You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৮১

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১। এদিন রাত বারােটা এক মিনিট থেকে রাত ৩টার মধ্যে কুমিলা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও যশাের কারাগারে একে একে ফাসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন বারােজন বীর মুক্তিযােদ্ধা সামরিক অফিসার। দু’বছর পর ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে একই কারণে বীর মুক্তিযােদ্ধা লে. কর্নেল ফজলে হােসেন ফাসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ তাে বটেই উপমহাদেশের আর কোথাও কোনাে একটি ঘটনায় একসঙ্গে এতজন সামরিক অফিসারের ফাসির ঘটনা আর ঘটেনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই ফাসির ঘটনাটিই সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘটিত সর্বশেষ ফাঁসি।  তেরজন মুক্তিযােদ্ধা সামরিক অফিসারের ফাসির ঘটনাটি জানতে আমাদেরকে সে সময় থেকে আরাে চার মাস পেছনে ফিরে যেতে হবে। ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে মৃত্যুবরণ করেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। নিহত হন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ােজিত লে, কর্নেল আহসান, ক্যাপ্টেন হাফিজসহ কয়েকজন। এর তিনদিন পর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কথিত নায়ক মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম সেনা হেফাজতের মধ্যে নিহত হন। নিহত হন অভ্যুত্থানের দু’জন অফিসার মঞ্জুরের ভাগ্নে লে. কর্নেল মাহববুর রহমান বীর উত্তম ও লে. কর্নেল মতিউর রহমান বীর বিক্রম। | চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের রেশ ধরেই চট্টগ্রাম কারাগারের অভ্যন্তরে এক সুকঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ৩১ জনকে অভিযুক্ত করে চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলা’ নামে একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্টমার্শাল গঠন করা হয়। কোর্ট মার্শালের প্রেসিডেন্ট হন মেজর জেনারেল আবদুর রহমান পিএসসি। (স্ক্রিনে জেনারেল আবদুর রহমানের ছবি দেখিয়ে বলা হবে- মেজর জেনারেল আবদুর রহমান পরবর্তীকালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সে সময়ে তার পরিবার অভিযােগ করেছিল তাকে বিষপ্রয়ােগে হত্যা করা হয়েছে। জীবিত না থাকায় এ ডকুমেন্টারিতে তার কোনাে বক্তব্য সংযুক্ত করা যায়নি)

১০ জুলাই শুরু হয়ে মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে ২৮ জুলাই কোর্ট মার্শালটি শেষ করা হয় । ১১ আগস্ট ঘােষণা করা হয় কোর্ট মার্শালের রায় । রায়ে বারােজনকে ফাসি,

দশজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ ও বাকিদের মুক্তি দেয়া হয়। এই কোর্ট মার্শালের রায়ের বিরুদ্ধে ৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর রিট প্রত্যাখ্যান করা হয় । ঐদিনই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু করে ২২ সেপ্টেম্বর আপিল প্রত্যাখ্যান করে। ঐদিনই ২২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে কার্যকর করে ফেলা হয় বারোজন মুক্তিযােদ্ধার ফাসি। চট্টগ্রামের এই কোর্ট মার্শাল নিয়ে সে সময়ই প্রহসনের অভিযােগ উঠেছিল। অভিযােগ ছিল মূল অনেক নায়ক ও সহযােগীদের রক্ষার জন্যই এই বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ সারাদেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলাে এই বিচার নিয়ে প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাড়াহুড়াে করে গােপনেই বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তেরজন মুক্তিযােদ্ধা সামরিক অফিসারকে। সে সময়ে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন১. ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, পিএসসি ২. কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন ৩. কর্নেল আবদুর রশিদ বীর প্রতীক, পিএসসি ৪. লে. কর্নেল আবু ইউসুফ মােহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম বার ৫, লে. কর্নেল দেলাওয়ার হােসেন বীর প্রতীক পি এস সি ৬, লে. কর্নেল ফজলে হােসেন ৭. মেজর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ ৮. মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া বীর প্রতীক ৯, মেজর কাজী মমিনুল হক ১০. মেজর মুজিবুর রহমান ১১. ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার ১২. ক্যাপ্টেন জামিল হক ১৩. লে. রফিকুল হাসান খান।

চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলা ‘৮১

অভিযুক্তদের গ্রেফতার : ১ জুন থেকে ৩ জুন ১৯৮১ কোর্ট মার্শাল শুরু : ১০ জুলাই ১৯৮১, চট্টগ্রাম কারাগার প্রেসিডেন্ট : মেজর জেনারেল আবদুর রহমান, পিএসসি কোর্ট মার্শাল শেষ : ২৮ জুলাই ১৯৮১ অভিযুক্তদের জেলে প্রেরণ : ২৮ জুলাই ১৯৮১ রায় ঘােষণা : ১১ আগস্ট ১৯৮১ হাইকোর্টে রিট : ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ রিট প্রত্যাখ্যান : ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সুপ্রিমকোর্টে আপিল : ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সুপ্রিমকোর্টে শুনানি শুরু :১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ আপিল প্রত্যাখ্যান : ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১

রাত বারােটা এক মিনিট থেকে রাত তিনটা সর্বমােট কোর্ট মার্শাল ১৮ দিন

ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, পিএসসি বিএ- ১৮৫ ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, পিএসসি।

জন্ম : ২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯

জন্মস্থান : দামলা, বিক্রমপুর

বাবা : মহিউদ্দীন আহমেদ সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৬৩

কমিশন : ১৯৬৪ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ৩য় ইস্টবেঙ্গল সেকেন্ড ইন কমান্ড “জেড ফোর্স” যুদ্ধে খেতাব : বীর বিক্রম বিবাহ : ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সন্তান : ১ ছেলে ২ মেয়ে সর্বশেষ অবস্থান : কমান্ডার, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, রাজশাহী কারাগার

রাত ২.৩০ মি: কবর : বনানী, ঢাকা। ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দীন আহমেদ ২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার ঐতিহাসিক লস্কর পরাগল খাঁ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগােলে এমএ পড়াবস্থায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ‘৬৪ সালে কমিশন পেয়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম প্রহরেই ২৬ মার্চ মহসীন চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল সেন্টারের এডজুটেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল-এর সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং জেড ফোর্সে মহসীন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য মহসীন ‘বীর। বিক্রম’ খেতাব লাভ করেন। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর হত্যাকাণ্ডের সময় ব্রিগেডিয়ার মহসীন চট্টগ্রামে ৬৯তম পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২ জুন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ‘৮১ সালে রাজশাহী।

কারাগারে রাত আড়াইটায় ফাঁসির মঞ্চে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। ফাসির পর ২৩ সেপ্টেম্বর বনানী কবরস্থানে জাতীয় ও মুক্তিযােদ্ধা সংসদের পতাকায় আচ্ছাদিত করে ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে সমাহিত করা হয় । সমাহিত করার পর মুক্তিযােদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে তাকে সামরিক কায়দায় স্যালুট করা হয়। এ সময় জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল।

জেলখানায় থাকাবস্থায় ব্রিগেডিয়ার মহসীন ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে তার বড় ও ছােট দু’ভাইকে দুটি চিঠি লেখেন।

ছােট ভাইকে লেখা ব্রিগেডিয়ার মহসীনের চিঠি

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ইং

হবু,

আমার দোয়া নিও। জানি না এটাই কি তােমার কাছে শেষ চিঠি লিখা কি না? আল্লার ইচ্ছায় সবই হয়। কাজেই দুঃখ করে লাভ নাই । | তােমার ভাবী, কবিতা, কুতু ও আমার তানিম আন্ধু রইল । তুমি ওদের দেখাশুনা করাে। শুধু ভাই হিসাবে নয়। তুমি একজন মুক্তিযােদ্ধা এবং আমিও একজন মুক্তিযােদ্ধা এই হিসাবে। দশটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি এই সােনার বাংলাদেশের জন্য। আজ দেশ তার পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়েছে মৃত্যুদণ্ড । একদিন এই দেশের মাটি কথা বলবে। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়। | হবু বড় ভাই হিসাবে অনেক সময় তােমাকে গালমন্দ করেছি। যদি কখনও এমন কিছু করে থাকি মাপ করে দিও। আর হয়তাে তােমাকে ভালাে মন্দ কিছু বলতে পারবাে না। তােমার ভাবী ও ছেলে মেয়েদের আবুল বাসার দেখাশুনা করবে। আর বাকি আল্লার ইচ্ছা। আমার বড়ই ইচ্ছা ছিল যে তানিমকে ভালােভাবে মানুষ করে তুলবাে। তা আর বুঝি হলাে না। তােমাকে শেষ একটা কথা বলে যাই। এখান থেকে কোরান শরীফ নিয়ে যেও। কোরান শরীফ ও নামাজ পড়বে। ভবিষ্যতের ও পরকালের পাথেয় হিসাবে। আল্লার নাম করাে তবে জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবে। আমরা সাত ভাই ছিলাম। এখন থেকে তােমরা হবে ছয় ভাই। তােমাদের সেজদা আর গুনার ভিতর থাকবে না। আল্লার ইচ্ছায় সবই হচ্ছে। মহান সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে কোনাে কাজই হচ্ছে AT I so don’t feel sorry. Please do look after your Bhabi and my childrens. All of them are fond of you. I am not sorry for anything except the wrong allegation and witness produced against me. ALLAH THE GREAT knows only what have ! done?

আল্লা তােমার মঙ্গল করুক ভবিষ্যতে উন্নতি কর এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর । এই দোয়াই রইল তােমার জন্য। হবু, আমার ছােট ভাই খােদা হাফেজ।

তােমার সেজদা

বড় ভাইকে লেখা ব্রিগেডিয়ার মহসীনের চিঠি

মেজদা, আমার সালাম নিবেন। কপাল মন্দ হলে কী করা যায়। আল্লার ইচ্ছা এই ছিলাে। মেজদা জানি না আপনার কাছে এটাই আমার শেষ চিঠি কি না? আপনার সঙ্গে কখনও যদি বেয়াদবি করে থাকি আমাকে মাপ করে দিবেন। মেজদা বেবী, কবিতা, কুতু ও আমার তানিম আলু রইল। আপনি ওদের। খোঁজখবর নিবেন। ওদের সবই আমি ছিলাম । আমার অনুপস্থিতিতে ওরা অসহায়। আবুল বাসার ওদের দেখাশুনার ভার নিয়েছে। বাকি আল্লার ইচ্ছা। তানিম আন্ধু একটু বড় হলে ওকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দেখিয়ে আনবেন। আমি তাে আর পারলাম না।

জীবনে অনেক আশা ছিলাে। ছেলেমেয়েদের ভালােভাবে মানুষ করবাে। তা বুঝি আর হলাে না। কবিতা ও কুতু কোরান শরিফ খতম করেছে। কুতু Talent group-এ 4th হয়েছে Comilla Board-এ বৃত্তি পরীক্ষায়। তানিম আন্ধু 1st হতাে। আপনি দেশে ফিরে এলে ওদের খোঁজখবর নিবেন।

আমার মনে কোনো ব্যথা নাই। শুধু এইটুকু ব্যথা রয়ে গেলাে যে মিথ্যা। সাক্ষী ও অপবাদ দিয়ে আমাকে অপমান করা হয়েছে। দশটি বছর যে দেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করলাম তার পুরস্কার হলাে মৃত্যুদণ্ড। পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু বাংলাদেশেই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এই পুরস্কার।

| মেজদা আমাকে আপনি মাপ করে দিবেন। জীবনের অনেক কয়টি বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম। যদি কখনও জান্তে অজান্তে কোনাে বেয়াদবি করে থাকি মাপ করে দিবেন।

আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। এখন থেকে আপনারা হবেন ছয় ভাই। মেজদা খােদা হাফেজ ইতি লেবু

ব্রিগেডিয়ার মহসীনের শেষ চিঠি

বেবী,

আমার শেষ চিঠি তােমার কাছে। রাত্র ১-৩০মি. ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ইং। আর কিছুক্ষণ পরেই আমি পরপারে চলে যাবাে। আল্লার ডাক এসেছে। সময়দিন-তারিখ নির্ধারিত কাজেই আল্লাহ ছাড়া আর কারাে কোনাে শক্তি নাই আমাকে এই পৃথিবীতে বেঁধে রাখতে। তােমরা ভালােভাবে থেকে আমার কবিতা, কুতু ও তানিম আব্বাকে দেখাশুনা করাে। আল্লাহ সত্য। এ সমস্তই উছিলা। আল্লাহ জানেন আমি কী করেছি।

পৃথিবীর লােক তাতে রং দিয়েছে।

আমি তােমাদের জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না। সবাইর কাছে। আমার হয়ে মাফ চেয়ে নিও। মার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করবে।

আল্লাহর হাতে তােমাদের তুলে দিয়ে গেলাম। তিনিই তােমাদের দেখাশুনা করবে।

কবিতা, কুতু ও তানিম আন্ধুরা ভালােভাবে থেকো। নামাজ ও কোরান পড়াে আমার জন্য দোয়া করাে।

বেবী তুমি তােমার আব্বার সাথেই থাকবে। খােদা হাফেজ। বিদায় নিচ্ছি। বিদায় দাও।

মহসীন ২৩/৯/৮১ ব্রাত্র ১টা ৩০মি,

কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন পি.এস.সি বিএ- ২০০ কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন পিএসসি

জন্ম : ২৪ জুলাই ১৯৪৫ জন্মস্থান : মুরাদপুর, কুমিল্লা বাবা : রহিম উদ্দীন সেনাবাহিনীতে যােগদান : অক্টোবর ১৯৬৫ কমিশন : ৮ মে ১৯৬৬ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ৬নং সেক্টরের

“সাহেবগঞ্জ” সাব সেক্টর কমান্ডার | বিবাহ : ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সন্তান : ৪ মেয়ে সর্বশেষ অবস্থান : কমান্ডার, ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, কুমিল্লা কারাগার কবর : মুরাদপুর, কুমিল্লা কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন পি.এস.সি ২৪ জুলাই ১৯৪৫ সালে কুমিল্লা জেলার মুরাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি এপ্রেন্টিস স্টুডেন্ট হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ৮ মে ১৯৬৬ সালে নওয়াজেশ কমিশন লাভ করে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে ২২ বেলুচ রেজিমেন্টে কর্মজীবন শুরু করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর সময় নওয়াজেশ রংপুরে

কর্মরত ছিলেন। দেশমাতৃকার আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। এবং বিদ্রোহ ঘােষণা করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। ১৪ এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের পক্ষে রংপুরে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বিদ্রোহ করেছেন। পুরাে মুক্তিযুদ্ধের সময় নওয়াজেশ ৬নং সেক্টরে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে তিনি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর হত্যার সময় নওয়াজেশ রাঙ্গামাটিতে ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে ভােররাতে কুমিল্লা কারাগারে বীর মুক্তিযােদ্ধা। নওয়াজেশ ফাসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন। ফাসির পর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী নওয়াজেশকে কুমিল্লার মুরাদপুরে সমাহিত করা হয়।

স্ত্রী মমতাজ নওয়াজেশকে লেখা কর্নেল নওয়াজেশের শেষ চিঠি

প্রিয় মমি (মমতাজ নওয়াজেশ) আমার শতকোটি আদর, স্নেহ, ভালােবাসা এবং আদর রইল। সবাইকে আমার জন্য দোয়া করিতে বলিবা যাতে আল্লাহ তালাহ আমাকে বেহেস্থে দাখিল করে। আমার লাশটা আমার আব্বার মাজারের ঠিক পূর্ব দিকে দাফন করিতে তােমাদের প্রতি অনুরােধ রইল। আমার শেষ দোয়া আল্লাহর প্রতি আল্লাহ তােমাদের সবাইকে সুখে রাখুক। রনি, রুজি, হেপী এবং বাবুকে আমার অশেষ স্নেহ ও দোয়া জানাইও। আমি সব সময় তােমাদের জন্য দোয়া করিব। সবাইকে দোয়া ও শুভেচ্ছা।

তােমাদের নওয়াজেশ ২৩.৯.৮১

কর্নেল এম এ রশিদ বীর প্রতীক পি.এস.সি

কর্নেল মােহাম্মদ আবদুর রশিদ ২২ জুলাই ১৯৪৪ সালে রাজশাহী জেলার হেতেম খা-তে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি বি.কম পাশ করেন। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে রশিদ ৪র্থ যুদ্ধ ফোর্সে যােগদানের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ৭ জুলাই ১৯৬৬ সালে কমিশন লাভ করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৭ এফ.এফ রেজিমেন্টে সৈনিক জীবন শুরু করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা শুরু করার সময় ক্যাপ্টেন রশিদ রাজশাহীর সারদা ক্যাডেট কলেজের এডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৬ মার্চ দেশমাতৃকার আহ্বানে সাড়া দিয়ে

প্রতিরােধ সংগ্রামে যােগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে ৭নং সেক্টরের শেখপাড়া সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রশিদ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রশিদ বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন। ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় কর্নেল রশিদ কাপ্তাইয়ে ৬৫ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২ জুন ‘৮১ সালে কর্মরত থাকাবস্থায় কর্নেল রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ‘৮১ সালে ভােররাতে ময়মনসিংহ কারাগারে এ বীর মুক্তিযােদ্ধার ফাসি কার্যকর করা হয়। ফাসির পর রশিদকে ২৩ সেপ্টেম্বর কলাবাগানস্থ নিজ বাসভবনের সামনে সমাহিত করা হয়।

মিসেস আনােয়ারা রশিদ

২৩ সেপ্টেম্বর ‘৮১ সালে ফাসি হওয়া কর্নেল এম এ রশিদ বীর প্রতীক-এর স্ত্রী ৩০ মে যেদিন জিয়াউর রহমান মারা যান উনি তখন কাপ্তাই উনার হেড অফিসে। ছিলেন, ৬৫ ব্রিগেডে। ৩১ মে আমরা জানতে পারি জিয়াউর রহমান মারা যান। উনি ২ জুন গ্রেফতার হন। এরপরে আমি ঢাকায় চলে আসি। এর মধ্যে আমার। শ্বশুর চিটাগাং গেলেন। ওখানে ডিফেন্ডিং অফিসার বললেন রশিদের বিরুদ্ধে তাে কিছু পাওয়া যায়নি, বিচারের পর ওকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিছুদিন পরে আমার শ্বশুর বললেন, তুমি খোঁজ নিয়ে দেখ তাে কী হলাে রায়ে। ফোন করলাম। পরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বলল যে, উনার তাে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হলাে। তখন আমার শ্বশুরকে বললাম, তখন চিল্কার করে কেঁদে ওঠে। আমরা যতবারই জেলে গিয়েছি উনি এক কথাই বলেছেন, আমি একদম নির্দোষ, কোরান শরীফ ছুঁয়ে প্রমাণ করেছেন। আমাকে ষড়যন্ত্র করে মারা হচ্ছে। যেহেতু আমি মুক্তিযােদ্ধা। আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে বিচারটি করা হলাে। এই বিচারটি আমরা। কোনােদিনই মেনে নেব না।

ইকবাল রশিদ রানা

কর্নেল এম. এ. রশিদ বীর প্রতীক-এর ছেলে আমি তখন ২য় শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম, ১৯৮১ সালে। মােট ছয়বার ময়মনসিংহ। কারাগারে আমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আমি খুব ছােট ছিলাম, তারপরেও কথাগুলাে খুব মনে পড়ে এখনও। বাবা বলতেন- আমি নির্দোষ, মুক্তিযােদ্ধা এটিই আমার একমাত্র অপরাধ। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পরে ৩১ মে আমার বাবাকে জেনারেল মঞ্জুর চিটাগাংয়ে ডেকে পাঠান। আমার বাবাকে চিটাগাংয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় এটুকুই। এই হত্যাকাণ্ড বা বিদ্রোহের সাথে তার কোনােরকম কোনাে যােগসাজশ ছিল না। আমার বাবাকে যখন ফাসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় তার একটিই কথা ছিল

Long live Bangladesh. বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হােক। তিনি মৃত্যুর আগে। বলেছিলেন আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তখন একতলায় যারা অবস্থান করেছিলেন লে, মােসলেহ উদ্দিন (ময়মনসিংহ কারাগারে), মেজর দোস্ত মােহাম্মদ, মেজর ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন তাদেরকে তিনি বলেছিলেন আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, তােমরা সাক্ষী থেক। আমি এমনও শুনেছি যে তখনকার যারা অফিসার ছিলেন যে রায়টি আগেই লেখা হয়েছিল, প্রিন্ট আউট করা হয়েছিল মালিবাগের একটি প্রেস থেকে। মুক্তিযুদ্ধে যার যত বড় অবদান তার তত বড় শাস্তি নির্ধারিত ছিল।

লে. কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম, পি.এস.সি। বিএ- ৩০১ লে. কর্নেল এ.ওয়াই.এম মাহফুজুর রহমান

বীর বিক্রম বার, পিএসসি

জন্ম :১ অক্টোবর ১৯৪২

জন্মস্থান : কটিয়াদি, কিশােরগঞ্জ বাবা : সায়েদুর রহমান। সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৬৭ কমিশন : জুন ১৯৬৮ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ১নং সেক্টরের “মনুঘাট” সাব সেক্টর ও

“শ্রীনগর” সাব সেক্টর (শেষ দিকে) কমান্ডার যুদ্ধে খেতাব : বীর বিক্রম বিবাহ : ১৯৬৯ সন্তান : ৩ ছেলে ১ মেয়ে। সর্বশেষ অবস্থান : সর্বাধিনায়ক-এর সচিবালয়

থেকে প্রেসিডেন্ট-এর একান্ত সচিব মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, চট্টগ্রাম কারাগার কবর : বনানী, ঢাকা লে, কর্নেল আবু ইউসুফ মাে. মাহফুজুর রহমান ১ অক্টোবর ১৯৪২ সালে কিশােরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার চরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে মাহফুজুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ‘৬৮ সালের জুন মাসে মাহফুজ কমিশন লাভ করে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। ২৫ মার্চ ‘৭১ সালে দেশব্যাপী মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মাহফুজ চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে একজন অগ্রদূত অফিসার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১নং সেক্টরে যুদ্ধের শেষের দিকে শ্রীনগর সাব সেক্টর কমান্ডার এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনুঘাট সাব সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মাহফুজ কালুরঘাট, রামগড়, বেলুনিয়া, আখাউড়াসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ

করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মাহফুজ বীর বিক্রম বার অর্থাৎ দুইবার বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন। ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার সময় লে. কর্নেল মাহফুজ রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরে লে. কর্নেল মাহফুজকে ৪ জুন গ্রেফতার করা হয় এবং ১৭ জুন মুক্তি দেয়া হয়। এক মাসেরও বেশি সময়ের পর ৪ জুলাই মাহফুজকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর। ভােররাতে চট্টগ্রাম কারাগারে অসীম সাহসী এই বীর মুক্তিযােদ্ধাকে ফাঁসি দেয়া। হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বনানী কবরস্থানে ব্রিগেডিয়ার মহসীন ও মাহফুজকে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়।

স্ত্রী মালার কাছে লেখা লে. কর্নেল মাহফুজের চিঠি

মালা, আমি ভালাে আছি। সারাদিন রাত নামাজ রােজায় ভাবছিলাম এই বুঝি মুক্তি পাব । এমন বিচারের রায় হবে ভাবিনি। কোর্ট আমার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। মালা, আমি যে এ ঘটনায় সম্পূর্ণ নির্দোষ, তা কেবল আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

যেহেতু দুজন অফিসার প্রাণ বাঁচাতে আমার নাম দিয়েছে যে তারা আমার সঙ্গে আগে যােগাযােগ করেছিল সেইজন্য আমাকে চারদিন ধরে এক জায়গায় রেখে জোর করে আমার জবানবন্দীতে মিথ্যা লেখে সই করিয়েছে। তবে যাই লিখেছি আমি সই করেছি প্রাণ বাঁচাতে। কোর্টে সেই প্রশ্ন উঠান হয়েছিল, কিন্ত শুনলনা। | যাক, তুমি মাকে নিয়ে ও মাসুম সহ “জিয়া ভাবীকে যেভাবে পার এটা বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করিবে, বলবে যেন প্রেসিডেন্টকে টেলিফোনে বলে দেন শুধু Death sentence টা ক্ষমা করে আমায় মুক্তি দেন। যদি স্বীকার না করতে চান, তাহলে প্রাণের বিনিময়ে Life Imprisnment (১৪ বছর) দেন, পরে আল্লাহ চাহেতাে আস্তে আস্তে কমান যাবে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড’ আদেশটা মাফ করিয়ে নিবেই। | আমি জেলের তরফ থেকে একখানা Mercy Pettition করছি। ১-৩ দিনের মধ্যেই তা পাঠাবে প্রেসিডেন্টের কাছে। সেই পিটিশনটাতেই প্রেসিডেন্ট মওকুফ করলে করবেন। তুমি এমএসপি, মি. সৈয়দ আমিনুর রহমান প্রাইভেট সেক্রেটারি টু প্রেসিডেন্টকে খুব করে অনুরােধ করবে, ঐ ফাইলটা গেলে যেন সহানুভূতির সাথে দেখান। প্রয়োজন হলে মাকে নিয়ে পিএসও-র বাসায় যেয়ে অনুরােধ করবে এবং একদিন প্রেসিডেন্টের ইন্টারভিউ এর জন্য ডেট নিয়ে যেয়ে এর বলে মওকুফ করাবে। আমি গিয়াসকেও একটা চিঠি দিয়েছি এবং চেষ্টা করতে বলেছি। তুমি ওর সঙ্গে যােগাযােগ করাে। সৈয়দ আমিনুর রহমান প্রাইভেট সেক্রেটারির বাসায়। যেয়ে দেখা করে প্রেসিডেন্ট-এর ইন্টারভিউ-এর ডেইট নিতে পার। বাইরে অন্য যে কোনাে লােকের সঙ্গে দেখা করবে না বা কিছু বলবে না। লিগাল পয়েন্ট-এর প্রয়ােজনে আমাদের ডিফেন্স কাউন্সিল-এর লে. কর্নেল ইবরাহিম, কর্নেল আইনউদ্দিন-এর সঙ্গে দেখা করাে। আমার Dsep Fund এ টাকা আছে প্রায় ১২ হাজার টাকা, ব্যাংকে দেড় হাজার। আমার কিছু ঋণ রয়ে গেছে, তােমার দশ হাজার রেখে বাকিটা শােধ করে দিও। ২৪ ইনফেন্ট ডিভ হেডকোয়াটার্সে প্রায় দেড় হাজার, ৫৫ ডিভ হয় সামান্য কিছু, আর ৪ ইস্ট বেঙ্গলে সামান্য দিয়ে দিও। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ, এরপরও যদি আমার মৃত্যুদণ্ড হয় আমি আল্লাহর উপরই বিশ্বাস রাখি। আমি তােমাকে ভালােবাসি প্রাণ দিয়ে, তােমার জন্য আমি পরকালেও অপেক্ষা করব। আমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করবে, কখনও অন্যায়ভাবে শাসন করাে না। আমি ওদের খুব আদর করতাম। তুমি শপথ করে বলল- তুমি কোরান শিখবে, আমি মরে গেলে আমাকে কোরান পড়ে শুনিও। চিন্তা করাে না, আমরা সবাই মরব, এবং দেখা হবে। মা-কে অন্তর দিয়ে সেবা করাে যা আমি পারিনি এবং দোয়া নিও। আমাকে তােমরা সবাই মাফ করে দিও। ইতি মাহফুজ মনে রেখােযদি মার্সি পিটিশন-এ ডেথ মওকুফ না করা হয়, তবে তুমি মা, ছেলে-মেয়ে সহ প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ নিবা।

একমাত্র কন্যা কুমকুমকে লেখা লে. কর্নেল মাহফুজের চিঠি

কুমকুম, মা মণি তুমি আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি ইতি- তােমাদের পাপী

মাসুম রহমান লে. কর্নেল মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম-এর ভ্রাতুস্পুত্র আমি মাসুম রহমান। আমার চাচা লে. কর্নেল মাহফুজুর রহমান, একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। ৪ জুন উনাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৭ দিন আটকে রেখে এটি প্রমাণিত হয় যে উনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এবং উনাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার ৪ জুলাই প্রথম রমযান তারিখে উনাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে উনার কাছ থেকে জেলখানায় দেখা করে যে কাগজপত্র পাই এবং যে দুটি চার্জশিট পাই সেই দুটি চার্জশিটের একটিতেও কর্নেল

১৩০

মাহফুজের নাম ছিল না। এমনকি যখন কোর্টমার্শাল আরম্ভ হয়ে যায় তখনাে। কোনাে চার্জশিট ছিল না। ফাঁসি দেয়ার পরে যে চার্জশিট আমরা দেখতে পাই। সেখানে যেসব ঘটনা বলে উনাকে জড়ানাে হয়েছে, আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। এসব ঘটনাগুলাের একটিও সত্য নয়। | আমার হাতে যে কাগজগুলাে এর মধ্যে দুটি হচ্ছে চার্জশিট। একটি হচ্ছে এসেম্বলি অব কোর্ট মার্শাল সংক্রান্ত নােটিশ । এই চার্জশিট দুটি সিগনেচার করেছেন তকালীন সেনাপ্রধান হুসেন মুহম্মদ এরশাদ। এটির তারিখ হচ্ছে ৩ জুলাই ১৯৮১। যে দুটি চার্জশিট আছে এই চার্জশিটে যে অফিসারদের নাম আছে তার কোথাও কর্নেল মাহফুজের নাম নেই এবং এই চার্জশিটে যে চার্জ তার মূল বক্তব্য হচ্ছে চিটাগাং সেনানিবাসে একটি বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহে দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনা। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ৩ জুলাই চার্জশিট দুটি কমপ্লিট করা হলাে। ১ মাস কোর্ট অব ইনকোয়ারি এবং সমস্ত কার্যক্রম করার পর ৪ জুলাই আবার সেনাপ্রধান একটি ফরমান জারি করলেন সেখানে কোর্ট গঠন করে দিলেন, যে কোর্টে আসামিদের বিচার হবে। তখন তিনি আরেকটি লিস্ট তৈরি করলেন যে লিস্টে বলা হলাে যে নিম্নোক্ত এ্যাকুইসড ব্যক্তিদেরকে এই কোর্টে বিচার করা হবে, সেখানে হঠাৎ করে কর্নেল মাহফুজের নাম। যেখানে একমাস কোট অব ইনকোয়ারি করে বিভিন্ন রকম খোঁজ খবর করার পর যে চার্জশিট দুটি তৈরি করা হলাে যেখানে কর্নেল মাহফুজের নাম নাই সেখানে একরাতে, কোনাে বিচার ছাড়া, কোনাে কোর্ট অব ইনকোয়ারি ছাড়া, কোনাে কিছু ছাড়া কীভাবে কর্নেল মাহফুজ এ্যাকুইসড হয়ে গেলেন। এদিকে কোর্ট আরম্ভ হয়ে গেছে ৪ জুলাই ১৯৮১ সালে, তখন যেহেতু কর্নেল মাহফুজের চার্জশিট ছিল না শুধু সে কারণে কোর্ট ১০ জুলাই পর্যন্ত এডজন্ট করা হয় এবং এর মধ্যে কর্নেল মাহফুজকে চিটাগাং সেনানিবাসে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে তার কাছ থেকে কনফেশনাল স্টেটম্যান নিয়ে তারপর তার নামে একটি চার্জশিট তৈরি করা হয় যেটি আমরা সরকার থেকে পাইনি কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি। আমরা উনার সঙ্গে জেলখানায় থাকাবস্থায় দুই তিনবার দেখা করেছি। কিন্তু যেদিন ফাসি হয়ে যায় সেদিন এত তড়িঘড়ি করে ফাসি হয় যার কারণে উনার সঙ্গে দেখা করার আর সুযােগ পাইনি। উনি যখন জেলখানায় ছিলেন (চিটাগাং জেলখানা) ওখান থেকে উনি কয়েকটি চিঠি দিয়েছেন। উনি একটি চিঠিতে উনার মা’র কাছে লিখেছেন, এই ঘটনায় আমি এতটুকুও জড়িত না মা। এরা আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাসি দিচ্ছে। কর্নেল মাহফুজের যে বিচার প্রক্রিয়া চলছিল আমরা এটি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম এবং আমাদের কোনাে সুযােগই ছিল না। উনার পক্ষ হয়ে কোনাে আইনজীবী নিয়ােগ করে আত্মপক্ষ সমর্থন করার। কর্নেল মাহফুজের ইচ্ছে ছিল যে উনার বড় ভাইয়ের কবরের পাশে কবর দেয়া হয় কিন্তু সেই অনুমতিটুকুও আমরা পাইনি যেহেতু উনার বড় ভাইয়ের কবর ছিল ক্যান্টনমেন্ট কবরস্থানে।

লে. কর্নেল এম. দেলাওয়ার হােসেন বীর প্রতীক পি.এসসি

বিএ- ৪০০ লে. কর্নেল মােহাম্মদ দেলাওয়ার হােসেন

বীর প্রতীক, পিএসসি

জন্ম :১ এপ্রিল ১৯৪৫

জন্মস্থান : রাজাপুর, বরিশাল। বাবা : আলহাজ্ব সেকেন্দার আলী সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১২ নভেম্বর ১৯৬৭ কমিশন ; ১৯ অক্টোবর ১৯৬৯ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ৬নং সেক্টরের

“মােগলহাট” সাব সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধে খেতাব : বীর প্রতীক। বিবাহ : ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭০ সন্তান : ৩ মেয়ে। সর্বশেষ অবস্থান :সহকারী পরিচালক, অর্ডন্যান্স সার্ভিসেস ২৪ পদাতিক ডিভিশন। মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, যশাের কারাগার কবর :রূপাতলী, বরিশাল লে. কর্নেল মােহাম্মদ দেলাওয়ার হােসেন ১ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে বরিশাল জেলার রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন এবং ১৯ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে অর্ডন্যান্স কর্পস-এ নিয়মিত অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ২৫ মার্চ ‘৭১ সালে দেশে সুমহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ক্যাপ্টেন দেলাওয়ার পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত ছিলেন। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৩ আগস্ট পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে দেলাওয়ার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন দেলাওয়ার ৬নং সেক্টরের মােগলহাট সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন। ১৯৮০ সালে লে. কর্নেল দেলাওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি অর্জন। করেন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান-এর হত্যাকাণ্ডের সময় দেলাওয়ার ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অর্ডন্যান্স সার্ভিসের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ভােররাতে যশাের কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে এ বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। ফাসির পর দেলাওয়ারকে বরিশালের রূপাতলীতে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

স্ত্রী শিমুলকে লেখা লে. কর্নেল দেলাওয়ার-এর শেষ চিঠি

শিমুল আমি চলে যাচ্ছি। খােদা হাফেজ। ইতিদেলাওয়ার ২২/৯/৮১

লে, কর্নেল শাহ্ মাে. ফজলে হােসেন বিএসএস- ৬৭৫ লে. কর্নেল শাহ মােহাম্মদ ফজলে হােসেন

জন্ম : ২৪ মার্চ ১৯৫০ জন্মস্থান : বরিশাল বাবা : সিরাজুল হক খন্দকার সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৭১ কমিশন : ৯ অক্টোবর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : “জেড ফোর্স”

| ৩য় ইস্টবেঙ্গল-এর অফিসার বিবাহ : ১৮ জুলাই ১৯৭৬ সন্তান :১ ছেলে। সর্বশেষ অবস্থান : অধিনায়ক, ৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট মৃত্যু : ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩, চট্টগ্রাম কারাগার। কবর : পটিয়া, চট্টগ্রাম লে. কর্নেল শাহ মাে. ফজলে হােসেন ২৪ মার্চ ১৯৫০ সালে বরিশাল জেলার মূল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ছুটি কাটাতে হােসেন দেশে ফিরে গ্রামের বাড়ি বরিশালে অবস্থান করছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে দেশব্যাপী। স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে হােসেন মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। ৯ অক্টোবর। ১৯৭১ সালে ভারতের মূর্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচ বা ফাস্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ৬১ জন অফিসার কমিশন লাভ করেন। ফজলে হােসেনও এই ব্যাচের সঙ্গে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের ৩য়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার হিসেবে ফজলে হােসেন বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ৬ষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কর্মরত। ছিলেন। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ফজলে হােসেন গুরুতরভাবে আহত হন। অসুস্থ থাকায় ফজলে হােসেনের বিচার পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত হয়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের

দুই বছর পরে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে অসুস্থ অবস্থাতেই ফাঁসির মঞ্চে চট্টগ্রাম কারাগারে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। অভিযােগ রয়েছে ফজলে হােসেনকে ফাসি না দিয়ে ইনজেকশনের মধ্য দিয়ে তার জীবনাবসান ঘটানাে হয়। ফাঁসির পর পটিয়ায় কাঞ্চননগর পীর সাহেবের বাসার সামনে ফজলে হােসেনকে সমাহিত করা হয়।

| স্ত্রীকে লেখা লে. কর্নেল ফজলে হােসেনের শেষ চিঠি

জান, তােমার মালা ছিড়ে গেল? দুঃখ করাে না। হাদিছে আছে যে সব রুহ রুহানী জগতে বন্ধু থাকে তারা দুনিয়ায় জীবনেও বন্ধু হয়। পরপারে আবার দেখা হবে ইনশাল্লাহ। সেখানে আর মালা ছিড়বে না। ছেলেটাকে ধমর্মতে মানুষ করাে। ধর্মের উপর থেক। খােদা হাফেজ তোমার মালা

মিসেস উলফাৎ আরা হােসেন

৩০ সেপ্টেম্বর ‘৮৩ সালে ফাঁসি হওয়া লেঃ কর্নেল ফজলে হােসেন-এর স্ত্রী | আমি এপ্রিল মাসে চলে আসলাম ঢাকায়, আমার মা অসুস্থ ছিল। দুপুরের দিকে | জানতে পারলাম প্রেসিডেন্ট জিয়া মারা গেছে। পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওর কয়েকজন ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন জানালাে ভাবী হােসেন বেঁচে আছে কিন্তু [আহত অবস্থায়। আমি চেষ্টা করলাম হােসেনের সাথে দেখা করতে, সিএমএইচএ যাওয়ার জন্য। কিন্তু গেট পর্যন্তও আমাদেরকে যেতে দেয়া হয়নি। পরে অনেক চেষ্টা করে ‘৮২’র শেষের দিকে দশ মিনিটের জন্য বলল দেখা করতে পারব সিএমএইচ-এ। পুরাে আর্মি ঘিরে নিয়ে গেল। তখন ও (হােসেন) খুব একটি কথা বলতে পারেনি। ৮৩’র সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মানে ও (হােসেন) মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে তখন আবার আমাকে দশ মিনিট সময় দেয়া হলাে ওর সাথে দেখা করতে। তখনও চিটাগাং জেলের মধ্যে ছিল, তখন ও (হােসেন) খুব অসুস্থ। ছেলেকে বলল যে তােমার আম্মুকে দেখ, তােমার আম্মুকে তােমার হাতে তুলে দিলাম। কীভাবে মারা গেছে সেটিও আমরা শুনিনি। কীভাবে মারল, কী করে মারল, ও (হােসেন) মারা যাওয়ার পরের দিন আমরা জানতে পারলাম যে ওকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। | একদম আর্মি পাহারা ছিল ওখানে, আমাদের কাউকে ওর কবরের কাছে যেতে দেয়নি। এইভাবে ছয়মাস কাটলাে। ছয়মাস পরে উনারা (আর্মি) চলে গেল। | উনার (হােসেন) কোনাে ট্রায়াল হয়েছে কিনা, কোনাে বিচার হয়েছে কি না।

দুই বছর পরে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে অসুস্থ অবস্থাতেই ফাঁসির মঞ্চে চট্টগ্রাম কারাগারে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। অভিযােগ রয়েছে ফজলে হােসেনকে ফাসি না দিয়ে ইনজেকশনের মধ্য দিয়ে তার জীবনাবসান ঘটানাে হয়। ফাঁসির পর পটিয়ায় কাঞ্চননগর পীর সাহেবের বাসার সামনে ফজলে হােসেনকে সমাহিত করা হয়।

| স্ত্রীকে লেখা লে. কর্নেল ফজলে হােসেনের শেষ চিঠি

জান, তােমার মালা ছিড়ে গেল? দুঃখ করাে না। হাদিছে আছে যে সব রুহ রুহানী জগতে বন্ধু থাকে তারা দুনিয়ায় জীবনেও বন্ধু হয়। পরপারে আবার দেখা হবে ইনশাল্লাহ। সেখানে আর মালা ছিড়বে না। ছেলেটাকে ধমর্মতে মানুষ করাে। ধর্মের উপর থেক। খােদা হাফেজ তোমার মালা

মিসেস উলফাৎ আরা হােসেন

৩০ সেপ্টেম্বর ‘৮৩ সালে ফাঁসি হওয়া লেঃ কর্নেল ফজলে হােসেন-এর স্ত্রী | আমি এপ্রিল মাসে চলে আসলাম ঢাকায়, আমার মা অসুস্থ ছিল। দুপুরের দিকে | জানতে পারলাম প্রেসিডেন্ট জিয়া মারা গেছে। পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওর কয়েকজন ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন জানালাে ভাবী হােসেন বেঁচে আছে কিন্তু [আহত অবস্থায়। আমি চেষ্টা করলাম হােসেনের সাথে দেখা করতে, সিএমএইচএ যাওয়ার জন্য। কিন্তু গেট পর্যন্তও আমাদেরকে যেতে দেয়া হয়নি। পরে অনেক চেষ্টা করে ‘৮২’র শেষের দিকে দশ মিনিটের জন্য বলল দেখা করতে পারব সিএমএইচ-এ। পুরাে আর্মি ঘিরে নিয়ে গেল। তখন ও (হােসেন) খুব একটি কথা বলতে পারেনি। ৮৩’র সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মানে ও (হােসেন) মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে তখন আবার আমাকে দশ মিনিট সময় দেয়া হলাে ওর সাথে দেখা করতে। তখনও চিটাগাং জেলের মধ্যে ছিল, তখন ও (হােসেন) খুব অসুস্থ। ছেলেকে বলল যে তােমার আম্মুকে দেখ, তােমার আম্মুকে তােমার হাতে তুলে দিলাম। কীভাবে মারা গেছে সেটিও আমরা শুনিনি। কীভাবে মারল, কী করে মারল, ও (হােসেন) মারা যাওয়ার পরের দিন আমরা জানতে পারলাম যে ওকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। | একদম আর্মি পাহারা ছিল ওখানে, আমাদের কাউকে ওর কবরের কাছে যেতে দেয়নি। এইভাবে ছয়মাস কাটলাে। ছয়মাস পরে উনারা (আর্মি) চলে গেল। | উনার (হােসেন) কোনাে ট্রায়াল হয়েছে কিনা, কোনাে বিচার হয়েছে কি না।

