You dont have javascript enabled! Please enable it! সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা - ১৯৭৭ সালে নিখোঁজ সৈনিকদের শেষ পরিণতি - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৭৭ সালে নিখোঁজ। সৈনিকদের শেষ পরিণতি

হেতেম খাঁ কবরস্থান রাজশাহী। হেতেম খাঁ কবরস্থানের সামনে আনােয়ার কবিরআমি এখন যে কবরস্থানের সামনে দাড়িয়ে এটি রাজশাহী শহরের হেতেম খা কবরস্থান। কবরস্থানটি রাজশাহীর একটি অন্যতম বড় কবরস্থান।

২ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীতে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে শত শত অনেকের মতে হাজার হাজার সৈনিক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং অনেকের মতে তারা ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন সেই সৈনিকেদের শেষ পরিণতি কোথায় কীভাবে হয়েছিল তা কেউ জানেন না। তাদের পরিবার কখনাে খোঁজ পাননি, তাদের আত্মীয়স্বজনের কী হয়েছিল। সেই বৃদ্ধা মা আজও হয়তাে-বা প্রতীক্ষা করছেন তার সন্তানের কী হয়েছিল, তার সন্তানও আজ প্রতীক্ষা করছেন তার বাবার কী হয়েছিল। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সেই সৈনিকদের কোথায়, কীভাবে দাফন করা হয়েছিল তার কোনাে হদিস কেউ কখনাে জানেনি।

আমরা আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি এই রাজশাহী জেলাতে অনেকগুলাে কবরস্থানে সে সময়ে রাতের বেলা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা এসে গণকবর দিতেন। আমরা ধারণা করতে পারি সেই গণকবরে সমাধি হয়েছিল সেই সময় সেই হতভাগ্য সৈনিকদের। এই কবরস্থান, যে কবরস্থানের সামনে আমরা এখন দাড়িয়ে, এই পুরাে কবরস্থানের অনেকটুকু অংশ জুড়েই সে সময়ে গণকবর দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের থেকেও আমরা শুনেছি, আপনারাও শুনতে পাবেন, তারা তাদের অভিজ্ঞতা বলেছেন আমাদের কাছে কীভাবে তারা দেখেছিলেন। সে সময়ে বড় কোনাে দুর্ঘটনাও ঘটেনি, সে সময়ে দেশে অন্যকোনাে বড় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেনি। শুধু এই হত্যাকাণ্ডটিই ঘটেছিল, যেটির ঘটনা রাজশাহীর জনগণ তখন চাপা ক্ষোভের মতাে ফিসফিস চাপাস্বরে তারা বিভিন্ন সময়ে বলতেন এবং সমস্ত রাজশাহী জুড়ে এটি ছিল একটি আলােচনার বিষয় কিন্তু কখনাে তারা মুখ ফুটে বলতে পারেননি কেন, কীভাবে এই কবরগুলাের তারা প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন। আমরা এলাকায় এসেই মাে. সেলিমকে পেয়েছি, যিনি গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।

আমরা এলাকায় এসে সিনিয়র সাংবাদিক আবুল হােসেন সাহেবকে পেয়েছি উনিও উনার অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বলবেন।  এই পুরাে কবরস্থানের যে জায়গাগুলাে আপনারা দেখছেন, এটি অনেক বড় কবরস্থান এবং এই বড় কবরস্থানে শুয়ে আছেন সে সময়ের সশস্ত্রবাহিনীর অনেক সদস্য। আমরা আশা করবাে কারা এই কবরগুলােতে সমাধিস্থ হয়েছেন সে ব্যাপারে অন্ততপক্ষে একটি তদন্ত কমিটি হবে। আমরা অনুমান করতে পারি ১৯৭৭ সালের সেই হতভাগ্য সৈনিকেরাই যারা ফাসির মঞ্চে সেদিন জীবন দিয়েছিলেন, সেই হতভাগ্য সৈনিকেরাই এখানে সমাধিস্থ হয়েছেন। আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি আপনাদের সামনে উদ্ঘাটন করতে এবং এই রাজশাহী শহরের অনেকগুলাে কবরস্থান সেখানেও আমরা আস্তে আস্তে যাব। সেখান থেকেও আমরা জানতে চেষ্টা করবাে, সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শী তারা কীভাবে দেখেছিলেন সেই সময়ের ঘটনাগুলােকে। তাদের নিজেদের চোখের সামনে তারা কী দেখেছিলেন, তারা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাই আপনাদেরকে জানাবেন।

আবুল হােসেন ফকির

সাংবাদিক, ‘৭৭-এর গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী হেতেম খাঁ কবরস্থান, রাজশাহী।

