You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানী আর্মির বগুড়া শহর আক্রমণ - কিছু ঘটনা - সংগ্রামের নোটবুক
এপ্রিলে পাক বাহিনী রংপুর, শান্তাহার, শেরপুর – এই তিন দিক থেকে বগুড়া শহর আক্রমণ করে। তা ছাড়া বিমান থেকেও পাক বাহিনী বগুড়া শহরের উপর আক্রমণ করে। ঐ সময় শহরের লোকজন জীবনের ভয়ে কোন দিকে দৌড়াতে না পেরে পুর্বদিকে মুক্ত দেখে নদী সাঁতরিয়ে চেলোপাড়ার দিক রওয়ানা হয়। পাক বাহিনী আক্রমণ করার সাথে সাথে সমস্ত শহর ঘেরাও করে ফেলে। কাজেই জনসাধারণ পালানোর সুযোগ পায় না। পাক বাহিনীর গুলির মুখে অসংখ্য লোকজন প্রাণ হারায়। আমি নিজের বাড়ী ছেড়ে চেলোপাড়ার দিকে রওয়ানা হই। চেলোপাড়ায় যাবার সময় আমি যে দৃশ্য দেখেছি ইতিহাসে তার নজির বিরল। চার থেকে পাঁচ শতের মত লোক মৃত অবস্থায় রক্তের মধ্যে ডুবে আছে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় তাদের মৃতদেহ পড়ে আছে। আর কুকুরেরা তাদের রক্ত পান করছে। পালিয়ে যাবার কোন উপায় ছিল না আমার। আমার মাথায় একটি টুপি ও হাতে একটি পাকিস্তানী পতাকা ছিল। আরও একজন মৌলভী এবং দুইজন লোক আমার সঙ্গে ছিল। তাদেরও মাথায় টুপি এবং হাতে পাকিস্তানী পতাকা ছিল। হঠাৎ করে একদল পাকসেনা আমাদের দেখে ঘিরে ফেলে। পাক বর্বর বাহিনী জিজ্ঞাসা করে তোমার কে? অবশ্য উর্দূতে।
 
জবাবে আমি বলি যে আমরা পাকিস্তানী বাঙ্গালী মুসলমান। তখন পাকসেনা কিছু সময় পর আমাদেরকে ছেড়ে দেয় এবং বলে যে তোমরা আগামিকাল সকাল ৮ টার পর আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। কারন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর আটটা পর্যন্ত কার্ফিউ থাকবে। পাকবাহিনীর কার্ফিউ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সকাল ৮ টার পর জনসাধারণকে একত্রে একযোগে হত্যা করে। আমি সেটা বুঝতে না পেরে পরের দিন আবার বাসাবাড়ী দেখার জন্য শহরের দিকে রওয়ানা হই। আসার সময় অন্য তিনজন লোক আমার সাথে ছিল। ঐ সময় কয়েকজন পাঞ্জাবী আমাদের ধরে ফেলে। ধরার পরপরই একত্রে লাইন করে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। গুলি করার সাথে সাথে দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অপর একজন বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় গর্তের ভিতরে পড়ে যায়। একজন পাঞ্জাবী এসে বেয়োনেট দিয়ে তার বুকটা চিরে দেয়। আমি সৌভাগ্যবশত গুলি না খেয়ে রক্তের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। একজন পাঞ্জাবী আমাকে পুনরায় দাঁড় করে পরপর দুই বার গুলি করে। প্রথম গুলিটি ফায়ার না হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার গুলি করে। ভাগ্যবশত গুলিটি আমার বাম পার্শ্বে দিয়ে চলে যায়। পাকসেনা কি যেন মনে করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে যে তোর হেঁয়াছে ভাগ যাও বাঙ্গালী। তখন আমি নিজের বাসার দিকে রওয়ানা হই। বাসায় আসার সময় আমি দেখতে পাই শুধু মানুষের মৃতদেহ। শহরের সমস্ত রাস্তা যেন রক্তে লাল হয়ে আছে। কুকুর তাদের মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে। আমি দেখতে পেলাম যে প্রথম দিনে খান দস্যুরা যে সমস্ত লোকজন হত্যা করেছিল সেগুলোকে শহরের রাস্তার পার্শ্বে গর্ত করে ৭-৮ জন করে পুঁতে রেখেছে। তাঁদের কারো হাত বা মাথা দেখা যাচ্ছে। কুকুরেরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে এই বীভৎস ও করুণ দৃশ্য দেখে চোখের পানি মুছতে আমার শিব্বাটী বাসভবনে উপস্থিত হই। বাসায় গিয়ে দেখতে পেলাম যে, একজন মেয়র ও তিনজন বেলুচী সৈন্য আমার নিজস্ব ক্যাম্প খাটটি পেতে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে তারা রাইফেল নিয়ে দাঁড়ায়। আমি বকি যে, আমি পাকিস্তানী বাঙ্গালী মুসলমান। এটা আমার বাসা এবং বাসাবাড়ী দেখতেই আমি এসেছি। তখন তারা আমাকে বলে যে এটা তোমার বাসা? তোমার খুব সাহস? এই বলে আমাকে বসতে বলে এবং মাংস ও রুটি খেতে দেয়। তা ছাড়া আমাকে বলে যে তোমার কোন ভয় নাই। রাত্রিতে তুমি তোমার ঘরে শুয়ে থাকবে। আমি কোন রকমে প্রথম রাত্রি অতিবাহিত করি। এখানে উল্লেখ করা হয় যে, পাক সেনা শহরে ঢুকেই অবাঙ্গালীদেরকে ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছিল; বাঙ্গালীদের ধন- দৌলত লুট করার জন্য। পরের দিন সকালে খান সেনারা আমাকে সংগে করে শহরে চলে আসে। খানসেনারা আমাকে লুট করার কথা বলে। তখন আমি বলি যে, আমি লুট করব না বা আমার কোন প্রয়োজন নাই। এইভাবে তিনদিন কেটে গেল। খান সেনার চার জনের মধ্যে একজন ছিল মেজর জাকি। ৪র্থ দিনে তারা আমার বাসা ছেড়ে দিয়ে রংপুর চলে যায়। পুনরায় মেজর শাকিরিয়া আমার বাসায় চলে আসে। এসে আমাকে বকে যে, তুমি এখান থেকে চলে যাও। এই বলে আমাকে সাথে করে সার্কিট হাউসে নিয়ে আসে। সেখানে গিয়ে আমি দেখতে পেলাম, রাজশাহী ভার্সিটি থেকে ধরে আনা কয়েকজন ছাত্রী। তারা বসে বসে কাঁদছে। পাক হায়েনারা তাদের উপর অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার করে । তাদের সারা দেহে ধর্ষনের চিহ্ন বিদ্যমান। ঐ দৃশ্য দেখে আমি মর্মাহত ও অতিভূত হয়ে পড়ি। দুই ঘন্টা পর মেজর শাকিরি আমার নিজের বাসায় ফিরে যাবার অনুমতি দেয়। কোন রকমে আমি নিজের বাসায় ফিরে আসি। এরপরেও মাঝে মাঝে খান সেনারা আমার বাসায় এসে তদন্ত চালায় এবং বলে যে তুমি মুক্তিফৌজকা লিডার বা মুক্তিদের সর্বরকমের সাহায্য কর। আমি সম্পূর্ন অস্বীকার করলে আমাকে দারুণ নির্যাতন ও প্রহার করে । দিনে-রাতে সব সময় আমার বাসায় এসে খান দস্যুরা অমানুষিক অত্যাচার করত। আমার দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল বলে খান সেনারা সব সময় দুই ছেলেকে খুঁজে বেড়াত । এরপর আমার বাসায় একটানা এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত অতিবাহিত করি। ১৪ ই সেপ্টেম্বর তারিখে নিজ ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এরপর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বগুড়া শহর মুক্ত হয়ে যায়। বগুড়া শহর ও বাংলাদেশের জয়ের পতাকা উত্তোলিত হয়।
 
স্বাক্ষর/-
এলাহী বক্স
ফিরোজা হাউস
শিব্বাটা, বগুড়া