DON OF DHAKA UNIVERSITY পাচপাত্তুর (1964-68)
ছাত্র রাজনীতির নোংরা রূপটির উদ্ভব হয়েছিল ১৯৫৮ সালে পাকিস্থানে সামরিক শাসন শুরু হলে। ঐ সময় দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল ছাত্রদের দমিয়ে রাখতেই তৈরী করা হয়েছিল সরকারের অনুগত ছাত্র নামের গুন্ডাবাহিনী। তবে এর আগে এ রকমের দখল পাল্টা দখলের রাজনীতি ছিলনা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলেও ছাত্র রাজনীতিতে সংঘাত সৃষ্টি হয়নি। মুসলিম লীগের সমর্থক তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের যারা শাহ আজিজ গ্রুপ নামে পরিচিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস গুলোতে থাকতেন। আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগ তাদের কখনও উৎখাত করার চেষ্টা করেনি।
তবে সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পরই ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে কোন্দল সংঘাত ও দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। আইয়ুব খানের গভর্নর মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতা ও গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে গঠিত হয় এনএসএফ বা ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন নামক ছাত্র সংগঠন। এদের দৌরাত্ম্য, গুন্ডামি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমেই শুরু হয় ছাত্র রাজনীতির কলংক।ওদের ক্যাডার বাহিনী বিরোধী ছাত্রদের মারধর করত, তাদের হল থেকে বের করে দিত, চাঁদাবাজি করত, বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাকায় মদ খেয়ে মাতলামি করত, এমনকি বাইরে থেকে সিনেমা জগতের এক উপনায়িকা পতিতাদের এনে আনন্দ-ফুর্তি করত। তবে তারা সবচেয়ে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করে শিক্ষক প্রহারের মাধ্যমে।
ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইদুর রহমান ‘পাচপাত্তু’ (বাড়ি বরিশাল) জমির আলী ও মাহবুবুর রহমান খোকা নামে মোনায়েম খানের অনুগ্রহভাজন তিন’জন শীর্ষ ক্যাডার ছাত্রনেতার উত্থান হয়। ফজলুল হক হলে পাচপাত্তুর থাকত। খোকা থাকত ঢাকা হলে (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল)। এই এনএসএফ-এর নেতা জমির আলী, খোকা, পাচপাত্তু আরও ২ জন আবু, জাহাঙ্গির, প্রমুখ গলায় সাপ ও কোমরে চাইনিজ কুড়াল ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসে টহল দেয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসের রাজনীতির সূচনা করে। বখাটে ছাত্র পাচপাত্তুর। এটি তার আসল নাম নয়, ছাত্রদের দেয়া নাম। সবাই তাকে এ নামেই চিনত, ডাকত। পাচপাত্তুই ছাত্র রাজনীতিতে হত্যার রাজনীতির প্রবর্তন করে।তবে গণতন্ত্রকামী ছাত্রনেতারা তখন এ ধরনের কলুষিত রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
এই মহাক্যাডার ‘পাচপাত্তুর’ হলো কিভাবে? ‘সে ছিল পড়াশোনায় অমনোযোগী। তাই পরীক্ষায় ফেল করায় প্রমোশন পায়নি। ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। তার সমসাময়িক ছাত্ররা যখন এমএসসি পার্ট টু-এর ছাত্র, সে তখনো পাস কোর্সেই আছে। কিন্তু সে বলে বেড়াত যে, সে এমএসসি পার্ট টু-এর ছাত্র। এ অবস্থায় বন্ধুরা ঠাট্টা করে নাম রেখেছিল পাচপাত্তুর (অর্থাৎ ডিগ্রি পাস থেকে পাস এমএসসি পার্ট টু থেকে পার্ট টু অর্থাৎ পাস পার্টটু, পাসপার্টটু থেকে পাচপাত্তুর নাম হয়)।’ প্রসঙ্গক্রমে স্মর্তব্য, আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ।১৯৬৮ সালের অক্টোবরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সংঘটিত এক ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে পাসপার্তু ছাত্রলীগের জঙ্গি কর্মীদের হাতে নিহত হন।পাচপাত্তু এবং এনএসএফ এর পাণ্ডারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ফিস্ট বা ভোজের গন্ধ পেলেই সেখানে গিয়ে হাজির হতো। সেদিন ছিল সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ফিস্ট। প্রতিবারের মত ফিস্ট শেষে পাচপাত্তু সাঙ্গপাঙ্গ সহ বন্ধুর রুমে বসে ড্রিঙ্ক করা শুরু করলো। সেই ঘরে হুর হুর করে ঢুকে পড়লো কয়েকজন লীগ ক্যাডার। এদের প্রধান অস্র হলো পিস্তল। সঙ্গীদের প্রত্যেকের হাতে একেকটি করে ধারালো ড্যাগার। পাচপাত্তু এবং ওর সাঙ্গপাঙ্গরা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পাচপাত্তুকে উদ্দেশ্য করে এক লীগ ক্যাডার বললো, জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের অনেক অত্যাচার করেছিস ও লাঞ্ছনা দিয়েছিস, এখন বল তোর মৃত্যুটা কীভাবে চাস?
লীগ ক্যাডার এর কথা শেষ হওয়ার আগেই সঙ্গীদের একজন পাচপাত্তুর তলপেটের একদিক হতে অন্যদিকে ড্যাগার চালায়। আরেক সঙ্গী বুকে চালায় ছুরি। সঙ্গে সঙ্গে পাচপাত্তুর রক্তাত্ত দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ওর সাথের অন্যান্য পাণ্ডারা এদিক ওদিক লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। লীগ ক্যাডার টি পাচপাত্তুর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সঙ্গীদের নিয়ে সলিমুল্লা হল ত্যাগ করে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তাররা পাচপাত্তুর মৃত্যু নিশ্চিত করে।
পাচপাত্তুর মৃতুর সংবাদ তড়িৎগতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই মুহূর্ত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আনন্দে নাচে গানে ভরপুর হয়ে ওঠে। পাচপাত্তুর মৃত্যুই সূচনা করে উণসত্তরের গণ আন্দোলোন। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা নারায়নগঞ্জের পতিতালয় থেকে খোকাকে ধরে আনে। রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে রেসকোর্স মাঠের মাঝখানে ফেলে রাখে। এনএসএফ এর গুণ্ডাদের অত্যাচারে লোকজন এতোই অতিষ্ট ছিল যে, তাঁদের রাজত্বের তিন বছর পর খোকার মৃতদেহটি স্পর্শ করতে মেথররা পর্যন্ত অস্বীকার করে। পরে অযত্নে পড়ে থাকা মৃতদেহটি পাশুপাখিদের খাদ্যে পরিণত হয়।