আমি সে সময়ে দৈনিক বার্তার রিপাের্টার, স্টাফ রিপাের্টার। আমাদের কাছে খবর এলাে রাজশাহী জেলখানায় আজ রাতে বেশ কিছু মানুষের ফাসি হবে। স্বাভাবিকভাবেই একটি টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমরা অপেক্ষা করলাম। রাত বাড়ার সাথে সাথে আমরা ওয়াচ (লক্ষ) রাখলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটি লক্ষ রাখলাম, এই ফাসি কাদের দেয়া হচ্ছে। একটি সূত্র জানিয়ে দিল যাদের ফাসি দেয়া হচ্ছে তাদের লাশ দেয়া হবে না। তাহলে কোথায় নেয়া হবে? ভােররাতের দিকে একটি ট্রাকে করে লাশ আনা হলাে এই হেতেম খাঁ কবরস্থানে এবং এর পাশে যে এলাকা আছে, এই জায়গাটায় (দেখিয়ে দিয়ে), কোনাে কবরখােদককে ডাকা হয়নি। তারা আর্মির লােকজনকে দিয়েই কবর খুঁড়েছে। কবর ঠিক না, গর্ত করে একটির উপর আরেকটিকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। যে লাশগুলােকে মাটি চাপা দেয়া হলাে কী তাদের অপরাধ ছিল সেটি আমরা জানি । বড়কথা লাশগুলাে তার আত্মীয়-স্বজনদের ফেরত দেয়া হয়নি। হিন্দু কী মুসলমান আমরা তাও জানি না, কোনাে মৃতদেহেরই জানাযা হয়নি। গণকবর। যাকে বলা হয়, কবর বলবাে না, এটিকে স্তুপাকারভাবে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। যতবার এই কবরস্থানের দিকে আসি মনের ভেতর পীড়া দেয়, বেদনাহত হই। মনটা ভারাক্রান্ত হয়। মাে. সেলিম

গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী হেতেম খাঁ কবরস্থান, রাজশাহী

১৯৭৭ সালের দিকে আমি দেখেছি, জিয়াউর রহমান যে সময়টিতে গদিতে আসে তার পরপরই আর্মিদেরকে এখানে কবর দেয়া হয়েছে। দিনের বেলাতে কবর খোড়া হয়েছে, রাত্রিবেলাতে নিয়ে এসে এখানে মাটি দেয়া হয়েছে।

আ.ক- আপনার নাম মাে. সেলিম আ,ক- আপনি কী করতেন ১৯৭৭ সালে মাে.সে- সে সময়ে আমি স্বর্ণকারের কাজ করতাম আ,ক- আপনার বাড়ি কোথায় মাে.সে- (হাত ইশারায়) হেতেম খাতে

আ.ক- হেতেম খাতে, এই কবরস্থানের সাথে আপনাদের পরিচয় তাে ছােটকাল থেকেই

মাে.সে- শিশুকাল থেকেই আ,ক- আপনারা কবরস্থানে প্রায়ই আসতেন

মাে,সে- আমরা মানে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কবরস্থানে, এটি আমাদের খেলাধুলার একটি অত্র এলাকা।

আ.ক- নিশ্চয়ই প্রতিদিন অনেক কবর আসে, অনেক মানুষের কবর দেয়, আপনারা দেখেন।

মাে.সে- হ্যা দেখি।

আ.ক-১৯৭৭ সালে হুট করে আপনাদের এলাকার অনেকে বলেছে বা আপনারাও জানেন ১৯৭৭ সালে হুট করে কিছু অদ্ভুত করব এসেছিল। হুট করে। রাত্রিবেলায় । আপনারা কীভাবে দেখেছিলেন, আপনার সে সময়ের কী স্মৃতি মনে আছে, কীভাবে কী দেখেছিলেন। | মাে.সে-আমি দেখেছি, রাত্রিবেলাতে আমরা কিছুসংখ্যক বন্ধু-বান্ধব মিলে রাত্রিবেলাতে এই অঞ্চলে তালের রস নামিয়ে খাব বলে এখানে এসেছিলাম। এসে আমাদের এক বন্ধু উনি মারা গেছেন- ওই গাছের উপরে আছেন (ইশারায় দেখাতে দেখাতে), আমরা নিচে আছি, দেখলাম যে একটি গাড়ি আসলাে। সম্ভবত আর্মির গাড়ি। আসার পরে আমরা লুকিয়ে গেলাম। আমাদের ওই বন্ধুটি তালগাছে ছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম এক-একটি খাটিয়াতে করে নিয়ে আসছে। আর এক একটি কবরে দুইটি, তিনটি করে ফেলে দিয়ে ওরা মাটি দিয়ে দিচ্ছে।

আ,ক- কবরগুলাে কারা খুঁড়ছিল

মাে.সে- কবরগুলাে সম্ভবত রেল কমিটি থেকে খোঁড়ানাে হয়েছিল। দিনের বেলাতে খুঁড়িয়েছে, রাত্রির বেলাতে উনারা এসে মাটি দিয়েছে।

আ.ক- লাশগুলাে আপনারা যখন দেখেছিলেন রাস্তার উপরে তখন কী আপনার দাফন-কাফন পড়ানাে অবস্থায় দেখেছিলেন। | মাে,সে- না, না, রীতিমতন তাদের গায়ে আর্মির ড্রেস পরানাে ছিল

আ,ক- যারা লাশ নিয়ে এসেছিল, ওরাও কি আর্মির ড্রেস পরে এসেছিল মাে.সে- জি। আ-ক- তারা কী পরিমাণ লাশ নিয়ে এসেছিল, কতজন লােক হবে কবর দিয়েছিল মাে.সে- মােটামুটি দুই, আড়াইশ’ হবে আ.ক- দুই, আড়াই’শ, কতদিন ধরে। মাে.সে- দুই, তিনদিন এরকম হয়েছে। বেশিদিন না, দুই, তিনদিন হয়েছে। আ,ক- প্রতিদিন কী পরিমাণ লাশ তারা নিয়ে আসত।

মাে.সে- এটি আমরা একটি গাড়ি দেখেছি, তারপরে আর রাতে কতগুলাে গাড়ি এসেছে সেটি আর জানি না।