কিছুই আমরা জানি না। কিছুই জানতে পারিনি এবং কোনাে কাগজপত্রও নেই । কিছুই দেয়া হয়নি। এমনকি তার ডেথ সার্টিফিকেটটি পর্যন্ত আমাদের দেয়া হয়নি। আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে আমরা মাঝে মধ্যে ব্রিতকর অবস্থায় পড়ি, বলতে পারি না যে কী হয়েছিল, যার জন্য তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে।

মেজর এ জেড গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ

বিএসএস- ৭২২ মেজর এ. জেড, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ

জন্ম : ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪৬

জন্মস্থান : ঢাকা বাবা : খান সাহেব হােসেন আলী সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৭১ কমিশন ; ৯ অক্টোবর ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ৪নং সেক্টর বিবাহ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সন্তান : ২ মেয়ে সর্বশেষ অবস্থান : উপ- অধিনায়ক

১১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, কুমিল্লা কারাগার

রাত ২.৪৫ মি. কবর : রাজাপুর, কুমিল্লা

মেজর আবু জাফর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে | গেলে ঢাকার টিএন্ডটি কলেজে বিএ ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় গিয়াস ৯ এপ্রিল আগরতলার বক্সনগরে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন বীর উত্তম, আশাফ সিদ্দিকী এবং অপরাপর বন্ধুকে নিয়ে ট্রেনিং শুরু করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। যুদ্ধের মধ্যেই গিয়াস বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সে যােগ দেন। ৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে ভারতের মূর্তিতে এই কোর্সের ৬১ জন অফিসারের সঙ্গে গিয়াস কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ৪নং সেক্টরে গিয়াস বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের সময় গিয়াস ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ২.৪৫ মিনিটে কুমিল্লা কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে এ বীর মুক্তিযােদ্ধার। জীবনাবসান ঘটে। ফাসির পর গিয়াসকে কুমিল্লার রাজাপুরে নিজগ্রামে সমাহিত করা হয়।

জেলখানা থেকে গােপনে স্ত্রীর কাছে লেখা মেজর গিয়াসের চিঠি

মম আমি ভালাে। তুমি কেমন আছ । সুমী/রুমী কেমন আছে। তারা বলেছিল আমাকে এবার আর চট্টগ্রাম থেকে যেতে দিবে না। সেটাই সত্যি, বুঝতে পারিনি। বেশি কিছু লিখতে পারবাে না। বুঝতেই পারছ চুরি করে লিখছি। আমার জন্যে বেশি করে দোয়া করাে। সম্ভব হলে বাবা আমানত শাহর মাজারে এসে বলাে। দেখা করতে দিলে চিঠি দেব। হিমু ভাইকে বললা জে, এরশাদ-ই এই কেইসের সবকিছু। ইচ্ছা করলে সে মাপ করে দিতে পারে। আর বিশেষ কী লিখবাে। হিমু ভাই, ফরু ভাইকে বলাে চিটাগাং-এ খবরাখবর রাখতে আমার সম্বন্ধে । আদনান হক কাউকে দিয়ে টেলিফোন করাবাে সময় সময় । এলেই আমার খবর পাবে। আম্মাকে দোয়া করতে বইল। সুমী। রুমীকে দেখ। ইতি গিয়াস

স্ত্রীকে লেখা মেজর গিয়াসের শেষ চিঠি

মমতা। আমি আসি। তােমার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেতে পারলাম না । সুমীকে ও রুমীকে মেরাে না। তুমি এখন থেকে বাবা/মা হয়ে তাদেরকে বড় কর, লেখা পড়া শিখিও। তােমাকে সারা জীবন কষ্ট দিয়ে গেলাম। মাফ করে দিও। নিজে যদি পার নিজ পায়ে দাড়িও। তােমার যেখানে খুশি সেখানে থাকতে পার। আব্বা/ আম্মার সাথে আলাপ করে একটা ব্যবস্থা করে নিও। কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। ক্ষমা করাে বিদায় । সুমী রুমীকে আমার অফুরন্ত স্নেহ দিও। গিয়াস মৃত্যু- ২৩/৯/৮১ রাত ২টা-৪৫ মিনিট

মিসেস মমতা আহম্মেদ মেজর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ-এর স্ত্রী তখন আমি চিটাগাং শহরের বাসায় থাকতাম, ষােলশহর। সকালের দিকে আশেপাশের লােকজন সবার মুখে শুনতে পেলাম জিয়াকে কারা মেরেছে। জুন মাসের ২ তারিখে আমি ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আসার পরেরদিন শুনলাম মেজর গিয়াস আত্মসমর্পণ করেছে। আমি তখন যাত্রাবাড়ী আমার বড় ভাসুরের বাসায় উঠলাম। তাদেরকে জেলে নিয়ে গেল । ঐখানে দেখা করতে যাব, ঐখানে গিয়ে দেখা করতে পারলাম না। আবার চলে আসলাম ঢাকায় । আমার হাসব্যান্ডকেও কুমিল্লা জেলে পাঠাল । আমার বড় ভাসুর দেখা করার একটি অনুমতি নিল। দেখা করলাম। আমি জিগ্যেস করলাম কী হলাে? আমার মাথায়।

হাত দিয়ে বললেন বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানি না।

কারাগারে থাকাবস্থায় আমার সাথে দুইবার দেখা হয় এবং যখনি দেখা করতে যেতাম খুব একটি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারতাম না। সকালবেলা সবাই রেডি হচ্ছে যাওয়ার জন্য, কোথায় যাব আমি জিজ্ঞাসা করলাম- দেখা করতে যাব। তার মধ্যে আগের রাতেই মেরে ফেলা হয়েছে। | কিন্তু কী বিচার হলাে ওদের কিছুই জানতাম না, কী অপরাধ সেটিও জানতে পারলাম না আজ পর্যন্ত। ওরা কি আসলেই দোষী? মারা যাওয়ার আগেরদিন পর্যন্ত জানি না ওর (মেজর গিয়াস) কী হবে, কী সাজা হবে। ফাসি হবে না কি জেল হবে কিছুই জানতাম না। যেদিন তার ফাসি হয় সেদিন সে একটি চিঠি লিখে গেছে। বলেছে একদিকে মা, একদিকে বাবা হয়ে তুমি আমার সুমী, রুমীকে মানুষ কর । তারা যদি পড়ালেখা না শিখে তাহলে আমার আত্মা কষ্ট পাবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর। তােমার যেখানে ভালাে লাগে তুমি সেখানেই থেক। ওই নিয়ে বেঁচে আছি আজকেও।

মাহিন আহম্মেদ সুমী, নাহিদ আহম্মেদ রুমী মেজর গিয়াসের মেয়ে ‘৮১-তে যে ঘটনা ঘটেছে আমাদের প্রজন্ম তাে জানেই না মনে হয়, আমাদের পরেও অনেকে জানেন না যে কী ঘটনাগুলাে ঘটেছিল। আমরা মনে হয় এই ১৩টি পরিবার যারা ইনজুরড় হয়েছি তারা হয়তাে শুধু জানি যে আসলে মূল ঘটনাটি কী। এক্সপেক্টেশন শুধু এটিই যে সবাই জানুক। বিচার আসলে এদেশে চেয়ে তাে কোনাে কিছু হয় না।

মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া বীর প্রতীক বিএসএস- ৮৩৯ মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া।

বীর প্রতীক

জন্ম : ১৯৪৮ জন্মস্থান : ভাটপিয়ারী, সিরাজগঞ্জ বাবা : ফরহাদ হােসেন ভূইয়া। সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৭১ কমিশন : ৫ আগস্ট ১৯৭২ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ৬নং সেক্টর যুদ্ধে খেতাব : বীর প্রতীক বিবাহ : অবিবাহিত সর্বশেষ অবস্থান : ব্রিগেড মেজর

৬৫ পদাতিক ব্রিগেড

মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১

যশাের কারাগার, রাত ২.০০ কবর : মালশাপাড়া, সিরাজগঞ্জ মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া ১৯৪৮ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন। ভাটপিয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে ইয়াজদানী ‘৬৩ সালে এসএসসি ও ৬৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ‘৬৫ সালের শেষের দিকে তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদে ভর্তি হন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ইয়াজদানী ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ অবস্থায় দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ইয়াজদানী গ্রামের বাড়ি ভাটপিয়ারী হয়ে গাইবান্ধার রেীমারী ক্যাম্পে গমন করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর দুইটি ওয়ার কোর্সের অফিসার নির্বাচন করেন। প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসারগণ যুদ্ধের মধ্যেই ৯ অক্টোবর কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় কোর্সের অফিসারগণ ৫ আগস্ট ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে কমিশন লাভ করেন। ইয়াজদানী। দ্বিতীয় কোর্সের অফিসারদের সঙ্গে কমিশন লাভ করে সেনাবাহিনীতে তার কর্মজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে ইয়াজদানী ৬নং সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ৬৫ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর যশাের কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে রাত দুইটায় এই বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। ফঁাসির পর ইয়াজদানীকে সিরাজগঞ্জের মালশাপাড়া কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

মিসেস রওশন আরা খাতুন মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া বীর প্রতীক-এর মা একডালা, কালীবাড়ী, সিরাজগঞ্জ আমার বড় মেয়ের জামাই বলল যে আমরা খোঁজ পাইছি ও যশাের জেলে আছে, আপনেরা আসেন। যশােরে যখন জেলখানায় গেলাম তখন আমার ছেলে আমাকে বলল যে মা আমি তাে কোনাে অন্যায় করিনি। আপনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাস। রাখেন। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে না।

জানতে তাে চাই, সুষ্ঠু বিচারও চাই।।

মাে. সিদ্দিকুর রহমান ভূইয়া। রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া বীর প্রতীক-এর অনুজ আমি, আমার এক ভাই এবং মা আর তিন ভাই-বােন মিলে গেলাম তাদের সাথে দেখা করার জন্য। ভেতরে গিয়ে দেখি একরুমে কর্নেল দেলাওয়ার সাহেব আছেন, তার পরেরটায় বড় ভাই, তার পরেরটায় রফিক খান। রফিককে ভাই।

বলল যে দেখ আমি বললাম না যে কাল আমার মা আসবে। দেখ আজকে এসেছে। পরে দেখা করলাম। আম্মাকে ধরে কাদলেন আর বললেন সবাই মারা যাবে। তবে আপনি বিশ্বাস করেন এ ব্যাপারে আমি জড়িত না। পরকাল বলে একটি বিষয় আছে, তখন দেখতে পারবেন কি হয় না হয়।

কাজেই আমার কথা হলাে অন্যায়ভাবে এটি হয়েছে। এর যাতে সুষ্ঠু একটি বিচার হয়। কারণ যাদেরকে তারা মেরে ফেলেছে প্রায় অধিকাংশই মুক্তিযােদ্ধা। মুক্তিযােদ্ধাদের মেরে ফেলার জন্যই এটি একটি নীলনকশা করে তারা বসেছিল।

আলী আহম্মদ ভূঁইয়া

রওশন ইয়াজদানী ভূইয়া বীর প্রতীক-এর অনুজ। বিচার হলে কোর্টে হবে, জানবে, সবাই জানবে। আমরা দেখবাে কী হচ্ছে না। হচ্ছে। কিছুই হলাে না। ধুম ধারাক্কা করে একটি ঘটনা ঘটিয়ে দিল। আমার ভাই যে কোন জায়গায় আছে, কোন জেলে আছে বা কোথায় আছে আমরা সেই খবরটিও বের করতে পারিনি। অনেক কষ্টে আমার বড় ভগ্নিপতি তখন যশােরে, ঐখানে। পুলিশে খোঁজ নেওয়া, আর্মিতে খােজ নিয়ে অনেক কষ্টে জানতে পারে তিনি যশাের। জেলে আছেন। তারপরে অনেক চেষ্টা করে আমার মাকে খবর দেয়। আমার ভাইয়ের যে মৃত্যুটি, এই মৃত্যুটিও আমরা জানতে পারিনি যে আজ ঘটছে, কি কাল ঘটছে বা অন্য কোনােদিন ঘটবে। এমনকি তার ফাঁসি কবে হবে এটিও কেউ জানতে পারেনি। আমরা চাই এর একটি সুষ্ঠু বিচার হােক। বিচারে জানুক, জনগণ জানুক সত্যিকারে এরা দোষী না মুক্তিযােদ্ধা বলে, দেশ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের দূর করণের জন্যই হঠকারী করে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বারবার এটিই সবার কাছে বলেছি যে একটি সুষ্ঠু বিচার হােক। বিচারে যেটি হয়। আমরা সেটিই মানতে রাজি। কিন্তু এটি মানতে আমাদের খুবই কষ্ট লাগে ।

মেজর কাজী মমিনুল হক

বিএসএস- ৮৬২ মেজর কাজী মমিনুল হক জন্ম : ১৯৪৯ জন্মস্থান : মহিষমারা, বুড়িচং, কুমিল্লা বাবা : কাজী আলফু মিয়া সেনাবাহিনীতে যােগদান : ১৯৭১ কমিশন : ৫ আগস্ট ১৯৭২ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ২নং সেক্টর বিবাহ : ১৯৭৭ সর্বশেষ অবস্থান : উপ-অধিনায়ক

২৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট

মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, রাজশাহী কারাগার কবর : রেসকোর্স, কুমিল্লা মেজর কাজী মমিনুল হক ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানাধীন মহিষমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা চলাকালীন ১৯৭১ সালে দেশে শুরু হয় সুমহান মুক্তিযুদ্ধ। পরীক্ষা বাদ দিয়ে মমিন ৭ এপ্রিল মতিনগর সাব সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। যুদ্ধের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ওয়ার কোর্সে যােগদান করেন। মমিন মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী আগরতলার বক্সনগর ক্যাম্পে থেকে পাঁচড়া, চড়নল, সাংগুচাইল, গিলাতলা, হরিমঙ্গল প্রভৃতি সীমান্ত এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ৫ আগস্ট ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সের সঙ্গে কমিশন লাভ করে। মমিন তার কর্মজীবন শুরু করেন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যার সময়ে মমিন চট্টগ্রামের ঘাঘরা রাঙ্গামাটিতে ২৮ বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ‘৮১ সালে রাজশাহী কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। ফাসির পর মেজর মমিনকে কুমিল্লার রেসকোর্স কবরস্থানে। সমাহিত করা হয়। ফাসির সময়ে মেজর মমিনের স্ত্রী অন্তঃসত্তা ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃত পুত্রসন্তান প্রসব করেন।

জেলখানা থেকে বন্ধু হিটুকে লেখা মেজর মমিনের চিঠি

হিটু ভাই, অনেক দিন পর লিখছি, রাজশাহী সেন্ট্রাল জেল হইতে । জেনারেল জিয়ার। বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসাবে। বিচারে ফাঁসি দেওয়া হইয়াছে। এখন একমাত্র ভরসা আপনি। মার্সি পিটিশন আজ পাঠাইয়াছি। আপনি যদি মিসেস জিয়াকে বলেন ওনি প্রেসিডেন্টকে রিকোয়েস্ট করলে এবং জেনারেল এরশাদকে রিকোয়েস্ট করলে ক্ষমা পেতে পারি। বিশ্বাস করেন এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না আমি ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম মাত্র। আর ফ্রিডম ফাইটার হওয়ায় আজ ফাসি হচ্ছে। আপনি এটুকু অনুগ্রহ করেন। মমিন।

মিসেস সৈয়দা সাহেরা মােমেন। মেজর কাজী মমিনুল হক-এর স্ত্রী কাজীপাড়া, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া ৩০ মে আমি রাঙ্গামাটি আমার বােনের বাসায় ছিলাম। ৩ দিন পরে আমি একটু খবর পেলাম তাকে (মমিন) অ্যারেস্ট করা হয়েছে। দশ-বারােদিন পরে আমি

একটি চিঠি পেলাম আমার হাজব্যান্ডের আমি তাে কিছুই জানি না, যদি আমার মৃত্যু এভাবে থাকে তাহলে আমার মরতে হবে। তবে আমার মনে হয় চাকরি থাকবে না, যেহেতু আমি ফ্রিডম ফাইটার। অনেকদিন পরে একটি চিঠি আসলাে আমার হাজব্যান্ডকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে, রাজশাহী কারাগারে পাঠানাে হয়েছে। তখন আমি তাকে দেখতে গেলাম সেখানে যাওয়ার পরে ও (মমিন) খুব কান্নাকাটি করল আর আমাকে বলল যদি আমার জন্য একটি গুলি থাকে তাহলে হয়তাে আমার মৃত্যু হতে পারে, আমি এমনি কিছুই জানি না। পরে আমার ভাই আমাকে বলল যে চল আমরা রাজশাহী যাব। আমি রেডি, সকালবেলা টিকেট কেটে নিয়েছি যে আমি যাব, আমার হাজব্যান্ডকে দেখব। কিন্তু আমার হাজব্যান্ডকে আমি আর দেখতে পাইনি। আমাকে কুমিল্লায় আমার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে এসেছে। কেউ কিছু বলেনি। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম একটি ট্রাক এসেছে আমার হাজব্যান্ড-এর ডেডবডি। আজো আমি জানি না আমার হাজব্যান্ড কেন মারা গেল। কোন দোষে তাকে দোষারােপ করে মেরে ফেলল। আজো আমি সেই অপেক্ষায় আছি। আমি প্রত্যেক ইউনিটে জিগ্যেস করেছি কেউ আজো বলতে পারেনি মমিনের কোনাে দোষ ছিল। আমি আর কোনাে দিন আমার হাজব্যান্ড পাব না, আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমি সবার কাছে চাই সবাই জানুক, আমিও জানি আমার হাজব্যান্ড কিছু করেছিল কি না। আমি জানি একটিই শাস্তি শুধু মুক্তিবাহিনী হওয়াতে ওদের এই অবস্থা। আমি সবার কাছে বিচার চাই।

কাজী মােজাম্মেল হক

মেজর কাজী মমিনুল হক-এর অনুজ রেইসকোর্স, কুমিল্লা। আমার ভাই মেজর কাজী মমিনুল হক এখানে শায়িত আছেন। আমাদের সাথে তার চিটাগাং থাকাবস্থায় দেখা হয়নি। তার ফাঁসির রায় হওয়ার পরে আমাদের সাথে দেখা হয় রাজশাহী জেলে। আমার ভাই সবসময় বলতেন, আমাদেরকে বলেছেন উনি কীভাবে এখানে এসেছেন সেটি উনি জানেন না। এবং কী অপরাধে উনাকে ফাঁসি দেয়া হলাে, আমার ভাই জেনে যেতে পারেননি তিনি কেন মারা যাচ্ছেন, শেষ মুহূর্তে তিন কনকুলেশন ড্র করেছিলেন হয়তাে ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন বলেই তার এই পরিণতি। তার স্ত্রী বৈধব্য বেছে নিয়েছেন। এত ভারী বােঝা আমরা তাে বহন করতে পারছি না। আমিও মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার বাবাও মুক্তিযােদ্ধা পুলিশ অফিসার ছিলেন। যে স্বাধীনতার জন্য তারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল সে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফাসি বরণ করতে হয়েছে! দেশবাসী জানুক কেন তারা মারা গিয়েছে। তাদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়া হউক । আমরা এটির বিচার চাই, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এটির বিচার চাই।

মিসেস সৈয়দা সাহেরা মােমেন

মেজর কাজী মমিনুল হক-এর স্ত্রী আড়াই মাস পরে রাজশাহী জেল থেকে আমার নামে একটি চিঠি আসে, ওর মৃত্যুর আড়াই মাস পরে । ঐ লেখা চিঠি পড়ে আমি বুঝতে পারলাম ।

স্ত্রী রানীকে লেখা মেজর মমিনের শেষ চিঠি

রানী, শেষ চিঠি লিখছি মাফ করে দিও। শেষ দেখাও হল না। দুঃখ কর না। আমি মাফ করে দিলাম। আমার হয়ে সবার কাছে মাফ চেয়ে নিও। তােমার জীবনটা নষ্ট করলাম। বাচ্চা হলে বলিও সবকিছু। বাবাকে লিখেছি কোথায় কবর দিবে । তােমার জন্য কবরের পাশে ১/৩ কাঠা জমি দিতে । চট্টগ্রামের প্লট বিক্রি করে যদি ভালাে মনে কর এখানে বাড়ি করে থাকতে পার। সবার কাছে আমার হয়ে মাফ চেয়ে নিও। তােমারই মুমিন ২৩/৯/৮১ তােমার ভবিষ্যত সম্পূর্ণভাবে তােমার ইচ্ছায় চলবে।

মেজর মুজিবুর রহমান

বিএসএস- ১১৬৭ মেজর মােহাম্মদ মুজিবুর রহমান

জন্ম : ১৯৫৩ জন্মস্থান : মাইজদী, নােয়াখালী বাবা : মফজুলুর রহমান সেনাবাহিনীতে যােগদান : ৯ জানুয়ারি ১৯৭৪ কমিশন : ১১ জানুয়ারি ১৯৭৫ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ২ নং সেক্টর, কুমিল্লা বিবাহ : ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সর্বশেষ অবস্থান : অফিসার কমান্ডিং

| ৫৭৫ ফিল্ড ইনটেলিজেন্ট ইউনিট মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, রাজশাহী কারাগার কবর : সাতকুচিয়া, সুধারাম, ফেনী মেজর মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ সালে নােয়াখালী জেলার মাইজদীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে মুজিব পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে এয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। এ অবস্থায়

১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মুজিব দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে মে মাসে করাচি থেকে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। কুমিল্লা সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম বিএমএ কোর্স-এ যােগদানের মাধ্যমে মুজিব সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ১১ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে মুজিব প্রথম বিএমএ ব্যাচের সঙ্গে কমিশন লাভ করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মমিন ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পদে উন্নীত হয়ে চট্টগ্রামের ৫৭৫ ফিল্ড ইনটেলিজেন্স-এর অফিসার কমান্ডিং হিসেবে নিয়ােগ লাভ করেন। এই পদে কর্মরত থাকাবস্থায় ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হন। ২৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহী কারাগারে মাত্র ২৮ বছর। বয়সে এই বীর মুক্তিযােদ্ধার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাসির ২৪ দিন আগে ২৮ আগস্ট মেজর মুজিবের একমাত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। দশদিনের মাথায় নবজাতক সন্তান মারা যায় । ফাসির পর মেজর মুজিবকে গ্রামের বাড়ি নােয়াখালী জেলার সুধারাম থানার সাতকুচিয়া গ্রামে সমাহিত করা হয়।

জেলখানা থেকে স্ত্রীকে লেখা মেজর মুজিবের চিঠি

লক্ষ্মী প্রথমেই আমার আদর নিও। তবে শেষ নয়, নিশ্চয়ই মনে করলেই আমাকে পাবে। আল্লাহর ইচ্ছা। এটা মনে হয় শেষ চিঠি। আগেরগুলােও পড়। তােমার মনে আছে Engagement এর পরেরদিন তুমি আমাকে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা উপহার দিয়েছিলে । আজ আমি তােমাকে দেব গাের। মুজিব

ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আবদুস সাত্তার

বিএসএস- ১০৭০ ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আবদুস সাত্তার। জন্ম :৩১ জানুয়ারি ১৯৫১ জন্মস্থান : কচুয়া, কুমিল্লা কমিশন : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান : ১নং সেক্টর বিবাহ : অবিবাহিত সর্বশেষ অবস্থান : ৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, কুমিল্লা কারাগার কবর : হালিশহর, চট্টগ্রাম ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আবদুস সাত্তার ৩১ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে কুমিল্লা জেলার কচুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে

গেলে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অবস্থায় দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে পরীক্ষা বাদ দিয়ে সাত্তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে ১নং সেক্টরে ৬নং ইউনিট কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে চট্টগ্রামের মূল শহর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, হিলট্রাক্টের বিভিন্ন জায়গায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে সাত্তার জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন। ‘৭৫ সালে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রীভূত হলে সাত্তার সেনাবাহিনীতে যুক্ত হন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় সাত্তার ষষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২ জুন ক্যাপ্টেন সাত্তারকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ভােররাতে কুমিল্লা কারাগারে ফাসির মঞ্চে বীর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন সাত্তারের জীনাবসান ঘটে। ফাসির পর সাত্তারকে চট্টগ্রামের হালিশহর পাের্ট কলােনি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

মমা. আবদুল হাই

ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার-এর অনুজ মনােহরখালী, চট্টগ্রাম। কুমিল্লা জেলখানাতে আমি এবং আমার মা আমার আরাে ৩ ভাইসহ দেখা করি। উনার কোমরে এবং হাতে, গলায় সব জায়গায় লােহার চেইন দিয়ে উনাদেরকে ডেথ সেলে রাখা হয়েছে। আমার ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি এই অপরাধে অপরাধী আমি । কিন্তু একদিন আসবে, দেশের মানুষ আমাদেরকে স্মরণ করবে। আমি কোনাে অন্যায় করিনি। আমরা একদিন ছাড়া পাব- এই আশাটি উনার ছিল। আজো আমার মা’কে বলতে পারিনি কেন, কিসের জন্য আমার বড় ভাইকে ফাসি দেয়া হয়েছে। আমার মায়ের অবস্থা খুবই শঙ্কটাপন্ন, উনি বলতে পারেন না কী হয়েছে উনার । আমি এই হত্যার বিচার চাই, সুষ্ঠু বিচার চাই।

জাহেদা বেগম (বয়স-৭৩)

ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার-এর মা নয়াবাজার, চট্টগ্রাম ক্যপ্টেন সাত্তারের বৃদ্ধা মা মিসেস জাহেদা বেগমের বর্তমান বয়স- ৭২ বছর। শারীরিক অসুস্থতা ও বিভিন্ন কারণে বর্তমানে তিনি স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন । আমাদেরকে তিনি সাত্তার এবং তার ফাসি নিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন।

ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার-এর মায়ের বিবৃতি আমি কী বক্তব্য রাখবাে। কোনাে কথাই আজ আমি বলতে পারছি না। মনে এত কথা এত ব্যথা যা বােঝানাে সম্ভব নয়। যে সন্তানকে পেটে ধরেছিলাম তাকে

স্বাধীনতার লড়াইয়ের ময়দানে ছেড়ে দিয়েছিলাম । মরবে কি বাচবে এটা সেদিন ভাবিনি। দেশ স্বাধীন হলাে। অনেক মা তার সন্তানকে হারালাে এই স্বাধীনতা যুদ্ধে। আমার ছেলে সাত্তার ফিরে এলাে আমার বুকে। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডাক দিলেন সােনার বাংলা গড়ার জন্য। আমার ছেলেকে আবার ছেড়ে দিলাম। দেশমাতৃকার সেবায় যােগ দিল সে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। কীভাবে নিহত হলেন কারা তাকে হত্যা করলাে এর কিছুই দেশবাসী জানলাে না। অথচ সেনাবিদ্রোহের একটা অভিযােগ চাপিয়ে বেছে বেছে মুক্তিযােদ্ধাদের ফাসি দিল, জেল দিল, চাকরিচ্যুত করলাে। আমি তাে মা, আমার ছেলে তাে এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করে শক্রর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল অথচ আমার সেই সন্তান এই স্বাধীন দেশে একটা মিথ্যে অপবাদ নিয়ে বিদায় হবে এটা কি মেনে নেয়া যায়? আমার। ছেলে যদি সত্যি অপরাধী হয়ে থাকে তা হলে মা হিসেবে আমার কি তা জানার কোনাে অধিকার নাই? সরকারের কাছে আমার আবেদন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে। “৮১-র প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে জনসমক্ষে প্রচার করা হােক এবং প্রকৃতপক্ষে যারা দোষী ছিল তাদের মুখােশ খুলে দেয়া হােক। আমার সন্তান যদি নির্দোষ। প্রমাণিত হয় তাহলে যারা তাকে ফাসি দিয়ে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি দেয়া হােক। অন্তত মৃত্যুর আগে আমার মুক্তিযােদ্ধা সন্তানের হারানাে সম্মান ও গৌরব। পুনরুদ্ধার হয়েছে এটা আমি দেখে যেতে চাই।

ক্যাপ্টেন জামিল হক

বিএসএস- ১৫২৬ ক্যাপ্টেন জামিল হক

জন্ম : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ জন্মস্থান : রাওয়ালপিন্ডি, পাকিস্তান বাবা : এ.এফ.এম আবদুল হক সেনাবাহিনীতে যােগদান : নভেম্বর ১৯৭৫ কমিশন : ১৯৭৬ বিবাহ : ২১ এপ্রিল ১৯৭৮ সন্তান : ১ ছেলে সর্বশেষ অবস্থান : ২১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, চট্টগ্রাম কারাগার

রাত ১২.১৫ মি.। কবর : নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম। ক্যাপ্টেন জামিল হক ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানের কোয়েটা, পেশােয়ার ও ময়মনসিংহ ক্যাডেট

কলেজে পড়াশােনা করেন। ১৯৭৫ সালে জামিল আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশের পর ‘৭৫ সালের নবেম্বর মাসেই জামিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি। সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে লে, জামিল হক ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন এবং ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ােগ লাভ করেন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি হত্যার সময় তিনি এই পদেই। কর্মরত ছিলেন। ২৫তম জন্মদিনের তিনদিন পর চট্টগ্রাম কারাগারে ২৩ সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম উদীয়মান তরুণ অফিসার জামিল হকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তাকে কোনাে চিঠি লিখতে দেয়া হয়নি। এমনকি তার ছােট ভাই জিয়াউল হক তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পর্যন্ত পাননি। নিয়তির নির্মম পরিহাস জামিল হকের ফাসির সময় তার বাবা ব্রিগেডিয়ার আবদুল হক ছিলেন ডেপুটেশনে আইজি প্রিজন। ফাসির পর ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ী জামিল হককে চট্টগ্রামের গরীবুল্লাহ শাহ’র মাজারে সমাহিত করা হয়।

লেঃ রফিকুল হাসান খান

বিএসএস- ১৭৪২ লে. মােহাম্মদ রফিকুল হাসান খান

জন্ম : ১৯৫৮ জন্মস্থান : মেহেরপুর, কুষ্টিয়া বাবা ; মােহাম্মদ হাশেম আলী খান। সেনাবাহিনীতে যােগদান : ৩য় সপ্তাহ জুলাই ১৯৭৭ কমিশন : ১৮ জুন ১৯৭৮ বিবাহ ; অবিবাহিত সর্বশেষ অবস্থান : ৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। মৃত্যু : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, যশাের কারাগার কবর : মেহেরপুর, কুষ্টিয়া লেঃ রফিকুল হাসান খান ১৯৫৮ সালে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। রফিক ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়াশুনা করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৩ বছরের কিশাের রফিক মুক্তিযােদ্ধা পিতা মােহাম্মদ হাশেম আলী খানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে নদীয়া জেলার একটি ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকার ভিত্তিতে চতুর্দশ স্থান লাভ করে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এইচএসসি পাশের পর রফিক ‘৭৭-এর ২৫ জুলাই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ভাটিয়ারিতে যােগ দেন। ১৮ জুলাই

‘৭৮ সালে তিনি কমিশন লাভ করে ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মজীবন শুরু করেন। ৩০ মে ‘৮১ সালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের সময় রফিক ষষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবেই কর্মরত ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং ঘােষণা করেন ৩১ মে দুপুর বারােটার মধ্যে যারা শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করে অনুগত বাহিনীর সঙ্গে যােগ দেবে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হবে। পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ ১৮ ঘণ্টা বৃদ্ধি করে ১ জুন ভাের ছ’টা পর্যন্ত এর মেয়াদ বৃদ্ধি করেন এবং ঘােষণা দেন যারা এই নির্দেশ মানবে তাদের তিনি পূর্ণ নিরাপত্তা দিবেন। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার মেয়াদ বলবৎ থাকাকালীন সময়েই ৩১ মে ফেনীতে ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের অস্থায়ী সদর দপ্তরে লে, রফিক আত্মসমর্পণ করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ‘৮১ সালে যশাের কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে মাত্র ২৩ বছর বয়সে এই তরুণ বীর মুক্তিযােদ্ধা লে, রফিকের আড়াই বছরের সামরিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফাসির পর লে, রফিককে মেহেরপুরের পৌরসভা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে ফাঁসির মঞ্চে এই তরুণ অফিসারের জীবনাবসান ঘটে।

যশাের কারাগার থেকে বন্ধু জিয়াকে লেখা রফিকের চিঠি

C/0- DIG Jessore Central Jail 17 Sep 81.

My Dearest Zia পরম প্রতিপালক অপরিসীম দাতা দয়ালু মহাপবিত্র প্রভুর নামে প্রাণঢালা প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল । পত্রপ্রাপ্তির স্বীকার করছি। মৃত্যুর সেলে খুনী আসামি হয়ে তাের চিঠি প্রাপ্তির মর্যাদা ভাষায় অব্যক্ত। কৃতজ্ঞ ও আন্তরিক ধন্যবাদ। বস্তুত জিয়াকে রক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ দেখি তাকে খুনের দায়ে আমি জড়িত। আল্লাহ যদি চান সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই এবং সবই জানবি। তবে এটুকু নির্বিঘ্নে বিশ্বাস করতে পারিস আমি অপরাধপ্রবণ নই বরঞ্চ নৈতিক আর শেষে নৈতিকতার বােকামিই আমার কাল । গত ১১ আগস্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশ হাতে পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ ছাড়া কিছুই আসেনি আমার মনে ব্যক্তিগতভাবে আমি আন্তরিকভাবে নিরপরাধ। পরিবেশের নির্মম শিকার হিসেবে মেনে নিয়েছি। তুই বােধহয় জানতি জিয়াকে আমিও ভালােবাসতাম । সেই ১১ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি আমি। অবশ্য এতেও আমি দৃঢ়বিশ্বাসী যে এই মৃত্যুসেলে আমরা কল্পনাতীতভাবে এসেছি। নিশচয়ই সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায়। কোথায় তাের সাথে দেখা করার প্ল্যান ছিল। আর আজ এখানে। যাক সবকিছুর চাহিদা বিলীন হউক। ৩৮২৭৪৪ নাম্বারে ফুফুকে শুভেচ্ছা জানাস। আপাতত দেখা সম্ভব নয়। আল্লাহই জানে। বিয়ে

করে একটি সুন্দর একটা পবিত্র জীবন অতিবাহিত করিস। তাের সর্বপ্রকার মঙ্গল কামনা, প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তেআমি লে, রফিকুল হাসান খান মল্লিকপাড়া মেহেরপুর

মাে. হাশেম আলী খান

লে. রফিকুল হাসান খান এর বাবা মল্লিকপাড়া, মেহেরপুর আমি এবং রফিকের মা দুইজন তার ফাসি হওয়ার আগে প্রত্যেক সপ্তাহে যশাের গিয়ে দেখা করতাম। সে বলত আব্বা যেতে যখন হবে তখন সকাল সকাল যাওয়াই ভালাে। আমি দুনিয়াতে এসেছিলাম সাদা কাফনে, সাদা কাফন নিয়েই চলে গেলাম। আমি নির্দোষ, আমি এবং আমরা কয়েকজন জিয়াকে রক্ষা করার জন্য সার্কিট হাউজে গিয়েছিলাম। আমাদের যারা অর্ডার দিল, আমাদের উপরওয়ালারা, দেখলাম তারা আমার পেছন দিয়ে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে আমাদের সামনে সরাসরি স্টেনগান দিয়ে তার বুক ঝাঝরা করে দিল। আব্বা, আমরা নির্দোষ এই কথা সবসময় বলত। | যখন ফাসির হাইকোর্টের অর্ডার সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখলাে ঢেকে রাখা ট্রাকের ওপরে, বস্তার ওপরে উঠে বসলাম যদি শেষবারের মতাে বাবাকে দেখতে পাই। ভাের হয়ে গেল তখন দেখি যশাের জেল লােকে লােকারণ্য। সব রাস্তায় মিছিল। ওর ডেডবডি যাবে যে পথে, সব মিছিল। যশােরে আমি জেলার এডজুটেন্ট ছিলাম। সবাই আমাকে চেনে। আমার ছেলে বলে যশাের শহরে মাতম হচ্ছে। সবাই থামায়, থামিয়ে মুখ দেখে। সেই কফিন দেখাতে দেখাতে যশাের থেকে মেহেরপুরে আসতে লাগে ২ ঘণ্টা (স্ক্রিনে লেখা সাক্ষাঙ্কারটি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ধারণ করা হয়, তিনি ১৮ ডিসেম্বর ২০০৬ মৃত্যুবরণ করেছেন) সেখানে লেগে গেল ৮ ঘণ্টা। আমরা কিছুই জানতে পারিনি, আমার ছেলে কিসের অপরাধী। এখন রফিকের মাজার জিয়ারত এবং এখানে এসে মৃত্যুর প্রহর গোনাএই হচ্ছে আমার বর্তমান পেশা।

মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান (অব.) বীর উত্তম

সদস্য, চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলার জন্য গঠিত কোর্ট মার্শালের কোর্ট অব ইনকোয়ারি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় আমি ঢাকাতে স্কুল অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের কমান্ডেন্ট ছিলাম। ২ জুন আমাকে সেনাসদর থেকে টেলিফোন করে বলা হয় চিটাগাংয়ের একজন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমাকে বদলি করা

হয়েছে। আরাে বলা হলাে যে জেনারেল মান্নাফ রংপুর থেকে যাচ্ছেন চিটাগাং-এর জিওসি হিসেবে। তিনি হেলিকপ্টারে যাবেন ঢাকা হয়ে আমি যেন প্রস্তুত থাকি উনার সাথে চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য। আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে গেলাম এবং অল্পকিছু প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম হেলিকপ্টারের জন্য। তখন আবার সেনাসদর থেকে আমাকে জানানাে হলাে আমার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন যে আপাতত আমার চিটাগাং যাওয়ার প্রয়ােজন নেই। যেহেতু আমি একজন মুক্তিযােদ্ধা অফিসার এবং চিটাগাং সেনানিবাসের বর্তমান যে পরিস্থিতি তা কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটু ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সবাই মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন এজন্য ওখানকার সেনা সদস্যরা মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র একদিন পরেই মেজর জেনারেল মােজাম্মেল হােসেন যাকে এই ঘটনার তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য নিয়ােগ দেয়া হয়। তারই অধীনে আমাকে আবার সদস্য হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হলাে এবং ৩ তারিখেই আমাকে চিটাগাংয়ে পৌঁছাতে হলাে। তদন্ত আদালতে জেনারেল মােজাম্মেলের অধীনে নিযুক্ত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হাফিজ, কর্নেল গােলাম কাদের তদনীন্তন পরে যিনি মেজর জেনারেল হয়েছেন। আমি ছিলাম। এছাড়াও ওখানে উপস্থিত থাকতেন ব্রিগেডিয়ার আশরাফ পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল, উনি এনএসআইতে ছিলেন আর ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মহসীন ডাইরেক্টর অব ইন্টেলিজেন্স-এর। তদন্ত আদালত সাধারণত সেনাবাহিনীতে করা হয় প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা। এবং কারা আসলে কোনাে একটি ঘটনার সাথে জড়িত থাকে তাদের জবানবন্দি নেয়া। এই তদন্ত আদালতের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে যে জিনিসটি তৈরি করা হয় সেটিকে বলে সামারি অব এভিডেন্স অর্থাৎ সাক্ষীর সারসংক্ষেপ। এটির ওপর পরবর্তীকালে চার্জশিট প্রদান করা হয়। আমরা এই ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ের যে তদন্ত আদালত সেটির দায়িত্বে ছিলাম। চিটাগাংয়ে পৌঁছার পর পুরাে ঘটনা স্থান আমরা পরিদর্শন করি। তবে একটি জিনিস যেটি মানতেই হবে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ ছিল পুরাে সেনানিবাসে। মুক্তিযােদ্ধা এবং অমুক্তিযােদ্ধা অফিসার যারা ছিলেন তাদের ভেতরের কথাবার্তা এবং একটি মানসিক দ্বন্দ্ব যে ছিল তা দেখেই বােঝা যাচ্ছিল। সার্কিট হাউসে গেলাম। সেখানে যে রুমে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এবং বাকি সদস্য যারা ছিলেন তাদের সব জায়গাগুলাে দেখলাম এবং মােটামুটি একটি ধারণা নিয়ে আসলাম। একটি অভিন্ন বক্তব্য কিন্তু এই জবানবন্দিতে অভিযুক্তদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। যে তারা কেউই জানতেন না যে কী হতে যাচ্ছে এবং একটি জিনিস আবার সবার মুখে। এসেছে যে কর্নেল মাহবুব, মতি, ফজলে হােসেন, মেজর খালেদ এবং মােজাফফর এরাই পুরােপুরি সক্রিয় ছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এবং বাকি যারা তাদের সাথে গিয়েছিলেন তার জানত এটিই যে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে

