বেগম মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
বেগম মুজিবুর রহমান একজন স্মরণীয় এবং শ্রদ্ধেয়া মহিলা। অত্যন্ত বিনয়ী এবং সমপূর্ণা এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎকার বিস্মৃত হবার নয়। গত আট মাস ব্যাপী তার উপর দিয়ে যে দুঃখজনক ঝড় প্রবাহিত হয়েছে। তার ভয়াবহ স্মৃতি সত্ত্বেও তিনি অবিচলিতভাবে তার সকল কাহিনি আমাদের বলেছেন। এই ক-মাস তার সঙ্গে ছিল ছ বছরের কনিষ্ঠ পুত্র রাসেল এবং দুই কন্যা। তার অপর দুই পুত্র অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। সেই পুত্রদ্বয় কোথায়, কেমনভাবে রয়েছে, বেগম রহমানের তাও জানা ছিল না। বলা বাহুল্য, টিক্কা খান তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করার পর, শেখ সাহেব সম্পর্কে কোন খবর তিনি বা আর কেউ কিছুমাত্র জানতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, তার বা তার পরিবার বর্গের খবরাখবর কেউই নিতে পারেননি। উপযুক্ত খাদ্য বা পানীয় পর্যন্ত তাঁদের জোটেনি, সমস্ত রাত্রি কেটেছে মাটিতে শুয়ে। তবু কী অসীম তার স্থৈর্য, তিনি অসমসাহসিকা।
বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক সার্বিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বেগম লুৎফউন্নিসা রহমান জানান। যে, তিনি রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী নন। তিনি একজন গৃহবধু, শেখ সাহেব এবং পুত্রকন্যাদের দেখাশােনা তিনিই করে এসেছেন। তবে এইটুকু তার পক্ষে বলা সম্ভব যে, প্রভূত মূল্যের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন স্বাথক হয়েছে।
বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মতন শেখের মুক্তির জন্যে তারও আগ্রহ ছিল অপরিসীম।
বেগম রহমান কনিষ্ঠ পুত্রকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন যে, এমন কি সেপর্যন্ত সমস্ত রাত্রি জেগে কাটাতাে। পাকফৌজের বর্বর হত্যা আর অত্যাচার তাকে পর্যন্ত শিহরিত করেছিল। ১৭ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় বাহিনীর মেজর অশােক তারা তাকে মুক্ত করলেন তার আগে পর্যন্ত দখলদার ফৌজ তাঁর দিন এবং রাত্রির শান্তি কেড়ে নিয়েছে।
বেগম মুজিব বললেন, ভারতবর্ষের মানুষ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতার ভাষা তার জানা নেই। তিনি জানালেন যে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছাড়া ভারতবর্ষে যেতে পারবেন না।
সােভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তার মনােভাব কি, একথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তাঁর মতে, সােভিয়েত ইউনিয়নই সেই দ্বিতীয় রাষ্ট্র … ভারতবর্ষের পরেই ন্যায়নীতি এবং স্বাধীনতার পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল । তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন এরপর সােভিয়েত ইউনিয়ন … ভারতই শেখ সাহেবের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
কলকাতা এবং ভারতের অন্যান্য জনগণের স্লোগান, ইন্দিরা মুজিব ভাইবােন’ এর কথা জানানাের পর বেগম রহমান আর অঞসংবরণ করতে পারলেন না।
ভারতের জনগণকে তিনি জানালেন শুভেচ্ছা—সে শুভেচ্ছা তাঁর নিজের তাে বটেই, সমগ্র বাঙালি জাতিরও। আবার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি তার বাসভবনে, শেখ সাহেবের মুক্তির পর আবার আসছে। বললেন সকলকে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২