আ.ক- গাড়িটি কী জীপ ছিল, না অন্য কোনাে গাড়ি মাে.সে- না (হাত প্রসারিত করে দেখিয়ে), বড় গাড়ি। আ-ক- আর্মির গাড়ি মনে হওয়ার কারণ কী, কেন মনে হয়েছিল আর্মির গাড়ি। মাে.সে রীতিমতন তাদের ড্রেস ছিল। রীতিমতন তাদের ড্রেস ছিল আ-ক- কতক্ষণ ধরে তারা এই কবরগুলাে দিয়েছিল। মাে.সে- মােটামুটি ধরেন ঘণ্টা দুই, তিনেক। আ.ক- দিয়ে তারা গাড়িতে করে চলে গিয়েছে। মাে.সে- দিয়ে তারা গাড়িতে করে চলে গিয়েছে আ-ক- এরপরে তারা কী আবার এসেছেন

মাে,সে হয়তাে রাত্রে এসেছে। আমরা যেটুকুন সময় দেখেছি সেটুকু। হয়তাে রাতে আবার এসেছিল

আ,ক- দিনের বেলায় কী পরবর্তীকালে কোনাে পাহারা বা অন্য কোনাে কিছু ছিল

মাে.সে- না, এমনি হয়তাে মানুষজন চলাচল করতাে। কিন্তু আর্মির পাহারা ছিল না, হয়তাে পুলিশ ছিল, ঘােরাঘুরি করেছে।

আ,ক- এই যে গাড়ি এসেছে, কবরগুলাে দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের কী কথা ছিল, সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই দেখতে পরদিন এসে কবরগুলাে।

মাে.সে- হ্যা, দেখতাে, দেখেছে। আ.ক- সাধারণ মানুষের কী ধারণা ছিল।

মাে.সে না, তাদের তেমন কোনাে ধারণা ছিল না। যেহেতু সে সময়ে এখানে গ্রামবাসীর কোনাে কবর হতাে না। সব বেওয়ারিশ লাশের কবর হতাে, মেডিক্যালের যত বেওয়ারিশ লাশ সব এখানে এনে কবর দেয়া হতাে। যার জন্য মানুষ এদিকে আসতে খুব ভয় করতাে।

আ.ক- তাহলে এটি অনেকটা বেওয়ারিশ লাশের একটি কবরস্থান ছিল। এই

বেওয়ারিশ লাশের কবরস্থানের মধ্যে আপনি নিজের চোখে দেখেছেন সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্যকে কবর দিতে

মাে.সে-হা আ.ক- তাদের ড্রেস পরাই ছিল মাে.সে ছিল। আক– লাশগুলােতে আপনি কী রক্ত মাখানাে বা কী অবস্থায় দেখেছিলেন

মাে.সে- আমরা রাস্তাতে দেখেছিলাম রক্তজমাট, গাড়িতে নিয়ে আসলে যে অবস্থা হয়, যেভাবে রক্ত পড়ে

আ.ক- রক্তজমাট অবস্থায় ছিল মাে.সে- হ্যা। আ.ক- লাশগুলাের কোনাে দাফনকাফনও পরানাে হয়নি মাে.সে- না, না। আ,কএনে জাস্ট মাটি চাপা দিয়েছে, নাকি আরাে অন্য কিছু মাে.সে না (হাত দিয়ে দেখিয়ে), বাঁশ দিয়েছে, তারপরে মাটি দিয়েছে। আ.ক- এক কবরে কতজনকে দিয়েছে। মাে.সে- দুইটিও দিয়েছে, তিনটিও দিয়েছে। আর্ক- অনেকগুলাে কবর, কী পরিমাণ কবর হবে অনুমান এখানে ছিল।

মাে.সে- (হাত দিয়ে দেখিয়ে) মােটামুটি অনেকই ছিল। এখানে ফাকে ফাকে, এরকম গ্যাপে গ্যাপে দিয়েছে।

আ,ক- কতগুলাে হবে, পুরাে এলাকায় মাে,সে- ধরেন দুই, আড়াই’শ হবে। আ,ক- দুই, আড়াইশ’ হবে

মাে.সে- (হাত দিয়ে দেখিয়ে) এই সাইডে আছে, ঐদিকে আছে, ঐদিকে। আছিল (বিভিন্ন দিক দেখিয়ে)

মর্জিনা হাসান

গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী। হেতেম খাঁ কবরস্থান-এর পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা, রাজশাহী অনেক রাত হয়ে যেত, সবই যখন নিঝুম, তখন গাড়ি আসত। ট্রাক আসত। ট্রাক এসে ওখানে থামত । থামার পরে সেটা একটার পর একটা নিয়ে একদম সেই কবরের মধ্যে তিন-চারটা করে রেখে মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত। তখন লােকদেরকে বাহির হতে দিত না। বলত আপনারা ভেতরে যান। বাইরে আসবেন। একদিন না, অনেকদিন এসেছে সেই ট্রাক। আর আমরা জানছি যে হতেই। আছে, কিন্তু প্রকাশ করার কোনাে উপায় ছিল না ।

-কী গাড়ি আসত? আর্মির গাড়ি?