সার্কিট হাউস থেকে নিয়ে আসা হবে, সেনানিবাসে একটি দরবার করা হবে। পরদিন ভােরে জিওসি প্রথমদিকে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলেও পরবর্তীকালে কিন্তু তিনি সরাসরি এতে জড়িয়ে পড়েন। তার এরকম বক্তব্য ছিল- They have done it, I never wanted it. এবং আরাে এক জায়গায় আরাে কারাে মুখ থেকে আমরা শুনেছি যে উনি বলেছিলেন- ‘The young people have done it and I arm with them. বিচার শুরু হওয়ার আগেই কিন্তু আসল চক্রান্তকারী যারা ছিলেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীদের মূল সদস্য যারা ছিলেন তারা কিন্তু সকলেই তিন দিনের মাথায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে নিহত হয়ে যান। অবাক হওয়ার মতাে ব্যাপার হলাে যে গােয়েন্দা বিভাগের কাজকর্ম। ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছিল। তারপর জেনারেল মঞ্জুরের যখন বদলি হলাে মিরপুর স্টাফ কলেজে তখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল সেনানিবাসে। সে সম্পর্কে জানি না, তখন কীভাবে আগাম তথ্য দেয়া হয়েছিল সেনাসদরে। কিন্তু ঐরাতে যখন নৈশ প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র, গােলাবারুদ বের করা হচ্ছে, সশস্ত্র অবস্থায় লােকজন গাড়ি বহরের মাধ্যমে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই জিনিসগুলাে দেখার জন্য কেউ ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে এটিও মনে হতে পারে যে তাদের তখন দায়িত্ব ছিল যাতে ওরা সুচারুরূপে কাজগুলাে যেন সম্পন্ন করতে পারে- এই ব্যাপারটিও আমার মনে হয় আমরা তদন্ত আদালতে যদিও উদঘাটন করতে পেরেছি কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট কার্যকরী ব্যবস্থা বা যারা দায়ী ছিল তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা কিন্তু আমরা ভালােভাবে জানতে পারিনি। এবং মনে হয়েছে অনেককে হয়তাে এতে আরাে জড়ানাে যেত যেভাবে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সরাসরি নিয়ে আসা। হয়েছে এটিতে। জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডকে কিন্তু কোনােভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তদন্ত আদালতে কিন্তু লে. কর্নেল মাহফুজকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করিনি এবং উনাকে হেফাজতেও নেয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তকিালে দেখলাম তাকে মামলাতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে এবং তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এই জিনিসটি কীভাবে হলাে তা কিন্তু তদন্ত আদালতের বাকি সদস্যদের মনেও একটি সংশয় ছিল এবং সেই প্রশ্নটির উত্তর আমরা আজো খুঁজে পাইনি। তদন্ত আদালত সম্পন্নকালে আরেকটি জিনিস আমাদের খুব নজরে এসেছিল যে অভিযুক্ত প্রতিটি সেনা অফিসার তাদের বক্তব্যে কোনােধরনের রাখডাক রেখে কথা বলেননি। তাদের মধ্যে কোনাে জড়তা ছিল না। যে যেভাবে যে জায়গাতে ছিল তাদের বক্তব্য যেটি দিয়েছিল সেটি অন্য সদস্যদের অন্য অফিসারদের বক্তব্যে একই ধরনের জিনিস পাওয়া গেছে। ঐ অভিযুক্তদের মধ্যে ক্যাপ্টেন জামিল যে কনিষ্ঠতম অফিসারদের একজন ছিল, সে যে বক্তব্য দেয় তাতে কিন্তু আমরা মােটামুটি সব জিনিসটি পরিষ্কারভাবে পেয়ে যাই। তদন্ত আদালতে আমরা যেটুকু উদ্ঘাটন করতে

পেরেছিলাম আমি মনে করি সঠিকভাবে কিন্তু বিচারে সেভাবে পালন করা হয়নি। আজকে ২৫ বছর পর এখন পর্যন্ত কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকাণ্ডটি একটি বিরাট রহস্য হয়ে রয়েছে। যে ত্বরিত ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরাে বিচারকার্যটি সমাধা করা হয় এবং প্রথমদিকে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয় তাতে মনে হয় পুরাে । জিনিসটিকে আড়াল দেয়ার একটি প্রচেষ্টা ছিল। শ্বেতপত্ৰতেও সেটি অনেকটুকু পরিষ্কার হয়নি। পুরাে ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আবার নতুন করে বিচার, বিবেচনা এবং পর্যালােচনা করার প্রয়ােজন আছে। যারা দণ্ডিত হয়েছে তাদের। সন্তানেরা যে কলঙ্ক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা কি সত্যি তার প্রাপ্য? এসবের জন্য আমি মনে করি এই পুরাে জিনিসটিই আবার নতুনভাবে তদন্ত হওয়ার প্রয়ােজন আছে।

মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (অবঃ) বীর প্রতীক

চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলার কোর্ট মার্শালে আসামি পক্ষের কৌসুলি। ভুল হলে আমি সংশোধন করতে প্রস্তুত জাতির সামনে সাক্ষী রেখে কারণ যেটি বলছি স্মৃতি থেকে বলছি। তখন আমি সেনাবাহিনীতে লে. কর্নেল, ঢাকা সেনানিবাসে সেনাসদরে প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে যখন অফিসে গেলাম মােটর সাইকেল থেকে নামতে নামতে ফিসফিস কানাকানি শুনছি চট্টগ্রামে কিছু একটা হয়েছে। দেখলাম ভীষণ একটি থমথমে ভাব। একটি জটিল। পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ৩০ এবং ৩১ মে সময়টি কাটে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে পড়ি দশ-বারদিন পর। হঠাৎ করে একদিন সেনাবাহিনীর সদরদপ্তরে। এডজুটেন্ট জেনারেল শাখা থেকে আমাকে বলা হলাে চট্টগ্রামে যারা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার হবে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে এবং যারা আসামি। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনকারী হিসেবে তুমি ইবরাহিমের নামও এসেছে। তুমি কি তাদের এ অনুরােধ রক্ষা করবে। এই পর্যায়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে। হয়েছে। আমি সম্মত হই আমার যা হওয়ার হবে, আমি তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করব। পরবর্তীকালে জানতে পারলাম আমি একটি তিনজনের টিমের সদস্য হচ্ছি। একজন তারমধ্যে আমার ইমিডিয়েটলি জ্যেষ্ঠ যিনি তিনি হচ্ছেন কর্নেল আইনউদ্দিন বীর প্রতীক। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন তখন ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আনােয়ার হােসেন। ব্রিগেডিয়ার আনােয়ার হােসেন পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত একজন অফিসার ছিলেন এবং আইন উদ্দিন সাহেব ও আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসার ছিলাম। | চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পৌছালাম। আমাদেরকে জায়গা দেয়া হলাে। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার বা ইবিআরসি অফিসার্স মেসে। বলা হলাে আসামিরা সৰ চট্টগ্রাম কারাগারে আছে এবং সেখানে

আপনাদেরকে যেতে হবে। তাে সেই জেলখানায় ঢুকলাম। ঢুকে আমার মনে আছে যে আমাদেরকে সবগুলাে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আমরা সকলের সঙ্গেই একদিন, দুইদিন, তিনদিনে মনে হয় দেখা করলাম । হৃদয়বিদারক দৃশ্য এজন্য বলছি যে তাদের উপর যে অত্যাচার হয়েছিল শারীরিক এবং মানসিক সেটি আমরা বুঝতে পারলাম, অনুভব করলাম। সেটি আজকে কেউ বিশ্বাস করবে না। একই সেনাবাহিনীর অফিসার তার সহকর্মী অফিসারদের উপরে কীরকমভাবে মানসিক নির্যাতন এবং কীরকমভাবে শারীরিক নির্যাতন করতে পারে। পিঠে লােহা দিয়ে পিটিয়েছে, বেত দিয়ে পিটিয়েছে, গরম তপ্ত লােহা শরীরের সব জায়গায় লাগিয়েছে, নখের ভেতরে সুঁই দিয়েছে, টেনে নখ তুলে ফেলেছে, মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে, হাঁটু কনুই জয়েন্টে পিটুনি দিয়েছে, সেগুলাে ফোলা ফোলা অবস্থায় আছে, চেখের নিচে কালাে দাগ পড়ে গেছে, ঘুষি মেরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি এবং বলতেও লজ্জা লাগে কিন্তু না বললেও নয় মলদ্বার দিয়ে তাদেরকে শক্ত কঠিন জিনিস প্রবেশ করিয়েছে, তাদের পুরুষাঙ্গের ওপরে আঘাত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা অনেকেই কান্নাকাটি করল আবেগে। তারা চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেললাে নিজেদের বুক, আমাদের বুক এবং আমরা কিছুক্ষণের জন্য নিজেরাও আবেগে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গিয়েছিলাম। এখানে না বললেই নয় যে আমরা কিন্তু একলা ছিলাম না। আমাদের সঙ্গে সবসময় গােয়েন্দা বাহিনীর লােক থাকত। তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার আগেই মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিদের মতাে কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল সেখানে ছােট্ট একটি রুম তিন ফিট বা চার ফিট বাই চার ফিট এরকম। একজন লােক পরিষ্কারভাবে শুতেও পারে না, একজন লােক শান্তিতে বসতেও পারে না। সেখানে একটি সানকি দেওয়া হত, মাটির সানকি। সেই সানকিতে তারা পায়খানা করত, সেই সানকিতে প্রস্রাবও করত, সেই সানকিতে তারা ভাতও খেত। আমরা চেষ্টা করেছি। বুঝে নিতে যে ১৯৮১ সালের সেই ভয়াল রাত্রি ৩০ মে’তে ঘটনাটি কী হয়েছিল। কেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলাে। প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১ সালের যারা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন তাদেরকে একসেপ্ট করে নেওয়া জাতীয় রাজনীতির ac foco Betafenco 261 23- In the body politics of the nation. এবং এটির জন্যই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজের জীবন দিয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। | কারাগার থেকে দুই-তিনদিন পরে বেরােলাম। দুইদিন পরে বেরােলাম মানে দুই-তিনদিনই গিয়েছি সকালে যাই দুপুরে আসি বা দুপুরে যাই বিকেলে আসি এরকম আর কি। তাে এক মাস পরে যখন সমস্ত বিষয়টি শেষ করে চলে আসছিলাম তখন আমাদের সমস্ত সুটকেস উল্টিয়ে ঝেড়ে নেড়ে সমস্ত কাগজপত্র গােয়েন্দা বাহিনীর লােকেরা রেখে দিল এবং বলল যে কোনােপ্রকার কলমের শিসে করেও যেন কোনাে জিনিস এই কোর্ট মার্শাল সম্বন্ধে এখান থেকে বাইরে না।

যায় এবং যেটি তােমাদের স্মৃতিতে আছে সেটি তােমাদের রাষ্ট্রীয় অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের আওতায় তােমাদের পেট থেকে, তােমাদের মাথা থেকে বাইরে যাবে না। তিনদিন পরে আমরা বুঝলাম ধারণাটি কী। তখন আমাদের দাঁড়াল যে। আমরা পারিপার্শ্বিক কিছু জ্ঞান আমাদের দরকার। ওরা যা বলেছে সেটি সত্য না তার বাইরে কিছু আছে। সে জন্য আমরা প্রস্তাব রাখলাম যে পরিবার-পরিজনদের। সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যেন আমরা দেখা করতে পারি অবশ্যই। তারা এটিকে মেনে নিল। দেওয়ানহাট ব্রিজের কাছে টাইগার পাসের কোনায় পাহাড়ের ওপরে। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস বা এমইএস-এর একটি ইনসপেকশন বাংলাে। ছিল। সেই বাংলােটি আমাদের জন্য ছেড়ে দিল। | কিছুদিন পরে কোট মার্শাল শুরু হলাে। কোর্ট মার্শাল আসলে একটি বিচারকক্ষ আর কি। বিচারকগণ বসেন একটি মঞ্চে। লালসালু কাপড় দিয়ে ঘেরা থাকে। একপাশে সাক্ষীদের জন্য খাচা থাকে আরেকপাশে টেবিলে আমরা আসামি পক্ষের উকিলেরা বসেছি। এটি চট্টগ্রাম কারাগারের অভ্যন্তরেই একটি কক্ষকে সাজানাে হয়েছে কোর্ট মার্শাল হিসেবে, বিচার করার জন্য। নিয়ম মােতাবেক বাদীপক্ষ অর্থাৎ সরকার পক্ষ উনাদের বক্তব্যটি প্রথমে পড়ে শােনালেন। তারপর আমাদের বক্তব্য। সেটি পড়ে শােনালাম। তারপর সরকার পক্ষ থেকে সাক্ষীদের আনা শুরু হলাে। সাক্ষীদের মধ্যে যাদেরকে আনা হয়েছে তারা সামরিক কর্মকর্তা, তারা সাক্ষী। দিয়েছে যেসব কর্মকাণ্ডের সেগুলাে ছিল ফিজিক্যাল মুভমেন্টের । কোর্ট মার্শাল বেশ কয়েকদিন চলেছে। কথা কাটাকাটি হত। যুক্তি তক্কো উপস্থাপিত হত। কিন্তু চারপাঁচটি কথা এখানে বলে রাখতে হবে। | এক, যে প্রতিরক্ষা গােয়েন্দা পরিদপ্তর বা ইংরেজিতে ডিজিএফআই যেটিকে বলে তাদের কর্মকর্তাগণ কোর্টের ভেতরে বসে থাকতেন। এটি আইনের বিরুদ্ধ কাজ। উনারা যখন বসে থাকতেন তখন আমরা আপত্তি দিতাম আদালতের কাছে যে ইনার উপস্থিতি এটি অবৈধ। আদালত তখন বলতেন আগামীকাল থেকে আপনি আসবেন না। আগামীকাল থেকে তিনি আসতেন না, আরেকজন আসতেন। তখন আমরা বলতাম যে আবার উনি এসেছেন। আদালত বলতাে যে কালকের জন তাে আর আসেননি। এখন নতুন লােককে নতুন আদেশ দিতে হবে। অর্থাৎ আদালত নীরবে সরকার কর্তৃক নেওয়া এই অবৈধ পদক্ষেপটিকে সমর্থন করছে। দুই, তারা ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে আসামিদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতাে যে তােমরা খবরদার এটি বললে মার খাবে, ওটি বললে এই হবে, ওটি বললে ওই হবে এবং আমাদের সঙ্গেও আকারে ইঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করত যে আপনারা যারা আসামি পক্ষ সমর্থন করছেন আপনাদেরও সীমারেখার মধ্যে থাকতে হবে। আপনারা খেয়াল রাখবেন যে আপনারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করছেন এখনাে। তিন, আরেকটি কথা বলে রাখতে হবে যে আমাদেরকে সময় কম দেওয়া

হত। আমরা যথেষ্ট সাক্ষীকেও ডাকতে পারিনি। চার, আরেকটি কথা বলতে হবে, আমরা সরকার পক্ষের সাক্ষীদেরকে জেরা। করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাইনি। পাঁচ. আরেকটি কথা বলতে হবে যে আসলে আমরা ডিফেন্ডিং অফিসার বা আত্মপক্ষ সমর্থনকারী ব্যক্তি ছিলাম তাে মাত্র তিনজন। আর আসামি তাে ছিল ২৯ জন না ৩১ জন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সেনাবাহিনীর আইন মােতাবেক তারা ন্যায়বিচার পাবে কিন্তু আমরা এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সকলেই ন্যায়বিচারটি পায়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে মানুষ কীভাবে মিথ্যে কথা বলে তার একটি একজাম্পল। এই পয়েন্টটি আমিই তুলেছিলাম ব্যক্তিগতভাবে। বেশিরভাগ পয়েন্টগুলাে তুলতেন জেনারেল আইন উদ্দিন সাহেব। তৎকালীন বাংলাদেশ টেলিভিশনে এবং তকালীন বাংলাদেশ রেডিওতে তখনকার আমলে সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ-এর টেপ করা ভাষণ, এক-দুই মিনিটের ভাষণ প্রচারিত হত। সেই ভাষণটি ছিল এই যে-তােমাদেরকে নিঃশর্তভাবে আমরা ক্ষমা করে দেব, তােমরা যদি এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ কর। নিকটস্থ সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাও বা নিকটস্থ থানায় যাও। তােমাদেরকে আমরা ক্ষমা করে। দেব। এই বাণীগুলাে রেডিও এবং টেলিভিশনে মে মাসের ৩০ তারিখ সন্ধ্যা থেকে বা ৩১ তারিখ সকাল থেকে মে মাসের ৩১, জুন মাসের ১ তারিখ, জুন মাসের ২ তারিখ প্রচারিত হয়েছে ঘণ্টায় ঘণ্টায় রেডিও বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে। যারা আসামি তাদের মধ্যে এরকম বহু ব্যক্তি আছে যারা ঐ আহ্বানটি শুনে। আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে বা থানায়। এখন তাদেরকেও আসামি করা হয়েছে। আদালতে সরকার পক্ষ এটি বেমালুম অস্বীকার করল। আদালত সেটি বিশ্বাস করল এবং দুঃখের ব্যাপার হলাে আমরা বলতে চাইলাম যে আপনাদেরকে এটি শুনাই, শােনেন। তারা শুনল তারা শুনে প্রশ্ন করল, বলল এটি তাে ভেজালও হতে পারে, এটি নকল কণ্ঠও হতে পারে। আদালত তখন আমাদেরকে নির্দেশ দিল আপনাদেরকে সত্যায়িত কণ্ঠ আনতে হবে। অর্থাৎ আর্কাইভ, রেডিও বাংলাদেশের রেকর্ড থেকে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের রেকর্ড থেকে আপনাদেরকে এটি এনে দিতে হবে। তখন আমরা বললাম- এটির জন্য। আমাদের সময় প্রয়ােজন এবং সেই সময়ের প্রয়ােজনে আমরা দরখাস্ত দিলাম । তারা দরখাস্ত মঞ্জুর করল এবং বলল একদিন না দুইদিন তােমাদেরকে সময় দিলাম। একদিন না দুইদিন সময় দেয়াটি আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এখানে এটির মালিক তাে আমি না, এটি রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থা। আমি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি সরকারের এবং সেই আদালতের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড। তারা আমাদের সঙ্গে বেঈমানি করেছে, মােনাফেকি করেছে। তারা আমাদেরকে সেই। টেপ আনতে দেয়নি, সেই টেপ এনে বাজিয়ে শােনাতে দেয়নি। তাদের হুকুম।

ছিল যে রেডিও বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মকর্তা এসে বলবে এটি অমুক তারিখে বাজানাে টেপ আমি সত্য বলে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। এই ঘটনাটি তারা আদালতে করতে দেয়নি, তার পূর্বেই তারা আদালতকে পুনরায় বসিয়ে, তারা এই আদালতটিতে রায় টায় দিয়ে শেষ করে দিল এবং এরজন্য দায়ী তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার সাহেব। ইনাদের উভয়ের এই মিথ্যাচারের জন্য এবং এই অন্যায়ের জন্য বিচার হওয়া প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি। | শাস্তিটি আইনের মাধ্যমে হতে হবে, শাস্তিটি আনুপাতিক হতে হবে। আদালত সম্পর্কে, কোর্ট মার্শাল সম্পর্কে আমার এটিই বক্তব্য যে অনুপাতের বাইরে অনেককে শাস্তি দিয়েছে, নির্দোষ অনেকে শাস্তি পেয়েছে, দোষী ব্যক্তি অনেকে বাইরে থেকে গেছে। আদালত যেদিন শেষ হবে সেদিন আমরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট চিত্তে, অসন্তুষ্ট মন নিয়ে আদালতের কক্ষ থেকে বেরিয়েছি। ‘৮১ সালের পুরাে ঘটনাটিকে পুনরায় কি বিচার করা যায়? ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রউবিনের ১ম পৃষ্ঠা এবং ২য় পৃষ্ঠায় এই কলামটি এসেছে। ফরাসি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন রিফিউজ- উনার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযােগ আনা। হয়েছিল- বিদেশিদের সঙ্গে ১৮৯০-এর দশকে। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি। করেছিলেন, তার বিচার হয় কোট মার্শালে বা আদালতে। সেই বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি আপিল করেন। সেই আপিলে পুনরায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। কিছুদিন পর ফরাসি জনগণ এবং তার সহকর্মীরা বলল আমাদের সঙ্গী ক্যাপ্টেন রিফিউজের বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়েছে। আমরা তার পুণরায় বিচার দাবি করি । ফরাসি সরকার এবং সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ সেটি মেনে নিয়েছিল। মেনে নিয়ে তার পুনরায় বিচার করেছে এবং সেই বিচারে রিফিউজ নির্দোষ প্রমাণিত হয়। এখন ইতােমধ্যে কিন্তু তিনি মারা গেছেন। মারা যাওয়াতে ফরাসি সরকার তার সম্মানটিকে পুনর্বহাল করা হলাে। জাতির সামনে, তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হলাে, তার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলাে এবং রাষ্ট্রপতি সেই সকল কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিলেন। আমি দাবি করছি। পুনরায় আরেকবার কোর্ট মার্শাল করুন। এটি রিভিউ করুক। কারণ এতবড় একটি ঘটনা ঘটেছে, নির্দোষ ব্যক্তিরা যারা শাস্তি পেয়েছে তারা যেন বেঁচে যায়। দোষী যদি কেউ থেকে থাকে শাস্তি দেন আমার আপত্তি নেই। | নির্দোষ ব্যক্তি যে শাস্তি পেয়েছে এটি নিঃসন্দেহ আমি। একটি একজাম্পল রফিক। তারা কিন্তু সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করেছেন, সঠিক জায়গাতে। আত্মসমর্পণ করেছে, তার বন্ধুর কাছে। কিন্তু সেটি রেকর্ডে না রেখে মিথ্যা কথা। বলা হলাে। তার বন্ধুকে যখন আমরা সাক্ষী হিসেবে ডাকতে চেয়েছি তাকে। ডাকতে দেয়া হয়নি।

মেজর ইসহাক আহমদ বেগ পিএসসি (অব.)

২৩ সেপ্টেম্বর ৮১ সালে ফাঁসি হওয়া লে, রফিক-এর কোর্সমেট।

রফিকের সাথে পরিচয় আমার ‘৭৭-এ বিএমএ-তে। একসাথে আমরা পােস্টিং পাই কমিশনের পর যশােরে। আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে যশােরে থাকাকালীন সময়ে। দশটার দিকে আমাকে ঘুম থেকে ধাক্কিয়ে উঠাল আমার বােন। যেয়ে দেখি বিচারপতি সাত্তার ভাষণ দিচ্ছেন। কতিপয় দুষ্কৃতকারী রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। এবং এর সাথে এও বললেন যে যারা ১ জুন সকাল ৬ টার মধ্যে সারেন্ডার করবে বা আত্মসমর্পণ করবে তাদের সকলকেই সাধারণ ক্ষমতার আওতায় ফেলা হবে অর্থাৎ তাদের কোনাে বিচার হবে না। আমি নােয়াখালী এক্সপ্রেসে করে ভােররাতের দিকে পৌছালাম কুমিল্লায়। ইউনিটে গিয়ে দেখি উপ-অধিনায়ক তখনাে ইউনিটেই। বাকি ইউনিট ফাকা। উনি আমাকে বললেন যে একটি পিকআপ যাবে একটু পরে ফেনীতে, তুমি ফেনীতে চলে যাও। গিয়ে সােজা তুমি রিপাের্ট করবে ব্রিগেডে । আমি রিপাের্ট করে জানলাম যে আমাকে জিএসও-৩ হিসেবে অস্থায়ী নিয়ােগ দেয়া হয়েছে। এবং আমার কাজ হলাে চিটাগাং থেকে যারাই আসছে, যেসব সৈনিক তাদেরকে আত্মসমর্পণ করানাে এবং তাদের অস্ত্রগুলাে জমা নেওয়া। সন্ধে ছ’টায় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম লে, রফিক, লে, মােসলেহ এবং আরাে কিছু অফিসার মিলে এসেছে। আত্মসমর্পণ করতে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার খুব আনন্দ হলাে রফিক এসেছে আর আত্মসমর্পণ করার সময় তখনাে ১২ ঘণ্টারও বেশি বাকি। রফিককে আমি আমার কক্ষে জায়গা করে দিলাম । কাছে শুয়ে রাতে দু’জন কথা বলছি। রফিক হঠাৎ বলল আমাকে- “দোস্ত, আমাদেরকে ওরা ঝুলিয়ে দেবে।’ ওরা তােমাকে ঝুলিয়ে দেবে কেন? একে তুই প্রায় ১২ ঘণ্টার মতাে আগে আমার কাছে। আত্মসমর্পণ করেছিস। আমি ইন রাইটিং তাের আত্মসমর্পণের ব্যাপারটি নিয়েছি। এবং সিল এন্ড সাইন- তাের তাে কোনাে ভয়ই নেই। তাের তাে কোনােরকম বিচারই হবে না। | ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, ফাসি হয়ে গেল অন্যান্য ১২ জন অফিসারের সাথে রফিকেরও। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করার যে মেয়াদোত্তীর্ণ কাল তারও ১২ ঘণ্টার মতাে আগে যে একেবারেই ফরমালি, অফিশিয়ালি আমার কাছে সারেন্ডার করে তার ফাসি হয় কীভাবে? এই প্রশ্নটি আমার আজকেও। রাষ্ট্রপতি তাে কোনাে হেলাফেলার পদ নয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার যিনি অবশ্যই একজন বিচারপতিও ছিলেন, তার মুখ দিয়ে বলা এই কথার কি কোনাে দাম নেই? আজো আমাকে এই ব্যাপারটি তাড়িয়ে বেড়ায় কেন আমি তখন রফিককে বললাম না, রফিক, তুই চলে যা এখন এখান থেকে, ভেগে চলে যা, যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যা। কেন আমি তাকে বলেছিলাম যে সাধারণ ক্ষমার।

আওতায় তাে তুই পড়েছিস। কারণ কোনাে সময় আমার মাথার মধ্যেও আনতে পারিনি যে রাষ্ট্রপতি মিথ্যে কথা বলতে পারেন।

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ আইন উদ্দিন (অব.) বীর প্রতীক

চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলার কোর্ট মার্শালে আসামি পক্ষের কৌসুলি ১৯৮১ সনে আমি রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। কিছুদিন পরে তড়িঘড়ি করে যখন চিটাগাং-এ বিদ্রোহীদের ট্রায়াল করার একটি বন্দোবস্ত করা হলাে তখন। আমাকে ঢাকা থেকে এডজুটেন্ট জেনারেল জানাল যে আমাকে ডিফেন্স কাউন্সিল হিসেবে যেতে হবে ঐ ট্রায়ালে এবং একদিন পরে আমাকে ঢাকায় ডাকিয়ে নিয়ে আসা হয় এবং আমাকে উনি ব্রিফিং দেন। তারপরে আমি চিটাগাং ট্রায়ালে যাই। সে ট্রায়ালে গিয়ে যেটি আমি দেখতে পেলাম ট্রায়ালের আগেই তাদেরকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে এবং তাদের উপরে অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল নওয়াজেশ, কর্নেল রশিদ প্রত্যেকেরই গায়ের চামড়া প্রায় উঠানাে হয়েছিল, নােখ উপড়ানাে ছিল এবং তাদের হাতে পায়ে বেড়ি বাঁধা ছিল। তারপরে ট্রায়াল শুরু হলাে। সেই ট্রায়ালে জেনারেল আব্দুর রহমান নামে একজন রিপ্যাট্রিয়ট অফিসার- উনি সেটির চেয়ারম্যান ছিলেন, সাথে আরাে পাঁচজন অফিসার ছিলেন যারা মেম্বার হিসেবে কাজ করেছে। কোর্টের স্থান ছিল চট্টগ্রাম জেলখানার ভেতরে একটি বিল্ডিংকে রিনােভেট করে কোর্টের আকার ধারণ করানাে হলাে এবং প্রথম দিন যখন কোর্ট শুরু হলাে তখন সবাইকে সিভিল ড্রেসে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় নিয়ে আসল। আমি আপত্তি জানালাম যে তাদের এখনাে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, তাদের পানিশমেন্ট হয়নি, তাদেরকে ইউনিফর্ম ছাড়া কেন আনা হলাে। ঐখানে যে জাজ এডভােকেট ছিল উনি বললেন যে। অবজেকশন সাসটেনন্ড । সুতরাং কোট এডজন্ট করে তাদেরকে পরেরদিন আবার ইউনিফর্ম পরিয়ে কোর্টে হাজির করানাে হলাে। কোর্ট ইন ক্যামেরা ছিল অর্থ হলাে কোর্টের ভেতরে কোর্টের প্রেসিডেন্ট, মেম্বার, প্রসিকিউটর এবং ডিফেন্স কাউন্সিল এবং একুইসড ছাড়া অন্য কারাে থাকার কথা নয়। কিন্তু ওখানে ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন-এর অফিসার বসা থাকত। এটির অর্থ এই ছিল যে ডিজিএফআই বা এএসইউর লােকজন থাকলে আমরা ভয় পাব এবং আমরা যাতে আমাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে না পারি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রত্যেক একুসড-এর সাথে কথা বলার এবং তাদের যে স্টেটমেন্ট এবং যেটুকু কোর্টের ভেতরে প্রমাণিত হলাে এতে আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে ওই বারােজন। যাদের ফাসি দেয়া হয়েছে এর ভেতর বেশ কয়েকজন ছিল যারা নিরপরাধ এবং তাদের খেলাফ কোর্ট মার্শালেও সাক্ষী প্রমাণে এটি প্রমাণিত হয়নি যে তারা অপরাধ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলাে যে তাদের ফাসি হয়ে গেছে। পরে যেটি

আমি জানতে পারলাম তেরজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল এর ভেতর মেজর কাইয়ুম নামে একজন অফিসারকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ওই মেজর কাইয়ুম তখন দেশত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যায়। কোর্ট মার্শাল যখন গঠিত হয় সেই কোর্ট মার্শাল চলে ১৭ দিন এবং কোর্ট মার্শালের ভেতরে যে অবস্থা ছিল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান আমাকে এক, দুইবার যেটি কোর্টের ভেতরে উনি করতে পারেন না, উনি আমাকে ধমক দিয়েছেন এবং ক্রস একজামিনেশন-এর সময়ও আমি যে ক্রস একজামিনেশন করেছি পরে যখন এটির প্রসেডিং-এর খসড়া পেতাম তাতে দেখা যেত বেশিরভাগ ক্রস একজামিনেশন-এর যে অ্যানসার সেগুলাে থাকত না কোশ্চেনও থাকত না। এটি কোর্ট মার্শালের নিয়ম-বহির্ভূত ব্যাপার। বজলুর রহমান নামে ছিল জাজ এডভােকেট । উনি কোর্ট মার্শালের কিছুদিন পরেই পাগল হয়ে যান এবং উনি মেডিকেলে বাের্ড আউট হন এবং পরে তিনি সুইসাইড করেন। এটি দিয়ে আমি বলতে চাচ্ছি যে ওই জাজ এডভােকেট যেহেতু তার নিউট্রাল দায়িত্ব ঠিকমতাে পালন করতে পারেননি কোর্টের ভেতরে এরজন্য তার ভেতরে একটি অনুশােচনা কাজ করেছে যার ফলে তার তার ব্রেন আউট হয়ে যায় তিনি পাগল হয়ে যান। শেষপর্যন্ত উনি সুইসাইড করে মারা যান। ২৯ জন যাদেরকে ট্রায়ালে নেয়া হলাে। সবাই মুক্তিযােদ্ধা। ঘটনার দিন যখন মিউটিনি হয় চিটাগাংয়ে যে সেকশনের নিচে তাদেরকে ট্রায়াল করা হয় সেই সেকশনে কিন্তু ফ্রিডম ফাইটার, রিপ্যাট্রিয়ট বলতে কোনাে জিনিস ছিল না ।

ঐখানে আরাে অনেকে ছিল যারা ঐ মিউটিনিতে পার্টিসিপেট করেছে তাদেরকে ট্রায়ালে আনা হয়নি যেহেতু তারা ফ্রিডম ফাইটার নয়। আমাদের ক্রস একজামিন করার জন্য যেটুকু প্রসিডিং আমাদের হাতে দেয়ার কথা সেগুলাে পুরােপুরি দিত না। দেয়ার পরে পরেরদিনই আবার তারা নিয়ে নিত সেগুলাে এবং আমাদের প্রত্যেকদিনই একটি করে সার্টিফিকেট দিতে হত যে এই কোর্ট সংক্রান্ত কোনাে কাগজ বা কোনাে লেখার টুকরাে কাগজ কিছুই আমাদের। সাথে থাকবে না। যার জন্য আমাদের ওই আগেরদিনের প্রসেডিং-এর খসড়া নিয়ে সামান্য একটু স্টাডি করা ছাড়া অন্য কোনাে গত্যন্তর ছিল না। আমাদের ক্রস একজামিনেশন-এর সময়েও অনেক সময় আমাদের বাধা দিয়েছে। যেমন আমি একটি উদাহরণ বলতে পারি প্রথম যে প্রসিকিউশন উইটনেস ছিল ব্রিগেডিয়ার আবদুল ওয়াহেদ। উনার ব্যারাসিটি এবং উনার ক্রেডিবিলিটি শেক করার জন্য আমি এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ১০১ থেকে ১১৪ পর্যন্ত ধারাবলে যখনি ক্রস একজামিনেশন করেছি কোনাে এক স্টেজে ব্রিগেডিয়ার ওয়াহেদ জ্ঞান হারান এবং উনি চেয়ার নিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। তখন কোর্ট এডজন্ট করে এবং ঐ ব্রিগেডিয়ার ওয়াহেদকে দ্বিতীয়বার আর ক্রস একজাম করতে দেয়া হয়নি। তারপরে আরেকজন উইটনেস-এর কথা আমি বলব, আমরা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে।

এসেছিলাম তােফাজ্জল হােসেন বেগ। তাকে কোর্টের ভেতরে আমার জানামতে আমি তাকে প্রমাণ করে ছেড়ে দিয়েছি যে সে মিথুক। যারা ফিজিক্যালি সাক্ষী দিতে আসল কোনাে একটি সাক্ষীও এফেক্টিভ ছিল না। সিকিউরিটি রক্ষা করার জন্য একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। উনি প্রত্যেকদিনই জেলখানার ভেতরে ঢোকার সময় আমাদের ব্যাগ, কাগজপত্র সব চেক করতেন। বেরিয়ে আসার সময়ও চেক করতেন এবং সময় এত কম ছিল যে ১৭ দিনের ট্রায়ালে আমার মনে আছে আমি এভারেজ রাতে দুই-তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারিনি। একটি অসহনীয় অবস্থাতে ডিফেন্স কাউন্সিল কতটুকু করতে পারে? আর আমাদের সাথে। যে ব্রিগেডিয়ার ছিল আনােয়ার হােসেন পরে উনি মেজর জেনারেল হন উনি ডিফেন্স কাউন্সিল হিসেবে কোনাে কাজই করেননি। উনাকে মূলত রাখা হয়েছিল আমাদেরকে কন্ট্রোল করার জন্য। এত তড়িঘড়ি করে এত বড় একটি কোর্ট মার্শাল করা হয়েছে, এতগুলাে অফিসারের কোর্ট মার্শাল অ্যাট এ টাইম ওয়াল্ড হিস্ট্রিতে নেই। | জেনারেল রহমান যিনি কোর্ট মার্শালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তার সম্পর্কে আমি শুধু একটি কথাই বলতে পারি তিনি একসেন্ট্রি টাইপ লােক ছিলেন। পট করে মেজাজ হারাতেন। পরে বাইরে গিয়ে উনি আমাকে থ্রেট করলেন যে আমি বেশি। কথাবার্তা বললে উনি আমাকে দেখে নেবেন। কোর্ট মার্শালের পরে একটি হােয়াইট পেপার পাবলিশ করে আইএসপিআর-এর মাধ্যমে। যে হােয়াইট পেপারটিকে আমি বলতে চাই এটি ব্লাক পেপার ছিল এবং সত্যের অপলাপ ছিল। যা ছিল তার সবই ছিল এক তরফা এবং সাজানাে ঘটনা।

আজিজ-উর-রহমান

জেলা প্রশাসক, রাজশাহী জেলা- ১৯৮১

আমি তখন বৃহত্তর রাজশাহী জেলা প্রশাসক। ডিআইজি আমাকে টেলিফোন করলেন বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে আজকে রাতেই ফাসির আদেশ কার্যকর করতে হবে অন্যথায় সেন্ট্রাল জেল উড়িয়ে দেয়া হবে। তারপর এলাে সেইদিন। সন্ধ্যার পর আমি আমার বাসভবনের অফিসে কাজ করছিলাম। ডিআইডি প্রিজন আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। তার হাতে একটি ফাইল। তিনি আমাকে বললেন আজকেই ফাসির আদেশ কার্যকর করা হবে। মৃত্যুদণ্ডের আদেশে আমি দেখলাম মূল তারিখটি কেটে দিয়ে সেখানে আবার নতুন তারিখ বসানাে হয়েছে। সেখানে একজন কর্নেলের সিগনেচার। আমি ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন এবং দুইজন ফাস্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকে আনলাম । ভারপ্রাপ্ত এসপি করুণভাবে অব্যাহতি চাইলেন। আমি ঢাকার সাথে যােগাযােগ করতে চেষ্টা করলাম। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের টেলিফোনের সাথে আমার টেলিফোনের ক্রস কানেকশন হয়ে গেল। শুনতে পেলাম কে যেন কাকে

বলছে রাজশাহীর ডিসি বাগড়া দিচ্ছে। খাবার টেবিলে ঢাকার থেকে একটি এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম আসলাে। সেই টেলিগ্রামে লেখা ছিল- The execution must be done by tonight repeat by tonight. Any Violation shall be seriousely death with. তারমানে Violation-এ আমারই কি মৃত্যু হবে। পােস্ট অফিসের লােকেরা Deal কথাটিকে বানান ভুল করে Deal টাকে Death করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পরে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের কমান্ডেন্ট একজন মেজর আমাকে টেলিফোন করে জানাল বগুড়া থেকে মিলিটারি পুলিশের দু’জন। মেজর এসেছে। তারা আমাকে জানাল যে তারা ডেথ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছে। বগুড়া থেকে এবং ফাসির মঞ্চে তারা উপস্থিত থাকবে। | যাদের মৃত্যুদণ্ড হবে কয়েক ঘণ্টা পরে তাদের জন্য আমি প্রার্থনা করলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সকালবেলা আমাকে হােম সেক্রেটারি আবার টেলিফোন করলেন যে যাদের ফাসি হয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজন যাচ্ছে। রাজশাহীতে, কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছাবে। তাদের কাছে যেন ডেডবডিগুলাে দিয়ে দেয়া হয়। সকাল নয়টার দিকে আমি সেন্ট্রাল জেলে ডিআইজির রুমে গেলাম। আমি এসপিকে বললাম গাড়িটাড়ি যােগাড় হয়েছে, পুলিশ স্কোয়াড ঠিক করেছেন? ডিআইজিকেও আমি প্রশ্ন করলাম লাশগুলাে কি কফিনে ভরা হয়েছে? এই কথা শােনামাত্র ওখানে যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত হয়ে গেল। চারিদিকে চিৎকার করে উঠল। সবাই কেঁদে দিল। মহসীন উদ্দিন সাহেবের ওয়াইফ আমার দিকে রক্তচক্ষু মেলে বললেন- আপনি কি আমার স্বামীকে মেরেই ফেললেন। আমিও চিকার করে বললাম না, আমি তাদেরকে ফাসি দিইনি। ওই ওরা তারা দিয়েছে, সামরিক প্রশাসন দিয়েছে। আমরা দিইনি। আমি পাশে জেলারের রুমে এসে বসলাম। সেখানে দু’জন মেজর বসা আর জেলার বসা। বেগম মহসীন উদ্দিনের কাছে খবর পাঠালাম। তিনি কি তার স্বামীর লাশ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যেতে চান? তিনি খবর পাঠালেন তিনি খুনীদের হেলিকপ্টারে লাশ নেবেন। মিলিটারি পুলিশের দুই মেজর রিপ্যাট্রিয়ট মেজর এবং বাংলাদেশের রিক্রুট মেজর তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। বাংলাদেশের রিক্রুট মেজর রিপ্যাট্রিয়ট মেজরকে পারে তাে গুলি করে হত্যা করে। প্রচণ্ড গালিগালাজ করছে, যে আপনাদের ষড়যন্ত্রের জন্যই এগুলাে হচ্ছে। আমি তাদের দু’জনকেই প্রবলভাবে ধমক দিলাম। আপনারা করছেন কী? আপনারা করছেন কী? এভাবে দু’জন , দু’জনের দিকে তাকায়ে নিজেরা মারা যাবেন আপনারা। দেশের যে চরম ক্ষতি হচ্ছে সেটি কি টের পাচ্ছেন না। জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সম্পদ ছিলেন। জেনারেল মঞ্জুর দেশের সম্পদ ছিলেন। গতরাতে যারা প্রাণ দিলেন তারাও তাে দেশের সম্পদ ছিলেন। এভাবে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা কি টের পাচ্ছেন না? নিশ্চয়ই কোথাও কোনাে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র আছে। কোনাে চক্রান্ত আছে। আপনারা শান্ত হন। একেবারে শান্ত হন। তারা একেবারে চুপসে চুপ

মেরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রাক এসে হাজির হলাে। প্রথমে ব্রিগেডিয়ার। মহসীন উদ্দিনের লাশ ট্রাকে তােলা হলাে। পরবর্তীকালে মেজর কাজী মমিনুল। হক-এর লাশ ট্রাকে তােলা হলাে। মেজর মমিনুল হকের ছােট ভাই বিদায় নেয়ার সময় আমার দুটো হাত ধরে বলল স্যার আমার জন্য দোয়া করবেন। আমিও কান্না চাপতে পারলাম না। তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলাম। রাস্তায় প্রসেশন বের হলাে ফাসি দেয়া চলবে না, চলবে না।  আমার ড্রইং রুমে মেজরদের অত্যন্ত বিধ্বস্ত দেখা গেল। তাদের একজন। আমাকে বিবরণ দিল সেসময় । ফাসির দুটো মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিনকে স্যালুট দিয়ে তাকে বলল- Sir would you mind sign this proclamation. ব্রিগেডিয়ার মহসীন কাগজটির দিকে তাকিয়ে উনি 49672- No would not sign. This is insulting. I am a Brigadiar 478 আমার ফাসির দণ্ডের কাগজে সই করবে একজন কর্নেল এটি অপমানজনক। এটিতে আমি সই করব না। তবে ফাসিতে ঝুলতে আমি রাজি আছি।

কাজী ফারুক আহম্মেদ

মেজর কাজী মমিনুল হক-এর অনুজ রেইসকোর্স, কুমিল্লা সকালবেলা ডেপুটি জেলার রব বললাে যে ফারুক আস, তুমি দেখতাে তােমার। ভাইয়ের ডেডবডি কোনটি। তৃতীয়টি খুললাে আমি বললাম এটিই আমার ভাই। তখন বললাে যে ডেডবডি তাে তােমাকে দেয়া যাবে না। আমি সরাসরি ডিসি। সাহেবের ওখানে গেলাম, ডিসি সাহেবের সাথে কথা বললাম। বলল তােমার। ভাইয়ের লাশ তুমিই নিবে, তুমি চিন্তা কর না, আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি । সকাল ১০টা কি সাড়ে ১০টায় আমি ট্রাকে করে ডেডবডি নিয়ে বাইরােডে। কুমিল্লা শহরে যখন পৌঁছি তখন রাত প্রায় ১২টা। এরপরে জানাজা দিলাম। এখানে রেসকোর্সে। পরে রেসকোর্স কবরস্থানেই উনাকে সমাহিত করি। কেন। উনাকে ফাঁসি দেয়া হলাে, কী অপরাধ উনার আমরা জানতে চাই।।

মেজর আহসান উল্লাহ (অবঃ)

সাব সেক্টর কমাণ্ডার- ৯নং সেক্টর, ‘৮১ সালে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত তখন আমি স্টাফ কলেজে ছিলাম । নিয়মিত সেনাবাহিনীর পদ থেকে দূরে। ছিলাম। স্টাফ কলেজে যাওয়ার পরে আমি ক্লাস করছি। ব্রিগেডিয়ার ক্যানরুল। ছিলেন। কী একটা আমাদের এক্সারসাইজ ছিল। আমাকে উনি ডেকে নিলেন, সিএ ছিল। দেখ Major I am sorry to tell you that you have to pack up and go back. You have been dismissed from the Army. সে বলল যে।

আমি খুব দুঃখিত। আমি বুঝতেছি না যে তােমাকে কেন ডিসমিস করা হলাে। এটি কেমন একটি বজ্রাঘাতের মতাে যে আমি স্টাফ কলেজ থেকে ক্লাস করছি ওখান থেকে ডেকে নিয়ে বলে- You are dismissed from the Army. বিবিধ কারণে তােমাকে আজকেই স্টাফ কলেজ ছেড়ে দিতে হবে। একটি পিকআপ দিল, আমার যে ব্যাগ, বস্তা ছিল গুটিয়ে নিয়ে আমি বাসায় চলে গেলাম, মােহাম্মদপুরে। বাসায় গিয়ে দেখি আমার বাসার গেটে অলরেডি দুই-তিনজন ভিখারি একজন পান দোকানদার বসে আছে। আমার গিন্নি তাে টোটালি আপসেট বলল আরে এটি কী ব্যাপার তুমি আসার আগে পুলিশ এসেছে মােহাম্মদপুর থানা থেকে যে তুমি কখন আসতেছাে, এখানে লােকজন বিষয়টি কী। আমি বললাম আমিও তাে জানি না আমাকে সেনাবাহিনী থেকে ডিসমিস করে দিয়েছে। তাে করার কী, টেক ইট ইজি, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি এটিই তাে প্রাপ্য। এর মধ্যে চিটাগাং গেলাম। চিটাগাং থেকে এসে দেখি মােহাম্মদপুর থানার পুলিশ এবং লােকজন দাড়িয়ে আছে বলল যে আপনার বাসা এখনি খালি করতে হবে। অলরেডি তারা ঠেলাগাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। গিন্নি চলে গেল ওর ভাইয়ের বাসায়, আমি চলে গেলাম চিটাগাং-এ।

আমাকে যদি ডিসমিস করতে হয় আমাকে ক্লিয়ারলি বলতে হবে, পরে। আমাকে যে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়েছে ঐখানে লেখা আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আপনার সমস্ত পদ কেড়ে নেয়া হলাে এবং আপনার সমস্ত নির্ধারিত পদ থেকে বরখাস্ত করা হলাে। আমাকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেয় না, গেটের মধ্যে। ছবি লাগিয়ে দিয়েছে। এই সেনাবাহিনীতে যে কী ধরনের অন্যায় কাজ হয়েছে। এটি যদি একসময় কেউ দেখে তাহলে পরে আপনারা বুঝতে পারবেন। যখন অভ্যুত্থানটি হলাে স্পেশালি বিমানবাহিনীর লােকজন ইনভলব ছিল আমি তখন। ৪৪ ব্রিগেডের বিএম । অনেক অফিসারদেরকে বােধহয় কুমিল্লাতে ট্রায়াল হয় এবং হ্যাগড় করানাে হয়, যেখানে কিন্তু আমি একটি ব্রিগেডের বিএম আমার এলাকার মধ্যে কুমিল্লা পড়ে আমাকে কেউ কোনাে কিছু জানায়নি। শুধুমাত্র যে অফিসার এদেরকে নিয়ে গিয়েছিল, বােধহয় কুমিল্লা জেলে স্থানান্তর করেছিল সে যাওয়ার সময় আমার বাসায় ডিনার করে তখন আমি জানতে পারি যে কত অফিসারদেরকে ওর গাড়িতে করে নিয়ে এসেছে।

আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হলাে নট রিটায়ারমেন্ট ইভেন কিন্তু কেন এই কারণটি আজ পর্যন্ত আমি জানি না। অফিশিয়ালি আমাকে জানানাে হয়নি, কেন আমাকে বরখাস্ত করা হলাে। এই রকম ভাবে এই অন্যায় মােস্ট অব দ্য ফ্রিডম ফাইটার অফিসারদের প্রতি করা হয়েছে।

মেজর রেজাউল করিম (অব.)

চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলায় ১০ বছর কারাভােগী

৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যা, চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহের কথিত নায়ক মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের আত্মসমর্পণ ও ১ জুন। সেনা হেফাজতে নিহত হওয়ার ঘটনা এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামরিক আদালতে চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এখনাে একটি রহস্যময় অধ্যায়। আমরা সেসময়ে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে সর্বশেষ অবস্থানকারী, মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ মামলায় ১০ বছর কারাভােগী মেজর রেজাউল করিমের জবানীতে শুনব তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই প্রথম তিনি কোনাে মিডিয়ার সামনে সেই লােমহর্ষক দিনগুলাের ব্যাপারে মুখ। খুললেন। প্রথমবারের মতাে উন্মোচিত হচ্ছে সেসময়ের অনেক অজানা অধ্যায় এবং রহস্যের। যার মাধ্যমে নিষ্পত্তি ঘটতে পারে অনেক কল্পকাহিনী এবং অনেক। গুজবের

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে আমি ইন্টারভিউ দিই জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে। কমিশন র্যাঙ্কে চান্স পাই। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। তার কিছুদিন পরে রক্ষীবাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে মার্জ করানাে হয়।

১৯৮০ সালের সম্ভবত জানুয়ারিতে আমার পােস্টিং হয় চিটাগাংয়ে। চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে যখন আমি ছিলাম সেখানে আমাকে সময় সময় বাস্কেটবল, ফুটবল। বা ভলিবল খেলাগুলােতে অংশ নিতে হয়েছে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ৩০ তারিখ সকালে ভােরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সম্ভবত ৫টা থেকে ৫.৩০ বা পৌনে ছয়টা এরকম সময় হবে। দরজা কড়া নাড়ার শব্দ, ঘুম থেকে উঠলাম, অনেকটা বিরক্তি সহকারে। দরজা খুলে দেখি আমার অফিস রানার একেবারে যুদ্ধসাজে আর্মসসহ আমার বাসায় হাজির। আমি দেখে চমকে উঠলাম। কী ব্যাপার! দরজা খােলার সাথে সাথে সে আমাকে স্যালুট দিল। সালাম দিয়ে বলল স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছে, সব অফিসারদেরকে সালাম দেয়া হয়েছে, অফিসে যাওয়ার জন্য। আপনাকে টেলিফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না, যে কারণে আমাকে পাঠানাে হয়েছে যাওয়ার জন্য। আমার বাসায় যে টেলিফোন ছিল সেটি বৃষ্টি হলেই ডেড বন্ধ হয়ে যেত। ২৯ তারিখ রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়, সে বৃষ্টির কারণে আমার টেলিফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে আমার সঙ্গে কেউ টেলিফোনে যােগাযােগ করতে পারেনি। আমি তাকে জিগ্যেস করলাম কী ব্যাপার? আমাকে সে বলল, স্যার বের হয়ে দেখেন। তখন আমি ঘর। থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসি। বারান্দায় এসে দেখলাম আমাদের আর্মি। ট্রাকগুলাে সােলজারসহ যুদ্ধসাজে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হচেছ আর ক্যান্টনমেন্টে ইন করছে। অফিসে যাওয়ার পর ঢুকেই দেখি কর্নেল মতিউর।

রহমান। তার হাতে অস্ত্র, তিনি বিভিন্ন দিক নির্দেশনা-দিচ্ছেন সবাইকে। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলল-Yes ReZa come here, Where have you been? আমি বললাম আমি বাসায় ছিলাম। বাসায় ঘুমিয়ে ছিলাম । You donit know anything? আমি বললাম না স্যার কেন কী হয়েছে? বললেন Zia is dead. আমি বললাম What? বলল- Yes Zia is dead. এখন আমরা যারা ফ্রিডম ফাইটার আছি তাদেরকে ইউনাইটেড থাকতে হবে। We all freedomfighters should be united. আমি কোনাে উত্তর করলাম না। আমি কী উত্তর দিব, আমি চিন্তা করছিলাম। আমি আস্তে করে উনার পাশ কেটে আমার অফিস রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। উনি সাথে সাথে আমাকে আবার ডাকলেন। ডেকে বললেন তুমি। কোথায় যাচ্ছ, এদিকে আস। রাতে-তাে তােমাকে পেলাম না এখন একটু কাজ কর। আমি বললাম কী কাজ। বলল তুমি এখন সার্কিট হাউজে যাবে। You go to Cirkit House with the troops এবং সেখানে জিয়াউর রহমানের ডেডবডি আছে এবং তার ডেডবডি চট্টগ্রাম পাহাড় এলাকায় নিয়ে যাবে। নিয়ে কোথাও কবর দিয়ে আসবে। আমি সরাসরি না বলে আমি তাকে বললাম আমায় অন্য কাজ দিন। উনি একটু রাগান্বিত হলেন। রাগান্বিত হলে আরেকজন অফিসার থামিয়ে দেয়ার পর উনি আমার জায়গায় মেজর শওকতকে সিলেক্ট করলেন। আমি যখন আবার পাশ কেটে চলে যেতে থাকলাম আবার আমাকে ডাক দিয়ে। বললেন তুমিও যাও ওদের সাথে। তুমি ঐখানে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের যে সমস্ত জীবিত লােক আছে তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আস। তাদের বলবে। এখানে তাদের নিরাপত্তা নেই। এই কথা বলে তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসবে কারণ আমাকে সেই ছেলেদের নিরাপত্তা দিতে হবে ক্যান্টনমেন্টে এনে। তুমি তাদের সাথে যাও। আমি কী করলাম? আমি ওই অফিসার যারা জিয়াউর রহমানের ডেডবডি কবর দিতে গেল তাদের গাড়িতে না উঠে আলাদা গাড়িতে উঠলাম । আলাদা পিকআপ, যে পিকআপে করে তাদেরকে আনা হবে সেই পিকআপে উঠলাম। সেখানে আমি বেছে বেছে যে সমস্ত ট্রপসরা সাধারণত আমার সাথে খেলাধুলা করে, একটু আমার সাথে ফ্রি তাদেরকে সাথে নিলাম। সার্কিট হাউজে নামার পর ঐ গ্রুপটি চলে গেল দোতলার দিকে, সার্কিট হাউজের। আমি নিচের দিকে নামলাম। নেমে ডাক দিয়ে জিগ্যেস করলাম গার্ড রেজিমেন্টের কারা আছে, তারা এদিকে আসেন। জোরে ডাক দিলাম। ডাক দেয়ার সাথে সাথে একজন সুবেদার সাহেব দৌড়ে এসে আমাকে ঠাস করে অর্থাৎ খুব সজোরে পাও মেরে স্যালুট করলাে। স্যালুট করে বলল আসসালামু আলাইকুম স্যার, আমরা স্যার আপনাদের দলে। আমি থ খেয়ে গেলাম। আমি এখনাে কোনাে কথাই বলিনি, আমি জাস্ট ঢুকলাম সার্কিট হাউজে, ঢােকার সাথে সাথে এসে সুবেদার সাহেব বলছে আসসালামুআলাইকুম স্যার, আমরা স্যার। আপনাদের দলে। আমি বললাম দেখেন সুবেদার সাহেব আমি কোনাে দলের নই। আমি সারারাত বাসায় ঘুমিয়েছি, কারা প্রেসিডেন্টকে মেরেছে, কখন মেরেছে, কীভাবে মেরেছে আমি কিছুই জানি না। সকালবেলা আমাকে বাসা। থেকে ডেকে নেয়া হয়েছে। ডেকে আমাকে বলা হলাে যে আপনারা যারা আছেন। গার্ড রেজিমেন্টের লােক তাদের এখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই। আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে, আমি আপনাদের নিতে এসেছি। তাদেরকে রেডি হতে বলে আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠলাম। ঠিক আছে, তারা রেডি হােক, আমি একটু উপরে ঘুরে দেখে আসি। উপরে উঠলাম সিঁড়ি দিয়ে । উঠে দেখি সিড়ি বারান্দায় একটি ডেডবডি, একটি চাদর বা কম্বল (ঠিক মনে নেই) সম্ভবত কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা। পুলিশ আর্মসসহ গার্ড দিচ্ছে, লাশটিকে পাহারা দিচ্ছে। আমি জিগ্যেস করলাম এটি কার লাশ। বলল স্যার প্রেসিডেন্ট সাহেবের লাশ। আমি বললাম খােল তাে। খুললেন। আমি তাকিয়ে দেখি একটি নতুন সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরা, উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার একটি চোখ খুলে ঝুলে আছে, আর গুলি এপারওপার হয়ে আছে, সব দিক মানে এই সাইডটি (হাত দিয়ে চেহারার বাম দিক দেখিয়ে) ছিদ্র হয়ে গেছে, ছিদ্র ছিদ্র ঝাঝরা হয়ে গেছে একদম। আমি আর চাদর নিচে নামাতে বললাম না। আমি বললাম তাড়াতাড়ি ঢেকে দাও। ঢেকে দিল। তারপরে বারান্দা দিয়ে আরেকটু দূর গেলাম। দেখি আরেকটি লাশ। লাশের হাতটি বাইরে ছিল। এইভাবে হাতটি ছিল ( ডান হাতটি কনুই ভাঁজ করে দেখিয়ে), এই পাের্শনটি দেখা যাচ্ছিল। এই পাের্শনটি দেখে দেখলাম ‘৮০-‘৮১ সালে ব্যাঙ্ককের একটি শার্ট ছিল, ড্রাগন ছবি থাকত । ড্রাগন শার্ট বলতাম আমরা, এটি আমরা খুব পরতাম ঐসময়ে। ঐ শার্টটি পরা। আমি বললাম ড্রাগন হাত দেখি খােল তাে। খুলে দেখি কর্নেল আহসানের লাশ। তিনি তখন রাষ্ট্রপতির পিএস-এর দায়িত্বে ছিলেন। আরেকটু সামনে গেলাম। দেখি বিরাট লম্বা একটি ডেডবডি। পা বের হয়ে আছে। কম্বল যেটি দিয়ে ঢেকেছে, মাথা ঢাকার পরে পা। বেরিয়ে আছে। আমি বললাম খােল । খােলার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। ক্যাপ্টেন হাফিজ। ক্যাপ্টেন হাফিজ হলাে আমার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু । সেও একজন রক্ষীবাহিনীর অফিসার ছিল। আমরা একই কোর্সের অর্থাৎ সেও ফিফথ। জেআরবি কোর্স, ৫নং কোর্সে। শুধু তাই নয় ট্রেনিংকালে হাফিজ যখন গান। গাইতেন আমি তখন হারমােনিয়াম বাজাতাম। বেশ লম্বা, ৬ ফুট লম্বা। লাশ। দেখার সাথে সাথে আমার আগের রাতের কথা মনে পড়ে গেল। অর্থাৎ ২৯। তারিখ রাতের বেলা আমি যখন রাতের নাইট ট্রেনিং-এ আসি তখন হাফিজ আমাকে টেলিফোন করে বলল দোস্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি কাল চলে যাবেন ঢাকায়। আমি উনাকে বলে ছুটি নিয়েছি, এয়ারপাের্টে বিদায় দেয়ার পর আমি। ক্যান্টনমেন্টে চলে আসব, তাের কাছে। তুই একটি জিপ অন পেমেন্টে রাখিস। দুই বন্ধু মিলে বেড়াব। দু’দিন বেড়াব। দু’দিন বেড়ানাের পর আমি যাব। আমি

ছুটি নিয়েছি। প্রােগ্রাম হলাে, রাতের বেলায় আমার যে ট্রান্সপাের্ট হাবিলদার আছে, হাবিলদার ট্রান্সপোের্ট তাকে খবর দিয়ে অনপেমেন্টে ৩০ তারিখ একটি গাড়ি নিয়ে আমি ঘুরবাে । যার জন্য অনপেমেন্টে একটি জিপ অর্ডার দিয়ে রাখলাম । সেই ৩০ তারিখে হাফিজকে নিয়ে আর ঘােরা হলাে না। ক্যান্টনমেন্টে আসলাম। এসে ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে ঢুকলাম। ঐখানে। গিয়ে কর্নেল মতিকে রিপাের্ট করলাম। বললাম স্যার আমি ওদের তুলে এনেছি, এখন কী করব? তিনি বললেন ঠিক আছে, ওদেরকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে মেজর মুজিবের কাছে দিয়ে আস। তারপর আমি গাড়িসহ বের হয়ে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে গেলাম। সেখানে গিয়ে মেজর মুজিবকে বললাম ওরা গার্ড রেজিমেন্টের জীবিত লােক। ওদেরকে তােমার কাছে দিয়ে যেতে বলেছে, ওদের খাওয়া-দাওয়ার যা কিছু করার করবা। আমি ওদেরকে রেখে গেলাম । ওখানে রেখে আমি চলে এসেছি। অপরদিকে বাকি যে টিম ছিল সে টিম লাশ নিয়ে সম্ভবত কবর দিতে চলে গিয়েছিল। আমি যখন ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে ওদেরকে রেখে আসি, আসার পরে যখন ডিভ হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করলাম। গেট দিয়ে প্রবেশ করে যখন জেনারেল মঞ্জুরের অফিস ক্রস করি তখন অফিস বারান্দায় জেনারেল মঞ্জুর পায়চারি করছিলেন। আমি দেখেই তিনি কল করলেন, রেজা কাম হেয়ার ।

আমি চট করে তার সামনে গিয়ে স্যালুট করে দাঁড়ালাম। অ্যাটেনশন পজিশন, জেনারেল মঞ্জুর যখন আমাকে জিগ্যেস করলেন রেজা তুমি কোথেকে আসছ? আমি বললাম স্যার সার্কিট হাউজ থেকে আসছি। তিনি বললেন- কী কী দেখলে? আমি সার্কিট হাউজে যা যা দেখেছি উনাকে বলার পরে তিনি চুপ করে কতক্ষণ নীরবতা পালন করলেন। সাথে সাথে এক ঝটকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন Oh, What they have done! What they have done! তারপরে আমাকে জিগ্যেস করলেন তুমি কি রাতে সার্কিট হাউজে গিয়েছিলে? বললাম, না স্যার, আমি সার্কিট হাউজে যাইনি। আমি বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। বলল তােমার মাথা ঠাণ্ডা আছে? আমি বললাম হ্যা ঠাণ্ডা আছে, থাকবে না কেন? বলল দেখ, ওদেরতাে মাথা গরম, তােমারতাে মাথা ঠাণ্ডা আছেYou give the full security. Now on word you are my chief security, ok. এই কথা বলে আমার কাধ ধরে একটি ঝাকি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি বললাম রাইট স্যার । ব্যাস আমি তার চিফ সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলাম। আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। রুম সেট করেছি, উনি যেখানে যেখানে যাচ্ছেন তার সাথে যাচ্ছি। ফাস্ট ৬৯ ব্রিগেডে গেলেন জেনারেল মঞ্জুর। ব্রিগেডে যাওয়ার পর উনি ট্রপসদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিলেন। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে টেলিফোন আসল। জেনারেল মঞ্জুর টেলিফোনে কথা বলতে গেলেন। আমি তার সাথে দাড়িয়ে আছি। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ওভার হেয়ার

করছিলাম । অর্থাৎ অপর দিক থেকে কী বলছে এটিও মােটামুটি কিছুটা ওভারহেয়ার করছিলাম। ওপার থেকে অর্থাৎ ঢাকা থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে বলা হচ্ছিল জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলার জন্য । বলছে- You please talk to General Ershad. জেনারেল মঞ্জুর বলছে What bloody Ershad, I canit talk to him. জাস্ট এভাবে বলছে, What bloody Ershad do not talk to him. He is a thief, he is a corrupted person. I cannot talk to him. Ta ঠাস করে টেলিফোনটি রেখে দিলেন। চলে আসলেন। তার কয়েক মিনিট পরে আবার টেলিফোন। উনি গেলেন টেলিফোন ধরলেন। আবারও অপর প্রান্ত থেকে 4010, For God’s sake sir, for god’s sake, you cool down, you cool down, you talk to General Ershad, you talk to General Ershad. GA 403 61206- What bloody Ershad. He is a thief, he is a corrupted person. I cannot talk to him- বলে আবার টেলিফোন রেখে দিলেন। উনি এখান থেকে বের হয়ে ডিভ হেডকোয়ার্টারে আসলেন। সেখান থেকে ইবিআরসিতে গেলেন। সেখানেও লােকজনের সামনে বক্তব্য রাখলেন। উনি যে বক্তব্য। রাখছেন কোথাও তিনি বলছেন না জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে বা নিহত করেছি বা আমি করেছি বা অমুক করেছে- এসব কিছুই উনি বক্তব্যে বলছেন না। পরিবেশটি এমন হয়ে গেল জিয়াউর রহমান নিহত হলেন আর দেশটি যেন দুটি ভাগ হয়ে গেল। একটি গ্রুপ চাচ্ছে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় যেতে। আরেকটি গ্রুপ চাচ্ছে জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে এরশাদকে ঠেকাতে । জিয়াউর রহমানকে কে মেরেছে, কেন মেরেছে, এরকম। কোনাে আলােচনাও কেউ করছে না। রাতের বেলা জেনারেল মঞ্জুর থাকলেন অফিসে। আমিও অফিসে থাকলাম। জেনারেল মঞ্জুর উনার অফিস রুমে, আমি বললাম স্যার আপনি ঘুমান, আমি। আপনাকে পাহারা দিচ্ছি। আমি সারারাত বারান্দায় বসে থাকলাম আর্মসসহ, আমার ট্রপসসহ । রাত জেগে ওরা পাহারা দিল। পরদিন সকালবেলা আবার সেই ছােটাছুটি । উনি (জে, মঞ্জুর) আর্টিলারি সেন্টার, চিটাগাং হালিশহরে যে আর্টিলারি সেন্টার সেখানে গেলেন। সেখানে ট্রপসদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন। এখানে একটি বিষয় দেখলাম ইবিআরসির কমান্ডেন্ট ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ। ব্রিগেডিয়ার আজিজ জেনারেল মঞ্জুরের সাথে চলাফেরা করছেন আবার গােপনে এরশাদের পক্ষ হয়ে আরেকটি গ্রুপ তৈরি করছেন। ব্রিগেডিয়ার আজিজের আন্ডারে আরেকজন কর্নেল ছিলেন তার নামও আজিজ উনি আবার ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন, উনি সন্ধ্যায় এসে চুপ করে বলে গেলেন (এটি হলাে ৩০ তারিখ সন্ধ্যে) ব্রিগেডিয়ার আজিজ গােপনে গােপনে জেনারেল মঞ্জুরের বিরুদ্ধে ওয়ার্ক করছেন। একথা শুনে কয়েকজন অফিসার উত্তেজিত হলেন। উত্তেজিত হওয়ার পর জেনারেল মঞ্জুর তাদেরকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। উনি ব্রিগেডিয়ার

আজিজকে কল করে উনার সাথে রাখলেন। অর্থাৎ জেনারেল মঞ্জুর যেখানে যান। ব্রিগেডিয়ার আজিজকে তার সাথে সাথে রাখার চেষ্টা করেন। সেভাবে আর্টিলারি সেন্টারে ব্রিগেডিয়ার আজিজ ছিল আমাদের সাথে ইবিআরসি কমান্ডেন্ট, ডিসি অফিসে গেলেন। ডিসি অফিসে যখন জেনারেল মঞ্জুর বক্তব্য রাখেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ তখন তার পাশে দাড়িয়ে। আমি গেটে আছি, ডিউটি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি । ফটো সাংবাদিক ছবি তুলতে গেলেন, যখন ফটো সাংবাদিক ছবি তুলতে। গেলেন তখন ব্রিগেডিয়ার আজিজ চট করে ঐখান থেকে সরে গেলেন। সরে এসে আমার কাছে চলে আসলেন। চলে এসে বললেন সিকিউরিটি-টিকিউরিট সব ঠিক ঠাক আছে তাে? অর্থাৎ যখন ছবি তােলা হলাে ঐ ছবিতে উনি ধরা পড়েননি। উনি এসে আমার সাথে কথা কললেন। ইবিআরসি থেকে আমরা চলে আসলাম। চিটাগাং ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে । হেডকোয়ার্টারে এসে শুনলাম কিছু ট্রপস যাদেরকে ডিফেন্স নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে কিছু ট্রপস এবং অফিসার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে। অর্থাৎ জেনারেল মঞ্জুরকে যখন প্রস্তাব দেয়া হলাে এরশাদের সাথে কথা বলার জন্য, জেনারেল মঞ্জুর যখন ডিনাই করলেন এরপর জিয়াউর রহমানের হত্যার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব জেনারেল মঞ্জুরের উপর চাপিয়ে দিয়ে টিভি-রেডিওতে ঘােষণা আসতে থাকল এবং চিটাগাং-এর সবাইকে বলা হলাে বিদ্রোহী এবং সবাইকে বলা হলাে তােমরা বিদ্রোহী দল ত্যাগ করে লয়েল ফোর্সের কাছে চলে আস এবং সেটি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। চলে যাচ্ছে লোকজন। মেজর কাইয়ুম, মেজর দোস্ত মােহাম্মদ, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস এরা কিছু ট্রপস নিয়ে চলে গেলেন। চলে যাওয়ার পর জেনারেল মঞ্জুর তাড়াতাড়ি মিটিং ডাকলেন। তখন আমার মনে আছে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ উনি তখন বিএমএ-এর কমান্ডেন্ট ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ আসলেন, ব্রিগেডিয়ার আজিজ আসলেন। সবাইকে নিয়ে তিনি (জেনারেল মঞ্জুর) মিটিং করছেন ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে সন্ধ্যার পরে রাতে। এটি ৩১ তারিখ রাতের বেলা। আর নিরাপত্তার দায়িত্বে যেহেতু আমি ছিলাম, আমার উপর অর্ডার ছিল ঐ মুহূর্তে ডিভিশন হেডকোয়ার্টার থেকে কেউ বের হবে না। বাইরে থেকে কেউ ভেতরে। আসবে না। আমি সেই মােতাবেক ডিউটি করছি, অর্ডারও সেভাবে দেয়া আছে। হঠাৎ করে দেখলাম জেনারেল মঞ্জুরের রুম থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নামটি আমার এই মুহূর্তে মনে নেই, তকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের সম্ভবত এটি ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ছিল তারই কমান্ডিং অফিসার, তিনি বের হয়ে যাচ্ছেন। যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন আমি বললাম, সরি স্যার এখন কারাে বের হওয়া বা বাইরে থেকে কারাে প্রবেশ করা এটিতাে নিষেধ স্যার। উনার পেছনে পেছনে কর্নেল মতি বের হয়ে আসলেন। ততক্ষণে কিন্তু আমরা জেনে গিয়েছি জিয়াউর রহমানকে কর্নেল মতিউর রহমান গুলি করে হত্যা করেছেন। এর বেশি আমাদের পক্ষে তখন জানা সম্ভব হয়নি। মতি

আমাকে বলল না, আমাকে যেতে দাও, উনাকে যেতে দাও। আমার কাজ আছে, উনার কাজ আছে, বলেছে যেতে দাও। বললেন জিওসি বলেছে উনাকে যেতে দিতে । একথা বলার পর আমি উনাকে ছেড়ে দিলাম। উনি চলে গেলেন। বেশ। কিছুক্ষণ আমি একটি রুমে বসে আছি, পাশে জেনারেল মঞ্জুরের রুমের দিকে তাকিয়ে। উনার দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার পাশের রুমটায় বসে আছি। হঠাৎ করে সেখানে মেজর খালেদ আসল। মেজর খালেদ আসার পরে বললাম মেজর খালেদ তুমি একটু বস। আমার তাে বাসায় যাওয়া হয়নি, আমি একটু বাসায় যাই। আমি উনাকে বসিয়ে বাসায় গেলাম । আমার বাসা ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি ছিল, হেঁটেই যেতাম হেঁটে আসতাম । আমার বাসার কাছে এমপি চেকপােস্ট, সেখানে ক্যাপ্টেন এমদাদ সেও আমার বন্ধু, কোর্সমেট সে ডিউটি করছে। এমদাদের সাথে দেখা হলাে। দেখা হওয়ার পর আমাকে বলছে- দেখ রেজা, দেশের যে পরিবেশ, জেনারেল মঞ্জুর যে ঘাউরা, ঠিক এভাবে- জেনারেল মঞ্জুর যে ঘাউরা সে তাে কোনাে অবস্থাতেই এরশাদের কাছে সারেন্ডার করবে না। আর এরশাদও জেনারেল মঞ্জুরকে ছাড়বে না। এখন এয়ার রেইড হবে, অনেক কিছু হবে। So try to save your skin. আমি বললাম আমি তাে উনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। এখানে গ্রুপিং-টুপিং বােঝার বিষয় আমার না। আমি আমার জিওসির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি, ব্যাস এটুকুই আমি বুঝি। আর এর বেশি বুঝতেও চাচ্ছি না, বােঝার প্রয়ােজনও মনে করছি। না। বাসায় গেলাম। বাসায় যাওয়ার পরে আমার ওয়াইফ আমাকে বলল বাসায় এসেছ ভালাে হয়েছে। চল তাড়াতাড়ি আমরা কুমিল্লায় চলে যাই। আমি বললাম মানে? মানে দেখ সবাই একে একে কুমিল্লায় চলে যাচ্ছে। আমরাও ওমনি চলে যাই। আমি নিজে বলব, সবাইকে বলব যে তুমি সারারাত বাসায় ঘুমিয়ে ছিলে। তুমি এর সাথে জড়িত না, কিছু না। তুমি কেন খামখা এখানে থাকবে। তুমি চল, আমরা একসাথে কুমিল্লায় চলে যাই। তখন আমি বললাম দেখ আমি আমার জিওসির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। এই মুহূর্তে তাকে ছেড়ে আমার যাওয়া সম্ভব নয়। তখন আমার ওয়াইফ, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। আমার এখনাে মনে আছে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। সে আমার হাত ধরে টানাটানি করছে। হাতটি ছুটিয়ে আমি বললাম সরি, আমি উনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি, আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়। আমি চলে আসলাম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখি ডিভিশন হেড কোয়ার্টারের পাশেই কিন্তু আমাদের একটি হেলিপ্যাড আছে। সেখানে হেলিকপ্টার থাকত। বা প্রয়ােজনে হেলিকপ্টার আসত আবার চলে যেত। ঐ জায়গায়টায় একটি হেলিকপ্টার এনে রাখা হয়েছিল। জেনারেল মঞ্জুর দিনের বেলায় হেলিকপ্টারটিকে সরিয়ে দিয়েছে । উনি বললেন এই হেলিকপ্টারটি এখানে থাকলে ট্রপস মনে করবে জেনারেল মঞ্জুর যে কোনাে সময় হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যেতে

পারেন। টুপসের মনােবল ডাউন হয়ে যাবে। কাজেই আমি এখানে হেলিকপ্টার রাখবাে না। সেই হেলিকপ্টারটিকে তিনি চিটাগাং এয়ারপাের্টে ব্যাক করে দিলেন। আমি ফেরত আসলাম। এসে বসে আছি। হঠাৎ করে জেনারেল মঞ্জুর উনার অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলেন। আমায় কল দিলেন। আমি গিয়ে উনার গাড়িতে উঠলাম । জেনারেল মঞ্জুরের সাথে গাড়িতে বের হয়ে এলাম উনার বাসায়, গাড়িটি উনার বাসায়, উনি নেমে বাসায় গেলেন। আমি গাড়িতেই বসে থাকলাম। আমার তখন এর আগের রাত অর্থাৎ ৩০ তারিখ সকালবেলা যে অফিস থেকে ডেকে আনা হলাে, এরপর থেকে এক মিনিটের জন্যও আমার কোনাে রেস্ট নেই। যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ আমার মনে হয়েছে একটু রেস্ট নিই। জিওসি ঘরে ঢুকেছে আমি একটু রেস্ট নিই। আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি জানি না গাড়ির ঝাকিতে চোখ খুললাম। দেখলাম জেনারেল মঞ্জুর গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার জিওসির যে ফ্ল্যাগ ছিল সেটি খুলে রাখল। আর উনার জিপের সামনে যে স্টার ছিল, মেজর জেনারেলের যে দুটি স্টার থাকে সেটি কাভার দিয়ে ঢেকে দিল। ঢেকে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে টান দিলেন । টান দিয়ে সােজা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের পূর্ব-দক্ষিণ পার্শ্বে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসারের যে অফিস তার বরাবর যে গেট ছিল সেই গেট দিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। বের হয়ে জিপ সােজা রওয়ানা দিল হাটহাজারীর দিকে। হাটহাজারির কাছাকাছি জেনারেল মঞ্জুর ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি সাইডে রাখতে। সাইডে রাখল। কিছুক্ষণ পর বলছেন- আসছে না, আসলাে না কেন? তখন আমি বুঝতে পারছি।

কার কথা বলছে। পরে আমি বুঝলাম হি ওয়াজ ওয়েটিং পর হিজ ফ্যামিলি । উনার ফ্যামিলির জন্য উনি অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম আপনি স্যার। ফ্যামিলিটিকে স্যাকরিফাইস করেন। ফ্যামিলিটি স্যাকরিফাইস করেন কারণ এখন যে মুহূর্ত আপনার বেঁচে থাকা দরকার। আপনি কোথায় যেতে চান বলেন। আমরা সেখানে আপনাকে নিয়ে যাই । উনি উত্তর দিলেন- নাে, আই ক্যাননট মুভ উইদাউট রানা। রানা হচ্ছে উনার ফ্যামিলি। আই ক্যান নট মুভ উইদাউট রানা। কিছুক্ষণ পরে জিওসির একটি স্টাফ কার থাকে। সেই স্টাফ কারটি জিপ ক্রস করে চলে যাচ্ছিল। তখন জেনারেল মঞ্জুর বলল তাড়াতাড়ি স্টার্ট দাও। অর্থাৎ আমরা যে জিপটি সাইডে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সেটি স্টাফ কার লক্ষ্য করেনি। আমরা ফলাে করে গিয়ে ধরলাম। দেখলাম হ্যা সেখানে উনার ফ্যামিলি রয়েছে। জেনারেল মঞ্জুরের ফ্যামিলি এবং কর্নেল দেলাওয়ারের ফ্যামিলি। দুইটি ফ্যামিলি রয়েছে সেই গাড়িটিতে বাচ্চাটাচ্চাসহ। পরে আমরা সামনে গেলাম। সামনে গিয়ে মেজর খালেদ আসলেন, ইয়াজদানী সাহেব আসলেন। আরাে কয়েকজন আর্মি অফিসার আসলেন। আসার পরে আমরা ভাগাভাগি হয়ে গাড়িতে রওয়ানা দিই। আমরা সম্ভবত তিনটি গাড়িতে মুভ করছিলাম হিলট্রাক্সের দিকে। যতটুকু আমি। তখন জেনেছিলাম জেনারেল মঞ্জুর একটু সেফ সাইডে যেতে চাচ্ছেন হিলট্রাক্সের।

দিকে। সেখান থেকে উনি উনার পজিশন অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবেন কী করা যায়, না করা যায়। যেহেতু চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট থেকে তখন অনেকেই চলে গেছে। জেনারেল মঞ্জুর এবং আমি একই গাড়িতে ছিলাম। আমার সাথে। জেনারেল মঞ্জুরের বাচ্চারা ছিল । আমরা মুভ করছি। কর্নেল মতির যে গাড়িটি ছিল সে গাড়িটি বেশ অনেকদূর চলে গিয়েছে আমাদের ফেলে । বুঝতে পারলাম কার নির্দেশে এই রাস্তায় আসলাম আর কর্নেল মতিই বা কোথেকে আসল এবং কী কারণে তিনি সবার সামনে চলে গেলেন। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু জাস্ট জিওসির সিকিউরিটি হিসেবে তার সাথে থাকছি আর দেখছি। আমাদের দৃষ্টির সীমার বাইরে চলে গেছে কর্নেল মতির গাড়ি। সবার সামনে। ছিল। হঠাৎ সামনে গােলাগুলির আওয়াজ। গােলাগুলির আওয়াজ শােনার পর আমি গাড়ি থামাই। ততক্ষণে বােধহয় ভােরের আলাে ফুটবে ফুটবে ভাব। এরকম। কিন্তু খােলা জায়গায় দূর থেকে আবছা আবছা কিছু বােঝা যায় । জেনারেল মঞ্জুরের একই গাড়িতে আমার সাথে মেজর গিয়াস ছিলেন। জেনারেল মঞ্জুর নিজে গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। আর গিয়াস তার পাশে বসা, আমি পিছনে বসেছিলাম। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে পাহাড়ের দিকে উঠে দেখি দূরে লােকজন ছােটাছুটি করছে। তখন নিচে এসে আমরা চেষ্টা করলাম গাড়িটিকে ঘুরানাের জন্য। জেনারেল মঞ্জুরের গাড়ি আর স্টার্ট নিল না। কোনাে অবস্থাতেই গাড়িটিকে ঘােরাতে পারলাম না। মানে স্টার্টই নিল না। উনার (জেনারেল মঞ্জুর) সুটকেস ছিল গাড়িতে। সেই সুটকেস রেখে আমরা চলে গেলাম অন্য একটি গাড়িতে। সে গাড়িতে করে কিছুদূর ব্যাক করলাম। পেছনে যখন ব্যাক করি। ঐখানে আমাদের সাথে আরেকটি পিকআপ ছিল। পিকআপে ছিল কর্নেল ফজলে হােসেন এবং ক্যাপ্টেন জামিল। এরা সার্কিট হাউজে যেদিন জিয়াউর রহমান মারা যায় সেই রাতে ঐ গ্রুপের সাথে ছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন। এই দুইজন ঐ পিকআপে ছিলেন। মেজর খালেদ এবং মেজর ইয়াজদানী এই দুইজন ঐ গাড়িতে অর্থাৎ মেজর খালেদ গাড়ি চালাচ্ছিলেন মেজর ইয়াজদানী পাশে বসে ছিলেন আর পেছনে ওরা ছিল। পেছনে কিছুদূর এসে আমরা গ্রামে ঢুকি। আর ফজলে হােসেন। এবং ক্যাপ্টেন জামিলকে সেফ সাইডে রেখে আসার জন্য খালেদ এবং ইয়াজদানী গাড়িটি নিয়ে পিছনে গেলেন। আমরা গাড়িতে বসে আছি অনেকক্ষণ, তারপরে দেখি ওরা আর আসে না। না আসায় আমরা পায়ে হাঁটা শুরু করলাম, অজানা উদ্দেশ্যে। আমরা রাস্তায় দুইবার গাইড বদল করি। তৃতীয় গাইড নিয়ে যখন চলাফেরা করি বাচ্চাদের ক্ষুধা লাগে। খাবার আনার জন্য গাইডদের টাকা দেয়া। হয়, আমরা একটি টি গার্ডেনের পাশে বসি। ওদের পাঠানাে হয় খাবার আনার জন্য। ওরা যখন খাবার আনতে যাবে তখন একজন বুড়াে লােক বললেন ওদেরকে যে টাকা দিলেন ওরা তাে লোেক ভালাে নয়। ওরা তাে টাকা নিয়ে চলে। যাবে। তখন জেনারেল মঞ্জুর আবার ডাক দিলেন- এই এদিকে আস। উনি

বললেন খাবার লাগবে না। তখন তারা বলল আমাদেরকে সন্দেহ করেন। ঠিক আছে যান তাহলে লাগবে না। আমরা আপনাদের লগে যাব না। আমরা কি আপনাদের টাকা মেরে দেব? বাচ্চারা তখন কান্নাকাটি করছে, তাদের ক্ষুধা লেগেছে, জেনারেল মঞ্জুর তখন বললেন ঠিক আছে যাও। কিছু মুড়ি, কলা এগুলাে নিয়ে আস। ওরা গেলেন। কিছুক্ষণ পরে কিছু কলা, মুড়ি নিয়ে আসলেন। এসে আমাদের বলা শুরু করল তাড়াতাড়ি পালান। আমি বললাম আরে কী। হয়েছে? বলল এখানে আর্মি আসছে। আমি এসে ঐখানে আরাে দুইজন আর্মির ড্রেস পরা চোখটাখ বেঁধে রেখেছে। আর এখানে ঘােরাফেরা করছে। খোজ করছে লােকজন ধরার জন্য। এখানে বলাবাহুল্য আমাদেরকে লােকজন জিগ্যেস। করছিল বিষয়টি কী? আমরা এরকম বললাম ক্যান্টনমেন্টে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। এখন কে কার পক্ষে আছে না আছে আমরা জানি না। ফ্যামিলি নিয়ে আমরা এখন গ্রামের দিকে চলে আসছি। আমরা সেফ সাইডে। যাওয়ার জন্য। আমরা এটিই বলছিলাম গ্রামবাসীকে। জেনারেল মঞ্জুরের পকেটের উপরে মঞ্জুর কথাটি লেখা ছিল। নেমপ্লেটটি উনার এখানে (ইশারায় বুক পকেটে) লাগানাে ছিল। এই নেমপ্লেটটি বেশ কিছুক্ষণ পরে খুলে তিনি পকেটে ঢুকান। আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরেক এরিয়াতে চলে আসলাম। সেখানে আমাদেরকে গাইড এক বাড়িতে উঠাল। বলল আপনারা এখানে খাওয়া-দাওয়া করেন। এখন আর হাঁটা যাবে না। সন্ধ্যার পর আবার হাঁটতে হবে। এখন হাঁটতে গেলে অসুবিধা আছে। সে মােতাবেক ওদের কথামত আমরা ঐখানে বসলাম। আমি ঘরের বাইরে দাওয়ায় বসে আছি। আর্মস আমার হাতে আছে। আমি নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি জেনারেল মঞ্জুরের। বাচ্চারা খাওয়া-দাওয়া করল। ফ্যামিলি খাওয়া-দাওয়া করল । ঐ বাড়িতে আমরা কিছু টাকা-পয়সা দিলাম। খাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হলাে। জেনারেল মঞ্জুর এবং মেজর গিয়াস তারাও খেতে বসল। আমাকে ডাকা হয়েছিল খাওয়ার জন্য, কিন্তু আমি খেতে পারিনি। আমি বললাম আমি খাব না। এত পরিশ্রম করেছি, এত সজাগ থেকেছি। আমার জাস্ট ভােমিটিং ফিলিং হচ্ছিল। আই ওয়াজ ফিলিং ভােমিটিং যে কারণে আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না। ওরা যখন খাচ্ছে জাস্ট দূরে হঠাৎ আমরা কুকুরের আওয়াজ শুনতে পেলাম। দূর থেকে যখন কুকুরের অস্বাভাবিক ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম তখনই জেনারেল মঞ্জুর ঘরের ভেতর থেকে ডেকে আমাকে বলল রেজা কুকুর ডাকছে কেন? আমি তাকে সরাসরি উত্তর দিলাম জানি না কেন। ডাকছে। বললেন তুমি ভেতরে আস। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতরে ঢুকে জেনারেল মঞ্জুর আসলে আমরা ভেতর থেকে উকি দিয়ে দেখলাম । আমরা পাহাড়ের একটি ঢিবির উপরে, একটি টিলার উপরে ছিলাম। আমাদের অনেক নিচে জমি, তার দূরে আরেকটি পাহাড়ের টিলা। সেই টিলার উপরে। দেখলাম পুলিশ, পুলিশের ড্রেস পরা মনে হচ্ছে মুভ করছে। নড়াচড়া দেখলাম।

