You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই আগস্ট, বুধবার, ২৮শে শ্রাবণ, ১৩৮১

বন্যা দুর্গত মানুষ ও বিদেশি সাহায্য

দেশে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে তাতে এ পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে এবং আরো হবে। এই ব্যাপক ক্ষতির মোকাবিলা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও দ্রব্যের প্রয়োজন তা শুধু দেশীয় সম্পদ দিয়ে সম্ভব নয়। এজন্য বিদেশি সাহায্যের দরকার রয়েছে। বিশ্বের বন্ধু দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়াই মারাত্মক দুরবস্থায় কাটিয়ে উঠতে আমাদের বহু সময় লাগবে। সে কারণে বৈদেশিক সাহায্য চেয়ে আমাদের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। বেশ কিছু সংখ্যক দেশ ও সেবা সংস্থা ইতিমধ্যেই সে আবেদনে সাড়া দিয়েছে। গত মাসের শেষে ৩০টি দেশের প্রতিনিধি হেলিকপ্টারে চড়ে বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বন্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। এদিকে গত ২রা আগষ্ট আন্তর্জাতিক রেডক্রস লীগের প্রতিনিধি মিঃ অ্যাডামস সরেজমিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অবলোকন করে বলেছিলেন- ‘আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া এমন একটি বিরাট জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা করা একটি জাতীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ এরপর বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সহানুভূতিসূচক বাণী প্রেরণ করা হয়েছে এবং স্বল্প হলেও কিছু কিছু দেশের সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে। এ পর্যন্ত যে সকল দেশ সাহায্যদানের কথা ঘোষণা করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে- ব্রিটেন, আফগানিস্তান, ভারত, জাপান, পূর্ব জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, কুয়েত প্রভৃতি দেশ। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি থেকে গত পরশুদিন তিন হাজার মেট্রিক টন ও মেট্রিক টন ভেষজ তেল জরুরি সাহায্য হিসেবে প্রদান করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখিত পরিমাণ গম ও ভেষজ তেলের মূল্য হবে দশ লক্ষ ডলার। এতে করে দেশের ৮৩ হাজার বন্যাদুর্গত মানুষকে তিনমাস রিলিফ দেওয়া সম্ভব হবে। এই খাদ্যসাহায্য ছাড়াও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বাংলাদেশ ১৫ লক্ষ মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করে দেবার কথাও ঘোষণা করেছে। আশা করা যাচ্ছে, দেশের এই অসহায় মানবাত্মার পাশে বিশ্বের আরো অনেক বন্ধুদেশ অনতিবিলম্বে এসে দাঁড়াবে। বস্তুত বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে আন্দাজ করা যায়, বন্যার কারণে যে ক্ষতি সাধিত হবে তা মোকাবেলা করতে দেশের আর্থিক মেরুদন্ড অনিবার্য ভাবে ভেঙ্গে পড়বে। এইভাবে দুঃসহ অবস্থা থেকে কিছুটা রেহাই পাবার জন্য তাই প্রয়োজন বৈদেশিক সাহায্য। যে কোন জাতির এ ধরনের দুর্যোগের সময় বন্ধু দেশ সমূহ অবশ্যই এগিয়ে এসে থাকে। জাতি হিসেবে এটা একটা নৈতিক কাজ ও বটে। বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিকামী স্বাধীনতা সংগ্রামেরত দেশের মানুষের সাহায্য-সমর্থনের ব্যাপারে আমাদের ও ক্ষমতার মধ্যে একটা কর্তব্য রয়ে গেছে। সে কর্তব্য পালনে বাংলাদেশ সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বিদেশের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, ‘বাংলাদেশ যেহেতু দুনিয়ার সহানুভূতিও সমবেদনার মধ্যে জন্মলাভ করেছে সেহেতু তারা মনে করে বাংলাদেশকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখা ও দুনিয়ার দায়িত্ব।’ মূলত এ ধরনের উক্তি করার পূর্বে তাদের জানা দরকার ছিল যে বাংলাদেশে কারো সাহায্য ও সহানুভূতি পাবে-এ আশা করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করে নি। যাদের কাছে এই সংগ্রামকে ন্যায়তঃ বলে মনে হয়েছে তারাই সেদিন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কারো দয়ায় কোন জাতি স্বাধীন হয় না আর হলে সে স্বাধীনতার স্থায়িত্বও লাভ করে না। বাংলাদেশের মানুষ এটা জানে। আমাদের আজকের এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের কাছে এ জন্য আবেদন জানাবো যে, প্রাকৃতিক কারণে দেশে যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং বন্যার পরে আরো যে সকল সম্ভাব্য ক্ষতি সাধিত হবে-তাকে রোধ করার জন্য এবং সম্ভাব্য জীবনহানি থেকে অসহায় মানুষকে বাঁচানোর জন্য আপনারা এগিয়ে আসুন। মনুষ্যত্বের এই নিদারুণ অবস্থাতে আপনারা বাস্তব সহানুভূতি জ্ঞাপন করুন। বিত্তবান দেশের প্রতি আমাদের বিশ্বাস রয়েছে-তারা পূর্বের ন্যায় অসহায় মানুষের সেবায় এগিয়ে আসবেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