আর্মির গাড়ি ছিল, ট্রাক যেটি বহর। এখন কতগুলাে আসত। ধরেন যে একটি লাশ বহন করতে কতজন লাগে? সেই কয়জন থাকত । ড্রাইভার তাে থাকতই। তার সাথে পাঁচ-সাতজন থাকত। জাস্ট নিয়ে যেয়ে মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত। এটিতাে সবাই জানে।

কবরখােদক

কবরের মধ্যে কয়েকবার হাতকড়া পেয়েছি, কবর খুঁড়তে গিয়ে।

সপুরা স্টেডিয়াম কবরস্থান

রাজশাহী মাহতাব উদ্দিন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক গণখবর, ‘৭৭-এর গণকবরের প্রত্যক্ষদশী। চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গবেষণা কেন্দ্র সপুরা স্টেডিয়াম কবরস্থান, রাজশাহী আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক গণখবরের সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীতে যে ব্যর্থ অভ্যুথান হয়েছিল এবং তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের, সেনা সদস্যদের সামরিক আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তার বেশকিছু সেনা সদস্যকে রাজশাহী জেলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং রাজশাহী শহরের বিভিন্ন গােরস্থান তাদেরকে কবর দেয়া হয়। এই ঘটনা ঘটবার আগে থেকেই প্রচারিত ছিল যে রাজশাহী জেলখানায় অনেক বন্দি আছে এবং যে কোনাে মুহূর্তে তাদের ফাসি হতে পারে। এটি সারা শহর জুড়ে আলােচ্য বিষয় ছিল। তখন সকলে বিস্মিত হচ্ছিল বিষয়টি নিয়ে। সামরিক আইন তখন ছিল, কার্টু ছিল রাত্রিবেলায়। প্রতিদিন রাত্রিবেলায় কার্টু তখন বলবৎ ছিল, দিনের বেলায় ছিল না। চাপা ক্ষোভ ছিল। রাজশাহী শহরে অনেকগুলাে কবরস্থান, তার মধ্যে মহেষবাথান, গােরহাঙ্গা, হেতেম খাঁ, সপুরা, টিকাপাড়া ইত্যাদি গােরস্থানে লােকজনকে কবর দেয়া হয় এবং তারমধ্যে কয়েকটি গােরস্থানের কবর আমি নিজে দেখেছি। তার একটি হলাে হেতেম খা। সেখানে গণকবর, গণকবর বলা যায়, সেখানে রাতারাতি অনেকগুলাে কবর দেয়া হয়েছিল। একাধিক দিন ধরে এই কবর দেয়ার ঘটনাটি ঘটেছে। আবার এই যে এখন যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সপুরা গােরস্তান, এখানে কবরস্থানে আমি দেখেছি যে আর্মিদের মাটি দেয়া হয়েছিল।

এখানে এই যে পুকুরের মতাে আছে (হাতে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে)। এই এলাকায় ঐ পার জুড়ে সমস্ত দিক, ঐ এলাকা জুড়েই কবর দেয়া হয়েছিল এবং ঐ পশ্চিম পাশের ঐ কোনাতেও সেগুলাে আমি তখন দেখেছিলাম এবং কিছু স্থানীয় লােককেও জিগ্যেস করে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এগুলাে সে সমস্ত কর। আর টিকাপাড়ারটা দেখেছিলাম। এই তিনটি কবরস্থানের কবর। আমি দেখেছিলাম। সচেতন মানুষ হিসেবে এটি আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। অনেকেই জিনিসটা জানে কিন্তু তখন ভয়ে বলতে চাইতাে না, জিগ্যেস করলেও বলতাে না। অনেকেই এড়িয়ে যেত। সকালবেলায় পরেরদিন, রাত্রিবেলায় যখন কবর দেয়া হয়েছে এ সমস্ত সেনা সদস্যদের, সাধারণ মানুষকে তখন থাকতে দেয়া হয়নি কথাটি ঠিক কিন্তু পরেরদিন তার পরেরদিন তাে মানুষ দেখেছে, কিন্তু তারপরেও মানুষ এমন একটি পরিবেশে ছিল, রাজনৈতিক পরিবেশ, মানুষ ভয়ে বলতে চাইতাে না।  এই সপুরা গােরস্থানটি খুব প্রাচীন গােরস্থান হলেও এটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এটি অনেকটা বেওয়ারিশ লাশের মতাে বেওয়ারিশ গােরস্থান ছিল- এটি বলা যায়। এখানে যে সেনা সদস্যদের কবর দেয়া হয়েছিল, অধিক সংখ্যক সেনা সদস্যদের এখানে দেয়া হয়েছিল তার কারণ হিসেবে এটি বলা চলে এখানে লােক চলাচল খুব কম। আশেপাশে বসতি প্রায় ছিল না তখন, আর এটির অদূরেই সেনা। দপ্তর রয়েছে। এখানে ক্যান্টনমেন্ট আছে খুব কাছাকাছি এলাকায়। সে জন্যই মনে। হয় এই সপুরা গােরস্থানে অনেক সেনা সদস্য, সাজাপ্রাপ্ত সদস্য যারা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন তাদের এখানে কবর দেয়া বলবাে না, এটিকে ডাম্প করাই বলতে হবে কারণ যেটি শুনেছি এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলেছেন যে তিনটি, চারটি, পাঁচটি লাশ দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে এবং এটিও দেখা গেছে যে কবরের উপর কবর দেয়ার সময় মাটি খুঁড়তে গিয়ে হাতকড়া পড়া অবস্থায় সেনা কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, মদের বােতলও পাওয়া গেছে।

