You dont have javascript enabled! Please enable it! সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা - ১৯৭৭ - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৭৭

২ অক্টোবর ১৯৭৭। সেদিন সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘটিত হয়েছিল একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। বলা হয়ে থাকে এ অভূত্থানে বিমান বাহিনীর সৈনিকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এর দুই দিন আগে ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাসে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান। আর এ অভ্যুত্থানের জের ধরে পরবর্তী দু’মাসে সশস্ত্র বাহিনীতে যা ঘটেছিল এককথায় আমরা বলতে পারি সারাবিশ্বে তা নজিরবিহীন। বিশ্বের আর কোথাও যুদ্ধকালীন অবস্থা ব্যতীত এর নজির পাওয়া যাবে না। এসময় বিলুপ্ত ঘােষণা করা হয় বগুড়ার ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনী ম্যাসকারেনহাস এ লিগেসি অব ব্লাড গ্রন্থে বলেছেন, যে, এসময় পরবর্তী দু’মাসে বাংলাদেশের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ১১৪৩ জন সৈনিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস’ শীর্ষক পুস্তিকায় এদিনের ঘটনাকে সারাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও বিমান বাহিনীর জন্য কালাে দিন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পুস্তিকাটিতে বলা হয়েছে। এসময় ৫৬১ জন বিমানসেনা প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশে সে সময়ে প্রায় সকল কারাগারেই গণফাসি দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশের প্রায় সকল প্রগতিশীল সংগঠনই তখন এর প্রতিবাদ করেছিলেন। অভিযােগ উঠেছিল প্রহসন ও কোনাে আইনকানুনের পরােয়া করেই নাম কা ওয়াস্তে বিচার ও ফাসির ঘটনাগুলাে ঘটানাে হচ্ছিল। ফাসি দেওয়া পরিবারগুলাে তাদের স্বজনদের বিচারের ঘটনা জানা তাে দূরে থাকুক ফাসি এবং এর পরে লাশেরও কোনাে হদিস পাননি। আমরা এখন সে সময়ে ফাসি হওয়া কয়েকটি পরিবারের সদস্য, জেলখাটা কয়েকজন সৈনিক, একটি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করবাে সে দিনগুলাে এবং সে ঘটনাগুলােকে ২ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে ব্যর্থ অভুথানের সময় ঢাকার কুর্মিটোলা এয়ারপাের্টে জাপানি রেড আর্মির হিদাকা কমান্ডাে ইউনিটের ৫ জন সদস্য ১৫৬ জন যাত্রীসহ জাপান এয়ার লাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করার পরই আবার ঢাকায় অবতরণে বাধ্য করে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলােচনা এবং সম্পূর্ণ ঘটনাটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় ঢাকা বিমানবন্দরে অভ্যুত্থানটি শুরু হয়।

কর্পোরাল খায়রুল আনােয়ার

১৯৭৭ সালের ঘটনায় ৮ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত আমি তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে জয়েন করি। ১৯৭৩ সালে আমাদেরকে রিপ্যাট্রিয়েশনে আনা হয়। তারপরে বাংলাদেশ এয়ারফোর্সে আমরা জয়েন করি। বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের বিএএফ জহুরুল হক বেস যেটি, অর্থাৎ চট্টগ্রাম বেস-এ আমার প্রথম পােস্টিং হয়। সেখানে ১৯৭৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমি কাজ করি। তারপরে আমাকে বিএএফ বেস বাশার-র ট্রান্সফার করে আনা হয়। ১৯৭৭-এ সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একটি জাপানি এয়ারক্রাফট হাইজ্যাক করে আনে জাপান রেড আর্মি গেরিলারা। সেখান থেকে আমাদের দুর্ভাগ্যের শুরু হয়। | পাঁচদিন বন্দি বিনিময় চলেছিল। ১ অক্টোবর রাতে (বন্দি বিনিময় যেদিন শেষ) আমরা টেলিভিশনে দেখে রাত ১২ টায় যখন নিজ নিজ ব্যারাকে ফিরি তারপরে ঘুমানাে ছাড়া আর বিশেষ কোনাে চিন্তা ছিল না। ঘুম ঠিক পুরাে করতে পারিনি, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাত সাড়ে তিনটা কি চারটা অব্দি ভীষণ গােলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। আমাদের ব্যারাক ছিল কুর্মিটোলাতে । আমরা মেস থেকে খাওয়া-দাওয়া করে, সেখানে রিক্রিয়্যাশন রুমে কিছু সময় কাটিয়ে রাত ১২ টার দিকে ব্যারাকে ফিরি। রাত সম্ভবত সাড়ে তিনটে কি চারটার সময়ে গােলাগুলির আওয়াজে আমাদের ঘুম ভাঙে। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছিল কিছু লােক। তাদেরকে চেনার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোনােভাবে চেনা যাচ্ছিল । বেশিরভাগ লােকই কালাে ইউনিফর্ম পরা ছিল, মাথায় কালাে ক্যাপ ছিল। আর বার বার বলছিল বেরিয়ে আস। লােকগুলাে খুব অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছিল। কী করব চিন্তা করে ঠিক করতে পারছিলাম না। এমন সময় সেই কালাে ইউনিফর্ম পরা একজন লােক এসে আমার রুমে ঢুকল। আমাকে তার রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করল। আমি নিচে পড়ে গেলাম। বলল তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে আস। বিপ্লব হয়ে গেছে। তখন প্রাণের ভয় ছিল। প্রাণ রক্ষা করাটাই ছিল একমাত্র কাজ। সে যে হুকুম দিল তাই তামিল করলাম।

