছি, ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনে দুঃখ বারণ করেছি; সেই আন্দোলন ও সংগ্রাম সফল হওয়ার পর মাত্র তিন বছরের মধ্যে দেখছি, আমরা অনেকেই রিপভ্যান উইঙ্কল হয়ে গেছি, নিজের সমাজ, স্বদেশ ও স্বকালকে আর চিনি না।সমাজ ও স্বদেশও আমাকে আর চেনে না। উইঙ্কল ঘুমিয়ে বিশ বছর কাটিয়েছিলেন আমি না ঘুমিয়ে তিন বছর কাটিয়েছি এবং নিজের সমাজ ও স্বদেশের বিপুল পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসাতে পারি নি।ফলে সবকিছুই আমার কাছে অপরিচিত ঠেকছে। এই অপরিচয়ের দুর্বোধ্য অবজ্ঞার মুখোমুখি হয়ে আমার সজল কন্ঠে আজ একমাত্র নীরব গানঃ ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু।’
আমি যে সমাজকে চিনি, সে সমাজ আর নেই। যে স্বদেশকে চিনি সে স্বদেশ আর নেই। যে সংস্কৃতি ও রুচির মধ্যে আমার বিশ্বাসের সহজ শ্বাস প্রক্রিয়া, তাও আজ আর নেই। এখন আমার চারদিকে অবিশ্বাস ও অপরিচয়ের দেয়াল। অস্ত্রের দেয়াল। মৃত্যুর দেয়াল। মূঢ় ক্ষমা ও যুক্তিহীন শত্রুতার দেয়াল। এই দেয়ালে মাথা খুড়ি, এমন শক্তি, এমন তারুণ্য আমার নেই। আমি শুধু পারি দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে নিজের ভাঙ্গা কন্ঠ মেলাতেঃ ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু।
যুক্তি যতদিন ছিলে ততদিন কলম চালিয়েছি। কিন্তু অস্ত্রের সঙ্গে লড়তে জানি না। প্রজ্ঞা যতদিন ছিলে ততদিন তর্ক চালিয়েছি। কিন্তু মূঢ়তার সঙ্গে যুঝতে জানি না। বহুভেদ যতদিন ছিল, ততদিন বাহুতে বাহু মিলিয়েছি। কিন্তু বাহুবল দেখাতে জানি না। এই পরিবর্তন ভালো কী মন্দ তাও আমি জানি না। আমি শুধু জানি, এক অপরিচয়ের দুর্ভেদ্য দেয়াল আমাকে স্বদেশ ও স্বকালের সঙ্গে ক্রমশঃ আড়াল করে ফেলেছে। এখনকার তারুণ্যের ভাষা আমি জানি না। যুবশক্তির অভিষেকেও আমি তাই রবাহুত। আমন্ত্রিত নই।আজ আমার শুধু প্রার্থনা, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু।’
যে পরিবর্তন এসেছে অথবা আসছে, তাকে মানতে না পারি, কিন্তু তার মঙ্গল কামনা করি। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলি, দুখের তিমিরে যদি জ্বলে তবে মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক। আমরা মিথ্যা হই, ব্যর্থ হই— কিছুই যায় আসে না। দেশ সত্য হোক। জাতি সত্য হোক। দশ বছর আগে একদিন সাহিত্যের অঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। আজ যদি পত্রিকা সম্পাদনা বা সাংবাদিকতার ‘আকঢ় ভনিতাময়’ জীবন থেকে অকস্মাৎ বিদায় নেই, তাহলেও দেশ ও জাতির কোন ক্ষতি নেই। একদিন আশা ছিল—
‘সুচির সঞ্চিত আশা
সম্মুখে করিয়া উদঘাটন
জীবনের অক্ষমতা
কাঁদিয়া করিব নিবেদন।
মাগিব অনন্ত ক্ষমা—‘
দুঃখ রইল, তা আর হল না। ক্লান্তি, জীবনের চারদিকে এখন ক্লান্তির দেয়াল। এই দেয়াল ভেদ করি এমন শক্তি ও সাহস কোনোটাই আমার নেই। এটা যদি পলায়নবাদীর ভূমিকা হয়, তাই হোক।
তবে সংগ্রামের ভূমিকা যে নয় তা আমি জানি। আরো জানি, কোনো সংগ্রামীর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের এই গান মানায় না—‘ ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু।’
ক্ষমা শুধু প্রভুর কাছে নয়, ক্ষমা চাই দুঃখিনী স্বদেশ ও নিরানন্দ স্বজআতির কাছে। শুধু মনে মনে বলি, এই সর্বমঅয় গ্রাম্যতা ও যুক্তিহীন বিকারের কাছে আমার ক্লান্তি যেন আশ্রয় না খোঁজে। প্রচু তুমি আমার ক্লান্তি ক্ষমা কর। ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু।
(জনপদের সৌজন্যে)