গােরহাঙ্গা কবরস্থান রাজশাহী

জমসেদ আলী।

গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী গােরহাঙ্গা কবরস্থান, রাজশাহী আমার নাম জমসেদ আলী, সুলতানাবাদ বাড়ি, গােরস্থানের পাশে। ১৯৭৭ সালে আর্মিদের যে মাটি দেয়া হয়, তখন আমরা এখানে এসে দাড়িয়ে দেখতাম, তাদেরকে চাপা মাটি দেয়া হয়েছে। কিছু শুকুর জর্দা ফ্যাক্টরির মসজিদের মােড়ে, কিছু কড়ই গাছের লগ্নের পাশে, কিছু এপাড়ে, তাদেরকে চাপা মাটি দেয়া হয়েছে। তখন আমি লেখাপড়া করি।

টিকাপাড়া কবরস্থান

রাজশাহী রাজশাহীর টিকাপাড়া কবরস্থানে। ২ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ঘটেছিল একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান। আর এই অভ্যুত্থানের জন্য

বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর হাজার হাজার, অনেকের মতে শত শত সৈনিক ফায়ারিং স্কোয়াড অথবা ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই হতভাগ্য সৈনিকদের লাশের পরিণতি কী হয়েছিল কেউ জানে না। আমরা আমাদের এই ডকুমেন্টারির জন্য একটি ব্যাপক অনুসন্ধান চালাই। আমরা আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পারি ১৯৭৭ সালে রাজশাহীর চারটি কবরস্থান- এই টিকাপাড়া কবরস্থান, হেতেম খা কবরস্থান, মহিষবাথান কবরস্থান এবং গােরহাঙ্গা কবরস্থানে রাতের বেলা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা তাদের সশস্ত্রবাহিনীর কিছু লাশ এনে দাফন করেছিলেন। কিন্তু এই লাশগুলাে কাদের ছিল কেউই জানতে পারেনি এবং এই লাশগুলাে এক ধরনের মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষ দূর থেকে এই ঘটনাগুলাে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সে সময়ে এই ছােট জেলা শহর রাজশাহীতে এটি ছিল একটি আলােচনার বিষয় এবং রাজশাহীর জনগণ ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে এই বিষয়গুলাে নিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু কখনাে তারা এর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। এরকম একটি জ্বলন্ত স্মৃতি নিয়েও কখনাে তা প্রকাশ করার সুযােগ পাননি। | অনুমান করা যায় সেই কবরগুলাে বিমানবাহিনীর সেই হতভাগ্য সৈনিকদের এগুলাে সশস্ত্রবাহিনীর সেই হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ হওয়ার একটি অনুমান আমাদের পক্ষে করা সম্ভব কারণ সে সময়ে সশস্ত্রবাহিনীর সৈনিকেরা সেই লাশগুলাে তাদের গাড়িতে করে বহন করে এনেছিলেন এবং অনেক স্থানে লাশগুলাের গায়ে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের ড্রেসও পরা ছিল।

আমরা আমাদের এই অনুসন্ধানের সময় প্রতিটি এলাকায় এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক লােকেরই সন্ধান পেয়েছি । এই টিকাপাড়া কবরস্থানে আমরা সন্ধান পেয়েছি সে সময়ে রাজশাহী প্রেসক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট চৌধুরী। খােরশেদ বিন আলম, আমরা সন্ধান পেয়েছি এখানে এলাকার মুরুব্বি জহুর হােসেন চৌধুরী, আমরা আরাে সন্ধান পেয়েছি সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আমজাদ বাঙ্গালী, আমরা আরাে সন্ধান পেয়েছি মুক্তিযােদ্ধা সংসদের বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আলহাজ্ব শরীফ উদ্দিন। আমরা তাদের মুখ থেকে শুনেছি, আমরা এখন তাদের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করবাে তারা কী দেখেছিলেন

চৌধুরী মাে. খুরশিদ বিন আলম (সাংবাদিক)

গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী কবরস্থান পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা টিকাপাড়া কবরস্থান, রাজশাহী আমি চৌধুরী মাে. খুরশিদ বিন আলম। আমি বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি রাজশাহী শাখার সাবেক সভাপতি এবং রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭৭ সালে অক্টোবর মাসে রাজশাহীতে ন্যাশনাল ফুটবল প্রতিযােগিতা হচ্ছিল। যে প্রতিযােগিতায় বিভিন্ন জেলা দল, সার্ভিসেস এবং বিশ্ববিদ্যালয় দল অংশগ্রহণ করে থাকে। আমার যতদূর মনে পড়ে তারিখটি ছিল