বেরিয়ে আসলাম। সামনে গাড়ি দাঁড়ানাে ছিল। সেই গাড়িতে করে সৈনিকদের নিয়ে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছে, কী করতে হবে, কোনাে কিছুই জানি না। আমাদেরকে যে গাড়িগুলােতে করে সেগুলাে ছিল বিমানবাহিনীর এমটি স্কোয়াড্রনের বিভিন্ন ধরনের গাড়ি । ট্রাক, ৫৬ সিটার কোচ ছিল ইত্যাদি । আমাদের ক্যাম্পের পাশে ছিল আর্মি সিগন্যাল ইউনিট । আমাদের ক্যাম্পটিকে রেইড বা আক্রমণ করেছে। সিগন্যাল ইউনিটের লােকেরাই পরবর্তকিালে আমাদের কাছে এটি পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের যে গেটটি ছিল, সেটি খুবই অরক্ষিত ছিল। সেখানে প্রভােস্ট যারা ডিউটিরত অবস্থায় ছিল তারা আর্মিদেরকে বাধা দিচ্ছিল এবং আমাদের তৎকালীন চিফ অব এয়ার স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদের সাথে যােগাযােগ করছিল। টেলিফোনে বারবার আমরা কী করবাে, এভাবে অপরিচিত লােকজন, আর্মির লােকজন আমাদের ক্যাম্পে ঢুকছে, তাদের বলছে বিপ্লব হয়ে গেছে, বিপ্লবে যােগদান কর-তার আদেশ চেয়ে বারবার তার সাথে যােগাযােগ করছিল কিন্তু এজি মাহমুদ কোনাে সিদ্ধান্ত দেয়নি এবং বলেছিল যা ভালাে মনে। কর তাই কর- Donit disturb me, I am busy with the Imany important and national interested job. যাই হােক আমরা প্রাণের ভয়ে বের হলাম এবং গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে করে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলাে পুরনাে এয়ারপাের্টের কাছাকাছি আমাদের আরেকটি বেস বিএএফ বাশার মানে তেজগাঁও বেসে। বলে রাখা ভালাে আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। ১ অক্টোবর রাতে আমি সিক রিপাের্ট করেছিলাম অর্থাৎ ২ অক্টোবর সকালে আমার মেডিক্যাল স্কোয়াড্রনে যাওয়ার কথা। আমার পেটে তখন প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। এই অসুস্থাবস্থায় ওই গাড়ি থেকে নেমে আমি চলে আসলাম কুর্মিটোলা বেস-এর একটি স্কোয়াড্রন-এর কাছে- ওখানে একটি ক্যান্টিন ছিল। সেই ক্যান্টিনের পেছনে আমি বসে থাকলাম। তার পাশেই ছিল বেস আর্মরি অর্থাৎ অস্ত্রাগার ।