অর্থাৎ জেনারেল মঞ্জুর বুঝে ফেললেন সম্ভবত পুলিশের উপস্থিতি। তিনি আমাকে বললেন ঠিক আছে মনে হয় পুলিশ আমাদের এদিকে আসছে। আমি সারেন্ডার করব। তিনি শুধু একথা বললেন। আমাকে বললেন তুমি এবং গিয়াস (আমার সাথে মেজর গিয়াস ছিলেন) তােমরা স্কেপ কর। আমি সারেন্ডার করব। জেনারেল মঞ্জুরের ওয়াইফ বলছেন তুমি রেজা ভাই এবং গিয়াস ভাইকে নিয়ে স্কেপ কর । আমরা ওদেরকে ডিলে করিয়ে রাখি। যারা আসছে ওদের সাথে কথা বলে ডিলে করাবাে। তােমরা স্কেপ কর। জেনারেল মঞ্জুর বলল নাে, আমি স্কেপ করবাে না, আমি সারেন্ডার করব। আমাকে আর গিয়াসকে বলল তােমরা চলে যাও। তখন আমি বললাম না স্যার আমি তাে আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন। করছি, আপনি যদি না যান আমিও যাব না। আপনি যদি সারেন্ডার করেন আমিও আপনার সাথে সারেন্ডার করব । তারপর আমি উনাকে বললাম নিজের থেকে ঠিক আছে স্যার আপনি আগে দেখেন পুলিশের বিহ্যাভিয়ারটি কেমন। এটার জন্য। আমরা একটু সেফ সাইডে যাই। ঐ বাড়ির পেছনে একটি ঝােপ ছিল । বুশ টাইপের একটি ঝােপ ছিল। ঐ পাহাড়টির নিচে পেছনের দিকে একটি খালের মতাে ছিল। ঐ খাল দিয়ে পানি সেচ করা হত। সেচের জন্য পানি দিত। আমি বললাম স্যার এক কাজ করি আমরা ঐ ঝােপটার ভেতরে লুকাই এবং সেখান থেকে অবজার্ভ করি। পুলিশ কী করে, আমরা ওদের জাস্ট বিহ্যাভিয়ারটি একটু দেখি। তারপরে আমরা সারেন্ডার করি। জেনারেল মঞ্জুর আমার কথাটি মানলেন। জেনারেল মঞ্জুর গিয়ে সরাসরি ঝােপের ভেতরে ঢুকলেন।

আমি সরাসরি ঝােপের ভেতরে না ঢুকে ওই পাহাড়ের টিলা থেকে জাম্প করলাম পানিতে। পানিতে জাম্প করে পানির নিচে ডুবসাঁতার দিয়ে জঙ্গলের দিকে জাস্ট আন্দাজ করে কিছুদূর এগুলাম। এগােনাের পরে যখন পানির উপর ভাসলাম তখন দেখি আমি বুশ দ্বারা কাভারড অর্থাৎ আই এম অলরেডি কাভারড বাই দ্য বুশ। পাহাড়ের উপর দিয়ে যে বুশটি ঢাল পর্যন্ত ঢেকে গেছে সেই বুশের ভেতরে আমি। দাঁড়ানাের পরে দেখি আমার পানি কোমর পর্যন্ত হাইটে। অর্থাৎ বুক সমান থেকে একটু নিচে আমার পানির হাইট। আমি কেঁপের ভেতরে। আমি আস্তে আস্তে পাড়ে গেলাম কিনারে, আমি ঝােপের ভেতরে। আমি এমনভাবে এমন অবস্থানে ছিলাম অর্থাৎ আমাকে বেরােতে হলে আবার সেই ঝােপ থেকে পানির ভেতর দিয়ে এসে বের হতে হবে। এছাড়া আর কোনাে রাস্তা নেই আমার বের হওয়ার। আমার কাছে একটি স্টেনগান ছিল, চাইনিজ স্টেন। ৭.২ মি.মি চাইনিজ স্টেন ছিল। অলরেডি অর্মসের ভেতরে পানি ঢুকেছে। আমি ঝাকুনি দিয়ে মােটামুটি ঠিক করলাম । ঠিক করে বসে আছি আর কান খাড়া করে আছি। চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। জাস্ট আমার দৃষ্টির আড়ালে জেনারেল মঞ্জুর। হঠাৎ উপর থেকে কিছু বাশির আওয়াজ পেলাম। বাশির শব্দ শুনছি আর কিছু শােনা যাচ্ছে না। জেনারেল মঞ্জুরের কণ্ঠ ভেসে আসল। উনি আমার মাথার উপরে, উনার

ইউনিফর্ম পরা, যখন উনি দাঁড়ালেন পাতার মচমচ যে শব্দ সেই পাতার মচমচ শব্দ শুনলাম। আর জেনারেল মঞ্জুরের কণ্ঠ। জোরে জোরে জাস্ট যে কথাগুলাে উনি বললেন আমি শুনতে পেলাম- এই যে বাবারা তােমরা ওইখানটায় দাড়াও, সামনে আসবে না। আমি আসছি। সামনে আসলে তােমাদের অসুবিধা হবে। জাস্ট এভাৰে উনি কথাগুলাে বললেন। বলে জঙ্গলের ভেতর থেকে হনহন করে উনি বের হয়ে গেলেন। উনি যে বেরােচ্ছেন এবং পাতায় তার ইউনিফর্মের সাথে ঘষার যে সাউন্ড সেটি আমি পাচ্ছি। তারপর আর কোনাে আওয়াজ নেই। কোনাে শব্দ পাচ্ছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না জাস্ট কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। তারপরে আমি আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কোনােরকমে বের হই। এক ফাক দিয়ে। আমি দেখি দুটি পুলিশ দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে আর চিৎকার করে বলছে ভাই আপনারা কে কোথায় আছেন এসে পড়েন। আপনারা সারেন্ডার করেন। আপনাদের কমান্ডার সারেন্ডার করেছে। এই সমস্ত কথাবার্তা বলছে। আমি দেখলাম জেনারেল মঞ্জুর একটি গাছের নিচে বসে আছে। সে আনমনে একটি সিগারেট টানছে আর তার পাশে বাচ্চারা বসে। জঙ্গলের ভেতর থেকে আমি শুধু অবস্থানটি দেখছিলাম। আমার কাছে তখন আর্মস। ইচ্ছে করলেই তখন আমি পুলিশ দুটোকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম, কোনাে ব্যাপারই ছিল না। আমার জন্য। আমি তা না করে আস্তে আস্তে দাঁড়ালাম। আমার বুক অবধি তখন। জঙ্গলের গাছ, বুশরা। আমি দাড়ানাের পরে আমার বুক অবধি হলাে। আমার হাতে যে আর্মস আছে বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। এটি বুশের নিচে লুকানাে। আমার হাতে ধরা । আমি দাঁড়ানাের সাথে সাথে আমাকে কেউ হ্যান্ডস আপও বলছে না, কিছুই বলছে না। আমাকে দেখে পুলিশ জাস্ট বলছে এই যে গেরাই আসেন আসেন। আমাদের ডিফেন্স অর্থাৎ ফোর্সে একটি কথা আছে গ্রামের একই এলাকার লােক হলে গেরাই বলে। এই যে গেরাই আসেন আসেন। এখানে বলে রাখা দরকার আমার কাধে মেজরের যে র্যাঙ্ক শাপলা সেটি ছিল না। আমি বেশ কিছুক্ষণ আগে এটি খুলে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ চলার পথে, চলার পথে আমি সেটি খুলে ফেলেছিলাম। যে কারণে আমি অফিসার না সিপাহি, আমাকে দেখে সিপাহির মতাে মনে হচ্ছিল। কারণ যেহেতু আমার কোনাে র্যাঙ্ক ছিল না। সেহেতু সিপাহি বলছে গেরাই আসেন আসেন। আমি বললাম ঠিক আছে আসছি আসছি। একথা বলে আমার যে আর্মসটি ছিল সেটি আমার পায়ের ভেতরে ঠেকিয়ে রেখে আস্তে আস্তে মাটিতে ছাড়লাম। কোনাে সাউন্ড হলাে না। আর্মসটি জঙ্গলে রেখে আমি নিজে বের হয়ে আসলাম। আমার ইনটেনশনটি ছিল এরকম যদি কোনাে বিহ্যাভিয়ার খারাপ দেখি তাহলে আমি যাতে জাম্প করে জঙ্গলে গিয়ে আর্মসটি ইউস করতে পারি আমার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে, আমার জিওসির নিরাপত্তার স্বার্থে। যে কারণে আমি আর্মসটি আপাতত রেখে তারপরে বের হলাম। বের হওয়ার সাথে সাথে আমাকে তারা আমার পরিচয় জিগ্যেস করছে । জিগ্যেস করার সাথে সাথে আমি বলছি আমার নাম রেজা। যখনই আমি বললাম আমি মেজর রেজা তখনই তারা জাস্ট কাপছে। পুলিশগুলাে কাপছে আর বলছে স্যার আপনার কাছে কি কোনাে আর্মস ছিল নাকি। আর্মস আর্মস! আমি বললাম ছিল। স্যার কোথায় কোথায় আর্মস স্যার । আমি বললাম আছে জঙ্গলের। ভেতর নিয়া আসি। না না স্যার। আপনি না। অর্থাৎ তখনাে তারা কাপছে। এতক্ষণ কিন্তু তারা খুব একটি সিরিয়াস ছিল না। আমি তখন তাদের বললাম আপনারা যেভাবে পজিশন নিয়ে দাড়িয়েছিলেন আর আমি যে পজিশনে ছিলাম ইচ্ছে করলে আপনাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম। আমি যখন এটি করিনি তার মানে আমি এটি করবাে না।

আর আমার জিওসি আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলাম উনি সারেন্ডার করেছেন আমি ইচ্ছে করেই সারেন্ডার করছি। কাজে আপনারা ভয় পাবেন না। পরে আমি ওদেরকে দিয়ে আর্মসটি এনে সারেন্ডার করে দিলাম। আমি যখন এই কথাগুলাে বলছিলাম তখন জিওসি চট করে আমার দিকে দেখল, সরি ফাস্ট মঞ্জুরের বড় মেয়ে বলে উঠল পাপ্পা পাপ্পা রেজা আঙ্কেল সারেন্ডার করেছে, রেজা আঙ্কেল সারেন্ডার করেছে। বড় মেয়ের নাম ছিল নিতু। নিতু বলল বাবা বাবা রেজা আঙ্কেল সারেন্ডার করেছে, জেনারেল মঞ্জুরও চট করে ঘাড় ঘােরালাে। উনিও ঘাড় ঘুরিয়েছেন আমিও ততক্ষণে উনার কাছাকাছি চলে গেছি। তখন উনি আমাকে জাস্ট বললেন- Reza, Why you have surrendered my boy. ওরা তাে আমাকে মেরেই ফেলবে। তােমরা যদি সবাই একে এক সারেন্ডার কর তাহলে আমার কথা দেশবাসীকে কে বলবে? তখন আমিও একটু ইমােশনাল হয়ে গেলাম। ইমােশনাল হয়ে বললাম স্যার আপনার মতাে একজন মুক্তিযােদ্ধা, আর্মির জেনারেল নাম করা জেনারেল, আপনাকে যদি ওরা মেরে ফেলে তাহলে আমার মরতে কোনাে আপত্তি নেই। And I want to die with you. একথা বলার সাথে সাথে উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ওহ মাই কমরেড! ওহ মাই কমরেড! বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জড়িয়ে ধরে উনি যে সিগারেটটি টানছিলেন অর্ধ-খাওয়া সিগারেট নিজের হাতে আমার ঠোটে লাগিয়ে দিয়ে বললেন ইউ স্মােক দিস, ইউ আর মাই অনলি কমরেড । একথাটি বলে আমাকে দিলেন সিগারেট টানতে। আমি সিগারেট টান দিয়ে ফেলে দিলাম । তখন পুলিশ দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করছিল। আমি তখন বললাম ডাকাডাকি কইরেন না। আপনার ডাকাডাকি করার দরকার নেই। আমাদের সাথে আরাে একজন ছিল উনি এতক্ষণে পাস মানে পালিয়ে গেছেন। অর্থাৎ যখন জেনারেল মঞ্জুর আমাকে এবং গিয়াসকে সরে যেতে বলেছিলেন তখন গিয়াস বলল রেজা তুমি যাবে নাকি? আমি বলেছি না আমি যাব না। জেনারেল মঞ্জুর যদি যায় আমি যাব। আর জেনারেল মঞ্জুর যদি সারেন্ডার করে আমিও উনার সাথে সারেন্ডার করবাে। উনি যেখানে যাবে আমি উনার সাথে থাকব, আমি যাব না। তখন মেজর গিয়াস বললেন ঠিক আছে, তাহলে তুমি থাক আমি

গেলাম। মেজর গিয়াস কিন্তু আগেই চলে গিয়েছিলেন। ওই সময়টিতে পুলিশের উপস্থিতি যখন আমরা টের পাই । যে কারণে আমি বললাম উনি এতক্ষণে পাস করে চলে গিয়েছেন কাজেই আর দেরি করে লাভ নেই। চল আমরা মুভ করি। | ঐখানে যে পুলিশগুলাে এসেছিল তাদের নেতৃত্বে ছিল একজন হাবিলদার, পুলিশ হাবিলদার আর কেউ কাছাকাছি ছিল না। আমরা বেশ কিছুদূর হাঁটাহাঁটি করি। হাঁটার পর পাহাড় থেকে নিচে নেমে সমতল ভূমিতে আসলাম। রাস্তায়। তখন দেখা হলাে পুলিশ অফিসার মি, কুদ্ছ। উনার সাথে দেখা হলাে এবং উনার সাথে এমইএস-এর বােধহয় আরেকজন অফিসার ছিলেন কিনা ভুলে গেছি তা। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আমাদেরকে নিয়ে প্রথমে তারা দাঁড় করিয়েছেন। তারপরে জেনারেল মর হাবিলদারকে বললেন নাে, মুভড়, কোনাে দাড় করানাে। নয়। কারণ আমার একটি সন্দেহ ছিল বিগত দিনে আমরা সেনাবাহিনীতে দেখেছি এক একটি ইনসিডেন্ট হয় তার পরবর্তীকালে দেখা যায় কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। যে কারণে কোনাে কিছুরই সঠিক ইতিহাস আমরা আজ পর্যন্ত। জানতে পারিনি। জেনারেল মঞ্জুর, আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করার। চেষ্টা করেছি যদিও আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি, মােটামুটি একটি আপ্রাণ চেষ্টা ছিল অন্তত উনাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। উনাকে যদি আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি একদিন না একদিন সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে। আমি সেজন্য বললাম না, ইউ মুভ, আমি হাবিলদারকে বললাম নাে, ইউ মুভ কোনাে দাঁড়ার্দাড়ি নেই। আমরা জাস্ট মুভ করছি। সামনে আসার পর ওখানে পুলিশের একটি জিপ নিয়ে এসেছিল। ওই জিপে আমরা সব উঠলাম। জিপে কিছুদূর যাওয়ার পর সেখানে অবস্থান ছিল একটি প্রাইভেট কার। সেই কারে জেনারেল মঞ্জুর এবং উনার ওয়াইফ এই দুইজনকে নিয়ে এনএসআই-এর অফিসার, সম্ভবত কুদুছ সাহেব ঐটিতে ছিলেন- উনারা উঠলেন। আর জিপের ভেতরে আমি, মিসেস দেলােয়ার, বাচ্চাদেরকে নিয়ে জিপে থাকলাম । টি বাগানটির এরিয়াটি ছিল ফটিকছড়ি থানায়। আমাদেরকে প্রথমে ফটিকছড়ি থানায় নেয়ার চেষ্টা করে তারপরে আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হাটহাজারির দিকে রওয়ানা দেয়। আমরা হাটহাজারির দিকে পৌছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হাটহাজারি থানায় আমরা পৌছার পর আমাদেরকে ওসি সাহেবের রুমে নেয়া। হলাে। আমরা সেখানে বসলাম। সেখানে আমাদের জন্য কিছু কোল্ড ড্রিঙ্কস আমার মনে আছে এখনাে সেভেন আপ খাওয়া হয়েছিল আর ডানহিল সিগারেটের। প্যাকেট এনে দিল। জেনারেল মঞ্জুর খাচ্ছিলেন। ততক্ষণে সেখানে চট্টগ্রামের। তৎকালীন ডিআইজি শাহজাহান সাহেব, পুলিশের ডিআইজি ছিলেন তিনি, পরবর্তীকালে সচিব হয়েছিলেন এবং ২০০১-এ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তিনি তখন ডিআইজি চিটাগাং শহরে। তিনি উপস্থিত হওয়ার পর জেনারেল মঞ্জুর বললেন শাহজাহান সাহেব আমার অনেক কথা।

আছে। আপনি আমাকে কিছু সাংবাদিক দেন আমি কথা বলতে চাই। তখন শাহজাহান সাহেব বললেন সরি স্যার আপনাকে কোনাে সাংবাদিকের সাথে কথা। বলতে দিতে নিষেধ আছে। এরপর জেনারেল মঞ্জুরের সাথে জাস্ট উনার একটু কথাকাটি হলাে, একটু তর্ক করলেন। উনি বললেন সরি স্যার যতক্ষণ আপনি ছিলেন তখন আপনার কথা শুনেছি এখন অন্যরা আপনার জায়গায় এসে গেছে। এখন তাদের কথা আমাদের শুনতে হচ্ছে। জেনারেল মঞ্জুর শাহজাহান সাহেবকে বললেন, শাহজাহান সাহেব দেশের রাষ্ট্রপতি মারা গেল- The President of the country has been assasinated. I have been blamed. So I should get an opportunity to face the trial. আমাকে আপনি ইমিডিয়েটলি চট্টগ্রাম জেলে নেন। জেলখানায় নিয়ে যান। আমাকে সেফ কাস্টডিতে নিয়ে যান, যাতে আমি ট্রায়াল ফেস করতে পারি, আমাকে যেন সেই সুযােগ দেয়া হয়। এর আগে আমরা যখন সারেন্ডার করি সেদিনটি ছিল ১ তারিখ । ৩১ তারিখ। দিবাগত রাতে, গভীর রাতে আমরা রওয়ানা দিই। সারাদিন হাঁটার পর ১ তারিখ। বিকেল চারটার দিকে আমরা সারেন্ডার করেছিলাম, চা বাগানের কুলির বাড়িতে। আর হাটহাজারি থানায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার পরে শাজাহান। সাহেবের সাথে এই কথাগুলাে হচ্ছিল। জেনারেল মঞ্জুরকে ধরার জন্য ৫ লাখ টাকা ঘােষণা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার, জীবিত বা মৃত যেভাবে হােক ধরার জন্য। ৫ লাখ টাকা ঘােষণা দেয়া হয়েছিল এটি আমাদের জানা ছিল না। সারেন্ডার করার পর আমরা জানতে পারি। সেই সুবাদে জেনারেল মঞ্জুর শাহজাহান সাহেবকে বলেন- শাহজাহান সাহেব আমি যার কাছে সারেন্ডার। করেছিলাম তাকে একটু ডাকেন। ডাকার পর তখন কুদ্ছ সাহেব আসলেন। জেনারেল মঞ্জুর বললেন- No, No he was not there. I have not surrendered to him. আমি তাে একজন হাবিলদারের কাছে সারেন্ডার করেছি। আমি তখন উকি দিয়ে দেখলাম, ওসি সাহেবের রুমের দরজার বাইরের ফাক দিয়ে হাবিলদার সাহেবের দাড়ি দেখা যায়। দরজাটি জাস্ট ফাক ছিল। তার। দাড়িটি দেখা যাচ্ছিল, সে উকি মারছিল। আমি তখন বললাম স্যার ওই তাে সেই হাবিলদার, যার কাছে আপনি সারেন্ডার করেছিলেন। শাহজাহান সাহেব সেই হাবিলদারকে ডাকলেন। এই তুমি ভেতরে আস। তখন হাবিলদার ভেতরে এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালেন। তখন জেনারেল মঞ্জুর তার কোমরে রক্ষিত, জামার নিচে। লুকায়িত পিস্তলটি আস্তে আস্তে বের করা শুরু করলেন। যখনি তিনি পিস্তলটি আস্তে আস্তে বের করেন তখন সবাই জাস্ট অ্যালার্ট হওয়ার চেষ্টা করলেন, চমকে গিয়ে। উনি বললেন, না, না ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভয় পাবেন না, আমি গুলি। করবাে না। আমি আমার এই পিস্তলটি এতক্ষণ পর্যন্ত সারেন্ডার করিনি কারণ-I was not confirmed that I am in the safe custody, আমার সাথে আমার ফ্যামিলি ছিল, আমি ছিলাম । আমার সাথে যদি কেউ মিসবিহ্যাভ করতাে তাহলে

আমি এটি ইউস করতাম। I am confirmed that I am in safe custody, I am getting the opportunity to face the trial. কারণ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে। আমার এই আর্মস সারেন্ডার করব। এই বলে পিস্তলটি নিয়ে ওই হাবিলদারকে। কাছে ডাকলেন। ডেকে বললেন শাহজাহান সাহেব আমি এই হাবিলদারের কাছে সারেন্ডার করছি, আমার নামে ঘােষিত যে পাঁচ লাখ টাকা তার হকদার হচ্ছে এই হাবিলদার, এই টাকার প্রতি অন্য কারাে কোনাে দাবি নেই । আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে আর্মসটি তার কাছে দিচ্ছি।

শাহজাহান সাহেবকে সাক্ষী রেখে সকলের সামনে উনি সেই পিস্তলটি তার। কাছে দিয়ে দিলেন। দেয়ার পর থেকেই জেনারেল মঞ্জুর প্রেসার ক্রিয়েট করছেন শাহজাহান সাহেব তাড়াতাড়ি আমাদেরকে চিটাগাং জেলে পাঠান। আমাদেরকে একটি পুলিশের ট্রাকে উঠান হলাে। পুলিশের ট্রাকে আমরা উঠলাম, উঠে বসে। আছি। সেই ৫টন ট্রাক। ট্রাকের পেছনে বেঞ্চের মতাে, সেখানে আমরা বসে আছি। কিন্তু ট্রাক স্টার্ট দেয় না। শাহজাহান সাহেবও তখন আমাদের সামনে। আসছেন না। কিছুক্ষণ পরে দেখি আর্মির গাড়ি এসে ঢুকল, হাটহাজারি থানায় । যখন আর্মির গাড়ি ঢুকল তখন আমি সাথে সাথে জেনারেল মঞ্জুরকে বললাম, স্যার আর্মির গাড়ি ঢুকেছে। তখন মঞ্জুর ঐখানে যারা অফিসার ছিলেন, পুলিশের ট্রাকের কাছাকাছি তাদেরকে বললেন শাহজাহান সাহেবকে খবর দাও। শাহজাহান সাহেব আর আসেননি। আসলেন ক্যাপ্টেন এমদাদ। এসে গাড়িটির। পেছনের সাইডে নিচে এসে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে মিসেস মঞ্জুরকে বলছিলেনভাবী আমরা আপনাদেরকে নিতে এসেছি। আপনি আসেন। তখন মিসেস মঞ্জুর। বলেছেন- নাে, আমি কেন আপনাদের সাথে যাব। আমরা পুলিশের কাছে । সারেন্ডার করেছি, আমরা জেলে যাব। আপনাদের কাছে যাব না। জেনারেল মঞ্জুর। কিন্তু শাহজাহান সাহেবের সাথে যখন কথা বলেন তখন তিনি একটি কথা কয়েকবার রিপিট করেছিলেন, শাহজাহান সাহেব, কোনাে অবস্থাতেই কিন্তু। আমাকে আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করবেন না। আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করলে। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আমাকে তাড়াতাড়ি সেফ কাস্টডিতে পাঠান। আমাকে জেলে পাঠান। ঐ সেই একই কথা- I should get an opportunity to face the trial. দেশবাসীর জানতে হবে। আমার অনেক কথা বলার আছে এবং সেটি বলব আমি। আমাকে আর্মির কাছে দেবেন না। সেই মােতাবেক মিসেস। মঞ্জুর বলল আমরা পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছি, আমরা পুলিশের কাছে যাব। তখন জেনারেল মঞ্জুর চট করে দাড়িয়ে গেলেন। দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে গাড়িটির। পেছন দিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদের দিকে এগুলেন। বললেন- Who is that officer? Who is that officer? তখন এমদাদ আস্তে করে একটু পেছনে হঠলেন। তখন জেনারেল মঞ্জুর বলছেন তােমাদের লজ্জা করে না, তিন বছর, সাড়ে তিন বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তােমাদের জন্য, এই সেনাবাহিনীর

জন্য, দেশের জন্য কী করেছি? তােমরা সব ঘটনা ঘটালে, তােমরা সব গিয়ে। সারেন্ডার করলে, এখন তােমরাই এসেছ আমাকে ধরে নিতে? তােমাদের লজ্জা। করে না। যাও আমি তােমাদের সাথে যাব না, পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছি, আমি জেলে যাব, পুলিশের কাছে যাব। তােমাদের কাছে আর যাব না। যাও বলে। ধমক দিলেন। | এমদাদ পিছে সরে গেলেন। পিছিয়ে গিয়ে একজন সুবেদারের কাছে কি জানি। কথা বলল। তারপর সুবেদার সামনে আসল। আসার পর কাছে এসে বলল আপনি আসেন, আপনি আসেন। সাথে সাথে জেনারেল মঞ্জুর বলল নাে, যাও আমি তােমাদের সাথে যাব না। যখন তিনি যাও আমি তােমাদের সাথে যাব না। বলে হাতটি এরকম করলেন (ইশারায় নাড়ানাে, তিনি কিন্তু পিছনে একদম কিনারায়) তখন সেই সুবেদার খপ করে তার ডান হাতটি ধরল। ধরে এক হ্যাচকা টানে নিচে নামিয়ে দিল। যখনই সুবেদার জেনারেল মঞ্জুরের হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিচে নামাল এরপর জেনারেল মঞ্জুর আর কোনাে কথা। বলেননি। তখন আরাে দু’জন সম্ভবত সিপাহি বা ল্যান্সনায়েক হবে (আমার ঠিক মনে নেই) গাড়িতে উঠল। তারা উঠে মিসেস মঞ্জুরকে টেনে হিচড়ে নামালেন। বাচ্চাদেরকে নামালেন। তখন সম্ভবত একজন পুলিশ অফিসার বলল ভেতরে মেজর সাহেব রয়ে গেছেন। তখন এমদাদ আসল। এমদাদ আমাকে দেখে চমকে উঠল। আমাকে দেখে চমকে উঠে সাথে সাথে সে বলল, দোস্ত তুই চলে আয়। আমি আগেই বলেছি এমদাদ আমার কোর্সমেট, ক্যাপ্টেন হাফিজ যিনি রাষ্ট্রপতি। জিয়াউর রহমানের সাথে শহীদ হয়েছেন উনার গার্ড রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন তিনিও আমার কোর্সমেট, রক্ষীবাহিনীর অফিসার ছিলেন। এমদাদ যাকে পাঠিয়েছে জেনারেল মঞ্জুরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিও আমারই কোর্সমেট, রক্ষীবাহিনীর অফিসার এবং একই ব্যাচের আমরা। সে আমাকে বলল দোস্ত তুই চলে আয়। তখন আমি তাকে বললাম হােয়াট ইজ দিস? তােমরা জেনারেলের সাথে এরকম বিহ্যাভ করছ কেন? তােমাদের যদি বলাই থাকে নিতে হবে, আমাকে বল, বুঝিয়ে বল আপনি না গেলে বাই ফোর্স আমাদের নিতে হবে, আমাদের এটি অর্ডার আমাদেরকে বুঝিয়ে বল তা। এভাবে তােমরা নিচ্ছ কেন? তখনই আমাকে এমদাদ বলল- Please for God’s sake তুই চুপ থাক, কিছু বলিস না। তুমি সিচুয়েশন বুঝতে পারছ না, তুমি চুপ থাক । Have confidence upon me? আমি তাে তােমার বিষয়ে সব জানি। Have confidence upon me? আমরা কিছু কাজ কারবার করব তুমি বাধা দিও না। তুমি চলে আস। তারপর আমি গাড়ি থেকে নামলাম। জেনারেল মঞ্জুরকে তাে নামিয়ে উনার চোখ, হাত, পা বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলল আমার চোখের সামনে, আমারও চোখ বাঁধল, হাত বাঁধল। হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে আমাকেও গাড়িতে উঠাল। এরপর আমি জাস্ট এমদাদের গলার আওয়াজ শুনলাম, সে বলল, তুমি মিসেস মঞ্জুরকে

জিওসির বাসায় নিয়ে যাও, আর মেজর সাহেবকে ব্রিগেডিয়ার আজিজের অফিসে নিয়ে যাও। আর আমি জেনারেলকে নিয়ে গেলাম । জাস্ট এটুকু শুনলাম। | তারপরে গাড়ি মুভ হয়ে গেল। চোখ তাড়াহুড়াে করে এমনভাবে বেঁধেছিল জাস্ট নিচের ফাক দিয়ে একটু একটু দেখা যাচ্ছিল। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম গাড়ি কোনদিকে যাচ্ছে। টের পেলাম ইবিআরসি মানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের দিকে। ঐখানে নেয়ার পর আমাকে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামানাে হলাে। নামানাের পর ব্রিগেডিয়ার আজিজের কণ্ঠস্বর শুনলাম। আমাকে দেখেই বলল, রেজা নাকি? আমি বললাম জি স্যার। তােমার সাথে আর কে কে ছিল? আমি বললাম আমাদের সাথে মেজর গিয়াস ছিল, সে পালিয়ে গেছে। তখন ব্রিগেডিয়ার আজিজ মেজর আকরামকে ডেকে বলল তুমি রেজাকে মেজর মুজিবের কাছে দিয়ে আস। অর্থাৎ সেই মেজর মুজিব ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কমান্ডার যার কাছে আমি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের জীবিত সদস্যদের রেখে এসেছিলাম। তার কাছে নিয়ে যেতে বলছে। আকরাম আমার পিঠে হাত রেখে বলল ভাই রেজা চল। আমি তখন ডিবেট করলাম হােয়াট ইজ দিস? আপনারা এটি কী ধরনের বিহ্যাভ করছেন। আমাদেরকে আপনারা আনেন, এভাবে চোখ, হাত, পা বেঁধে আনতে হবে, এরকম বিহ্যাভ করছেন কেন? আজকে আপনারা যাদেরকে দিয়ে আমাদের চোখ হাত-পা বাঁধছেন একদিন তার আবার আপনাদের হাত-পা-চোখ বাঁধবে। এটিতাে আপনারা ঠিক করছেন না। মেজর আকরাম বললেন- Please for God’s sake. রেজা প্লিজ চুপ কর। হি ইজ মাই সিনিয়র অফিসার। চুপ কর, চুপ কর বলে জাস্ট আমার পিঠে হাত বুলিয়ে গাড়িতে নিয়ে এফআইইউ (ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)-তে মেজর মুজিবের কাছে রেখে চলে আসল। ঐখানে নেওয়ার পর আমার চোখ খুলল। চোখ খােলার পরে মেজর মুজিব আসল। ওদের সাথে দেখা হলাে। মেজর মুজিব তখন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। শুধু বলল। স্যার আপনি থাকেন এখানে। (আমার কাপড় সব ভেজা ছিল। আমি যেহেতু পানিতে নেমেছিলাম ।) আপনার কাপড় চেঞ্জের ব্যবস্থা করছি, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সেল আছে, থানায় যেমন সেল থাকে তালা মেরে বন্ধ করে রাখে। ঐ সেলের ভেতরে আমাকে তালা মেরে রেখে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কাপড় আনল, খাওয়া-দাওয়া দিল। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। রাতে ঘুমালাম। দুদিন পর ঘুমালাম। পরেরদিন সকালবেলা মুজিব আসলেন। মুজিব নাস্তা নিয়ে আসল। সম্ভবত তার বাসা থেকে নাস্তা বানিয়ে এনেছিল। আমি মুজিবকে বলেছিলাম আমাকে কিছু নিউজপেপার দাও। তখন সে বলল সরি স্যার নিউজপেপার বা এরকম কিছু দেওয়া আপনাকে নিষেধ আছে। আমি পুরনাে ম্যাগাজিন নিয়ে আসি। একটি পুরনাে বিচিত্রা নিয়ে এসে দিয়ে বলল এটি পড়ে সময় কাটাতে থাকেন। আমি আস্তে করে জিগ্যেস করলাম- What about

General Manzoor? উনি ডানে বামে তাকিয়ে আস্তে করে আমাকে বলল গতরাতে আর্মি চিফের নির্দেশে জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঐ সময় আর্মি চিফ ছিল জেনারেল এরশাদ। সে শুধু এইটুকু বলতে পারল। সে আরাে বলল দেখেন স্যার আমিও তাে মুক্তিযােদ্ধা, এখন তাে মুক্তিযােদ্ধাদের সব ধরা হচ্ছে, অ্যারেস্ট করা হচ্ছে, আমিও তাে ভয় পাচ্ছি, না জানি আমার কী হয়। আবার আমাকে ধরে কি না। স্যার টেনশন কইরেন না, আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন বলে সে চলে গেল। আমি তখন দেখলাম বাকি যারা এফআইইউর লােকজন সব নতুন। অর্থাৎ চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের যে সমস্ত লােকজন দায়িত্বরত ছিলেন তাদেরকে চেঞ্জ করে ঢাকা থেকে যাদেরকে আনা হলাে তাদেরকে আমরা চিনছি না। যে কারণে কিছু জিগ্যেস করে কোনাে উত্তর পাচ্ছি না এই অবস্থা। আমার অপজিটে ক্যাপ্টেন মুনীরকে দেখলাম । ক্যাপ্টেন মুনীর ঐ যে প্রথম গাড়িটি সামনে চলে গিয়েছিল সে গাড়িতে ক্যাপ্টেন মুনীর ছিল। মুনীরের কাছে জিগ্যেস করলাম। মুনীরের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওরা যখন সামনের দিকে যাচ্ছে তারা দেখেছে যে দুটি আর্মির ট্রাক, আর্মির লরি ট্রপসসহ এগুচ্ছিল। তখন কর্নেল মতি জিপ টান দিয়ে নিয়ে সামনে যখন ট্রাককে ক্রস করে বা কাছাকাছি যায় ঐ ট্রাক থেকে মেজর মান্নান যিনি তখন। ১২ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড, ২/আইসি তিনি লাফ দিয়ে। নামলেন। নেমেই আর্মস তাক করে বললেন হ্যান্ডস আপ। আপনি নড়বেন না। যখন তাদেরকে এই কথা বলল তখনি কর্নেল মতি বলল, হ্যা মান্নান কর কী, কর কী, হােয়াট ইজ দিস, কী করছ, কী করছ। তাদের মধ্যে এই সমস্ত কথা হচ্ছিল। মুনীর বলল আমি আর কিছু বুঝতে পারিনি। হঠাৎ গােলাগুলির শব্দ শুনলাম । গাড়িতে ছিলেন কর্নেল মাহবুব আর কর্নেল মতি। তাদের লাশ পড়ে গেল। আরেকজন সুবেদারের ডেডবডি সাথে পড়ল । আর বাকি ট্রপস উল্টাপাল্টা সব গােলাগুলি করছে। মুনীর বলল, আমি তখন চিৎকার করে বললাম এই তােমরা কী শুরু করেছ, তােমাদের বাপ আসছে। আমি সাথে সাথে এই কথা বললাম। মানে হি ওয়াজ মিনিং মঞ্জুর। একথা বলার সাথে সাথে সব ট্রপস লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে আর্মির গাড়িতে উঠল। আর্মির গাড়ি দুটো চলে গেল । মুনীর যখন দেখল আমরা আর আসছি না, আর এরা মরে আছে, আর এদিক সেদিক সব আর্মস ছড়িয়ে আছে তখন সে কাছাকাছি ফটিকছড়ি থানা ছিল, দৌড়িয়ে থানায় গেল। থানায় গিয়ে ওদেরকে খবর দিয়ে নিয়ে এসে থানায় সারেন্ডার করল। আর আর্মসগুলাে কালেকশন করাল। সেই ফটিকছড়ি থানা থেকে এই ডিভিশন। হেডকোয়ার্টারে পরে তাকে এই সেলে রাখা হয়। মুনীর আমার অপজিটে। | আমি মুজিবকে খুঁজছিলাম। কারণ দেখলাম মুজিব ছাড়া আর কেউ কিছু বলছে। মুজিব নেই। আসে না, আসে না, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল আসে না। বিকেলে আমি একজনকে জিগ্যেস করলাম মেজর মুজিব কই? সে আসছে না।

কেন? তখন সে আস্তে করে বলল সরি স্যার মেজর মুজিব আসতে পারবেন না। অসুবিধা আছে। তখন আমি বুঝলাম মুজিব একজন ফ্রিডম ফাইটার আমিও একজন ফ্রিডম ফাইটার তাকে হয়তাে আমার কাছে আসতে দেবে না। কারণ আমি আগেই বলেছি জিয়াউর রহমানকে কে মেরেছে, কেন মেরেছে, এটির তদন্ত নেই, কথাবার্তা নেই, আওয়াজ নেই। জাস্ট এরশাদের নেতৃত্বে নন ফ্রিডম। ফাইটার যারা তাদেরকে নিয়ে একটি গ্রুপ হয়ে গেল এবং তারা ঢাকায় ছিল আর মঞ্জুরের নেতৃত্বে ফ্রিডম ফাইটারদের একটি গ্রপ হয়ে গেল। যে কারণে চিটাগাংয়ে এরকম বেছে বেছে মুক্তিযােদ্ধাদের ধরা শুরু হলাে। | আমি ভাবলাম মুজিব আসছে না, আচ্ছা ঠিক আছে। সারাদিন গেল, রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়া করে, তখনই আমাদের জন্য অফিসার্স মেস থেকে কাপড় এনে দিল। আমরা কাপড় চেঞ্জ করে রাতে ঘুমালাম। সকালে উঠলাম, আবার সারাদিন গেল। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে শােয়ার পরে আমি ঘুমিয়ে থাকলাম। হঠাৎ ভাের রাতে আমাদের ডাক পড়ল । স্যার উঠেন, স্যার উঠেন ডাকছে কেউ। উঠলাম। উঠে দেখি অচেনা মুখ। বলল স্যার আপনাদেরকে নিতে এসেছি। তখন আমি মুনীরকে জিগ্যেস করলাম (পাশের সেলে) কী ব্যাপার আমাদের কোথায় নিবে এখন। আমরা তখন বুঝতে পারছিলাম না রাত না ভাের না ভােররাত । আমাদের কাছে ঘড়ি নেই। সন্দেহ হলাে হয়তাে আমাদেরকেও মেরে ফেলতে পারে। মনে এরকম একটি সন্দেহ হলাে। আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে আমরা যাচ্ছি। আমাদের একটু সুযােগ দেন। আমরা অযু করে নিই। বলল না সরি স্যার। টাইম নেই। আমি বললাম দেখেন কী বলছেন এটি? আমরা জানি আমাদের কী। করবে এখন। আমাদেরকে নিয়ে এখন মেরে ফেলা হবে। আমরা তাে মুসলমান। আমরা অযু করব, তওৰা কাটবাে, দোয়া দরুদ পড়ব। তারপরে আমরা মরব। আমরা কি সেই সুযােগটিও পাব না নাকি। এটি কী বলছেন আপনি। বলল, সরি। স্যার, সরি স্যার। আমরা স্যার কিছু বলতে পারব না। আমরা জানি না স্যার। আপনাদেরকে এখনি যেতে বলছে টাইম নাই। মুনীরকে বললাম মুনীর আমরা। যখন নিয়ত করেছি অজু করার অসুবিধা নেই আমাদের নিয়ত কবুল হয়ে গেছে। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে থাক আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। | আমরা বের হলাম। এবার কিন্তু চোখ টাইট করে বাঁধলাে। হাত পিঠমােড়া করে বাধল। এর আগে যখন চোখ বেঁধে হাটহাজারি থানা থেকে নিয়ে এসেছিল তখন কিন্তু ফাক দিয়ে একটু একটু দেখতে পারছিলাম। এবার কিন্তু আরাে টাইট করে বেঁধেছে। যে কারণে আমি তখন ইবিআরসি, ব্রিগেডিয়ার হাফিজ, তারপরে ব্রিগেডিয়ার লতিফ তাদেরকে দেখেছিলাম। তারা বসেছিল। আমি দাঁড়ানাে। অবস্থায় তাদের দেখেছিলাম। এবারে টাইট করে চোখ বেঁধেছে, হাত পিঠমােড়া। করে বেঁধেছে এবং গাড়ির সিটের সাথে ক্রস করে বেঁধেছে। যে কারণে আমরা মােটামুটি কনফার্ম আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেরে ফেলার জন্য। জেনারেল