১৮ অক্টোবর ১৯৭৭ সাল। ১৮ অক্টোবর বিকেলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সেমিফাইনাল। আমরা স্টেডিয়ামের নিচে সকাল সাড়ে দশটার দিকে নেমে এসেছি। তখন সেনাবাহিনী টিমের একজন ক্যাপ্টেন যিনি টিমের ম্যানেজার ছিলেন তিনি ঐখানে এসে পৌঁছান। এসে ভারাক্রান্ত চেহারা নিয়ে বলেন আজকে সেনাবাহিনী খেলতে পারবে না, এই অপরাগতার জন্য আমরা খুব দুঃখিত। সবার মধ্যে আমাদের ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয় সেনাবাহিনী আজকে খেলতে রাজি হলাে না কেন, ব্যাপারটি কী? | এই টিকাপাড়া গােরস্থান, এটি রাজশাহীর । মেইন গেটের সামনে আমার বাড়ি। স্টেডিয়ামে রাত নয়টা পর্যন্ত পরদিনের খেলার প্রস্তুতির ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার পরে আমি রাজশাহী প্রেসক্লাবে যাই। তখন আমি রাজশাহী প্রেসক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ‘৭৭ সালে। রাজশাহী প্রেসক্লাব থেকে পৌনে বারােটা, বারােটার দিকে বের হয়ে এসে যখন আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার বাড়িতে আসি তখন সােয়া বারােটা থেকে সাড়ে বারােটা এরকম সময় হবে। বাড়ির সামনে দেখি সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক দাঁড়ানাে এবং সেনাবাহিনীর ট্রাকের চারপাশে পাঁচ-ছয়জন পাহারারত অবস্থায়। কিন্তু তাদের পােশাক সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা স্যান্ডােগেঞ্জি এবং সাদা কেডস। তখন সঙ্গে সঙ্গে আমার ঔৎসুক্য হয় তাহলে আমরা শুনেছি যে ২ অক্টোবর এবং বগুড়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তাদের ফাসির নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাহলে আজকে রাতেই কি সেই ফাসিগুলাে হচ্ছে? তার জন্য সেনাবাহিনী টেনশনে থকবে, খেলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, এইজন্য খেলা বন্ধ করা হলাে। এই মনে করে আমি একটু থমকে দাঁড়িয়েছি । দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে দেখি ঠিক এই যে কদমগাছটি (হাতে আঙ্গুল দিয়ে ইশারার সাহায্যে দেখিয়ে) দেখছেন, তখন এতবড় না, ছােট কদমগাছএই জায়গাটিতে ৩-৪টি হ্যাজাক এবং সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা স্যান্ডােগেঞ্জি পরা কিছু লােক এই জায়গায়টিতে কবর খুঁড়ছে। তখন থমকে দাঁড়াতে- যারা ট্রাকটি পাহারা দিচ্ছিল তারা বলে- আপনি দাঁড়ালেন কেন? আপনার বাড়ি কোথায়? আমি দেখালাম যে আমার বাড়ি এটি। তখন বলল যে আপনি বাড়িতে ঢুকে যান। আমি ঘরে ঢুকে একটি কাপড়ের কেডস, যেটি পায়ের অনেক উঁচু পর্যন্ত, সেই কেডসটি পরে নেই, স্যান্ডেল খুলে, প্যান্ট, শার্ট পরে গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে মাথা ঢেকে (দেখিয়ে) এই পাশের কাছাকাছি আসলাম। আমি কবরস্থানের পেছন দিক দিয়ে পুকুরের পাশ দিয়ে এসে অনেকটা কাছাকাছি প্রায় ২৫ গজের কাছে এসে ঝােপঝাড়ের কাছে চলে আসি। ওখান থেকে দেখি যে চারজন লােক কবর খুঁড়ছে, কোদাল দিয়ে। খুঁড়তে খুঁড়তে ফজরের আজানের একটু আগে দেখলাম কিছু ট্রাকের শব্দ। তারপরে দেখলাম সেনাবাহিনীর পােশাকে কিছু লােক কম্বলে জড়ানাে একেকটি লাশ কম্বলে জড়িয়ে পায়ের দিক ধরে একজন আরেকজন মাথার দিক ধরে নিয়ে আসছে। নিয়ে এসে ঐগুলাে কবরে ফেলছে। উপর থেকে

ফেলে দিচ্ছে। ফেলে দিয়ে সেগুলাে সরাসরি কোদাল দিয়ে কবরগুলাে মাটি দিয়ে ভরে দিচ্ছে। তখন আমি একজন একজন করে শুনেছি, লাশগুলাে যখন কবরে ফেলছে, আমি শুনেছি। মােট লাশ তারা নিয়ে এসেছে বারােটি। যখন আজান হলাে, আজান হওয়ার পর সকাল হয়ে এসেছে তাদের সব কাজ শেষ করতে, এরমধ্যে আজান হওয়ার সাথে নামাজ পড়ার জন্য অনেক মুরুব্বি বা যারা নিয়মিত ফজরের নামাজ পড়ে তারা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। সেখানে কিছু লােকের রাস্তায় জটলাও সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী তাদেরকে অনুরােধ করছে। আপনারা চলে যান। বারােটি কবর খুঁড়েছে, আটটি মাটি দিয়ে ঢাকা, আর চারটি পৌনে একহাতের মতাে, পুরাে একহাত হবে না কবর খোড়া। কিন্তু ওগুলাে বন্ধ ও করা হয়নি বা কোনাে লাশও নাই ।

জহুর হােসেন চৌধুরী

কবরস্থান পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা। টিকাপাড়া কবরস্থান, রাজশাহী কেবল নামাজ পড়ে এসে দেখি যে এখানে টানা কবর। তারপরে অনেক মানুষই তাে দেখেছে, টানা কবর। অনেক লােকই তাে ছুটে এসেছে। তখন তাে ঘেরাও ছিল না, খােলা ছিল। তখনতাে গােরস্থানে ঘেরাও ছিলনা, গাছ ছিল না।

আমজাদ বাঙ্গালী

সাবেক কমিশনার ২৫নং ওয়ার্ড টিকাপাড়া কবরস্থান, রাজশাহী। আমি আমজাদ বাঙ্গালী, ২৫নং ওয়ার্ডের এক্স কমিশনার, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। হাজী শরীফউদ্দিনসহ আমরা এখানকার হান আলী হক মাজারে অবস্থান করতাম। প্রতিদিনই রাত্রিতে আমরা এখানে অবস্থান করি। হঠাৎ করে একদিন দেখি গাড়ি আসল, আর্মির লােক এসেছে। এই সমস্ত জায়গাতে (হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে) কবর হচ্ছে। আমরা ওখানে যেহেতু নিরাপত্তার জন্য অবস্থান করছি, আমাদেরকে যাতে না দেখতে পায়। পরে বলত এটি যাতে প্রকাশ না হয়, লােককে যাতে না বলা হয়।