এই লােকগুলাে বেস আমারি ভেঙে কিছু অস্ত্র নিয়ে গেল আর আমাকে বলল এতে জয়েন করার জন্য। আমি বললাম আমি অসুস্থ, আমি কিছু জানি না। জাস্ট অপেক্ষা করছিলাম, কীভাবে আমি আবার আমার ব্যারাকে ফিরে যাব। এই অবস্থায় একজন লােক এসে খবর দিল, এয়ারপাের্টের ভেতরে কিছু অফিসারকে মেরে ফেলা হয়েছে। লােকজনের যে ছুটোছুটি-এটি এলােমেলাে ছুটোছুটি। কোনাে অর্গানাইজড ওয়েতে কেউ কিছু করছে না। সেখানে আমি খুব ব্যস্ত দেখেছিলাম আমাদের সার্জেন্ট আফসার ও তার কিছু পরিচিত লােকজন যাদেরকে তার সাথে কুর্মিটোলা ক্যাম্পে দেখতাম। এরা খুব ব্যস্ত ছিল। এর ভেতরে কয়েকজন আর্মিকে দেখেছি দৌড়াদৌড়ি করতে। এরপর দেখতে পেলাম তকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন আজমসহ কয়েকজন অফিসারকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। ধরে নিয়ে। এসে তাদেরকে লাইনে দাঁড় করানাে হলাে। দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ফায়ার করবে। অর্থাৎ তাদেরকে মেরে ফেলবে-এটি কমা দিচ্ছে সার্জেন্ট আফসার। গান যখন তাক করা হলাে এমন সময় কর্পোরাল আজাদ (আমাদেরই এয়ারফোর্সের কর্পোরাল আজাদ, বাড়ি বরিশাল) সামনে এসে দাঁড়াল। সামনে দাড়িয়ে বলল, এদেরকে মারার আগে আমাকে মেরে ফেল। তারপরে তাদেরকে মার। কারণ তারা জানিস যে এই অভ্যুত্থান কোনাে অভ্যুত্থান না, এটি একটি ষড়যন্ত্র, তােরা নিজেরা নিজেদের লােককে মারার জন্যই এটি করা হচ্ছে। এসব করে এদেরকে ছেড়ে দে অথবা এদেরকে হােস্টেজ হিসেবে রেখে ব্যারাকে ফিরে যা, পরবর্তীকালে নেগােসিয়েশন করা যাবে। এই কথাটি আফসারের কাছে মনে হলাে যেন গ্রহণযােগ্য হয়েছে।

তখন এদেরকে একটি খােলা ট্রাকে উঠিয়ে দিল। আমি জিগ্যেস করলাম ট্রাকটি কোথায় যাবে? বলল এটি কুর্মিটোলা ক্যাম্পে ফিরে যাবে। আমি কুর্মিটোলা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়লাম। অফিসারদের সামনে বসানাে হলাে, পেছনে আরাে বেশকিছু এয়ারম্যানসহ আমি ওই গাড়িতে ছিলাম । গাড়ি চলে গেল ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে অর্থাৎ সিগন্যাল স্কোয়াড্রনের ভেতর দিয়ে, আর্মি সিগন্যাল ইউনিট যেটি, এটির ভেতর দিয়ে আমাদের তেজগাঁও মেসের সামনে নামিয়ে দেয়। আর অফিসারেরা অন্যদিকে চলে গেল। আমি মেসে গেলাম। মেস থেকে ব্রেকফাস্ট করে ব্যারাকে ফিরে আসলাম। ফিরে আসার পরে লােকজনকে জিগ্যেস করে, অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের জিগ্যেস করলে সবাই একই কথা বলছে এটি কী করে হলাে? কে ঘটাল এবং কেন ঘটাল? কেউ কোনাে উত্তর দিতে পারছিল না। তৎকালীন কর্পোরাল এ.বি.সিদ্দিক (উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছিলেন, তারপরে এলএলবি করেছেন, বেশ ভালাে লেখাপড়া করেছেন) এর সাথে পরামর্শ করলাম কী হতে পারে। তিনি বললেন কী আর হবে? এখানে এক ধরনের মিউটিনির মতাে হয়েছে। এখানে বিচার হবে। বিচারে সরাসরি যারা জড়িত সর্বোচ্চ তাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, আর যারা সরাসরি জড়িত নয় তাদেরকে সর্বোচ্চ চাকরি থেকে বের করে দেয়া হবে। যারা এই কাজের সাথে জড়িত ছিল তারা কিন্তু পালিয়ে গেছে। আর যারা জড়িত ছিল না তারা আমার মতাে মনে করেছে আর কী হবে? আমাকে হয়তাে চাকরি থেকে বিদায় করে দেবে। আমরা থেকে গেলাম। পরেরদিন সকালবেলা অর্থাৎ ২ অক্টোবর ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আমাদেরকে কুর্মিটোলা খেলার মাঠে ডাকল। প্রভােস্ট গেটের সামনে খেলার মাঠে। লিভিং ইন এবং লিভিং আউট যত এয়ারম্যান আছে সবাইকে ডাকল। আমরা সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। অঝােরে বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রায় ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে তকালীন এয়ার চিফ এজি মাহমুদ আর্মি স্কোয়াড্রেড হয়ে আমাদের সামনে এলেন। এসে শুরুতেই আমাদেরকে বাস্টার্ড বলে সম্বােধন করলেন। অর্থাৎ আমরা সব বেজন্মা। এই বলে সম্বােধন করে ১ ঘন্টা বক্তব্য দিলেন। ১ ঘন্টা আমাদের গালিগালাজ করলেন।