দুষ্কৃতিকারীদের উৎপাত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদন একই দিনে প্রায় দশ জায়গায় অপরাধমূলক কাজের তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন রংপুরে হরঘাটের জনতা ব্যাংক শাখা ব্যাংক লুটের প্রয়াস, ফরিদপুরের পুলিশ স্টেশন এর অন্তর্গত চিকন্দিতে দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময়, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীর গুলিতে থানা আওয়ামীলীগ সেক্রেটারী জনাব আব্দুর রশিদ নিহত এবং মাদারীপুরে জাঞ্জিরা পুলিশ স্টেশন এর অধীনে প্রকাশিত করে হত্যা করা হয়েছে, কুমিল্লায় দুই ব্যক্তির দুষ্কৃতকারীর বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন, যশোরের সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীর গুলির শিকার হয়ে তিনজন মর্মান্তিক মৃত্যুবরন করেছেন এবং আশ্চর্যের কথা, রাজধানীর রিলিফ ক্যাম্পেও দুষ্কৃতিকারীরা জঘন্য হামলা চালিয়েছে।
দেশ যখন ভয়াল বন্যার কবলে আক্রান্ত কোটি কোটি লোকের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার আহাজারিতে দেশের আভ্যন্তরীণ আবহাওয়ায় যখন বেদনা-ভারাক্রান্ত-তখন দুস্কৃতিকারীরা তৎপরতা চালিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থার আরো ঘোলাটে ও অসহনীয় করে তুলছে। আর্ত অভিহিত মানবতার ত্রাণ ও পুনর্বাসন এর কাজে যখন সরকারের সম্ভাব্য সকল শক্তি নিয়োজিত, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত হচ্ছে এবং বিশ্ব বিবেকের প্রতি আরও ব্যাপক সাহায্যের জন্য মানবতার দোহাই দিয়ে আবেদন জানানো হচ্ছে, ঠিক তখনকার এই মুহূর্তে দুষ্কৃতিকারীদের করার প্রবণতা দেখে আমরা আতঙ্কিত না হয়ে পারছি না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দেশে কয়েক মাস যাবত যৌথ অভিযান শুরু হলে বিভিন্ন প্রকার সমাজ বিরোধী অভিযানে যথেষ্ট ভাটা পড়ে। যৌথ অভিযানে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করাও হয়। তাসত্ত্বেও দুস্কৃতিকারীরা অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় হামলা চালাতে পারছে কেমন করে এ একটা প্রশ্নও বটে! সবচেয়ে বড় কথা যৌথ অভিযান এখনো বলবত আছে। এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রকার সমাজবিরোধীদের উৎখাত করার কাজে আইনতঃ নিয়োজিত রয়েছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। তাই দেশ কাল পাত্রভেদে বা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে অথবা দলমতকে গৌণ ভেবে শুধুমাত্র মানবতার দাবিতে আজ আমরা সোচ্চার কণ্ঠে সমাজের কাছে সাহায্য কামনা করছি। এই অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে দুষ্কর্ম চলতে থাকলে আমাদের মান-মর্যাদা, মূল্যবোধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বহির্বিশ্ব খুব সহজেই ভুল বুঝতে পারে মাত্র মুষ্টিমেয় কতগুলি লোক সমাজ বিরোধী কাজের জন্য সমগ্র দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাস এমনভাবে কলঙ্কিত হতে থাকবে। এ কারুরেই কাম্য নয়। তা বরদাস্ত করাও যায় না।
একথা সত্য যে, হতাশা ও দুর্দশা মানুষকে বিকারগ্রস্ত করে তোলে। কিন্তু তাই বলে সেবিকার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্ষতের সৃষ্টি করবে তেমন সুযোগ তারা যাতে না পায় সে ব্যাপারে সুস্থ মানুষকে সচেতন থাকতেই হবে। আর ন্যায়ের অমৃত বাণী সহ বিচারের কন্ঠের দন্ড যেন তাদের জন্য প্রস্তুত থাকে-সেদিকেও সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ রাখা বাঞ্ছনীয়। কারণ চিরকালই মানবতার শত্রুরা দণ্ডিত হয়। ক্ষমা সেখানে ক্ষীণ দুর্বলতা। তবে দুষ্কৃতী দমনের তৎপরতা শুধু যে, সংশ্লিষ্ট মহল বা যৌথ অভিযান কারীদেরকেই একচেটিয়াভাবে করতে হবে এমন কথাও নয়। এব্যাপারে সাধারন মানুষ সহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর একনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ দেশের সার্বিক পরিস্থিতির স্থিতাবস্থা দেশবাসী সকলের জন্যই কল্যাণকর। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষকে সেই সার কথাটা বুঝতে হবে আজকে। বিশেষ করে দুর্যোগের দিনগুলো যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দেশটা বাসের অযোগ্য না হয়ে দাঁড়ায় সে-দিকেও সকলের লক্ষ্য রাখতে হবে এবং মানবতার এত বড় দুর্যোগ যারা বেপরোয়াভাবে অমানবিক ও নৃশংস কাজের দৃষ্টান্ত রাখছে তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। না হলে ইতিহাসের অমোঘ আবর্ত আমাদের ক্ষমা করবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!