আলহাজ্ব শরীফ উদ্দিন

মুক্তিযােদ্ধা, ‘৭৭-এর গণকবরের প্রত্যক্ষদর্শী টিকাপাড়া কবরস্থান, রাজশাহী ১৯৭৭ সালে বগুড়ার ২২ বেঙ্গলে অভ্যুত্থান বা ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে আমি প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত হই। ঘটনার দিন রাজশাহীতে এই কবরস্থানে হান আলী হক দরগাহ, আমরা এই দরগাহ-তে প্রায় রাত্রিযাপন করতাম। অনেক বন্ধু-বান্ধব, | শুভানুধ্যায়ী, অনুসারী এবং এখানে একজন সার্বক্ষণিক খাদেম ছিলেন বাঙ্গালী আঞ্জু

নামে পরিচিত ছিলেন। এই বাঙ্গালী আসহ আমরা সেদিন রাতে বসে আমাদের ধর্মকর্ম নিয়ে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলােচনা করছিলাম। এই সময় হঠাৎ গাড়ির শব্দ এবং অতি উৎসাহী হয়ে বাঙ্গালী আঞ্জু তখন ঝােপঝাড়, জঙ্গল ছিল, এত গাছপালা ছিল না, ফাকা জায়গা ছিল। ঝােপঝাড়ের ভেতর দিয়ে সে পেছন দিক দিয়ে এগিয়ে গেল এবং বলল বসুন আপনারা আমি দেখে আসি কী হচ্ছে। এসে বলল ভাই ভাই-কী ব্যাপার? এখানে তাে বিরাট ঘটনা, আর্মির লােক, আর্মির গাড়ি । বললাম আপনারা যেয়েন না, আমরা দূর থেকে অবজার্ভ করি। তখন দেখলাম একেক কবরে বিভিন্ন লাশ ফেলল। এক ধরনের মাটি চাপা দেয়া বলে। প্রায় সারারাত পর্যন্ত তারা ছিল। ভােরের দিকে তারা উইথড্র হয়ে চলে যায়। আমরা তখন গিয়ে | দেখি কিছু কবর, গণকবরের মতাে। আমরা যে যার কর্মস্থলে ফিরে যাই। আমার কাছে, আমি তখনাে জানি না আমার প্রিয়তম বেঙ্গল ২২ বেঙ্গলের সদস্যরা এখানে এভাবে মাটির নিচে মাটিচাপা হচ্ছে। আরাে অনেকের সাথে সুবেদার চান মিয়া, বক্সার লালু- বক্সার লালু আমার সহযােদ্ধা ছিল একাত্তরে । বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সে যুদ্ধ করেছে। লালুর যুদ্ধ আমাদের সবার কাছে একটি কিংবদন্তি হয়েছে। এত দুঃসাহসী যােদ্ধা আমরা কখনাে দেখিনি। সেই লালুর লাশও এখানে আছে কিনা আমার বিবেক আজও আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি জানতে পারি না আমার প্রিয়তম সহযােদ্ধার লাশটিও কি এখানে আছে, আমার প্রিয়তম সুবেদার মেজর চাঁন মিয়াও এখানে আছে না অন্য হেতেম খাঁ, না মহিষবাথান, না গােরহাঙ্গা, না বগুড়ার কোনাে গণকবরে কোথায় দাফন হয়ে আছে এগুলাে আমরা আজও জানি না।

টিকাপাড়া কবরস্থানের সামনে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার

– আপনার নাম

কালু

আপনি সে সময়ে কী করতেন

আমি ছােট ছিলাম

আপনি কী দেখেছেন

আমি দেখেছি যে এখানে বহু কবর হয়েছে।

আপনি কীভাবে দেখেছেন

আমরা স্বচক্ষে দেখেছি

স্বচোখে এসে দেখেছেন?

স্বচোখে দেখেছি কী পরিমাণ লােক এসে দেখেছে।

বহুত, বহু শত শত মানুষ এসে দেখেছে?

-শত শত মানুষ দেখেছে

– (আরেকজনকে) আমি জানতে চাইব আপনার নাম

আবু বক্কর

আপনি কী করতেন

সে সময়ে আমি ব্যবসা করতাম

কিসের

জর্দার ব্যবসা

আপনি কী দেখেছিলেন সে সময়ে

বহু রাত্রিতে এখানে ২০-৩০টি গাড়ি । মিলিটারির গাড়ি, মিলিটারিরা কিছু মিলিটারি পােশাকধারী মরা, দেখলাম যে রক্ত, রক্ত পড়ছে, স্ট্রেচারে করে গােরস্থানে ঢােকাচ্ছে এবং গােরস্থানে পরেরদিন দেখলাম