কারণ আগের রাতে যে এগারােজন অফিসার মারা গেছেন তারমধ্যে একজন তার ভগ্নিপতি ছিলেন, এজন্য তিনি বেশি অসন্তুষ্ট। তিনি এটিও বললেন তােমরা এগারােজনকে মেরেছ, ১১ ফ্যামিলির কান্না শুনেছ এবার এগারােশ’ জন প্রস্তুত হয়ে যাও তার মূল্য দিতে। (ফুটেজে ছবি দেখিয়ে এজি মাহমুদ বলেন, দিস ইজ রাস মাসুদ, হি ইজ মাই ব্রাদার ইন ল)। এই কথাগুলাে পরিষ্কারভাবে আমাদের বললেন। তারপর বলে গেলেন এই ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার কোনাে চেষ্টা কর না। চেষ্টা করলে তােমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলা হবে। আমাদের চারদিকে আর্মি ঘেরাও করে রেখেছে। আমরা যাতে কোনাে অবস্থাতে ক্যাম্প থেকে বের না হই। তিনি পুরাে এয়ারফোর্সটিকে আর্মিদের হাতে তুলে দিলেন। এয়ারফোর্সের কুর্মিটোলা ক্যাম্প চলে গেল আর্মির একজন নায়েক সুবেদারের হাতে। তার কন্ট্রোলে আমরা এখন চলাফেরা করতে লাগলাম। আমাদের ব্যারাকের সামনে তারা ট্যাঙ্ক এবং কামান বসিয়েছে, আমাদের দিকে তারা ভীষণ সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। তাদের কাছে রিপাের্ট আছে আমাদের কাছে ভালাে অস্ত্রশস্ত্র আছে, আমরা যে কোনাে সময় রিএ্যাক্ট করতে পারি । আমাদেরকে চারদিন পর্যন্ত পাহারা দিয়ে তারা যখন দেখল কিছু না, আমরা মেসে। যাচ্ছি, মেস থেকে খেয়ে ব্যারাকে ফিরছি, গানবাজনা করছি, হৈ-হট্টগোল করছিতখন এক রাতে সমস্ত ব্যারাকের চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখল কোথাও কিছু বসানাে আছে কি না। ব্যারাকের বাইরে কিছু নেই। তারপরে ব্যারাকের ভেতরে চেক করল। দেখল ব্যারাকের ভেতরে আমাদের জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। কুর্মিটোলা ক্যান্টিনের সামনে একটি খােলা ময়দান ছিল, সকালে আমাদেরকে তারা সেখানে ডেকে নিয়ে যেত। ময়দানে সারাদিন বসিয়ে রেখে বিকেলে ব্যারাকে ফেরত দিত।