মঞ্জুরকে মেরে ফেলেছে এই খবর আমরা জেনে ফেলেছি। আমাদেরকেও মেরে ফেলবে। মােটামুটি দোয়া দরুদ পড়ছি। কখন মারবে জানি না। খালি আন্দাজ করার চেষ্টা করছি গাড়িটি কোনদিকে যাচ্ছে। একসময় মনে হলাে এটি বােধহয় হাটহাজারির দিকে যাচ্ছে। হাটহাজারিতে আবার ফায়ারিং রেঞ্জ। ভাবলাম হাটহাজারির পাহাড়ের ভেতরে ফায়ারিং রেঞ্জ আছে ঐখানে হয়তাে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে। অনেকক্ষণ পথ চলার পর হঠাৎ করে মনে হলাে পাকা রাস্তায় গাড়ি চলছে। কারণ আমার মনে হলাে হাটহাজারির দিকে যে ফায়ারিং রেঞ্জে সেদিকের রাস্তা তাে একদম পুরাে মেলটেড হওয়ার কথা নয়। ঝাকিটাকি খাওয়ার কথা। যখন পাকা রাস্তার উপর দিয়ে যাচ্ছি তখন ভাবলাম আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এরকম চিন্তাভাবনা করছি। এবং আমি কনফার্ম ঢাকায় একবার যদি নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে সব জেনারেলরা থাকবে সেখানে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারব ইয়েস আই ওয়াজ নট ইনভলবড়, কেন আমার চোখ বাধা হলাে- এগুলাে বলতে পারব। পরে দেখি আবার অন্যরকম রাস্তা, উচু নিচু রাস্তা। একজায়গায় গাড়ি থামল। আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামানাে হলাে। গাড়িতে যখনই জিগ্যেস করি কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কেউ কোনাে কথা বলে না। এক পর্যায়ে একজন বলল স্যার আপনাদের সাথে আমাদের কথা বলা মানা । নামলাম। গাড়ি থেকে নামার পর একজন অফিসারের কণ্ঠ। সে তখন লে, ছিল, লে, মনােয়ার । আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল রেজা স্যার। আমি বললাম কে? বলল স্যার আমি মনােয়ার। আমি বললাম মনােয়ার কী খবর? বলল স্যার। আপনাদেরকে চিটাগাং জেলখানায় নিয়ে আসা হয়েছে। আপনাদের ট্রায়াল হবে। যেই বলল আপনাদের ট্রায়াল হবে সাথে সাথে বললাম আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হলাে জেলখানার ভেতরে। এটি বুঝলাম চোখ। খােলার পরে। আমরা জেলখানার ভেতরে গেলাম। ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পরে। | আমাদের চোখ খুলল। তাকিয়ে দেখি আমরা চট্টগ্রাম জেলখানার জেলারের অফিসে। জেলার/ ডেপুটি জেলার (আমার ঠিক মনে নেই) ছিল। চোখ খুলে দেখি। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল দেলাওয়ার, মেজর মুজিব- যে মুজিবকে খুঁজছিলাম সেই মুজিব। মুজিবকে দেখে আমি জিগ্যেস করলাম মুজিব কী। ব্যাপার? তখন মুজিব বলল স্যার সকালে আপনাকে নাস্তা দিয়ে আসার পরপরই আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সকালবেলা সে আমাকে নাস্তা দিয়ে গেল সেটি ২ জুন। ২ তারিখ সকালবেলা এসে আমাকে নাস্তা দেয়ার পর ২ তারিখেই তাকে অ্যারেস্ট করা হলাে এবং ৩ তারিখ আমাদেরকে চিটাগাং নেয়া হলাে। সেখানে অনেককে পেলাম। জেলখানায় আমাদের সকলকে এপ গ্রপ করে জেলের ভেতরে যে ফাসির সেল থাকে, কনডেম সেল, সেই সেলের ভেতরে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলাে। একেকটি রুমে আমাদেরকে তিনজন করে দিল। ব্রিগেডিয়ার মহসীন, মেজর মমিন এবং আমি এই তিনজন একরুমে। জেনারেল মঞ্জুর মারা।

গিয়েছেন আমাদের যাদেরকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল সেখানে সিনিয়র মােস্ট ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মহসীন। ব্রিগেডিয়ার মহসীন, আমি এবং মেজর মমিন এই তিনজন একসাথে ছিলাম । মেজর মমিনকে জিগ্যেস করলাম আপনি, কী ব্যাপার? মেজর মমিন বললেন ৩১ তারিখ রাতে যখন চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ, ব্রিগেডিয়ার আজিজ, জেনারেল মঞ্জুর সবাই একসাথে বসেছিলেন তখন ঢাকার সাথে নেগােসিয়েশন করার জন্য হান্নান শাহ দায়িত্ব নিয়েছিল। অর্থাৎ ঢাকার সাথে মঞ্জুরের চট্টগ্রাম ডিভিশনের সাথে একটি নেগােশিয়েট করার জন্য হান্নান শাহ দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং তিনি ঢাকার সাথে কথা বলছিলেন, জেনারেল মঞ্জুরের সাথে কথা বলছিলেন এবং আমরা যখন সেখান থেকে সরে আসি তখন মেজর মমিন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর গাড়িতে উঠে উনার সাথে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে উনাকে জেলে পাঠানাে হয়। | সেলের মধ্যে আমাদেরকে ২৪ ঘণ্টা তালা মেরে রাখা হত এবং এর ভেতরে আমাদেরকে গােসল করতে হত। একটি ফাসির সেল বেশ ছােট একটি রুম। রুমের এক কর্নারে ছােট একটি ডিব্বা। সেই ডিব্বাটি সুইপার দিয়ে যেত। দিয়ে গেলে একজন সেখানে তার মল ত্যাগ করত । মানে তার যখন মল ত্যাগ করার প্রয়ােজন হত সে মলত্যাগ করত। বাকি দুজন ঐ রুমের ভেতরে একটি কম্বল টেনে বেড়ার মতাে করত। অপরজন মলত্যাগ করত। স্বাভাবিক কারণেই চার পাঁচ হাত ভেতরে, এটি আমাদের জন্য অস্বাভাবিক ছিল। দুর্গন্ধের জন্য আমরা তখন আগরবাতি জালিয়ে রাখতাম। ঐখান থেকে কিছুদিন পরে আমাদেরকে আবার নিয়ে যাওয়া হলাে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। ইনকোয়ারি করার জন্য, তদন্ত করার জন্য। এই তদন্ত কমিটিতে নেয়ার আগে অর্থাৎ আমরা চিটাগাং জেলে যাওয়ার ঠিক দুই তিনদিনের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান (পরবর্তীকালে উনি বিদেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এখানে মারা গিয়েছেন) চিটাগাং জেলে আসলেন। এসেই ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে বলছেন মহসীন আপনি একজন নামকরা যােদ্ধা হয়ে জিয়াকে হত্যা করলেন? আপনি কীভাবে জিয়াকে হত্যা করলেন। তখন মহসীন বলল, নাে, আমি কীভাবে জিয়াকে হত্যা করব? আমি তাে তিনদিন ধরে অসুস্থ, আমি তাে ঘর থেকেই বের হতে পারিনি। অর্থাৎ ব্রিগেডিয়ার মহসীনের চোখ উঠেছিল, চোখ খুলতে পারতেন । যে কারণে চিটাগাং সিএমএইচ থেকে ডাক্তাররা দেখে তাকে সিক ইন কোয়ার্টার রিমান্ড করে। সিক ইন কোয়ার্টার রিমান্ড করাতে তিনি বাসায় থাকতেন। ঐ সময় তিনি বাসাতেই ছিলেন। রাতেও বাসায় ছিলেন। সবসময় বাসায় ছিলেন। ঐখান থেকে উনাকে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরদিন খবর দিয়ে আনা হয় এবং পরবর্তীকালে উনাকেও জেলে ঢােকানাে হয়। ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে তখন মাহমুদুল হাসান বললেন, আপনার কি মনে আছে সেই যে আমাদের তালিকা করেছিলেন। ব্যাপারটি হলাে ব্রিগেডিয়ার মহসীন যখন ডিরেক্টর।

অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ছিলেন তখন দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা করেছিলেন, সেনাবাহিনীর দুনীতিবাজ যারা তাদের একটি তালিকা করেছিলেন। যেটি রাষ্ট্রপতি চেয়েছিলেন। সেই তালিকার কথা বললেন এবং আরাে বললেন ঠিক আছে এবার তাে বাগে পাওয়া গেছে, এবার বুঝবেন। এই বলে জাস্ট মাথা। ঝাকুনি দিয়ে বলল এইবার বুঝবে। তারপরে আমার দিকে তাকাল। আমাকে দেখে বলল- Reza, How come you are with them? আমি বললাম স্যার আমি তাে জিওসির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলাম, বাসায় সারারাত ঘুমিয়েছি। আমাকে ডেকেছে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করার জন্য, আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। যখন উনি সারেন্ডার করেছেন। আমি সারেন্ডার করেছি, উনাকে মেরে ফেলেছে। ব্যাস আমাকে জেলে এনেছে, আমি এখানে এসেছি। এই তাে আমি জানি, আর কিছু জানি না। উনি আমাকে 4916 – Don’t worry, there will be court of inquiry, Don’t worry. আমাকে এই কথা বললেন। মাহমুদুল হাসানের সাথে আমি আবার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে একসাথে চাকরি করেছিলাম। যে কারণে হয়তাে এই কথা বলে। আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। | আমাদের কোর্ট অব ইনকোয়ারি শুরু হলাে। আমাদের চোখ বেঁধে চট্টগ্রাম জেল থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হত। মি. বেগ ছিলেন তখন ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার। তার অফিসে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানে। আমাদের তদন্ত শুরু হলাে। একদিকে তদন্ত হচ্ছে, আরেকদিকে টর্চার শুরু হয়ে গেল। আমাকে অবশ্য টর্চার করেনি। তারা প্রথম টর্চার শুরু করেছে কর্নেল দেলওয়ারকে দিয়ে। তারা অমানবিক, অমানুষিক টর্চার করল। তার আঙুলের ভেতর দিয়ে সুঁই ঢােকাল, পেনিসের ভেতর দিয়ে কাচের রড ঢুকিয়েছে, পিটিয়েছে এবং টর্চার করে বলেছে তারা যেভাবে বলবে সেভাবে স্টেটমেন্ট কর। তাদের মতাে মনগড়া স্টেটমেন্ট করিয়ে নিচ্ছে। মেজর মুজিবকে টর্চার করেছিল। | আমরা চিটাগাং জেলখানায় যাওয়ার কিছুদিন পরে মেজর ইয়াজদানী আসল, মেজর গিয়াস আসল। ঐ যে মেজর গিয়াস পালিয়েছিল পরবর্তীকালে সে আর পালায়নি। সে সারেন্ডার করেছিল ফটিকছড়ি থানায় । ফটিকছড়ি থানার ঐখানে একটি টি গার্ডেন ছিল সেই টি গার্ডেনের ম্যানেজারের কাছে সারেন্ডার করে। ওরা থানার মাধ্যমে তাকে পাঠিয়ে দেয়। আর মেজর ইয়াজদানী উনার সারেন্ডারটি একটি রহস্যময় ব্যাপার ছিল। মেজর ইয়াজদানী এবং মেজর খালেদ দু’জন একসাথে একটি পিকআপে ক্যাপ্টেন জামিল এবং কর্নেল ফজলে হােসেনসহ ছিলেন। তাদেরকে সেফ সাইডে রাখার জন্য যখন যাচ্ছিলেন তখন তারা দেখে পেছন থেকে আর্মির একটি গাড়ি ট্রপসসহ আসছে। এটি দেখে তারা গাড়িটি ঐভাবে ফেলে দুইজন দুইদিকে চলে যায়। মেজর খালেদ হারিয়ে যায় একদিকে মেজর ইয়াজদানী হারিয়ে যায় আরেকদিকে। মেজর ইয়াজদানী গ্রামে প্রবেশ

করে। একজন লােকের কাছ থেকে একটি লুঙ্গি, একটি গামছা, কাপড়-চোপড় এগুলাে টাকা দিয়ে নেয়। তার মােছ ছিল, মােছটিও সে চেঁছে ফেলে। তারপর সে হাটা শুরু করে। একটি খাল পার হওয়ার সময় তার মানিব্যাগটি হারিয়ে যায়। তখন তার পাঞ্জাবির পকেটে একটি আধুলি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে সে প্রায় ফেনী এলাকার সাইডে ইন্ডিয়ান বর্ডারের দিকে চলে যায়। সম্ভবত এটি হাইওয়ে এলাকার দিকে চলে আসে। আসার পরে উনাকে একটি যুবক সন্দেহ করে ডাকে। আড়ালে জিগ্যেস করে ভাই কি সমস্যা আছে না কি? আপনার সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। তখন ইয়াজদানী বললেন ভাই আমি একজন মুক্তিযােদ্ধা। সেনাবাহিনীতে এখন মুক্তিযােদ্ধা-অমুক্তিযােদ্ধা গণ্ডগােল শুরু হয়ে গেছে। আমি পালিয়ে আসছি, এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না। তখন সে বলল আপনি ভয় পাবেন না, আমরা মুক্তিযােদ্ধাদের পছন্দ করি। আমি আপনাকে একটি বুদ্ধি দিই। ঐ দেখেন ইন্ডিয়ান বর্ডার দেখা যায়। অর্থাৎ মেইন রােড থেকে বেশি দূরে না কাছাকাছি। জাস্ট আপনি এক দৌড়ে ঐ বর্ডারে চলে যান। আপনি চলে যেতে পারবেন। তখন ইয়াজদানী বলল নাে, আমি টস করবাে। দেখি কী করা যায় । টস করে দেখি আমার ভাগ্যে কী আছে। একথা বলে তিনি পকেট থেকে সেই আধুলিটি বের করলেন। বের করে উনি টস করলেন। হেড হলে সারেন্ডার করবে আর টেল হলে স্টেপ করবে। টসে হেড উঠল। তখন উনি বললেন না, টসে আমার হেড উঠেছে আমাকে সারেন্ডার করতে হবে। আমি এখন সারেন্ডার করব। এই কথা বলে মেইন রােড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ফেনীর সেই অলরেডি মেইনরােড দিয়ে তখন আর্মির গাড়ি মুভ করছিল। একটি গাড়ি যখন ইয়াজদানীর কাছাকাছি যায় গাড়ি থামানাের জন্য ইয়াজদানী হাত তুলেছিল। গাড়িটির সামনে বসা ছিল মেজর মাওলা। (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ফাস্ট ব্যাচের মেজর মাওলা। মেজর মুজিব যিনি এফ আই ইউ ছিলেন তিনিও একই ব্যাচের ছিলেন। খালেদা জিয়ার আপন ভাই মেজর সাঈদ ইস্কান্দার উনি এখন এমপি হয়েছেন তিনিও একই ব্যাচের। বর্তমানে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহম্মদ উনিও একই ব্যাচের) মেজর মাওলা যখন ইয়াজদানীকে ক্রস করে। যায় (খেয়াল করেনি) ইয়াজদানী হাত নাড়ছিল। যখন গাড়ি চলে যায় তখনই ইয়াজদানী মাওলা বলে চিৎকার করে ডাকে। ডাকার সাথে সাথে মাওলা গাড়ি ব্যাক করে। ব্যাক গিয়ারে গিয়ে আবার আসে। তখন ইয়াজদানীকে দেখে চিনে। প্রথমে চিনতে পারেনি। কারণ ইয়াজদানী মােছ ফেলে দিয়েছিল। উনার বেশ বড়সড় মােছ ছিল। ইয়াজদানী মাওলাকে বলে মাওলা আমি সারেন্ডার করব। মাওলা বলে স্যার আপনি সারেন্ডার করবেন। বলল হ্যা আমি সারেন্ডার করব। বলল ঠিক আছে আসেন। তারপরে মাওলা ইয়াজদানীকে নিল গাড়িতে । মাওলা ইজ এ ফ্রিডম ফাইটার। ইতােমধ্যে ওদের হাবভাব দেখে মাওলা বুঝতে পারছিল সারেন্ডার করলে ভালাে হবে না। যেহেতু সে ঐ জায়গায় ডিউটি করছিল, সে কারণে সে বলতে পারছিল না আপনি পালিয়ে যান আবার সারেন্ডার করুন এটিও বলতে পারছিল না। বিকজ হি লাইকড মেজর ইয়াজদানী। মেজর ইয়াজদানীকে আমরা সবাই লাইক করতাম। বেশ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। তার কিছুদিন পরে হঠাৎ দেখি কর্নেল মাহফুজকে পাঠাল। কর্নেল মাহফুজ চলে গেলেন ঢাকায়। হি ওয়াজ দ্য পিএস টু প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় গিয়ে কয়েকদিন থাকার পর হঠাৎ করে তাকে সেখান থেকে অ্যারেস্ট করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কর্নেল মাহফুজ আসার পর আমি তাকে জিগ্যেস করলাম কী ব্যাপার আপনি আবার এখানে কেন? আপনাকে কেন পাঠানাে হলাে? কর্নেল মাহফুজ বলল আমি ঢাকায় গেলাম । ঢাকায় গিয়ে বলছিলাম কর্নেল মতি প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার দুই তিনদিন আগে কী আলােচনা করল। কী করছিল, কেন এসেছিল, কার সাথে এসে দেখা করল, এগুলাে দেখা দরকার। তদন্ত দরকার। এসমস্ত কথাবার্তা আমি বলেছিলাম মনে হয় এ কারণে আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এটি বলে রাখা দরকার যিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গুলি করে হত্যা করেছেন সেই কর্নেল মতিউর রহমান জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার মনে হয় তিনদিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন, আর্মি হেডকোয়ার্টারে। সেখানে সেনাপ্রধান এরশাদসহ অনেকের সাথে তিনি দেখা করেছিলেন।

সেখানে জেনারেল এরশাদের সাথে কী কথা হয়েছিল কর্নেল মতি এবং এরশাদ ছাড়া আর কেউ জানে না, বলতেও পারবে । কর্নেল মাহফুজকে দেখে আমার খারাপ লাগল কারণ রক্ষীবাহিনী থেকে মার্জ হওয়ার পর কর্নেল মাহফুজের সাথে আমার চাকরি করার সুযােগ হয়েছিল। যখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মারা যায় হি ওয়াজ ওয়েটিং ইউথ দ্য ডেডবডি । রাষ্ট্রপতির লাশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে সম্ভবত চট্টগ্রাম কমিশনার বা এরকম কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ৩০ তারিখ সকালে মাহফুজকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়েছিল। অনেকটা হাউজ অ্যারেস্টের মতাে তাকে ব্রিগেড মেসে রাখা হয়েছিল। ৬৯ ব্রিগেড মেসে তাকে রাখা হয়েছিল অর্থাৎ এটিকে ধরা যায় হি ওয়াজ হাউজ অ্যারেস্টেড। আবার সেই কর্নেল মাহফুজকে জিয়া হত্যার অভিযােগে অ্যারেস্ট করা হলাে দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। ব্যাপারটি কী উনাকে এদিকে হাউজ অ্যারেস্ট করা হলাে আবার ওদিকেও তাকে পাঠানাে হলাে। আমি জিগ্যেস করলাম কী ব্যাপার? বলল আই ওয়াজ জাস্ট টেলিং কেন কর্নেল মতি আসল, কেন কথা বলল, আমি এভাবে কথাগুলাে বলেছিলাম বলে আমাকে অ্যারেস্ট করে পাঠিয়ে দিল। এক পর্যায়ে একদিন দেখা গেল আমি আর ব্রিগেডিয়ার মহসীন যে সেলে থাকতাম সেখান থেকে ব্রিগেডিয়ার মহসীনকে নিয়ে যাওয়া হলাে। দুইদিন তিনদিন চলে গেল ব্রিগেডিয়ার মহসীনের কোনাে খবর নেই। তাকে আর ফেরত আনেনি। আমাকেও একদিন নিয়ে যাওয়া হলাে। ব্রিগেডিয়ার আশরাফ (তখন কর্নেল ছিল, তখন হি ওয়াজ দ্য ডিরেক্টর অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) যার।

নেতৃত্বে টর্চারগুলাে হত। ওই সময়ে হি ওয়াজ দ্য টর্চার মাস্টার। কর্নেল দেলাওয়ারকে যখন আশরাফ টর্চার করে (কর্নেল আশরাফও কিন্তু ফ্রিডম ফাইটার, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল) কর্নেল দেলাওয়ার আশরাফকে বলল স্যার আপনি আমার সাথে একসাথে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করেছেন। কিছুদিন আগে পােস্টিং হয়ে চিটাগাং থেকে চলে গিয়েছেন, ঢাকা আর্মি হেডকোয়ার্টারে। আপনি যদি আমার জায়গায় আমার সাথে এখানে থাকতেন আপনারেও তাে একই অবস্থা হত। বিং এ ফ্রিডম ফাইটার আপনিও তাে ফাসতেন। এরপরে এটিও বলেছিলেন দেখেন আপনি যখন এখান থেকে পােস্টিং নিয়ে যান তখন আমি আপনাকে দাওয়াত করে খাওয়ালাম । যত্ন করে দাওয়াত দিলাম। আপনার সাথে কত একটি ভালাে সম্পর্ক ছিল আর আপনি আমাকে এভাবে টর্চার করছেন। (ব্রিগেডিয়ার আশরাফ পরবর্তীকালে জেনারেল হয়ে এনএসআই-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা নেয়ার পর) আশরাফ তখন তার উপরে আরাে রাগ করে- কী তুমি আমাকে খাওয়ার খােটা দিচ্ছ, মার বেটাকে বলে আরাে টর্চার করে। সেই আশরাফের মুখােমুখি আমি হই। আমাকে চট্টগ্রাম জেলখানা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তদন্তের স্বার্থে। তখন আশরাফ আমাকে দেখে ফাস্ট বললেন- রেজা গলাটা তাে বেঁচে গেল। ভালােই তাে চাকরি করেছ, গলাটা বেঁচে গেল। আমি বললাম মানে? আপনি কী বলতে চান? বললেন-হ্যা ঢাকার সবাই বলে, জেনারেলরা বলে রেজা একজন খেলােয়াড়, সে কোনাে গ্রুপিং করে না, কিছু করে না, সে কীভাবে এখানে আসল। যাক ওকে তাে অন্তত ফাসি দেয়া যায় না। তােমার কথা আলােচনা হয়েছে। তােমার ফাসি হবে না। গলা তােমার বেঁচে গেছে। বাট ডজ খাবা, তুমি। ডজ খাবা। তবে এই ডজটা না খাওয়ার একটা রাস্তা আছে। আমি বললাম কী রাস্তা আছে? বলল- তুমি তাে জান, তুমি জেনারেল মঞ্জুরের সাথে ছিলা। তুমি জান জেনারেল মীর শওকত আলী, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক, ফাস্ট এসএস, সেকেন্ড এসএস-এর অনেক অফিসার আছেন নাম বলল- তারা সবাই তাে এর সাথে ইনভলব ছিল, জিয়া হত্যার সাথে । তুমি তাে জান, তুমি তাদের নাম বল। কোর্টে তুমি ওদের নাম বল। নাম বল এন্ড ইউ লিভ দিস কান্ট্রি, এনজয় ইফরসেলফ ইন দ্য এবরড। গাে এবরড এনজয় ইউরসেলফ। কেন খামাখা ডজ খাবা। গলা তােমার বেঁচে গেছে এটা আমি তােমাকে গ্যারান্টি দিতে পারি । বাট ডজটা গ্যারান্টি হবে তখনি তুমি যদি একটু এভাবে কথা বল। তখন আমি বললাম স্যার, সরি স্যার আমি সারারাত বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। আমি কিছু জানি না।

আমাকে জাস্ট জেনারেল মঞ্জুর বলেছেন তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে। আমি তা পালন করার চেষ্টা করেছি। আর ল ফুল কমান্ড, আন ল ফুল। কমান্ড আমাদের তাে বলা হয়নি। কোনটি ল ফুল কমান্ড আর কোনটি আনল। ফুল কমান্ড । আমরা তাে এভাবেই দেখে আসছি। এই পর্যন্ত অনেক ঘটনা ঘটেছে। এরিয়া কমান্ডার যা বলবে আমাদের তাই শুনতে হবে। আমি তাই করেছি। এভাবে কথা বলার এক ছলে এক পর্যায়ে আমি তাকে জিগ্যেস করলাম ব্রিগেডিয়ার মহসীন কোথায়। ভাবলাম ডাইরেক্ট কীভাবে জিগ্যেস করি। আমি বললাম স্যার ব্রিগেডিয়ার মহসীন তাে আমার রুমে থাকতেন উনাকে দুই তিনদিন আগে নিয়ে আসা হয়েছে। এখনাে উনাকে ব্যাক করানাে হয়নি। উনার কিছু কাপড়-চোপড় ছিল আমার কাছে। এগুলাে উনার কাছে যদি পৌছানাে হত ভালাে হত। একথা বলার সাথে সাথেই আশরাফ হেসে দিল। হেসে দিয়ে বলল রেজা অত ঘুরাইয়া কথা বল কেন? জানতে চাচ্ছ ব্রিগেডিয়ার মহসীন মারা গেছে না বেঁচে আছে, তাই তাে। আমরা সহজে ওকে মারছি না। আমরা কাউরে মাইরা ফেলাই নাই। উনি আছেন, আছেন। সময়মতাে উনাকে ছেড়ে দেয়া হবে। একথা বলে তারপর উনি আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার যিনি ছিলেন বেগ তার সামনে নিয়ে গেলেন। উনি বসে থাকলেন। আমার কনফেশনাল স্টেটমেন্ট নিল। আমি আমার স্টেটমেন্ট দিয়েছি। আমাকে প্রেসার। দিয়ে কোনােকিছু বলানাের চেষ্টা করেনি। আমি যা বলবার সেটিই বলেছি। ভাবলাম আমার স্টেটমেন্ট হয়ে গেছে এটি হয়তাে কোর্টে দেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে কোর্টে এই স্টেটমেন্ট আর দেয়া হয়নি, জমা দেয়া হয়নি। আমি চলে আসলাম। তার একদিন পর ব্রিগেডিয়ার মহসীন ফেরত আসলেন চট্টগ্রাম। জেলে। জেলখানায় আমার সেলে উনাকে ঢুকিয়ে যখন তালা মেরে সিকিউরিটি চলে গেল সাথে সাথে উনি জামাটি খুলে আমাকে উনার পিঠ দেখালেন। লাল টকটকে চেহারা ছিল ব্রিগেডিয়ার মহসীনের। পুরােটি পিঠ মনে হয় রক্ত, চাপ চাপ রক্ত জমে আছে এমনভাবে টর্চার করেছে। তখন রােজার মাস ছিল ব্রিগেডিয়ার মহসীন বারে বারে বলেছে দেখ আমি রােজা রেখেছি। তখন তারা বিদ্রুপ হাসি হাসত। এই আশরাফের নেতৃত্বে তখন কর্নেল মহসীন ছিল আরেকজন (ফর্সা মতন সম্ভবত তিনি ডিজিএফআইতে ছিলেন, ক্যাটস আই, আমরা লাল মহসীন বলতাম তাকে) আরাে কয়েকজন ছিলেন তার সাথে তারাও টর্চার করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মহসীন তাদের মনগড়া স্টেটমেন্টে স্বাক্ষর করেছে। ততক্ষণ পর্যন্ত টর্চার করেছে।

এভাবে একে একে কর্নেল মাহফুজ, মেজর মুজিব এদের প্রত্যেককে টর্চার করে তাদের মনগড়া স্টেটমেন্টে স্বাক্ষর নিয়ে ঐ স্টেটমেন্ট এর বদৌলতে উনাদেরকে ফাসিতে ঝুলিয়েছিলেন। আমাদের সেই স্টেটমেন্ট শেষ হওয়ার পর কোট শুরু হলো। কোটটি শুরু হলাে চট্টগ্রাম জেলের ভেতরেই। আমরা যে ফাসির সেলে থাকতাম তার ভেতরে ছিল জেলখানার পুলিশ। আমরা অনেক কষ্ট করে তাদের মাধ্যমে আমাদের ফ্যামিলির কাছে। মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমার মনে আছে আমরা একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলাম (জেলখানার পুলিশরা ঢােকার সময় ভালাে করে চেক করা হত। তাদেরকে কোনাে কলম, কাগজ দেয়া হত না এবং কোনাে কাগজ কলম নিয়েও

তারা বের হতে পারত না)। আমরা সিগারেটের ভেতরে যে সাদা কাগজ থাকে। তার ভেতরে চিঠি লিখে দিতাম। জেলখানার পুলিশেরা প্যান্টের সেলাইয়ের ভেতরে বলপেনের লম্বা শিস ঢুকিয়ে নিয়ে আসত ঐটি দিয়ে আমরা চিঠি লিখে দিয়েছি। সেই চিঠি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আবার প্যান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে আমাদের ফ্যামিলির কাছে পৌছে জানিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর কী নির্যাতন করা হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা নির্যাতনের খবরটি পৌছাতে পেরেছিলাম। সেগুলাে কোনাে কাজ হয়নি, কোনাে ফল দেয়নি। | আমাদের সেই তথাকথিত বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে তখন। হঠাৎ করে একদিন আমাদেরকে চার্জশিট ধরিয়ে দিল। আমাকে যে চার্জশিট দেয়া হলাে সেখানে তিনটি চার্জ দেয়া হলাে- আমি মিউটিনিতে উস্কানি দিয়েছি, মিউটিনিতে জয়েন করেছি, আমি মিউটিনিতে সাপাের্ট দিয়েছি অর্থাৎ একটি সেনা বিদ্রোহ, এই বিদ্রোহ করার জন্য উস্কানি দিয়েছি, উস্কানি গ্রুপের সাথে আমি ছিলাম, আমি মিউটিনি করেছি, এদের সাথে যােগ দিয়েছি এবং সেই সিটিনিতে জিয়াউর রহমান সাহেব মারা গিয়েছেন- এভাবে চার্জশিট করা হলাে। চার্জশিট দেখে আমি থ খেয়ে গেলাম। আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট হতে পারে হ্যা আমি পরবর্তীকালে অর্থাৎ আমি জেনারেল মঞ্জুরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছি। সেজন্য কোনাে বিচার হয় কিনা আমি জানি না। যদি করা হয় সেটি করতে পারে। ইতিপূর্বে কখনাে হয়নি, কিন্তু মিউটিনি বা এরসাথে উস্কানিতে আমি ছিলাম বা এর সাথে আমি জড়িত এমন তাে হওয়ার কথা নয়। যাহােক বিচার শুরু হলাে জেলখানার ভেতরে। আমাদের সেলের চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা দেওয়া হলাে এবং কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করে সেখানে হেভি মেশিনগান এবং এন্টি এয়ারক্রাফট গান হয়তাে তারা মনে করেছিল যদি কোনাে মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ হেলিকপ্টার বা প্লেন দিয়ে বা ফাইটার নিয়ে আমাদের বাঁচানাের জন্য উড়ে চলে আসে সেটিকে হিট করার জন্য এন্টি এয়ারক্রাফট গান পর্যন্ত ছিল জেলখানার ভেতরে। জেলখানার ভেতরে তাদের পছন্দমতাে আর্মিদের দিয়ে সিকিউরিটির ব্যবস্থা নিয়েছে। আর জেলখানার বাইরে বিডিআর রাখা হয়েছিল। এভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের যেদিন প্রথম কোর্টে নেয়া হয়, জেলখানার ভেতরে দেখলাম একটি ঘরকে কোর্ট বানিয়েছে সামনে একটি টেবিলে বিচারকের আসন করা হলাে, আর আমাদেরকে কোর্টে বসানাে হলাে। এই কোর্ট শুরুর আগে আমাদের কাছে নাম চাওয়া হলাে। আমাদের বিচার হবে, আমাদের ডিফেন্সের জন্য নাম দিতে বলল। আর্মি রুলস, রেগুলেশন এবং অ্যাসপার মিলিটারি ল এমবিএমএলএ বলে এটিকে। বলা আছে। আমরা ডিফেন্সের জন্য ফ্রেন্ড নির্বাচন অর্থাৎ তাদেরকে বলা হয় ফ্রেন্ড অব দ্য অ্যাকিউসড। আমরা সেই মােতাবেক আমরা নাম দিয়েছিলাম। আমার মনে আছে। আমি তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার আমিন আহম্মদ চৌধুরী (পরবর্তীকালে মেজর

জেনারেল হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন), আমার অর্ডন্যান্স অফিসার ছিলেন | ব্রিগেডিয়ার সিরাজ (ডাইরেক্টর অব অর্ডন্যান্স ছিলেন) এই দুইজনের নাম দিয়েছিলাম। আরেকটি নাম ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু এই দুটি নাম | আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি যে নাম দিয়েছিলাম তাদেরকে ডিফেন্সের জন্য। পাঠানাে হয়নি। হঠাৎ একদিন জানলাম ডিফেন্সের জন্য আমাদের ফ্রেন্ড অব দ্য অ্যাকুইসড এসেছে। কে কে এসেছে? ব্রিগেডিয়ার আনােয়ার হি ইজ নট ফ্রিডম ফাইটার আর ছিলেন কর্নেল আইন উদ্দিন ও লে. কর্নেল ইবরাহিম। উনারা আমাদের সাথে কথা বলেন। আমার কথা শুনে বললেন তোমার তাে কোনাে ইনভলবমেন্ট দেখছি না। তােমাকে নিয়ে আমাদের কোনাে মাথাব্যথা নেই। আমাদের মাথাব্যথা যাদেরকে টর্চার করেছে এবং যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাবে আমরা তাদেরকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। তােমাকে নিয়ে কোনাে চিন্তাভাবনা নেই। তােমাকে নিয়ে আমরা কী চিন্তা করব? বিচার কাজ শুরু হলাে। সে বিচারে উনারা আমাদের ডিফেন্স দেয়ার চেষ্টা করলেন। উনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমাদের ডিফেন্স দেয়ার জন্য এবং উনারা যেভাবে ডিফেন্স দিয়েছেন এটি যদি কোর্ট মার্শাল না হত এবং বিশেষ করে আমাদের যে কোর্ট মার্শালটি হয়েছে সেটি ছিল কোর্ট ইন ক্যামেরা অর্থাৎ গােপন বিচার ছিল এটি। এখানে বাইরের কোনাে অর্থাৎ সিভিল কোনাে ল ইয়ার থাকতে পারবে না। আর নর্মাল কোর্ট মার্শাল যদি হত সেখানে সিভিল ল ইয়ার থাকতে পারত, থাকতে পারে। আমরা দেখলাম সাক্ষী চলছে। আমার বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষী আসছে না। কোনাে সাক্ষী নেই, সাক্ষী নেই, সাক্ষী নেই। আমরা দেখলাম বিচারটি সাজানাে অর্থাৎ কোর্টের যে বিচারক তিনি বায়াসড়। কীভাবে বুঝলাম বায়াসড? জেনারেল আবদুর রহমান ছিলেন কোর্টের চেয়ারম্যান। আর্টিলারির অফিসার। এই জেনারেল রহমানের সাথেও আমি একসাথে চাকরি করেছি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। হি ওয়াজ দ্য ব্রিগেড কমান্ডার। উনি ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন না, পাকিস্তান ফেরত অফিসার ছিলেন। সবসময় উনার একটি অ্যাটিচিউড থাকত মুক্তিযােদ্ধাদের বিপক্ষে। এবং যে কোনাে অনুষ্ঠানে, আমাদের অনেক অনুষ্ঠান হত আর্মিতে, কালচারাল প্রোগ্রাম হত, গেট টুগেদার হত, গেট টুগেদারের খাওয়াদাওয়ার পরে বসে গল্প হত বা খাওয়ার আগে গল্প হত। তখন জেনারেল রহমানকে আমি দেখতাম প্রায়শই পি করত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। এবং শুধু তাই নয় উনার এই আচরণে কোনাে লুকোচুরি ছিল না। উনি সবসময় স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন আমি মুক্তিযােদ্ধা পছন্দ করি না। অর্থাৎ সেনাবাহিনীতে উনি একজন মুক্তিযােদ্ধা-বিদ্বেষী। অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে চেয়ারম্যান করে পাঠানাে হয়েছে এবং শুরুতে তার যে ভাবভঙ্গিমা- সবাইকে ফাসি দিয়ে দাও এরকম একটি ভাব তার ছিল। প্রথম আমাদের ডিফেন্স বলল জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান তিনি। চট্টগ্রামে যে সমস্ত সৈনিক, অফিসারেরা ছিলেন তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য

একটি সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। যেটি রেডিওতে ঘােষণা হয়েছে, টিভিতে ঘােষণা হয়েছে এবং বলেছিলেন ঐ সময়ের মধ্যে যারা লয়েল ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তাদের কোনাে বিচার করা হবে না। জেনারেল মঞ্জুর এবং এরশাদের মধ্যে যখন কোনাে আন্ডারস্টেন্ডিং হলাে না তখন এরশাদ ঘােষণা করলেন মঞ্জুর এটির সাথে দায়ী এবং তােমরা যারা মঞ্জুরের সাথে আছ তােমরা তাকে ছেড়ে চলে আস, তােমাদের কোনাে বিচার হবে না। সেসময়ে অনেকেই চলে গিয়েছিল। আমাদের ডিফেন্স রেকর্ড দেখে দেখে বের করে দেখাল একমাত্র জেনারেল মঞ্জুরের সাথে আমি এই দু’জন ছাড়া সবাই বেঁধে দেয়া সময়ের ভেতরে কোথাও -কোথাও আত্মসমর্পণ করেছে। ইয়াজদানী আত্মসমর্পণ করেছে মেজর মাওলার কাছে, ক্যাপ্টেন মুনীর আত্মসমর্পণ করেছে ফটিকছড়ি থানায়, মেজর গিয়াস আত্মসমর্পণ করেছে টি গার্ডেনের ম্যানেজারের মাধ্যমে ফটিকছড়ি থানায়। আর বাকিরা ব্রিগেডিয়ার মহসীন থেকে শুরু করে সবাই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল সে সময়ের আগেই আত্মসমর্পণ করেছিল। একমাত্র জেনারেল মঞ্জুর এবং তার সাথে আমি ছিলাম এই দু’জনে ঐ সময়ের পরে আত্মসমর্পণ করেছি পুলিশের কাছে পাহাড়ে। তাহলে সে মােতাবেক বিচার হতে পারে জেনারেল মঞ্জুর এবং আমার এই দু’জনের। আর কারাে বিচার হতে পারে । আর জেনারেল মঞ্জুরকে যেহেতু মেরে ফেলা হয়েছে আর আমার কোনাে দোষই নেই, আমার নামে কোনাে সাক্ষী নেই, আমার বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষী নেই। যদিও সাজানাে বিচার তাও তাে সাজানাে সাক্ষী থাকা দরকার, সেই সাজানাে সাক্ষীও নেই। সেকারণে আমাদের ডিফেন্সে যারা ছিলেন তারা বললেন এদের বিচার হতে পারে না যেহেতু তারা আত্মসমর্পণ করেছে। তখন ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদকে ডাকানাে হলাে ঢাকা থেকে। উনি তখন ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন্স ছিলেন। উনি বললেন নাে, এটি আমরা জাস্ট একটি সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। সাইকোলজিক্যালি এই মিউটিনিকে দুর্বল করার জন্য আমরা চিফকে দিয়ে এটি বলিয়েছিলাম । কিন্তু এর জন্য কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। পরবর্তকিালে দেখা গেছে ছাড় এদেরকে দেয়া হয়নি, ছাড় দু’জনকে দেয়া হয়েছে। একজন হলাে দোস্ত মােহাম্মদ আরেকজন হলেন মেজর কাইয়ুম। দোস্ত মােহাম্মদ সারেন্ডার করার পর রেডিও-টিভিতে ঘােষণা দেয়া হয়েছিলএরা সারেন্ডার করেছে, কাইয়ূম সারেন্ডার করেছে। মেজর কাইয়ূমকে ছাড়টি ঐভাবে দেয়া হয়নি- বিচারে তার সাজা হয়েছিল। দোস্ত মােহাম্মদকে ট্রায়াল করা হয়নি। কিন্তু কাইয়ুমের ট্রায়াল হয়েছিল এবং সাজাও হয়েছিল কিন্তু অজানা কোনাে কারণে মেজর কাইয়ূমকে হঠাৎ করে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং সে বিদেশে চলে যায়। ট্রায়ালে যাদেরকে সাক্ষী করা হয়েছিল আমাদের ডিফেন্স তাদের জেরা করে সাক্ষীর যে ভেলুয়েশন, সাক্ষীর যে সাক্ষ্য সেটি যে কোর্টের এখতিয়ার এর মধ্যে পড়ে না এবং এই সাক্ষ্যতে যে সাজা হতে পারে না সেটি

কোর্টেই প্রমাণ করে দেন। আমার এখনাে স্পষ্ট মনে আছে কর্নেল জিল্লুর রহমান উনি ইলেভেন বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। একটি দুর্নীতির জন্য তাকে জেনারেল মঞ্জুর (জেনারেল মঞ্জুর কোনাে অবস্থাতেই দুর্নীতিকে টলারেট করতে পারতেন না। হি ওয়াজ এ ভেরি ভেরি অনেস্ট অফিসার এবং খুবই ডেডিকেটেড অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বিরাট অবদান ছিল। তিনি বীর উত্তম উপাধি পেয়েছিলেন। উনি তখন মেজর ছিলেন। যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান আর্মি খুলনার শিরােমণি এলাকায় জমায়েত হয়েছিল। শিরােমণি এলাকায়। জেনারেল মঞ্জুর তার ট্রপস নিয়ে, মেজর জলিলও সাথে ছিলেন- এদেরকেসহ চতুর্দিকে ঘেরাও করে হামলা চালিয়ে ট্রপসগুলােকে সারেন্ডার করিয়েছিলেন। সেখানে রীতিমত ট্যাঙ্ক ছিল। জেনারেল মঞ্জুর দুই হাতে দুই এসএল আর নিয়ে ফায়ার করতে করতে ট্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন এবং শিরােমণি ট্যাঙ্ক ব্যাটল বলে। এই শিরােমণি ট্যাঙ্ক ব্যাটল আমেরিকাসহ অনেক দেশে আর্মি ওয়ারের ওপর যখন ক্লাস হয় জেনারেল মঞ্জুরের ঐ ট্যাঙ্ক ব্যাটেলটি পড়ানাে হয়।) কর্নেল জিল্লুরকে ক্লোজ করে দিয়েছিলেন। উনি ব্যাটেলিয়নের একাউন্ট শাে করে তার অ্যাগেইনিস্টে পারসােনাল টাকা নিয়েছিলেন। যে কারণে তাকে ক্লোজ করা হয়েছিল। কর্নেল জিল্লুর যখন সাক্ষী দেয়া শুরু করল তখন আমাদের ডিফেন্স কোটে তাকে রীতিমত একজন দুনীতিবাজ এবং একজন চোর হিসেবে। প্রমাণ করে ছেড়ে দিয়েছিল। এবং বলা হলাে তার সাক্ষী গ্রহণযােগ্য নয়। এভাবে এক এক করে যত বানােয়াট স্বাক্ষ্য এনেছে গ্রহণযােগ্য নয়, গ্রহণযােগ্য নয়তারা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। আমাদেরকে কাউন্টার করতে পেরেছিলেন। স্বীকারােক্তি যেটি অর্থাৎ কনফেশনাল স্টেটমেন্ট এখানে যাদেরকে টর্চার করে ফাসি দেয়া হলাে যেমন ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল মাহফুজ, মেজর মুজিব, কর্নেল দেলাওয়ার এদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দাঁড় করাতে পারেনি। যেকারণে তাদেরকে টর্চার করে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে ঐটি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করা হয়। আর আমি যে স্টেটমেন্ট দিলাম সেটি তারা কোর্টেই উপস্থাপন করেনি। তখন আমাদের যে ডিফেন্স ছিলেন কর্নেল আইনউদ্দিন, লে. কর্নেল ইবরাহিম আমি তাদেরকে বললাম আপনারা তাে আমার পক্ষে কিছু বলছেন না। তারা বলেছে তােমার বিপক্ষে বললে না আমরা পক্ষে বলব। যেহেতু তােমার বিপক্ষে কেউ কিছু বলছে না আমরা তােমার পক্ষে কী। বলব? আমাদের ডিফেন্স প্রসিকিউশনে ছিলেন জেনারেল চিশতি এবং তখনকার কর্নেল আমসা আমিন এরা প্রসিকিউশন-এ সরকার পক্ষে ছিলেন অর্থাৎ আমাদের। বিপক্ষে। প্রসিকিউশনে যারা ছিলেন তারা খুব একটি সিরিয়াস ছিলেন বলে। আমার মনে হয়নি। কারণ তারা কনফার্ম ছিল আমাদের যা হওয়ার হবেই। যে কারণে মামলা যেটি সাজানাে হয়েছিল সেখানে আমাদের ডিফেন্স দে ওয়ার সাকসেসফুল বাট রেজাল্ট ছিল অপজিট। একদিন হঠাৎ করে কোট বন্ধ হয়ে।