যে সিরিয়াল কবর কেটে, ঐ কবরে লাশ দাফন করেছে, মেলা লাশ। তারা প্রত্যক্ষদর্শী এবং এখানকার বেশিরভাগ জনগণই এই ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী এবং এই ছােট জেলা রাজশাহীতে সে সময়ে এত বড় একটি আলােচিত ঘটনা ঘটেছিল এবং রাজশাহীর মানুষদের মুখে মুখে এই ঘটনাটি ফিরত অনেকদিন ধরেই। | এখনও জানে না সেই লাশগুলাে আসলে কাদের ছিল । কোন হতভাগ্য সৈনিকেরা এখানে সমাধিস্থ হয়েছে। সেই সমাধির পেছনে সেই হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে আনা হয়েছে না রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট থেকে আনা হয়েছে তারও কোনাে হদিস তারা জানে না। অনেকের ধারণা। লাশগুলাে রাজশাহী জেলখানায় হয়তােবা তাদের ফাসি হয়েছিল। আবার অনেকের ধারণা অনেক লাশ হয়তােবা বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকেই আনা হয়েছিল বা বগুড়া কারাগার থেকে আনা হয়েছিল। কারণ এতগুলাে লাশের যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেই ঘটনাটি এদেশের জনগণের কাছে একটি বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি এই রাজশাহীর সমস্ত এলাকায় সে সময়ে ব্যাপারটি এতদূর পর্যন্ত ঘটেছিল প্রত্যেকটি মানুষ সে সময়ে, কেউ বাদ ছিল না যারা ঘটনাটি শুনেনি এবং তারা বংশ পরিক্রমায় তাদের দাদাদের কাছ থেকে শুনেছেন, আর যারা জীবিত তারা প্রত্যেকে প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন এবং প্রত্যেকে এখনাে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তারা সে সময়ে গণকবরগুলাে দেখেছেন এবং সে সময়ের আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী আমরা এখন জানতে চেষ্টা করবাে, তিনিও দেখেছিলেন পরদিন সকালের এই কবরগুলাে। আমরা এখন তাকে জিগ্যেস করবাে

আপনার নাম। মাে, কফিল উদ্দিন আপনি কী করতেন সে সময়ে সে সময়ে আমি অফিসে যাচ্ছি ভাের ৬টায়

ভাের ৬টায়, অফিস ছিল কোথায়

সেরিকালচার অফিস, (হাত দিয়ে দেখিয়ে) আমি- এই গেট দিয়ে বের হচ্ছি আর কি

সেখানে আপনি কিসের চাকরি করতেন

আমি শ্রমিকের চাকরি করতাম।

আপনি পরদিন সকালে কী দেখেছিলেন

আমি এসে দেখছি এখানে সব ভিড়।

কী ব্যাপার! এসে ভেতর থেকে অফিসে না গিয়ে ঐখান দিয়ে বেরিয়ে দেখি ঐখানে শুধু কবর আর কবর।

ভােররাতে তারা এক কবরের উপর চারজন-পাঁচজন বা সিরিয়াল কর।

আলােচনা করছিল সে সময়ে সে সময়ে আলােচনা করছেন যে রাতারাতি তারা সেনাবাহিনী থেকে কবরগুলাে দেয়া হয়েছে বা গণকবর। রাতের বেলায় কবরগুলাে দেয়া হয়েছে। সে সময়ে মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে কী আলােচনা ছিল এখানে সেনাবাহিনী থেকে গণকবর দেয়া হয়েছে। এখানে তাদেরকে কবরস্থানে নিয়ে এসে ঢালাও কবর দেয়া হয়েছে। আমরা এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের থেকেই জানতে পেরেছি, তারা প্রত্যেকেই প্রায় কোনাে না কোনােভাবে কবরগুলাে দেখেছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে শুনেছেন। এই কবরগুলাে জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে ইতিহাসের কাছে, জাতির কাছে। রাজশাহীর জনগণের কাছে এখনাে প্রশ্ন, এত বছর পরেও তারা প্রশ্ন করছেন এখানে আসলে কারা এসেছেন। (স্ক্রিনে লেখা আমাদের অনুসন্ধানে রাজশাহীর মহিষবাথান, কুমিল্লার টিক্কারচর, বগুড়ার মাঝিড়াবাজার, ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানেও ১৯৭৭ সালের গণকবরের সন্ধান পেয়েছি। এছাড়াও অনেক লাশ হেলিকপ্টারে করে সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছিল) সেই সশস্ত্রবাহিনীর কোন এলাকার লােকেরা এখানে সমাধিস্থ হয়েছেন। এই লােকদের পিতৃপরিচয় কী ছিল? এই লােকদের নিবাস কোথায় ছিল? এই লােকেরা সত্যি সত্যিই কোনাে অপরাধের সাক্ষী ছিলেন, নাকি কোনাে একটি সাজানাে ঘটনায় তারা শিকার হয়ে এই নামজানাহীন অবস্থায় সমাধিস্থ হয়েছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন কেউই জানে , আসলে এরা কারা। কিন্তু এটি যে সশস্ত্রবাহিনীর লােকেরা দাফন করেছিলেন, সশস্ত্রবাহিনীর লােকেরাই এখানে সমাধিস্থ হয়েছেন এটি এখন দিবালােকের মতাে সত্য। কারণ সে সময়ে সশস্ত্রবাহিনীর লােকেরাই তাদের গাড়িতে করে লাশগুলাে নিয়ে এসেছিলেন। লাশগুলাে নিয়ে এসে সশস্ত্রবাহিনীর লােকেরা এখানে দাফন করেছে। সশস্ত্রবাহিনীর সেই হতভাগ্য সৈনিকদের পরিবার-পরিজনদের কাছে। একমাত্র একটি তদন্ত কমিশনই উদ্ঘাটন করতে পারে কোথায়, কে, কীভাবে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। কোথায় কে, কিভাবে মাটিচাপা পড়েছিলেন।

সূত্র : সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ – ১৯৮১ – আনোয়ার কবির