এরমধ্যে তারা শুরু করল একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে লাগিয়ে দেওয়া। একজনকে ডেকে নিয়ে বলল তােমাকে ছেড়ে দেয়া হবে তুমি কিছু লােকের নাম বল- কে কে এই কাজে গেছে। এটিতে তেমন একটি কাজ হচ্ছিল না। তারপরে স্লিপ দেয়া শুরু করল। যেমন- আনােয়ার। এখানে কতজন আনােয়ার আছে যেমন- খায়রুল আনােয়ার, আনােয়ার হােসেন, আনােয়ারুল ইসলাম, আনােয়ারুজ্জামান, মাে. আনােয়ার যত আনােয়ার আছে সকলকে বের কর। এভাবে একেকদিন একশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরজন বের করে গাড়িতে ভরে নিয়ে যেত। এভাবে পাঁচদিন যাওয়ার পর আমাকে বের করল। আমার সাথে আরাে পাঁচজন আনােয়ার ছিল, মােট ছয়জন আনােয়ার বের হই। এভাবে অন্যান্য লােকও ছিল। আমাদেরকে নিয়ে বর্তমানে সংসদ ভবনের যে। কমিউনিটি সেন্টার সেখানে ঢােকানাে হলাে। ১০ ফিট বাই ১০ ফিট একটি রুম। যেখানে সর্বোচ্চ দশজন লােক রাখা যেতে পারে সেখানে ৩০ জন, ৪০ জন করে। রেখে তালা বন্ধ করে দিল। বলল এর মধ্যে থাক। কোনাে কথাবার্তা বলবে না, নড়াচড়ার চেষ্টা করবে না। এভাবে এখানে দিন কাটাতে লাগলাম। খাবার সময়। যখন হত- সকালে নাস্তার সময়, দুপুরে খাওয়ার সময়, রাতে খাওয়ার সময় ঠিক ঐসময়টিতে আমাদের লােকজনকে ডেকে উপরে নিয়ে নির্যাতন করত, টর্চার করত তাদের আর্তনাদ, চিৎকার আমাদের কানে আসত। আমাদের হাত থেকে খাবার পড়ে যেত। আমরা খেতে পারতাম না। এভাবে ঐখানে ২০ দিন কাটল। ২০ দিন পরে ঐখানে ১২৫ জন লােক রেখে বাকি এয়ারফোর্সের সকল লােকজনকে বলল, You are all honourably accuited. অর্থাৎ আমাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হলাে, আমাদের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ পাওয়া যায়নি। আর বাকি ১২৫ জন যারা থাকল তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ এখনাে আছে, সেগুলাের তদন্ত চলছে। সত্যিকারে তারা দোষী কি না।

এটি তদন্ত করে তাদেরকে বের করে দেয়া হবে। আমরা চলে আসলাম। এয়ারফোর্স থেকে ৪টি ৫৬ সিটার কোচ গেল। ওই কোচে আমরা উঠলাম। ঠিক ব্যারাকে আসার আগে আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পাশে ১নং প্রভােস্ট স্কোয়াড্রন নামে, ড্রাম ফ্যাক্টরির সাথে এয়ারফোর্সের একটি অফিস আছে, সেখানে নিয়ে আসল। ঐখানে নিয়ে এসে রােদের মধ্যে ঐ গাড়িগুলােতেই লক করে রেখে দিল। ঐখানে এভাবে সারাদিন থেকে গেলাম। সন্ধ্যার সময় আবার গাড়ি চলল। গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে পৌছল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে আমাদের জামা-কাপড় রেখে এক টুকরাে সাদা কাপড় দিয়ে ভেতরে ঢােকানাে হলাে। জেলখানায় আমাদেরকে যে বিল্ডিংগুলােতে নিয়ে রাখল-সেখানে দেখলাম আগে থেকে অনেক এয়ারম্যান, অনেক আর্মির সদস্য পড়ে আছেন। কারাে সাজা হয়ে গেছে, কেউ আছে সাজার অপেক্ষায়। যাদের সাজা হয়ে গেছে তাদের কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। ওদের ওপর এমন টর্চার করা হয়েছিল, টর্চারে তাদের চেহারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। ওরা নড়াচড়াও করতে পারছিল না। ওদের মধ্যে একজনের নাম আমি বলতে পারি- সে হলাে কর্পোরাল আজম। সে ইংরেজিতে অনার্স করেছিল। কর্পোরাল আজমের বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযােগ ছিল সে মার্শাল ল কোর্টে ইংরেজিতে কথা বলেছিল। সেজন্য তাকে টর্চার করে দুই বছরের সাজা দিয়ে জেলখানায় পাঠাল। কিন্তু তার দুই বছরের সাজা আর খাটা হয়নি। যেদিন জেলখানায় পাঠাল সেরাতেই জেল হাসপাতালে সে মারা গেল। আমি যখন জেলখানায় তাকে দেখলাম তখন তার শরীর থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। অনেক চিৎকার করে জেলখানায় ডিউটিরত লােকদের ডেকে বললাম তাকে হাসপাতালে নাও। ওরা তাকে রাতে হাসপাতালে নিল। সকালবেলা শুনলাম সে মারা গেছে। তারপর আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন কার ডাক আসবে। জেলখানায় যখন রাত হয় তখন মনে হয় আমাদের ওপর নতুন গজব নেমে আসে। রাত ১২টার পরে চিরকুট নিয়ে জেলখানার কয়েদিরা আসে-ডাকার জন্য।