গেল। কেন কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল? ঐখন প্রসিকিউটর বলল আমাদের সবাইকে ফাসি দিতে হবে আর আমাদের ডিফেন্স বলল আমাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে, আমরা নির্দোষ। আর আমার নাম ধরে লাস্ট ফিনিশিংয়ে তারা বলেছিল তার (আমার) বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষী নেই, কিছু নেই, কোনাে উইটনেস নিই তাহলে কীভাবে তাকে সাজা দিবেন? আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। তখন আমাদের ডিফেন্সে যারা ছিলেন তারা ঐ প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন এরশাদের বক্তব্যটি। তারা ক্যাসেট নিয়ে আসলেন। জেনারেল রহমান বলল এটি চলবে না। জেনারেল রহমানকে যখন বলা হলাে এখানে আমাদের লােকজনকে টর্চার করা হয়েছে। তাদেরকে যখন বলল জামা খুলে দেখেন। বলল না, না কি জামা খুলে দেখব। কোর্টের চেয়ারম্যান যিনি তিনি বলছেন এটি তারা নিজেরা নিজেরা মারামারি করতে পারে। তাদেরকে যে ডিজিএফআই নিয়ে টর্চার করেছে এটি দেখেছে এমন কোনাে সাক্ষী আছে কি না। এটির তাে একমাত্র সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার আশরাফ- যিনি টর্চার করেছেন। অর্থাৎ যাদেরকে টর্চার করা হয়েছে তাদের সাক্ষী তারাই যারা টর্চার করেছে। তারা কি এসে সাক্ষী দেবে না কি? তারা তাে। জেলখানা থেকে নিয়ে গেছে উইদাউট ডকুমেন্টস, তারা লিখে নেয়নি। ডিজিএফআই সেলে ঢুকিয়েছে, চোখ বেঁধে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে গেছে। সেখানে টর্চার করে স্টেটমেন্টে সাইন করিয়েছে ব্যস এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে যখন আমাদের ডিফেন্স ফাইট দিচ্ছিল তখন জেনারেল চিশতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নাচাচ্ছিল আর বলছিল কোনাে লাভ নেই, কোনাে লাভ নেই যতই ফটফট করে কোনাে লাভ নেই যা হওয়ার তা হবেই। উচ্চস্বরে এভাবে তিনি বলছিলেন যখন মাননীয় তথাকথিত কোর্টের চেয়ারম্যান জেনারেল রহমান এবং তার সদস্যরা তাদের উপস্থিতিতে আমাদের উপস্থিতিতে এভাবে বলেছেন কিন্তু এর কোনাে প্রতিকার হয়নি। আর কোর্টের ভেতরে যারা টর্চার করেছে। রীতিমত দাঁড়িয়ে থাকত। যাদেরকে সাক্ষী দেয়ার জন্য আনতেন তাদের যদি কথার এদিক সেদিক হত সাথে সাথে আবার নিয়ে টর্চার করা হত। টর্চার করে। ধীরে ধীরে তাদেরকে দিয়ে সাক্ষী দেওয়ানাে হত। তারপরেও আমাদের ডিফেন্স তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। হাউএভার যখন বলা হলাে সেই রেডিও বার্তাটির কথা, ঘােষণার কথা যখন বলা হলাে তখন তারা বলল না আমরা এই ঘােষণাটি একসেপ্ট করব না। তােমরা যদি ঘােষণা আনতে চাও তাহলে ঢাকা। বেতার থেকে, রেডিও স্টেশন থেকে, টিভি-রেডিও স্টেশন থেকে যেখান থেকে ঘােষণা হয়েছিল তাদের কাছ থেকে অফিশিয়ালি এনে হাজির করাতে হবে। তখন আমাদের ডিফেন্স টাইম চায় ঐটি হাজির করানাের জন্য এবং অ্যাপ্লিকেশন জমা দেয়। কিন্তু এরপরে আর কোর্ট চলেনি। কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। আর কোর্ট চলেনি। উই আর ওয়েটিং সেটি আসবে, আবার আমরা কোর্টে যাব। সেই কোট আর চলেনি।

হঠাৎ করে একদিন দেখি আমাদের পাঁচজন পাঁচজন গ্রুপ করে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। একদিন আমাদেরকেও- ব্রিগেডিয়ার মহসীন, আমি, আমার সাথে মেজর মমিন, মেজর মুজিব এবং ক্যাপ্টেন ইলিয়াস এই পাঁচজনকে নিয়ে যাওয়া হলাে। আমাদের চোখ বাঁধা হলাে, হ্যান্ডকাপ বেঁধে হাত পেছনে, পায়ে। লােহার ডাণ্ডাবেড়ি। একই অবস্থায় আমাদেরকে কোর্টে হাজির করা হত। তখনও আমাদের হাতে হ্যান্ডকাপ এবং পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি। হাতটি এভাবে পিছে রাখত (পিছনে নিয়ে দেখিয়ে)। কয়ঘণ্টা এভাবে পেছনে হাত রাখা যায়? অনেক কষ্ট হত। আমরা কোর্টকে বারবার অনুরােধ করেছিলাম হাতটি অন্তত আমরা সামনে। আনি। তারা এটির অনুমতি দিত না। না দেওয়ায় পরে আমরা নিজেরাই কষ্ট। করে পায়ের নিচ দিয়ে নিয়ে এসে সামনে রাখতাম। এতে কোর্ট অনেক সময় অ্যানয়েড হত কিন্তু আমরা মানিনি। গাড়িতে করে নিয়ে গেল চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে আমাদেরকে হেলিকপ্টারে উঠানাে হলাে। হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। উড়ার পর আমার মনে আছে ঐ সময়ে হিন্দিতে একটি গান ছিল নূরি কি আজারে, নূরি ভূরি নূরি ওই ক্যাসেটটি বাজাতে বাজাতে ওরা যাচ্ছে। আমি চোখ বাঁধা, হাত বাঁধাবস্থায় গান শুনছি। হেলিকপ্টার উড়ছে। বার বার জিগ্যেস করছিলাম কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কেউ কোনাে কথা বলছে না। চিটাগাং থেকে হেলিকপ্টার ওড়ার পর একজায়গায় থামল। থামার পর জিগ্যেস করছি জায়গাটি কোথায়? তারা বলল সরি স্যার আমাদের কথা বলা নিষেধ। তখন আমি নিজেই টান দিয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আমরা ঢাকা এয়ারপাের্টে। তাড়াতাড়ি ওরা হা স্যার করেন কী, তাড়াতাড়ি আমার চোখ বেঁধে দিল । পরবর্তীকালে আবার হেলিকপ্টার উড়ল আকাশে। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলাে রাজশাহী। রাজশাহীর পুলিশ লাইনে আমাদেরকে নামিয়ে সেখান থেকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে ঢােকানাে হলাে। রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে তারপরে চোখ খােলা হলাে। অর্থাৎ বিচারের সমাপ্তি হলাে না, বিচারের রায় দেয়া হলাে না, আমাদেরকে সরানো হলাে। পাঁচজনের টিম আমাদেরকে ফাসির সেল, আবার এখানেও ফাসির সেলে। কনডেম সেলে। একেকটি সেলে একজন একজন করে ঢোকানাে হলাে। আমার। পাশের সেলে মেজর মুজিব ছিলেন। মেজর মুজিবের পরে ছিল ক্যাপ্টেন ইলিয়াস। তার পাশে ব্রিগেডিয়ার মহসীন। তারপাশে মেজর মমিন। এভাবে পাঁচজন ছিলাম। আমাদের হ্যান্ডকাপ খুলে দিল আর লােহার ডাণ্ডাবেড়িটি ছিল । কিছুদিন পর হঠাৎ একজন আর্মি অফিসার আসলেন। মেজর র্যাঙ্কের, নাম জানি।

। আমরা যে ফাসির সেলে ছিলাম, একটি কম্বলে শুতাম আরেকটি কম্বল মাথার নিচে দিতাম। তিনি এসে আমাকে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজ হাতে নিয়ে আমি দেখি এটি একটি রায়। সেখানে লেখা হয়েছে আমার ১৪ বছর জেল। আবার তার নিচে দেখলাম সেনাপ্রধান ঐ ১৪ বছর থেকে ৪ বছর কমিয়ে ১০

বছর কনফার্ম করেছে। ১০ বছর তাে আমার জেল হতে পারে না। আমি ভাবলাম জেল যদি দেয় হয়তাে ১০ মাস হতে পারে। আর আমার স্পষ্ট মনে আছে চিটাগাংয়ে কোর্টে জেনারেল আইনউদ্দিনকে বারাবার আমি পীড়াপীড়ি করছিলাম। আপনারা আমার জন্য কিছু বলছেন না কেন । তখন উনি বললেন তােমার বিরুদ্ধে। তাে কোনাে সাক্ষী নেই। তােমার কিছু হবে না। তারপরেও যদি উপরন্তু তােমাকে কিছু দেয় ১০ বছর ৮ বছর জেল দেবে না, হয়তাে চাকরি থেকে ডিসমিস করে দিতে পারে। হয়তাে জেল দিলে বছরখানেক দিতে পারে। দিলে একটি অ্যাপলিকেশন করলে ঐটি মওকুফ হয়ে যাবে। জাস্ট নামমাত্র তােমার একটি কিছু হতে পারে। তােমার এর চেয়ে বেশি কিছু হবে না। হওয়ার কোনাে রাস্তা নেই। এগুলাে বললেন। আমি ১০ বছর দেখে বললাম আরে এটা তাে কোনাে ভুল হয়েছে। ভাবলাম হয়তাে টেন মান্থস হবে। আমি ভাবলাম হয়তাে ১০ মাস। হবে ভুলে ইয়ার লিখে ফেলেছে। মেজর সাহেব দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন আমি আবার পড়ে গ্রিলের কাছ থেকে ডাক দিলাম এই যে মেজর সাহেব এদিকে আসেন, এদিকে আসেন। আসার পরে বললাম আরে ভাই এই কাগজে তাে ভুল হয়েছে। এটি মনে হয় ১০ মাস হবে, ভুলে বােধহয় ইয়ার লিখে ফেলেছে। তখন মেজর সাহেব বলছেন না না না এটি ঠিকই আছে, এটি ঠিক আছে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমার যদি ১০ বছর সাজা হয়ে থাকে তাহলে যাদেরকে টর্চার করে। মনগড়া স্টেটমেন্টে স্বাক্ষর করানাে হয়েছে তাদেও যেন কী অবস্থা! আমার পাশে মেজর মুজিব ছিলেন। জিগ্যেস করলাম মুজিব কী খবর? তখন মুজিব রিপ্লাই দিল ফাসি। আবার আরেকটু জোরে জিগ্যেস করলাম ইলিয়াস তােমার কী খবর? ইলিয়াস বলল স্যার আমাকে তাে ফাসি দিয়েছে, একথা বলে আবার সাথে সাথে বলল না স্যার স্যার আমাকে প্রথমে ফাসি দিয়েছিল কোর্ট, সেনাপ্রধান আমাকে ১৪ বছর কনফার্ম করেছে। তারপর ব্রিগেডিয়ার মহসীন, স্যার ব্রিগেডিয়ার মহসীন আপনার কী অবস্থা? ব্রিগেডিয়ার মহসীন বলল রেজা ফাসি। মেজর মমিন আপনার কী অবস্থ? ফাসি। দেখলাম আমাদের পাঁচজনের ভেতরে মেজর মুজিব, ব্রিগেডিয়ার মহসীন, মেজর মমিন এই তিনজনকে ফাঁসির অর্ডার দিয়েছে। আর ইলিয়াসকে প্রথমে ফাসি পরে ১৪ বছর কনফার্ম করেছে, আর আমার ১৪ বছর থেকে ১০ বছর কনফার্ম করেছে। তখন আমি বললাম ওদের, যদি ফাসি হয় তাহলে আমার ১০ বছর ঠিকই আছে। এ অবস্থায় আমরা থাকলাম। রায় দেয়ার পর যেহেতু আমি ও ইলিয়াসের ফাসির অর্ডার নেই আমাদের পায়ের লােহার ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দিল । আর যাদের ফাসির অর্ডার আছে তাদের ডাণ্ডাবেড়ি খােলেনি। আমরা থাকলাম। শুনলাম আমাদের ফ্যামিলির আত্মীয়স্বজনেরা এই রায়ের বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়েছে। শুধু তারা না আমার মনে হয় এইভাবে সাজানাে বিচারে একে একে মুক্তিযােদ্ধাদের ফাসি দেয়ার বিরুদ্ধে সারাদেশব্যাপী একটি প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই প্রতিরােধ আন্দোলন হয়েছে কিন্তু

মানবতার এই ডাকে কোন বিচারপতি সেদিন এগিয়ে আসেনি। ক্যাপ্টেন ইলিয়াস এবং আমি যেহেতু ফাসির আসামি ছিলাম না। আমাদেরকে বারবার বলছিল আপনারা তাে ফাসির আসামি না, আপনাদের দু’জনকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাই। অফিসারদের অর্থাৎ প্রিজনার ওয়ার্ড, যারা ক্লাসিফাইড প্রিজনার সেই ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। আমরা যেহেতু ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার ছিলাম। আমাদেরকে প্রথম শ্রেণীর বন্দি হিসেবে টিট করছিল। যে কারণে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা বললাম না আমাদের বন্ধুরা যাদের ফাসির অর্ডার হয়েছে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে এটি না দেখা পর্যন্ত আমরা যাব না, আমরা। এখানেই থাকব। আমরা যাইনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এসে আমাদের দু’জনকে নিয়ে গেল। বলল না, আপনাদের দু’জনকে এখানে রাখা যাবে না। আপনাদের। যেতে হবে। আমাদের মনে সন্দেহ হলাে যে সেদিনই তাদের ফাসি কার্যকর হবে? মনে সন্দেহ জেগেছিল। যাহােক আমরা যাওয়ার পথে উনাদেরকে জড়াজড়ি করে। কান্নাকাটি করে বিদায় নিয়ে গেলাম। যাওয়ার পর রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে আমি আর ইলিয়াস এই দু’জন থাকলাম। প্রতিদিন সুইপার যখন সকালে আসত, সুইপারের কাছ থেকে আমরা খবর নিতাম তাদের খবর কী। সুইপার এসে বলত ঠিক আছে, ঠিক আছে নাে প্রব্লেম। ২৩ সেপ্টেম্বর ভােরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে অপেক্ষা করছি সুইপার আসার জন্য। সুইপার আসছে না, আসে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে জেল সুবেদার আসল, সুবেদার মােজাম্মেল তার নাম। জিগ্যেস করলাম কী খবর, আজকে তাে সুইপার আসল না । বলল আসবে, হয়তাে পরে আসবে। আমি উনাদের খবর জিগ্যেস করলাম । না সমস্যা নেই, ঠিক আছে। বলে উনি তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন। কোনাে কথা বলেননি আমার সাথে। আমি দেখলাম হঠাৎ করে হেলিকপ্টার উড়ল, কোথাও হেলিকপ্টার নামল আবার কিছুক্ষণ পরে হেলিকপ্টার উড়ে গেল। আবার চিন্তা করছি, কাকে জিগ্যেস করব। হেলিকপ্টার আসছে কেন, কী ব্যাপার? জেলে যে আর্মিরা ছিল আমাদের ঐখানে ডিউটির জায়গায় সে হাবিলদার আসল। হাবিলদারকে জিগ্যেস করলাম কী খবর হাবিলদার সাহেব। উনাদের খবর কী? হাবিলদার তখন বললেন চলেন রুমের ভেতরে চলেন। তখন বারান্দা থেকে আমরা রুমের ভেতরে ঢুকলাম। বলল বসেন। বসলাম । হাবিলদার সাহেব করল কী? আমাদের হাত ধরল, হাত ধরে। বলল স্যার উনাদের মাফ করে দেন, বলেই কেঁদে দিল। উনাদের মাফ করে দেন। বলে কেদে দিল। সাথে সাথে আমরা বুঝে ফেললাম সে কেন কাদছে। আমরাও তখন ঝরঝর করে কাঁদছি। তখন বলল হা উনাদের ফাসি হয়ে গেছে এবং হেলিকপ্টারে মেজর মুজিবের লাশ নিয়ে গিয়েছে। আরাে কিছুক্ষণ পরে জেল সুবেদার আসলেন। ব্রিগেডিয়ার মহসীনের কাছে আমার একটি বই ছিল। একটি ধর্মীয় বই, আরাে কিছু জিনিস ছিল সেগুলাে ফেরত পাঠিয়েছিলেন বলেছিলেন মেজর সাহেবকে ফেরত দিবেন। বইটি আমি এখনাে রেখে দিয়েছি, কারণটি

হলাে বইটির ভেতরে ব্রিগেডিয়ার মহসীন ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। এই বইয়ের ভেতরে উনি আমাকে লিখে গেলেন, বিদায় নিলেন আমার কাছ থেকে ঐ বইয়ের মাধ্যমেই। যেখানে লেখা আছে- “রেজা, খােদা হাফেজ। ডাক এসেছে, চলে যাচ্ছি। আল্লাহ সময়মত আমাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন সময় রাত ১.৩৫ মি, ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১, মহসীন।” ব্রিগেডিয়ার মহসীন বিদায় নিলেন, ফাসি হয়ে গেল। আমি জেলে থাকলাম। তারপর সেখান থেকে জেল বদল করে কুমিল্লা, ঢাকা এভাবে প্রায় সাত বছর জেলে থাকলাম । আমার জেলে আরাে থাকতে হত কিন্তু একটি রিট করার সুযােগ হয়েছিল। বন্দিদের জেল মুক্তির জন্য মাঝে মাঝে বিজয় দিবসে ঘােষণা আসে এরকম একটি ঘােষণা এসেছিল। এই ঘােষণার প্রেক্ষিতে আমি রিট করে বেরিয়ে এসেছি। সাত বছর জেল খাটার পর আমি বের হলাম । বের হওয়ার পর অনেক জায়গায় আবেদন-নিবেদন করেছি। কিছু হয়নি। সর্বশেষ আমরা যখন দেখলাম আমাদের কোথাও স্থান নেই। আমরা কোর্টে যেতে পারবাে কোথাও যেতে পারবাে না। আমরা তখন সংসদীয় কমিটিতে অর্থাৎ জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায়। আমরা যখন জেল থেকে বেরিয়েছি তখন জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় । জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যখন গণতন্ত্র আসল, পার্লামেন্ট ফর্মের গর্ভমেন্ট আসল আমরা আবেদন করলাম। আবেদন করার পরে পার্লমেন্ট গভর্নমেন্ট সংসদীয় কমিটি থেকে আমার আমি আবেদনে একটিই বলেছিলাম আমার বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষী নেই, সাবুদ নেই, আমি জেলে ছিলাম । কেন আমার জেল হলাে? তখন সে জায়গায় আমাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য এবং পূর্ণ পেনশন ভাতা পরিশােধ করার জন্য সুপারিশ করল- যেটি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সবচেয়ে মজার বিষয় জিয়া হত্যার বিচার যেটি সিভিল কোর্টে হওয়ার কথা জিয়া হত্যার বিচার, সেই বিচারটি স্থগিত করা হয়েছিল। সেই জিয়া হত্যার বিচার স্থগিত করে তারা তথাকথিত সেনাবিদ্রোহের প্রহসনমূলক বিচারে ফাসি দিয়ে এটিকে কী করল? যাতে জিয়া হত্যার আসল খুনি বের না হতে পারে সম্ভাব্য সাক্ষীদের ফাঁসি দিয়ে দিল। কারণ জিয়া হত্যার বিচারের পরে যখন ফাইনাল তদন্ত হলাে, ফাইনাল তদন্ত হওয়ার পর এই বিগত ২০০১ সালের নির্বাচনের পর চট্টগ্রামের আদালতে জিয়া হত্যা মামলার ফাইনাল তদন্ত রিপাের্টে আমার বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষী না পাওয়ায় আমিসহ পাঁচজনকে জিয়া হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ‘৮১-তে আমাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হলাে আর সিভিল কোর্টে জিয়া হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হলাে। এরপর থেকে আমরা শুধু আবেদন-নিবেদন করেই যাচ্ছি ন্যায়বিচারের জন্য। সেই ন্যায়বিচার পাওয়ার ভাগ্য আর আমাদের জোটেনি। আর জিয়া হত্যার রহস্যও আর উদঘাটিত হয়নি। আমার দুঃখ এটিই আমি সাতটি বছর। জেলে থাকলাম। এই সাত বছর যে জেলে থাকলাম কী অপরাধে আমি জেলে থাকলাম? কেন থাকলাম? আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এটি নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।

লে, কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান (অবঃ) বীর বিক্রম

১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীতে অভুথান প্রচেষ্টার অভিযােগে কোর্ট মার্শালে বরখাস্ত ও কারাভােগী সশস্ত্র বাহিনীতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সময়ে কু প্রচেষ্টার অভিযােগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন অফিসার ও অসংখ্য সৈনিক। ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত ও সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকদের বিপথগামী করার অভিযােগে ২০ মে ১৯৮১ সালে লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রমকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। আমরা এখন লে. কর্নেল নূরুন্নবীর কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করবাে সে সকল দিনগুলােকে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়। রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়েও সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ্য করেছি। ১৯৭৩-এর আগস্ট থেকে ১৯৭৬-এর আগস্টের ফাস্ট উইক পর্যন্ত আমি ছিলাম ইংল্যান্ডে, স্টাফ কলেজ কোর্সে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে যায় বঙ্গবন্ধুর কিলিং-এর ঘটনা। এরপরে আরেকটি ঘটনা ঘটে সেটিও কর্নেল তাহেরকে নিয়ে। তাহের এবং আমরা একসাথেই যুদ্ধ করেছিলাম ১১নং সেক্টরে। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কয়েকদিন পরে আমি দেশে ফিরে আসি। আমার সেনাবাহিনীর পরিচিতদের মধ্যে প্রথম কর্নেল তাহেররই ফাসি হয়। এরপরে আরাে অনেকগুলাে অভ্যুত্থান ঘটে । আমি একটি অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিলাম, জড়ানাে হয়েছে। সামরিক বাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর কিলিং-এর পর কেউ বলে ১৭টি কেউ বলে ২২টি এ ধরনের অভুথান প্রচেষ্টা হয়েছে। আসলে সেনাবাহিনীতে এই অভ্যুত্থানগুলাের অধিকাংশই সাজানাে। সেনাবাহিনীর বিধান অনুযায়ী, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কোনাে বন্দি সেনাসদস্যকে আবার ফিরে অ্যাকটিভ সার্ভিসে। নেয়া হয় না। আমাদের দেশে সেটি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব অফিসার এসেছে এখানে রিপ্যাট্রিয়ট হয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে নেয়া। হয়েছে। এটি জেনেভা কনভেনশনের সম্পূর্ণ বিরােধী। এদেরকে নেয়ার ফলে সেনাবাহিনীতে দুটি বিপরীতমুখী গ্রুপ হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধা ভার্সেস রিপ্যাট্রিয়ট। রিপ্যাট্রিয়টদের সংখ্যা ছিল বেশি। মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। বিভিন্ন ভাইটাল পােস্টগুলােতে ওরাই পােস্টিং হয়। ওদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় মুক্তিযােদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়া হয়েছিল। একই কোর্সে পাস করা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ করার কারণে সে সিনিয়র হয়ে যাচ্ছে তাকে স্যালুট করতে হচ্ছে। তারা সেটি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। একেবারে প্রকাশ্যে দুটি গ্রুপ হয়ে গেল এবং এই গ্রপিংটি বড় রকমের আকার ধারণ করে এবং তারা

মুক্তিযােদ্ধাদের ইলিমিনেটেড করার একটি প্রিন্ট তৈরি করে ফেলে। এটির পেছনে সম্ভবত আইএসআই কাজ করে, পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। এই টোটাল এলিমিনেশন প্রসেসের অংশ হিসেবে অনেকগুলাে অভ্যুত্থান সাজানাে হয়। হয়তাে ড্রইংরুমে বসে আমরা আলাপ করছি সেটিকেও একটি অভ্যুত্থানে রূপ দেয়া হয়। আর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু কিলিং এরপর উনার কতগুলাে পলিসির কারণেও মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে, উনার উপরে। কারণ উনি শাহ আজিজের মতাে একজন রিনাউন রাজাকারকে যে জাতিসংঘে পর্যন্ত গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছে, তাকে উনি বানান প্রাইম মিনিস্টার। আমার জানামতে মেহেদীপুর আর ছােবরা ক্যম্প থেকে পাঠানাে ৪২ জন মুক্তিযােদ্ধা জয়পুরহাটে, ওদেরকে পাঠিয়েছিলাম একটি পাটের গােডাউন ছিল, এদের মধ্যে দুটি ছেলে আমাশয় রােগি ছিল, আমাশয় এর জন্য ভােরবেলা জঙ্গলে পায়খানা করতে গেছে, এই দুটি ছেলে বেঁচে ছিল আর বাকি ৪০ জনই ধরা পড়ে এবং তাদেরকে খেজুর গাছের সাথে লটকিয়ে প্রকাশ্যে বেয়নেট চার্জ করে মেরেছে এবং এর নেতৃত্ব দিয়েছে আবদুল আলীম করে একটি লােক, সেই আবদুল আলীমকে জিয়াউর রহমান বানায় মন্ত্রী। এইভাবে আমার রৌমারী একটি মুক্ত এলাকা ছিল। এই মুক্ত এলাকায় আমার বিরুদ্ধে যে অপারেশন পরিচালনা করেছে পাকিস্তানিদের পক্ষে তার নাম ছিল মুকুল কমান্ডার । মুকুল কমান্ডার মানে রাজাকার কমান্ডার যাকে মুকুল কমান্ডার না বললে ‘৭১-এ কেউ বুঝত না। একদিন জিয়াউর রহমান আমার রৌমারীতে, নূরুন্নবী তুমি এই চরাঞ্চলে এত টিন পেলে কোথেকে? আমি বললাম, স্যার মুকুল কমান্ডারদের ওই চরের দুটি চৌচালা ঘর ভেঙে এই টিনগুলাে এনেছি, বাঙ্কারে বাঙ্কারে পানিতে লােকজনের পায়ের আঙ্গুলের মাঝখানে ঘা হয়ে যাচ্ছে। আমি সব টিন খুলে নিয়ে এসেছি। এই মুকুল কমান্ডারের নাম একেএম মাইদুল ইসলাম মুকুল। আবুল কাশেম নামে একজন পাকিস্তান পার্লামেন্টারি মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিল তার ছেলে। তাকেও বানিয়েছে মন্ত্রী। মশিউর রহমান যাদু মিয়া সে ইন্ডিয়ায় গিয়ে ফেরত এসেছে, ভাসানীর সাথে থাকেনি। ফেরত এসে পাকিস্তানিদের। পক্ষে দালালি করেছে, তাকে বানিয়েছে সিনিয়র মন্ত্রী। এসব কারণে জিয়াউর রহমানের ওপরেও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে একটি বিতৃষ্ণা এসে যায় যদিও মুক্তিযােদ্ধা, একসাথে যুদ্ধ করেছে, সহ মুক্তিযােদ্ধা। তাদের মধ্যে একটি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এগুলােতে আস্তে আস্তে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে একটি এ্যাকশন রিঅ্যাকশন হতে থাকে। আর বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধাকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমান রিপ্যাট্রিয়ট অফিসারদেরকে যেমন এরশাদের মতাে একটি কুলাঙ্গার, তিনবার মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে ইভেন ২৫ মার্চ যখন আর্মি ক্র্যাকডাউন হয় সে তখন রংপুরে তার বাড়িতে ছিল। ৪ এপ্রিল তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চে ইচ্ছে করলে সে মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করতে পারত। করেনি। উল্টো গিয়ে রংপুর। ক্যান্টনমেন্ট, রংপুর টাউন ক্যান্টনমেন্টের পাশেই, তার বাসা ক্যান্টনমেন্ট থেকে

আধা কিলােমিটার। উল্টো গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে রিপাের্ট করে। আর্মি হেলিকপ্টারে সে ঢাকায় আসে। এসে পাকিস্তানে চলে যায়। এরপরে আরাে তিনবার সে এসেছে। পাকিস্তানের হয়ে এখানে ইন্টেলিজেন্স এর রিপাের্ট নেয়ার জন্য। তাকে বানিয়েছে সেনাবাহিনীর প্রধান। এছাড়া আরাে ভালাে ভালাে পােস্টে এইভাবে, মহব্বতজান চৌধুরী তাকে বানায় ডিজিএফআই, সে জিয়াউর রহমানের ক্লাসমেট। অথচ মুক্তিযােদ্ধা রয়ে গিয়েছিল। এসব ভাইটাল পােস্টগুলাে উনি এদেরকে দেন। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এটিকে কেউ ভালােভাবে। দেখেনি। যার জন্য এরা তখন মুক্তিযােদ্ধা ইলিমেনেশন-এর বিভিন্ন নাটক সাজাতে। থাকে। বিভিন্ন কু করে করে এগুলাে সাজিয়ে থাকে। এই ধরনের একটি কু’তে আমাকেও ইনভলব করে মানে আমাকে প্রধান হিসেবে আখ্যায়িত করে। দিদার। নামে একজন অফিসার ছিল, এরকম আরাে কিছু ছিল। প্রথম ৪টি ধারা আমার বিরুদ্ধে, তিনটিতেই মিনিমাম পানিশমেন্ট ছিল ডেথ। আইদার বাই ফায়ারিং স্কোয়াড অর বাই হ্যাংগিং। একটি ছিল সেকশন ফিফটি ফাইভ। ঐ সেকশনে আসলে কোনাে শাস্তি হয় না। ওয়ার্নিং হতে পারে। কিন্তু একবার ধরে ফেলেছে, একবার হ্যান্ডকাপ পড়ে গেছে, একবার ডিজিএফআই সেলে ঢুকিয়েছে কাজেই শাস্তি না দিয়ে তাে আর উপায় নাই। ভাগ্য আমার ভালাে, আমার কোর্ট মার্শালটি একমাত্র কোর্ট মার্শাল, ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল যেখানে বাইরের ল ইয়ার রাখতে দেয়া হয়েছে। ইট ওয়াজ এ ট্রায়াল কেস, টেস্ট কেস, বাহিরের ল ইয়ার রাখতে দিলে ডিফেন্ডিং ল ইয়ার হিসেবে অ্যাকিউসড়দের তাহলে কী হয়, এটি একটি স্টাডির মতাে ছিল। আমার অ্যাডভােকেট, বিনে পয়সার অ্যাডভােকেট ছিলেন অ্যাডভােকেট আমিনুল হক (পরে যিনি এটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন), আরেকজন ছিলেন গাজীউল হক ভাষাসৈনিক, আরেকজন ছিলেন সিরাজুল হক। বিশেষ করে সিরাজুল হক ছিলেন দিদারের ডিফেন্ডিং, আমার ছিল আমিনুল হক মেইনলি, আর গাজীউল হক। ইট ওয়াজ এ টেস্ট কেস। কোর্ট মার্শালের কাগজপত্র ওরা আগেই সাজিয়ে ফেলেছিল। ডেট দিয়ে কোথায় কোথায় মিটিং হয়েছে, কী কী হয়েছে, চার্জশিট ওরা আগেই বানিয়ে ফেলেছিল। আমার ডিফেন্ডিং অফিসারও আর্মির লােক দিয়ে দিয়েছে। মাহবুব এলাহী চৌধুরী সরকার পক্ষের একজন কৌসুলি হিসেবে কাজ করছিল। আমার নাম কোথাও ছিল না। দিদার ছিল ভেগে ইন্ডিয়ায় গিয়েছে, আসার পরে দিদারকে ইন্টারগেট করল। বলল তােমার কু প্রধান কে ছিল? বলল নূরুন্নবী। তােমরা সাকসেসফুল হলে নূরুন্নবী কী হত, তুমি কী হতে? নূরুন্নবী হত রাষ্ট্রপতি আমি হতাম সেনাবাহিনীর প্রধান। ওরা তাও বিশ্বাস করেনি। এরপরে জেনারেল মঞ্জুরকে এরসাথে ইনভলব করা হয়েছে। জেনারেল মঞ্জুরের ডিরেকশনে এগুলাে করা হয়েছে। আর সব ফাস্ট এসএস, সেকেন্ড এসএস-এর অফিসারদেরকে ইনভলব করা হয়েছে (ফাস্ট এসএস, সেকেন্ড এসএস- ১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কর্তৃক যুদ্ধের মধ্যে গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২টি ব্যাচ)। এটি তখনাে আমি কোর্টে বলেছি এবং আমার অ্যাডভােকেট আমিনুল হক সেই ট্রায়ালের কাগজপত্র আমার কাছে এখনাে আছেIt is nothing. It is an attempt to eleminate the freedom fighter officers. ওই অ্যালিমিনেশন-এর অংশ হিসেবে আমারটিও, এরপরে অনেক এরকম কু হয়েছে। এসব কু্যতে অনেক আর্মি অফিসার যেমন ‘৭৭-এ বগুড়ায় একটি কু ঘটানাের পরপরই এখানে একটি জাপানি প্লেন হাইজ্যাক করে একটি অভ্যুত্থান সাজানাে হয়েছিল । এটিও সাজানাে সিপাহি বিপ্লব। সেখানে আমার নিজ কানে শােনা বড় বড় জেনারেলরা নিজেরা সিপাহি, নায়েক, হাবিলদার হয়েছে, র্যাঙ্ক লাগিয়েছে। লাগিয়ে এটি একটি সাজানাে কু, আর্মির ভেতরে কোনাে জার্ম আছে কি, বিপ্লবী কোনাে জার্ম আছে কিনা ওটিকে বের করে আনা এবং ওগুলােকে শেষ করা । ঐ কু’তে গণআদালত করে বহু জেসিও, এনসিও সাধারণ সৈনিক এদেরকে ফাসি দেয়া হয়েছিল। এমনও ঘটনা আছে (আমি যখন জেলে ১ বছর ছিলাম) সে ফাসিতে যাবে না। কারণ সে কিছুই জানে না, এমন লােক আছে কিন্তু জাল মেরে, মাছ ধরার জাল মেরে তাকে জালে ফেলে আটকিয়ে তারপর ফাসিতে চড়াল। তারপরেও তারা চিকার দিয়েছে, আল্লাহ তুমি কি নাই, আমি তাে নির্দোষ, আমি তাে কিছুই জানি না। আমার কেন ফাসি হবে। তুমি কোথায়? এ ধরনের চিঙ্কার পর্যন্ত তারা দিয়েছে। এমনও ঘটনা আছে ফাসির যে রশি চড়াবে, কল্লা এমন এত নড়াচড়া করেছে বডি সে ফাসি নেবে না সে চিঙ্কার দিতেছে, তারপরে কল্লা রয়ে গেছে বড়ি ছুটে পড়ে গেছে। এরকম অনেকগুলাে ঘটনা আছে। এই ধরনের নৃশংসভাবে গণআদালত, গণফাসির আদালত আর কি! ফাঁসির আগেই এগুলাে। লেখা থাকত। এক-দুই মিনিট, তােমার নাম কী? বাবার নাম কী? কোন র্যাঙ্ক? কোন ইউনিট? এই সব জিগ্যেস করে রায় তােমার ফাসি- এভাবে করা হয়েছে এগুলাে। ফাসিগুলাে সব এরকমই। আদালতের রায় এরকমই করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অমানবিক, মানবিকতাবিরােধী এবং এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই ধরণের কোর্ট মার্শাল যেগুলাে হয় আর্মিতে এগুলােতে আসলে কারাে কোনাে ডিফেন্স নেয়ার সুযােগই থাকে না। তারাই আমার ল ইয়ার কে হবে, তারাই ঠিক করে দেয়। সে তাে তার চাকরির জন্য ওরা যা বলে দেবে তাই করবে। সে তাে চাকরি করে। এইভাবে ট্রায়ালগুলাে হয় এবং সবচেয়ে দুঃখজনক এই ট্রায়াল এই সব কেস আমাদের সিভিল কোর্টগুলাে নেয় না। সুপ্রিম কোর্টও নেয় না, কেউ নেয় । বলে বাবা ওটি কে আর্মির লােক। এগুলােতে আইনকানুনের পরিবর্তন প্রয়ােজন, আমাদের মানসিকতার প্রয়ােজন। সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি করে তারাও মানুষ, তারাও এদেশের নাগরিক। তাদেরও অধিকার আছে। একজন নাগরিক হিসেবে তারও অধিকার আছে ন্যায়বিচার পাওয়ার। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনাে সুযােগই নেই। সংবিধানে এগুলাে আসা উচিত । মানবাধিকার তাদের জন্যও প্রযােজ্য হওয়া উচিত। সব কু’তে দেখা যায় মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদেরই কেবল ফাসি হয়, চাকরি চলে যায়। একটি ঘটনাও নেই কোনাে রিপ্যাট্রিয়ট একজন অফিসারেরও ফাসি হয়েছে বা কোনাে অভুথানে তার চাকরি গেছে। চিটাগাং এর ঘটনার সময় বহু রিপ্যাট্রিয়ট অফিসারেরও ঐখানে পােস্টিং ছিল। কিন্তু কারাে তাে চাকরিও গেল, ফাসিও হলাে না। হলাে কার? মুক্তিযােদ্ধাদের। সব মুক্তিযােদ্ধাদের। একজনও নেই। যতগুলাে কু্য বাংলাদেশে ইনকুডিং কিলিং অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা সবগুলােই পূর্ব পরিকল্পিত । সবগুলাের ভিকটিম হচ্ছে মুক্তিযােদ্ধারা। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে যারা কিলিং-এ জড়িত ছিল। হিটলারের যারা এখনাে তাদের বিচার হচ্ছে। বয়স ৯০ বছর, ৮০ বছর, তারা প্রায় ৫০ বছর ধরে পলাতক। তারপরেও তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে নিয়ে। ট্রায়াল হচ্ছে। এখানে কেউ কেউ মতাে দেয় অতীতকে ভুলে যাও। আসলে তা নয়, অতীতই সত্য। যেসব কু্য বাংলাদেশে হয়েছে, যেসব ফাসি এবং যেগুলাের শাস্তি দেয়া। হয়েছে সবগুলােরই ইনভেস্টিগেট, রিইনভেস্টিগেট করা উচিত । সবগুলােরই কমিশন গঠন করে, দরকার হলে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন আইনবিদদের ডেকে যারা মানবাধিকারের উপর কাজ করে তাদেরকে রেখে কমিশন করে এসবগুলাের। উপরই টুথ কমিশন করে সবগুলােরই তদন্ত প্রয়ােজন।

লেঃ জেনারেল এম, হারুন অর রশীদ (অব.) বীর প্রতীক

সাবেক সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমি লে. জেনারেল এম. হারুন অর রশীদ বীর প্রতীক অবসরপ্রাপ্ত, প্রাক্তন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। আমি ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন প্রাপ্ত হই। আমার সৌভাগ্য আমার চাকরিতে যােগদানের কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে তকালীন যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। তা স্বচক্ষে লক্ষ্য করার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই গণজাগরণ বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে আটটায় আমরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘােষণা করি। পাকিস্তানি অফিসারদের বন্দি করে আমরা আমাদের যুদ্ধ ঘােষণা করলাম। মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের জন্য সরকার আমাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের কাজ শুরু হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পুনগঠিত করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রতীক হিসেবে সেনাবাহিনীকে দাঁড় করানাে। ১৯৭৫ সালে জাতির সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ঘটে যায়। সেটি হলাে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যার কারণে সেনাবাহিনীর যে মনােবল ছিল সেটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এবং সেনাবাহিনীর মনােবল এত নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে কেউ এটার বিরুদ্ধে

কোনাে কথা বলারও সাহস পাচ্ছিল না। ঐ ‘৭৫ সালের থার্ড নভেম্বর জেনারেল খালেদ মােশারফের অধীনে একটি কু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে কমান্ড চেইন ফেরত আনা এবং যারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ড চেইনে প্রবেশ করে অবৈধভাবে সেনাবাহিনীকে চালনা করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তাদেরকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডে নিয়ে আসা। এর মধ্যে সংগঠিত হয়েছে ৭ নভেম্বরের পাল্টা কু। এই কু্যর ফলে কয়েকজন সৈনিক অফিসারকে বিনা কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে। ৭ নভেম্বরের কু-এর পরে যারা ক্ষমতা দখল করল তারা ১৫ আগস্টে যারা জাতির কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল তাদেরকে পুরস্কৃত করল। তাদেরকে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন এবং অনেককে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে বদলি করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করে। এর মধ্যে শুরু হয় একটি চক্রান্ত যাতে বাংলাদেশে যে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সেই সৃষ্টিটিকে আমি বলব নস্যাৎ করে দিয়ে একটি নতুন ভাবধারা সৃষ্টি করা। তখন সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় যারা ছিলেন তারা। বিভিন্ন কুর অজুহাতে অনেক অফিসার, অনেক সৈনিককে মৃত্যুদণ্ড এবং বিভিন্ন। মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়। এই যে মৃত্যুদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয় এগুলাে সাধারণত দেয়া হয়েছিল প্রহসনমূলক কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে । বলতে গেলে এই সময় থেকে শুরু হয় সেনাবাহিনীর। অভ্যন্তরে নিয়ম-শৃঙ্খলাবহির্ভূতভাবে সৈনিকদের বা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা, বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া। তার প্রথম দৃষ্টান্ত আমার মনে হয় একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা বীর। উত্তম কর্নেল তাহেরের ফাসি। যদিও অনেকে জানেন কর্নেল তাহেরের ফাসিটি নির্ধারিত হয়েছিল একটি কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে। কিন্তু সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে কোর্ট মার্শাল সংঘটিত হওয়া উচিত এবং পরবর্তীকালে কোর্ট মার্শালের যে ধারা বিবরণী বা প্রসিডিং হওয়া উচিত সে ধরনের কিছুই এখানে ছিল না। মনগড়া কিছু অভিযােগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযােগ গঠন করা হয় এবং যখন কোর্ট মার্শাল চলে তখনই সেনাবাহিনীতে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড হবে এবং পরবর্তীকালে দেখা গেল তাকে সেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে। একবার যখন আইন-বহির্ভূতভাবে বা আইন ভঙ্গ করে। কোনাে কাজ করা হয় তখন দেখা যায় সেই আইন ভঙ্গ করাটি রীতিতে পরিণত হয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ঠিক একইভাবে আইন ভঙ্গ করাটিই রীতিতে পরিণত হয়েছিল। এর পরবর্তীকালে অনেকগুলাে ক্ষেত্রে যে সমস্ত কোট মার্শাল করে অফিসারদেরকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেয়া হয় সেই কোর্ট মার্শালগুলাের দিকে তাকালে সেখানে যে কোনাে সুস্থ মানুষ বুঝতে পারবে। এখানে নিয়মনীতির কোনাে ধারাবাহিকতা নেই এবং ইচ্ছাকৃতভাবে যে ভার্ডি সেগুলাে আগের থেকে ডিক্টেট করে এই কোর্ট মার্শালগুলােকে চালানাে হয়েছিল।