একজনের নাম ধরে ডাক দিল। সে সামনে গিয়ে জবাব দিল কী হয়েছে? আপনার দেখা এসেছে। রাত ১২টার পরে কী করে দেখা আসে? সে বের হতে চায় না। তাকে জোর করে বের করে নিয়ে যায়। সে আর ফেরত আসে না। তার মানে তাকে নিয়ে গিয়ে ফাসি দিয়ে দিল। তার দেখা ঐখানেই শেষ । এরকম একটি ঘটনা বলতে পারি। আমাদের এখানে একজন ছিলেন কর্পোরাল আকবর। কর্পোরাল আকবরের দুই বছরের সাজা হয়েছিল, আর আর্মির একই নামের এক সিপাহির মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। সে রাতে আর্মির আকবরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা। সে কনডেম সেলে বসে অন্যান্য লােকের সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় মশগুল ছিল। তাই তারা যখন তার নাম ধরে ডেকেছিল সে হয়তাে শুনেনি। তাই সে রেসপন্স করেনি। যারা ফাসি দিচ্ছিল তাদের রাতের মধ্যে যাদেরকে ফাঁসি দিচ্ছিল তাদেরকে তাে একত্রিত করতে হবে। তারপরে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। তাই তারা কোনাে একটি জায়গায় বেশিক্ষণ অপেক্ষা করছিল না। আমাদের এখানে এসে যখন ওরা আকবর বলে ডাক দিয়েছে আমাদের এখানের আকবর জবাব দিয়েছে। তাকে তারা ধরে নিয়ে গেল। সে বার বার বলছিল আমার দুই বছরের সাজা হয়েছে, জেলগেটে আমাকে সাজা পড়ে শুনানাে হয়েছে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। তারা তার কথার কোনাে তােয়াক্কা না করে তাকে শেষ গােসল করিয়ে যমটুপি পরিয়ে ফাসির স্টেজে নিয়ে গেলে। তার গলায় ফাসির রশি পড়িয়ে দিল। শেষ কথা হিসেবে সে বলল ঠিক আছে আপনারা আমাকে ফাসি দিচ্ছেন দেন, আমার কোনাে কথা শুনছেন না, আমার বাবার নাম, কোথায় চাকরি করি তাও শুনছেন না। তবে নাম্বার আছে। এয়ারফোর্সের নাম্বার আর আর্মির নাম্বারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। এয়ারফোর্সের নাম্বার ৭ ডিজিট, ৮ ডিজিট সর্বোচ্চ ৯ ডিজিট পর্যন্ত হয়। কিন্তু আর্মির নাম্বার অনেক বেশি। ১২, ১৩, ১৪ ডিজিট পর্যন্ত আছে। তখন উপস্থিত জেলার বলল ঠিক আছে তােমার নাম্বার বলাে। সে তার নাম্বার বলল-৬ ডিজিটের একটি নাম্বার।