জিয়া হত্যা মামলায় বারােজন প্রথমে এবং পরবর্তীকালে একজন তেরজন অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। এই এতবড় একটি কোর্ট মার্শাল এতজন অফিসারের বিরুদ্ধে একটি অভিযােগ এবং রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার মতাে একটি অভিযােগ এই অভিযােগের তদন্ত এবং সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ এবং তার বিচারবিশ্লেষণ সবকিছুই শেষ হয়েছে মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে। এবং এত দ্রুত এই ভার্জিক্টটি সরকারের অনুমােদন পায় এটি অবিস্মরণীয় একটি ব্যাপার! যদি তারা দোষী হয় তাহলে তাদেরকে ওপেন কোর্ট মার্শালে নিতে আপত্তি কোথায়? এবং তাদেরকে তাদের যথাযথ ডিফেন্ড করার সুযােগ দিতে আপত্তি ছিল কেন? ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৭৭ এর মধ্যে অনেকগুলাে কোর্ট মার্শাল সংঘটিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ঠিক কতজনের ফাসি হয়েছে এই পরিসংখ্যানটি কিন্তু কোথাও নেই। যদিও তখন আমি একজন মিড র্যাঙ্কিং অফিসার । তখন আমার পক্ষে এই পরিসংখ্যান বা কী হচ্ছে সেটি জানা সম্ভব ছিল না, কারণ এই ঘটনাগুলাে ঘটছিল এবং কোর্ট মার্শালগুলাে বা যে ধরনের বিচার বিচার ওপেন হচ্ছিল সেগুলাে ক্যামেরার মধ্যে ছিল, সকলের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছিল না। ১৯৭৭-এ বেশ কয়েকটি ঘটনা হয়। আপনাদের হয়তাে মনে আছে যেমন বগুড়াতে একটি ব্যাটালিয়ন বা ২২ বেঙ্গল বলে পরিচিত, তাদের একটি বিদ্রোহ হয় এবং ঢাকাতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিদ্রোহের ঘটনা হয়েছিল। এগুলাে সব মিলিয়ে একটি দারুন বিশৃঙ্খলার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী এবং সেনাবাহিনী অতিবাহিত করছিল। এই সময়টুকু মানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যদি বলতে চান। তাহলে বলতে হবে একটি বিশৃঙ্খল অধ্যায়। ‘৭৭-এর পর থেকে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলেও সৈনিকদের মধ্যে যে অসন্তোষ সেটি স্তিমিত করা সম্ভব হয়নি। যার একটি বহিঃপ্রকাশ ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হত্যা। জিয়াউর রহমানের হত্যার পরে আবার সেই নতুনভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি এবং জিয়াউর রহমানের যে হত্যাটি এটিকে ঠিক একটি কু্যর মাধ্যমে হয়েছে সেটি বলা যাবে

। কারণ এটি সেনাবাহিনীতে বহুল প্রচলিত প্রবাদ সেনাবাহিনীর তল্কালীন কমান্ডে যারা ছিল তারা একটি প্ল্যান অর্গানাইজেশন করে সেই অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা । জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাে হত্যা হলাে এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে যাদেরকে নাম দিয়েছিল সেই একটি বিশাল। জনগােষ্ঠী, যার ছিল সবাই মুক্তিযােদ্ধা তাদেরকে হয় হত্যা করা না হয়। সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়া। আমরা দেখতে পাই সেনাবাহিনীতে হত্যার পরে। যে কোর্ট মার্শালটি সংঘটিত হয়, প্রথমে বারােজন পরে একজন তেরজন। অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। এই একটি প্রহসনমূলক যে কোর্টমার্শাল এটি একটি হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় এতজনের বিরুদ্ধে এত গুরুতর একটি অভিযােগ, অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য মাত্র ১৮ দিন সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ কোর্ট মার্শালটি সম্পন্ন হয়।

যেখানে স্বাভাবিকভাবে একজন ক্রিমিনাল যে কয়েদি তাকে ফাঁসি দিতে গেলে বছরের পর বছর চলে যায় সেখানে ১৩ জন সামরিক অফিসার তাদের বিরুদ্ধে এত গুরুতর একটি অভিযােগ মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। এটি কীভাবে সম্ভব? দ্বিতীয়ত যে অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযােগগুলাে আনা হয়েছিল সেই অফিসারদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনাে সুযােগ দেয়া হয়েছিল কি? সেই অভিযুক্ত ৩১ জনকে ডিফেন্ড করার জন্য দেয়া হয়েছিল মাত্র তিনজন অফিসার। অথচ সেনা আইনে ক্লিয়ারলি লেখা আছে প্রত্যেক অভিযুক্তকে, তাকে নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য যথেষ্ট সুযােগ এবং সুবিধা দেয়া হবে। তিনজন অফিসার কি করে ৩১ জন অভিযুক্তকে ডিফেন্ড করতে পারে? | সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে আমার এই ধরনের অনেক উৎসুক এবং প্রশ্ন ছিল এগুলাের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই উত্তর আমি কোনােদিন নিজেও পাইনি। আমি একজন সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে যখন এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি তাহলে সেখানে দেশবাসী কীভাবে এর উত্তর খুঁজে পাবে সেটি আমার পক্ষে বােঝা সম্ভব না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কিছুদিন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকতে পারে এবং এর মধ্যে এমন কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেটির জন্য অস্বাভাবিক কিছু করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে বিবেককে পরিষ্কার করতে হবে। সেই বিবেককে যদি পরিষ্কার করতে চাই তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে কী হয়েছিল? কারা দোষী ছিল? এবং কীভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। এইজন্য হয়তাে আমরা অন্যান্য দেশের দিকে তাকাতে পারি, তারা কীভাবে করেছিল । আমার মনে হয় আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের যে টুথ কমিশন সে টুথ কমিশন এমন একটি কাজ করেছে এই কাজের ফলে আজকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে যে ধরনের ঘটনা হয়েছিল শ্বেতাঙ্গদের সময়ে এবং পরবর্তীকালে ট্রাঞ্জেশন সময়ে তার জন্য কেউ কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি। আমি মনে করি আমাদের এই সমস্ত যে অন্তরের প্রশ্ন তখন কী হয়েছিল? কীভাবে ঘটনাগুলাে ঘটেছিল? এবং এটির তদন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছিল কি না? এবং হলেও তাদের যে বিচারকার্যটি সেই বিচারকার্যটি কি নৈতিকভাবে হয়েছিল না অনৈতিকভাবে হয়েছিল? এটি বাহির করা আমাদের একটি জাতীয় এবং নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। এবং সেটি করা সম্ভব একমাত্র একটি জাতীয়ভাবে নিরপেক্ষভাবে টুথ কমিশন গঠনের মাধ্যমে। সেনাবাহিনীতে ১৯৭৫এর পর যে বিচার-বহির্ভূত বা অন্যায়ভাবে যে বিচারের ব্যবস্থা এবং আইনকানুনকে পাশ কাটিয়ে কর্মকর্তাদের ইচ্ছেপূরণ করার যে একটি প্রবণতা শুরু হয়, যার ফলশ্রুতিতে অনেক অফিসার অনেক সৈনিক প্রাণ হারিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন এমনকি তাদের ছেলেমেয়েরাও আজকে পর্যন্ত জানে না তাদের বাবার কী হয়েছিল বা তার লাশটি পর্যন্ত তারা পায়নি। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এটি এমন

একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন যেটি কোনােভাবে মানা যায় না। একটি মানুষ সে। কোথায় গেল, সশস্ত্রবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় সে ছিল তারপরে তার কোনাে হদিস নেই বা তাকে পাওয়া যাচ্ছে না এটি তাে হতে পারে না। এটি নিয়ে অনেকবার অনেকরকমের আলােচনা-সমালােচনা হয়েছে। আমরা যারা মিডল র্যাঙ্ক থেকে উপরের দিকে উঠে এসেছি আমাদেরকেও অনেক সময় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছি তখনও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে কিন্তু এগুলাের কোনাে উত্তর দেয়ার মতাে ক্ষমতা আমাদের নেই কারণ এদের কোনাে পরিসংখ্যান, এদের কোনাে ইতিহাস কেউ সংরক্ষণ করেনি। ইচ্ছেকৃতভাবে হতে পারে বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। তবে আমার মনে হয় এই ধরনের কোনাে ডকুমেন্ট হারিয়ে যাওয়ার কোনাে স্কোপ। অ্যাটলিস্ট সেনাবাহিনীতে থাকার কথা নয়। এর থেকে উত্তরণের উপায় একটিই সেটি হলাে নিয়মনীতি এবং সেনাবাহিনীর যে প্রচলিত ধারা সেটিকে উপযুক্তভাবে এবং যেভাবে করার সেভাবে যদি আমরা নিয়মের সাথে পালন করতে পারি তাহলে হয়তাে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফেরত আসবে এবং প্রফেশনাল দক্ষতাও বাড়বে। কিন্তু যে সমস্ত সৈনিকরা বা যে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন তাদের আত্মীয়ের, তাদের বাবার, তাদের ভাইয়ের, তাদের ছেলের খোঁজ-খবর পাচ্ছে না তাদেরকে তাে আমাদের কোনাে না কোনাে একটি উত্তর দিতে হবে। তারা কোথায়, তাদের কি হয়েছিল, তাদের কেন হয়েছিল। সে কোথায়, কেন এই সমস্ত উত্তরগুলাে। দিতে হলে আমাদেরকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে হবে কখন কি পরিস্থিতিতে তাদেরকে হয়তাে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল, হয়তবা তাদেরকে কোর্ট মার্শাল করা হয়েছিল, হয়তবা তাদেরকে ফাসি দেয়া হয়েছিল। আমি মনে করি মানবাধিকারের হিসেবে আমাদের যে কোনাে নাগরিককে তার আত্মীয়স্বজন কোথায় কীভাবে মারা গেল সেটি জানানাে একটি সরকারি দায়িত্ব। আমরা যারা সরকারে ছিলাম আমাদেরও দায়িত্ব ছিল। কিন্তু যেহেতু এটি সামগ্রিকভাবে কোনাে পরিকল্পনা করে, কোনােরকম ইনভেস্টিগেশন চালানাে সম্ভব হয়নি সেজন্য এটি বাহির করা বা এটি জানানাে সম্ভব হয়নি। তবে আমার মনে হয় ইংরেজিতে যে বাক্যটি আছে- Better then let then never, এটি কখনাে না হওয়ার চাইতে যত দেরিতে হলে এখনাে হওয়া সম্ভব। সেটি আমার মনে হয় জাতীয়ভাবে যদি আমরা একটি টুথ কমিশন গঠন করি, সেই টুথ কমিশনের মাধ্যমে আমরা স্থাপন করতে পারব কখন কে, কীভাবে, কোথায় জড়িত হয়েছিল। তাকে কীভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছিল এবং তার অপরাধ কী ছিল এবং সেই অপরাধ ঠিকভাবে প্রমাণিত হয়েছিল কিনা, তাহলে আমি মনে করি আমরা জাতীয়ভাবে একটি দায়মুক্তি পেতে পারি। | টুথ কমিশনের অনুসন্ধানে যদি এটি প্রমাণিত হয় বা এটি বােঝা যায় অনেকে নিদোষ ছিল তাদের অনেকে হয়তাে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে,

অনেকের ফাসি হয়েছে, অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে, তাদেরকে এই জীবনে ফেরত আনা সম্ভব নয়। কিন্তু একটি কথা তাদের যারা আত্মীয়স্বজন, তাদের উত্তরসূরি যারা তারা অন্তত এই পৃথিবীর বুকে জেনে যাবে তাদের বাবা, তাদের ভাই, তাদের সন্তান অন্যায় করে মৃত্যুবরণ করেনি। অন্যায়ভাবে যদি তাদের ফাসি হয়ে থাকে, অন্যায়ভাবে যদি তাদের শাস্তি হয়ে থাকে তাহলে সে অন্যায় থেকে দায়মুক্তি করার জন্য আমরাও জাতীয়ভাবে হয়তাে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারব। তাদের পরিবার-পরিজনকে ক্ষমা চেয়ে শান্তি দিতে পারব।

প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সেকশন চেয়াম্যান, লােক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সঙ্গে বহুদিন ধরে কাজ করেছি। সেই ‘৮৪ সালে থেকে আমি যখন ইংল্যন্ডে পড়াশুনা করছিলাম তখন বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গ্রুপটি ছিল অ্যামনেস্টির তার হয়ে আমি নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছি এবং পরবর্তীকালে ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে যুক্ত হই এবং ভারতে যখন মাঠ পর্যায়ে গবেষণার কাজ করছিলাম তখনাে আমাদের যে গ্রুপগুলাে ছিল ভারতে তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যখন স্থায়ীভাবে ফিরে আসি। সেই ‘৮৯ সন থেকে আমাদের যে গ্রুপগুলাে ছিল গ্রুপ ইনফরমেশন এবং তারপরে পরবর্তীকালে যখন সেকশন স্টেটাস পেলাম আমরা বাংলাদেশে, অ্যাকটিভ ইনভলব ছিলাম এবং আমাদের যে নির্বাহী পরিষদ ছিল আমাদের সেকশন থাকাকালীন সময়ে সে সময়ে নির্বাহী পরিষদে একাধিকবার কাজ করেছি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঢাকা মেট্রোপলিটন গ্রুপের আমি প্রতিষ্ঠাতা। সভাপতি। পরবর্তীকালে যখন সেকশন ডিসব্যান্ডেড হয়ে যায় তারপরে আমি। ইন্টারন্যাশনাল মেম্বার হওয়ার জন্য আবেদন করেছি এবং নিয়মিত টাচে আছি অ্যামনেস্টির বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কর্মতৎপরতার সঙ্গে। বাংলাদেশে অ্যামনেস্টির দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল-খবর রাখার একটি ঐতিহ্য আছে। সেই রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলাে ইভেন্ট আমরা এখানে সংঘটিত হতে দেখেছি, যতগুলাে ঘটনা বা দুর্ঘটনা সবকিছুর ব্যাপারেই অ্যামনেস্টির একটি স্ট্যান্ড ছিল। ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭৫-এর যে বিয়োগান্তব ঘটনায় পট পরিবর্তন ঘটল আমাদের দেশে, ক্ষমতার পালাবদল ঘটল এবং পরবর্তীকালে ‘৭৬-এ আমরা দেখলাম কর্নেল তাহেরের যে বিচারের নামে প্রহসন। এবং জুডিশিয়াল মার্ডার যেটিকে বলা যেতে পারে। তারও পরে আমরা ‘৮১-তে। জিয়াউর রহমানের যে নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে যে।

ট্রায়ালগুলাে হলাে এসবকিছু বিষয়গুলাে নিয়েই আমনেস্টি টাইম টু টাইম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অ্যামনেস্টি যে স্ট্যান্ড তার সপক্ষে নানা রকমের বক্তব্য হাজির করেছে। এবং এই সবকিছু মিলে আমরা যেটি দেখতে পেয়েছি ডেথ পেনাল্টি এটি নিয়ে কিন্তু অ্যামনেস্টির বরাবরের একটি স্ট্যান্ড আছে সেটি হচ্ছে আমরা। সকল ধরনের ডেথ পেনাল্টির বিরুদ্ধে। এটি যে কোনাে কারণেই হােক, যে। কোনাে কাজেই হােক। আমরা মনে করি একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যদি ঘটে এবং যাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, দায়ী করা হচ্ছে সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য পরবর্তীকালে যদি তাদেরকেও ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানাে হয় তাহলে কিন্তু সেই জীবন আর ফিরিয়ে আনা যায় না। আর ফেয়ার ট্রায়ালের স্বপক্ষে আমরা বরাবর অবস্থান নিয়েছি। ফেয়ার ট্রায়াল নিশ্চিত করাটি জরুরি এবং এর মধ্যে ট্রান্সপারেন্সিটা নিয়ে। আসা দরকার। গােপন ট্রায়াল বা বিচার এটি সঠিক অর্থে পরিপূর্ণভাবে বিচারের যে মানদ সেটি পুরােপুরিভাবে নিশ্চিত কুরা যায় না। বাংলাদেশে আমরা জানি। সেনা শাসনের আমলে বিভিন্নভাবে এধরনের গােপন ট্রায়ালের বিভিন্ন রকমের ঘটনা ঘটেছে এবং তার মধ্য দিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে প্রচুর সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাকে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানাে হয়েছে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এটি কোনাে অবস্থায় মানবাধিকারের যে মাপকাঠি আছে তা দিয়ে জাস্টিফাই করা যায় না। প্রত্যেকের ফেয়ার ট্রায়াল পাবার সমঅধিকার আছে এবং প্রত্যেকেরই জীবনধারণের অধিকার আছে। জুডিশিয়াল বা এক্সটা জুডিশিয়াল যে কোনাে ফর্মেই হােক কাউকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার আমরা বিরােধী। বিশ্বে একটি অন্যতম ওয়াচ উগ রােল প্লে করছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবছরই আমরা যে রিপােটগুলাে প্রকাশ করি অ্যানুয়ালি তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি চ্যাপ্টার বা সেকশন হিসেবে স্থান পায় এবং সারা বছরে বাংলাদেশে যে মানবাধিকার পরিস্থিতি তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা সেখানটায় উপস্থাপন করে থাকি। বাংলাদেশে আমাদের যে কাজ সেটি এখন সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। ভবিষ্যতে আশা করি আবার শুরু হবে। এখন ইন্টারন্যাশনাল মেম্বার হিসেবে আমরা কিন্তু আমাদের মতাে করে আর্জেন্ট অ্যাকশন বলুন তারপরে অন্য যে অ্যাপিলগুলাে সেগুলাে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। | আমাদের দেশে ১৯৭৬, ৭৭ এব ‘৮১ সনে আমরা বিভিন্ন কারাগারে এই ধরনের গােপন বিচারের মধ্য দিয়ে যে ফাসির ঘটনাগুলাে ঘটানাে হয়েছিল এবং সেটি রীতিমতাে একেবারে গােপনীয়তা বজায় রেখেই করা হয়েছে । কোনােরকমের ফেয়ার ট্রায়ালের সুযােগ ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। এবং অ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে জোরালাে প্রতিবাদ জানানাে হয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এই ধরনের যে হত্যাকাণ্ডগুলাে সংঘটিত হয়েছিল বিচারের নামে সেগুলাে কিন্তু ঠেকানাে যায়নি, আটকানাে যায়নি। ভবিষ্যতে যাতে

আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে আমাদের সবাইকে উচ্চকিত হতে হবে এবং শুধু যে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানইজেশনগুলাে আছে তাদেরই সচেষ্ট থাকলে চলবে না এর পাশাপাশি আমাদের দেশীয় যে সংগঠনগুলাে আছে যেমন হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশভিত্তিক সংগঠন এর আমি প্রেসিডিয়াম সদস্য। আমরা কিন্তু সক্রিয়ভাবে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছি, কাজ করার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কমিশন আছে, বাংলাদেশ সােসাইটি অব দ্য এনফোর্সমেন্ট অব হিউম্যান অব হিউম্যান রাইটস আছে, অধিকারের মতাে সংগঠন আছে সবাই মিলে যদি এই বিষয়গুলাে দি আটিকেল অব ফেইথ হিসেবে নিয়ে সক্রিয়ভাবে সােচ্চার থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের যে এক্সটা জুডিশিয়াল মার্ডার কিংবা ফেয়ার ট্রায়ালবিহীন যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সেগুলাে রােধ করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।

এ ধরনের গােপন বিচারের মাধ্যমে যাদের হত্যা করা হয়েছে বিশেষ করে প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের তাদের অনেকের লাশই কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলাে পায়নি। সেই লাশ প্রত্যর্পণ করা হয়নি। এই যে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতাে যে ব্যাপারটি এটি রীতিমতাে ন্যক্কারজনক এবং উদ্বেগজনক ঘটনা। কারণ অন্তত দেহাবশেষ ফেরত পাওয়ার অধিকার পরিবারের আছে।

ট্রায়ালের যে ব্যাপারটি ফেয়ারনেসের যে ব্যাপারটি বা পাশাপাশি এই ধরনের মানবিক ইস্যুগুলাে কিন্তু বিবেচনায় আসা দরকার। বিভিন্ন দেশে আমরা জানি বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রচুর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা আমরা জানি এবং বিভিন্ন দেশে এসব ঘটনার পরে অনেক দিন পরে হলেও টুথ কমিশনের মতাে কমিশন গঠন করা হয়েছে। বিষয়টিকে একটি মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে, উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং সেসব টুথ কমিশন যখন গঠন করা হয়েছে তখন জাতীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের সুযােগ হয়েছে সেখানে উপস্থিত থাকার, অংশগ্রহণ করার এবং বিষয়টিকে নিয়ে কথা বলার। আমরা চাই বাংলাদেশেও এই ধরনের যে ঘটনাগুলাে সংঘটিত হয়েছে বিশেষ করে সেনা শাসনামলে সেই ঘটনাগুলাের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার এবং প্রয়ােজনে টুথ কমিশনের মতাে কমিশন গঠন করে একটি মিমাংসায় পৌছানােটি জরুরি বলে আমরা মনে করি। এক্ষেত্রে স্থানীয় যে মানবাধিকার সংগঠনগুলাে আছে এবং আন্তর্জাতিক যে মানবাধিকার সংগঠনগুলাে আছে সবার সােচ্চার এবং ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের যেটি করা দরকার সেটি হচ্ছে টুথ কমিশন গঠন করাটি জরুরি এবং সংশ্লিষ্ট যে পরিবারগুলাে যে ভিক্টিম তাদের একটি সান্ত্বনার পরিপ্রেক্ষিত আছে এখানটিতে। এর পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা একটি দিকনির্দেশনা রেখে যেতে পারি

এবং রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবেও এই কাজগুলাে হতে পারে যার মধ্য দিয়ে আমরা | বলতে পারবাে অন্তত বিবেকের কাছে সন্তোষজনক একটি জবাব দিতে পারবাে না।

আমরা যারা বেঁচে আছি তারা অন্তত কিছু করতে সক্ষম হয়েছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনাগুলাের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে বাংলাদেশে হােক, দেশের বাইরে হােক বা অন্য কোনাে পরিমণ্ডলে হােক এগুলাে আটকানাের জন্য একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এবং এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এটিই আমরা আশা করতে পারি। বিষয়টিকে আমাদের আসলে জাতি হিসেবে আত্মজিজ্ঞাসা স্টেট উইদইন স্টেট যে অ্যাক্টররা আছেন তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক সময় মনে হয় এই ধরনের বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি হলে জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, নতুন করে পুরনাে বিরােধগুলাে চাঙ্গা হয়ে উঠবে ইত্যাদি। এই ভয়গুলাে কিন্তু অহেতুক এবং এই রকমের বিষয় নিয়ে সাই সাই ও করার কোনাে কারণ নেই। কারণ যেই সমস্যাগুলাে সংঘটিত হয়ে গেছে ছিল সেগুলাের মীমাংসা হওয়াটি জরুরি এবং ধামাচাপা দিয়ে রেখে বছরের পর বছর ভাবা যেতে পারে বিষয়গুলাে ফসিলাইজড হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কখনােই কিন্তু এই যে এর হাত থেকে কিন্তু পরিত্রাণ নেই। সুতরাং বিবেকের কাছে আমাদের স্বচ্ছ একটি অবস্থানে। চলে যেতে হবে এবং সেই কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের এই বিষয়গুলাে নিয়ে খােলামেলা স্পষ্ট বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়া দরকার এবং বিষয়গুলাের মীমাংসা হওয়া দরকার। স্টেট উইদইন স্টেট যে অ্যাক্টররা আছেন তাদের নেচার অব জবই এরকম তারা গােপনীয়তা ভালােবাসেন এবং তাদের নেচার অব জবের সঙ্গে আমাদের এই যে জিজ্ঞাসাগুলাে সেগুলােকে মিলিয়ে ফেলাটি ঠিক হবে না। আর অ্যাট দ্য ইন্ড অব দি ডে এটি তাে ট্যাক্স পেয়ারের মানি যেটি ব্যবহৃত হয় এই স্টেট অ্যাক্টরদের বেতন দিয়ে পুষবার জন্য। এই গােয়েন্দা বিভাগের লােকই বলুন বা সেনা কর্মকর্তা বলুন অ্যাট দ্য ইন্ড অব দ্য ডে তার পে চেক কিছু আসে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে এবং যেই রাষ্ট্র যত মানবিক সেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তত উজ্জ্বল, সমুজ্জ্বল আন্তর্জাতিক দরবারে। বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ এই দক্ষিণ এশিয়া যে উপমহাদেশ এই উপমহাদেশে সবচাইতে যেটিকে বলা যেতে পারে একমাত্র নেশন স্টেট ওই সেন্সে চিন্তা করলে, সবচাইতে হােমােজেনাস একটি স্টেট। সেজন্য আমাদের যে আকাক্ষা জাতীয় আকাক্ষা তার সাথে সঙ্গতি রেখেই আমাদের এই কাজটি করা। জরুরি হয়ে পড়েছে।

মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (অব.) বীর প্রতীক

আইন মানুষের জন্য, মানুষও আইনের জন্য। এটি যদি মেনে নিই তাহলে আইনে নাই বলে যে আমি একটি কাজ করতে পারবাে না তাতাে হতে পারে না। আইনকে সংশােধন করতে হবে পুনর্বিচার কর, পুনঃতদন্ত কর, দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দাও। কারণ এগুলাে যদি না করি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরাে ঘটতে পারে। আইন নাই মানে আইন করা যাবে না তা নয়। সুতরাং আমরাও চাই

আমাদের দেশে আইন হােক যে ২০ বছর পর এই দলিল জনগণের সম্মুখে পাবে, জনগণ জানতে পারবে, ২৫ বছর পরে জনগণ জানতে পারবে, ৩০ বছর পরে জনগণ জানতে পারবে এরকম। সংবেদনশীল ঘটনা, তথ্য, ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই বলে কি জনগণ জানতে পারবে না? পারবে টুথ কমিশন, সাউথ আফ্রিকায় টুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন, কম্বােডিয়াতেও হচ্ছে এটি। এটি জানানা গুজমান ইস্ট তিমুরের প্রেসিডেন্ট তিনি, ওদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা, সে এখন প্রেসিডেন্ট। তাদের দেশে এটি রিকনসিলেশন করেছে। আমাদের দেশে রিকেনসিলেশন-এর উদ্যোগটি নেয়া হয়নি। রিকনসিলেশন অথবা শাস্তি অর্থাৎ তিনটি জিনিস ঘটতে পারে একদোষী ব্যক্তি দোষ স্বীকার করবে বা বিচারের মাধ্যমে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা। হবে। হয়তাে স্বীকার করল বা সাব্যস্ত হলাে তখন দোষী ব্যক্তির কী হবে। দুটি জিনিস হতে পারে এক-তাকে শাস্তি দেয়া হতে পারে অথবা সে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে ক্ষমা করা হতে পারে। এই সবগুলাে কাজই বৈধ এবং করা। প্রয়ােজন। শাস্তি দিতে হলে দেন, ক্ষমা করতে হলে ক্ষমা করেন। কিন্তু এগুলাে করা উচিত বলে আমি মনে করি এবং জাতির অবশ্যই জানা উচিত।

এডভােকেট জেড আই খান পান্না

‘৭৫, ৭৬, ‘৭৭ এবং ‘৮১ এই চারটি সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতরে অসংখ্য মানুষকে ফাসি দেয়া হয়েছে। এই ভাগ্যহত ব্যক্তিরা জানে না, তাদের পরিবারেরা জানে না এদের অপরাধ কী ছিল। এমনকি বহু পরিবার আছে যারা জানে না তাদের এই সাজাপ্রাপ্ত ফাসিতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এই ডেডবডিটি বা এর কবরটি কোথায় দেয়া হয়েছে। আজকে আমরা দাবি করি, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা তারা দাবি করি, রাজনীতি যারা রাজনীতিবিদ তারা দাবি করি, আইনজীবী যারা তারা দাবি করি আমরা সভ্য সমাজের মানুষ। এত বড় বর্বরতা, এত বড় অসভ্যতা, ইতিহাসের এই নিকৃষ্টতম অধ্যায়কে আজকে জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। তাদের পরিবারকে জানানাে দরকার সেই সদস্যের লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে সাউথ আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি কথা তুলে ধরবাে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের প্রেক্ষাপটে যে অন্যায় অবিচার চলেছিল সেটিকে শাস্তি না দিয়ে হলেও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে একটি টুথ কমিশন গঠন। করা হয়েছে। আমরা এটি পারবাে না হয়তাে কর্নেল তাহেরকে ফিরিয়ে আনতে পারবাে না, সাতাত্তরে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারবাে না, ৩ নভেম্বর যে চারনেতাকে জেলের অভ্যন্তরে, সবচেয়ে নিরাপদজনক জায়গা বলা হয় কারাগারকে সেখানে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারবাে না, ‘৮১-তে তথাকথিত জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত করে ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধাকে যে ফাসি দেয়া হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে

আনতে পারবাে না। কিন্তু তাদের পরিবার-পরিজন, তাদের সন্তানাদি, আত্মীয়স্বজনের কাছে, দেশবাসীর কাছে তাদের সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেয়া আজকে আমাদের একান্ত উচিত এবং সে কারণেই একটি টুথ কমিশন করে হােক, এই ঘটনাগুলাের সঠিক তদন্ত করে হােক- বের করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা দরকার।

লরেন্স লিফশুলৎস

অবশ্যই হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা আছে যেগুলাের প্রতি সারাবিশ্বে সামান্যই মনােযােগ দেয়া হয়। বাংলাদেশেও কারাগারে মৃত্যু ও সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলাে ঘটেছে ১৯৭৫, ১৯৭৭ ও ১৯৮১ সালে। এগুলাের প্রতিও সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। | আশা করা যায় আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতাে একদিন বাংলাদেশেও একটি জাতীয় কমিশন গঠিত হবে এবং তা কারাগারে মৃত্যুর বহু ঘটনার দিকে ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি দেবে যেখানে সংক্ষিপ্ত বিচারের ফলে সংক্ষিপ্ত সময়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আর্জেন্টিনার কমিশন নুনকা মাস’ বা ‘আর কখনাে নয়’ নামে একটি উল্লেখযােগ্য রিপাের্ট তৈরি করেছে। এ রিপাের্টের অভিঘাত এমন এক সমাজে আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে যে সমাজ হেফাজতে হাজার হাজার অন্তর্ধান ও মৃত্যুর কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রয়ােজন তার অতীতের ঘটনার ব্যাপারে এধরনের একটি হিসাব নিকাশ করা। অনেক ঘটনাগুলাের মধ্যে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করছি যেগুলাের দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত : ১৯৭৫ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহকর্মীদের মৃত্যু, ১৯৭৭ সালে সারা দেশের কারাগারগুলােতে গােপনে চারশ’রও বেশি সৈন্যের মৃত্যুদণ্ড, ১৯৮১ সালে সেনা হেফাজতে জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যু এবং ১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনীর ১৩ কর্মকর্তার গােপন বিচার ও মৃত্যুদণ্ড।

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ আইন উদ্দিন (অব.) বীর প্রতীক

সুতরাং এখনাে সময় আছে আমি মনে করি যে এগুলাের একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। এই দেশের জনসাধারণের জানার অধিকার হিসেবে। সেনাবাহিনীর ইন্টার্নাল অনেক জিনিস হয়তাে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পাবলিককে জানানাে যায় না গােপনীয়তার খাতিরে, ওইটুকু না জানাক। কিন্তু ঘটনা কী ঘটেছিল ঐটি জানাতে কোনাে অসুবিধা নেই। ব্রিটিশরা কলােনি রুল করার জন্য যে ম্যানুয়াল অব মিলিটারি ল করে গেল কলােনি কন্ট্রোল করার জন্য সেই কলােনিয়াল রুল দিয়ে সার্বভৌম দেশে আজকেও সেনাবাহিনীর বিচার আচার সম্পন্ন করা হচ্ছে। এখানে বেশিরভাগই ন্যায় হতে পারে কিন্তু অন্যায় যে কয়েক পার্সেন্ট হবে না এমন কোনাে কথা নেই। যদি হয় তাহলে তাদের একটি ভেন্টিলেশন থাকা উচিত। ঠিক আছে কোর্ট মার্শাল বা কোর্ট অব ইনকোয়ারির উপরে হাইকোর্টে যাওয়া যাবে না, ফাইন,

সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যাবে না, ফাইন। কিন্তু এমন একটি কোর্ট হওয়া উচিত যেই কোর্টে একটি ভেন্টিলেশন থাকবে। আমি মনে করি সেনাবাহিনীর স্বার্থে যে বাহিনীতে আমি আমার জীবনের সুন্দর অংশটুকু কাটিয়েছি, এই, সেনাবাহিনীর প্রতি আমার দারুণ শ্রদ্ধা, আমি সেনাবাহিনীর প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকি। এই শ্রদ্ধাটি আরাে বাড়বে যদি সেনাবাহিনীর এই যে বর্তমান কলােনিয়াল রুল যেগুলাে আছে। এগুলাে যদি দু’বার রিক্যাস্ট করা হয় এবং কারাে ওপর যদি অন্যায় হয় তাহলে সেই অন্যায়টি যাতে রেক্টিফাই হয় এবং ভাবষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে- এজন্য আমি মনে করি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত, সে আইন অ্যামান্ডমেন্ট করে হােক আর অন্য কোনােভাবেই হােক।

হাসানুল হক ইনু

আমাদের তাে একটি জায়গায় আইনের শাসনে ফেরত যেতে হবে এবং আইনের শাসনে ফেরত যাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে যেখানে যেখানে অন্যায় হয়েছে, অবিচার হয়েছে সেই কাজ সংশােধন করে ফেলা। এইজন্য আমি মনে করি আজকে প্রত্যেকটি ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। এটি আমি বলি সত্য প্রকাশ কমিশন বা ইংরেজিতে টুথ কমিশন। সত্য ঘটনা দেশবাসীর জানার অধিকার আছে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কী হয়েছিল, কেন মানুষগুলােকে হত্যা করা হলাে, কী অপরাধ তারা করেছিল। এইজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শ্বেতপত্র জাতির সামনে উত্থাপন করা দরকার। সত্য প্রকাশ কমিশন তদন্ত করবে, অনুসন্ধান করবে, কীভাবে, কোনাে পর্যায়ে এই সৈনিকদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, নিহত করা হয়েছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি যদি তাদের প্রতি অন্যায় করা। হয়ে থাকে, যারা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত দেশবাসীর সামনে মুখােশ উন্মােচন করে তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলাে নেয়া দরকার ভবিষ্যতে কোনাে সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার সেই সাহস দেখাবে সেনাবাহিনীকে যারা কলঙ্কিত করেছিল, সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি যারা নষ্ট করেছিল তিনি অবৈধ ক্ষমতা দখল করেই হােক অথবা চক্রান্ত করার মধ্য দিয়েই হােক, সেই চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রকারীদের, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের অথবা সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহারকারী সামরিক শাসকদের বিচার-আচারটা বাংলাদেশে খুব জরুরি। হয়ে পড়েছে। এটি যদি আমরা না করতে পারি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভিত্তিভূমি রচিত হবে না ।

উ প সং হা র

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে ‘৭৫ থেকে ‘৮১ পর্যন্ত সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলাে ঘটেছিল সামরিক আদালতে বিচারের নামে, যেখানে ন্যূনতম পর্যায়েও আইন-কানুনের পরােয়া করা হয়নি। সেনা আইনে বিচারের যেসব বিধান রয়েছে সেসবও অনুসরণ করা হয়নি। এই প্রামাণ্য গ্রন্থে সামরিক আদালত ছাড়াও ফায়ারিং স্কোয়াডসহ নানাবিধভাবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ এসেছে। যুদ্ধকালীন অবস্থা ব্যতীত বাংলাদেশ তাে বটেই বিশ্বের আর কোথাও সশস্ত্র বাহিনীতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নজির পাওয়া যাবে না। বলা হয়ে থাকে, এ সময় সশস্ত্র বাহিনীতে ২২টির মতাে অভ্যুত্থান বা কু সংঘটিত হয়। এসব অভ্যুত্থানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৃত্যুবরণ করে সশস্ত্র বাহিনীর অসংখ্য সদস্য। অনেকের মতে সংখ্যাটি আড়াই হাজার বা এর বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ঘটনা নিয়ে আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে জনগণের কাছে কোনাে বক্তব্য প্রদান করা হয়নি। অভ্যুত্থানগুলাে নিয়ে সরকারিভাবে কোনাে ভাষ্য না থাকায় নানাবিধ প্রচার-অপপ্রচার রয়েছে। সর্বশেষ ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধার ফাসি হওয়ার ঘটনা-জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সে সময়ে সরকারিভাবে যে শ্বেতপত্র (হােয়াইট পেপার) প্রকাশ করা হয়েছিল সেটি এই প্রামাণ্য গ্রন্থেই আসামি পক্ষের ডিফেন্ডিং অফিসাররা ব্ল্যাক পেপার বলে উল্লেখ করেছেন। অনেকে মনে করেন, অভুত্থানের অজুহাতে সশস্ত্র বাহিনী থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বড় অংশকে অপসারণের নীলনকশা ছিল ঘটনাগুলাে। কারণ সে সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বের অধিকাংশই মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন না। আর তাই একতরফাভাবে মুক্তিযােদ্ধা অফিসার ও অসংখ্য সৈনিককে নিহত, ফাসি বা সশস্ত্র বাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীতে এ সময়ে মুক্তিযােদ্ধা বা পরবর্তীকালে অফিসার বাদে একজন অফিসারও ফাঁসির সম্মুখীন হননি। আজ থেকে ২৯ বছর আগে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘটিত এই ধরনের প্রত্যেকটি ঘটনাই বেদনাদায়ক ও মর্মস্পর্শী। সে সময়ে ফাসি হওয়া

অধিকাংশ পরিবার এখনাে জানে না কী ছিল তাদের অপরাধ? আর কেনই-বা। তাদের স্বজনদের এই দণ্ড? পুরাে বিষয়টিই দেশের মানুষের কাছে এক অজানা। অধ্যায় । ফাসি হওয়া সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে রহস্যাবৃত বিষয়। যেসব পরিবার সন্তান, স্বজন হারিয়েছেন তারা ঘটনাগুলােকে আজো মেনে নিতে পারেননি। অধিকাংশ পরিবার লাশের ও কোনাে সন্ধান পাননি। অনেকে। সরকারিভাবে নিখোঁজের তথ্য পেয়েছেন মাত্র! সশস্ত্র বাহিনীর এত সদস্য নিখোঁজ বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া নিয়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলাে দীর্ঘদিন। আশ্চর্যরকম নীরবতা প্রদর্শন করেছে। দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন থাকায় সংবাদ মাধ্যমও পুরােপুরি সেন্সরশিপের আওতায় ছিল। বিদেশি মাধ্যমগুলােতে মাঝে মধ্যে কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে । অদ্ভুত হলেও সত্য, বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলােও মানবাধিকারের এত বড় লঙ্ঘনকে এক ধরনের পাশ কাটিয়ে গেছে। দায়সারা গােছের বিবৃতির মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন! দেশের যে জেলাতেই আপনি যাবেন সেখানেই বিশেষ করে ‘৭৭ সালের ঘটনার শিকার অসংখ্য পরিবারের খোঁজ পাওয়া যাবে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অবস্থান। থেকে ঘটনাগুলাে উল্লেখ করা হলেও জাতীয়ভাবে কোনাে তদন্ত কমিশন বা সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও কোনাে কোর্ট অব ইনকোয়ারি বা তদন্ত আদালত গঠন করা হয়নি। কয়েকটি বড় ঘটনার পর তদন্ত কমিশন গঠনের কথা ঘােষণা করা হলেও জনগণ বা সামরিক বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই এর কোনাে কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেননি। অথচ এমনি প্রতিটি ঘটনাই বিস্তৃত অনুসন্ধানের দাবি রাখে। গণতন্ত্রসহ সশস্ত্র বাহিনীর স্বার্থেই এই ঘটনাগুলাের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া প্রয়ােজন। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারসহ সারা জাতির জানা প্রয়োজন কী হয়েছিল, ঘটনাগুলাে কীভাবে ঘটেছিল। আর তাই গ্রহণযােগ্য প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি টুথ কমিশন/ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করাসহ নানাবিধ প্রস্তাব। রয়েছে। সত্যিকার অর্থে এই ঘটনাগুলাে যেন জাতির সামনে প্রকাশ করা যায়। সেই ব্যবস্থা সরকার করবেন-এই প্রত্যাশা রাখি। গণতন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনীর। স্বার্থেই এর কোনাে বিকল্প নেই। আর এটি করতে পারলে হয়তাে দেশ ও জাতি। হিসেবে আমরা এই মৃত্যুর দায়বদ্ধতা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবাে।

সূত্র : সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ – ১৯৮১ – আনোয়ার কবির

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!