সেই নাম্বারটি যখন জেলার তার লিস্টের সাথে মেলালাে তখন দেখল মিলে না। তখন জেলার তাকে ধাক্কা মেরে স্টেজ থেকে নামিয়ে ফেলে। নামিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এই যে আকবর নামে একটি লােক সেদিন ফাসি থেকে বেঁচে গেল সে হিসেব জেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ তিন মাস মেলাতে পারেনি। তিনমাস পরে সেটি মিলিয়েছে। এরপরে আমার কী হলাে? আমি পাঁচদিন জেলখানায় অপেক্ষা করলাম- আন্ডার ট্রায়াল হিসেবে। পাঁচদিন পরে আরাে ২০ জন এয়ারফোর্সের লােক নিয়ে আমিসহ ২১ জনকে নিয়ে গেল আবার সেই ১নং প্রভাস্ট স্কোয়াড্রনে। এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। দুই ঘণ্টা পরে আমাদেরকে বলল গায়ের গেঞ্জি খুলে। নিজেরা নিজেদের চোখ বাঁধতে। আমাদের পরনে ছিল জেলখানার সাদা ধুতিটি বাঁধলাম।

এভাবে ব্লাইন্ড ফোন্ডেড অবস্থায় কোথায় নিয়ে গেল আমরা জানি না। তবে অনুমান করি ইব্রাহিমপুরের কোনাে একটি জায়গায়—যেখানে টর্চারগুলাে করা হত। সেখানে নিয়ে শুরু করে দিল নির্যাতন। যারা নির্যাতন করছিল তারাও এয়ারফোর্সের লােকই। তারা সবসময় মদ খেয়ে মাতাল থাকত। একেক জনকে একেক ভাষায় গালিগালাজ করত। টর্চার যে কত প্রকারের হতে পারে তা তাদের কাছে গেলে শেখা যাবে। যতভাবে সম্ভব ততভাবেই তারা টর্চার করেছে। ইলেকট্রিক শক, লাঠিপেটা, কিল, ঘুষি, থাপ্পড় সকল রকমের টর্চারই করেছ। এভাবে চোখ বাঁধাবস্থায় এখানে আমাকে রাখা হলাে পাঁচদিন । এই পাঁচদিন চোখ বাধাবস্থায় কখন দিন হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে এটি একমাত্র পাখির ডাক এবং আজানের আওয়াজে অনুমান করতাম। ভােরের আজান শুনে বুঝতাম ভাের হচ্ছে, পাখির ডাক শুনে বুঝতাম ভাের হচ্ছে, রাত কখন হচ্ছে সহজে বুঝতে পারতাম। না। নামাজ পড়েছি ওই বসাবস্থায়, অযু করতে চাইলে দিত না, অযু করা যাবে।

 মুখ ধােয়া যাবে না, কুলি করা যাবে না। ঐ অবস্থায় খাবার দিত। কী খাবার দিচ্ছে? কীভাবে খাব? হাত পেছনে বাঁধা থাকত। খাওয়ার সময় হাতটি খুলে দিয়ে দাড়িয়ে থাকত। খাওয়া হলে আবার পেছনে বেঁধে দিত। এভাবে আমাদের সময়গুলাে কাটল। একদিন আমার হাতে একটি কাগজ এবং কলম দিল। চোখ বাধাবস্থাতেই বলল এখানে সিগনেচার কর। যখন জিগ্যেস করলাম কী লেখা আছে, স্যার আমি কি জানতে পারি? তার প্রতি উত্তরে পেলাম একটি ভয়াবহ চড়। সে চড় খেয়ে আমার একটি কান ভারী হয়ে গেছে। এখনাে এটি সারেনি, জীবনে আর কখনাে সারবে না। বলল তােকে সই করতে বলেছি, তুই সই কর। এর বেশি আর কিছু না। সই করে দিলাম। তারপর আমার সঙ্গে আরাে কিছু লােককে নিয়ে সবার হাত-পা বেঁধে ১নং প্রভােস্ট স্কোয়াড্রনে নিয়ে আসল। এখানে ৩১নং স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসেছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার এস.ইউ খান- সাবের উদ্দিন খান। উনার বাড়ি সিলেট। এই সাবের উদ্দিন খানের এখানেই আমাদের বিচার প্রহসনটি হলাে। আমাদের ব্যাচে যেদিন বিচার হলো সেদিন সম্ভবত আমরা ছিলাম কুড়িজন। আমার ঠিক সংখ্যাটি মনে নেই। একজন একজন করে নিচ্ছে। প্রতিজনের জন্য এক থেকে দুই মিনিট সময় ব্যয় করছে। তারপর আমার সময় আসল। আমার শরীর চাদর দিয়ে মােড়ানাে। কেননা শরীরে টর্চারের চিহ্ন রয়েছে। তারপর পেছনে হাত বাঁধা, চোখ বাধা। সেখানে নিয়ে শুধু চোখের বাঁধনটি খুলে দিল। চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে সাবের উদ্দিন সাহেব বললেন তােমার বিরুদ্ধে অভিযােগ তুমি মিউটিনিতে অংশগ্রহণ করেছ। তােমার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। আমি বললাম আমি মিউটিনিতে অংশগ্রহণ করিনি। আমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না, যদি হয় তবে এটি হবে সম্পূর্ণরূপে অন্যায়। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন তুমি যে মিউটিনিতে অংশগ্রহণ করনি তার কোনাে সাক্ষী আছে কি না। আমি উনাকে বলেছিলাম আমি যে মিউটিনিতে অংশগ্রহণ করেছি তারও তাে কোনাে সাক্ষী নেই। তাহলে! আমি মিউটিনিতে অংশগ্রহণ করিনি, আর মিউটিনি কি আমি জানি না, আমি বুঝি না। এছাড়া ঢাকায় আমি সম্পূর্ণরূপে নতুন। তিনি একথাগুলাের কোনাে কিছুই বিশ্বাস। করলেন না। উনার ইচ্ছেমতাে লিখে দিয়ে চলে গেলেন। এরপর আমাকে সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

আমিই মনে হয় একটু বেশি সময় নিয়েছিলাম। তিন কি চার মিনিট হবে। এছাড়া বাকি সবাইকে এক থেকে দুই মিনিট-এ বিচার প্রহসন করে আবার চোখ হাত-পা বেঁধে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেল । ঢাকা। সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে আমাদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করল। একগ্রুপ চলে গেল কনডেম সেলে। অর্থাৎ তাদের ফাসির রায় হয়েছে। আরেক গ্রুপ, সে গ্রুপে আমি ছিলাম। আমাদেরকে নিয়ে গেল অন্য একটি জায়গায় যেটিকে বলা। হয় ৪নং বিল্ডিং। জেলখানার ভাষায় চার খাতা। চার খাতায় গিয়ে আমরা উঠলাম। সেখানে থাকলাম। কী রায় হয়েছে জানি না। কত বছর জেল হয়েছে। তাও জানি না। প্রায় এক মাস পরে জানতে পারলাম, যখন মার্শাল ল কোর্ট ডিজলভ করে দেয়া হলাে, তারপরে সাবের উদ্দিন সাহেব আমাদের সাজা শােনালেন। বললেন আমার আট বছর সাজা হয়েছে। আমাকে সম্ভবত অক্টোবরের ২৯ তারিখে সাজা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেদিন থেকে আমি ১৯৮১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল খাটি। সে সময়ে নির্দোষ লােকজনকে যে ফাসি দেয়া হয়েছে তার প্রমাণ দু-চারটি আমি দিই । কর্পোরাল আরজু তখন বিমানবাহিনীর চিফ অব এয়ার স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদের বডিগার্ড বা তার সেফটি অফিসার হিসেবে ডিউটিতে ছিল। অবস্থা যখন বেসামাল হয়ে গিয়েছিল তখন কর্পোরাল আরজু নিজেই তাকে একটি সেফ জায়গা-পুরাতন বিমানবন্দর অর্থাৎ কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের যে বাউন্ডারি ওয়াল আছে, বাউন্ডারি ওয়ালটি পার করে পশ্চিম দিকে দিয়ে দিয়েছে। বলেছে আপনি এখন চলে যান স্যার। আপনি এখন নিরাপদ। ওই কর্পোরাল আরজুর পরবর্তীকালে কি করে ফাসি হয়? সে শেষ পর্যন্ত বলেছে আমাকে ফাঁসি দেয়ার আগে অন্তত এজি মাহমুদকে জিগ্যেস করুন আমি উনাকে এয়ারপাের্টের সীমানা পার করে দিয়ে এসেছিলাম কি না- যখন ঘাতকেরা আসছিল তাকে মারার জন্য। তাহলে আমাকে কেন ফাসি দিচ্ছেন? উনাকে জিগ্যেস করুন। তারা জিগ্যেস করার প্রয়ােজন মনে করেনি। 

টর্চারের আরাে কিছু বর্ণনা আপনাদেরকে দিই। একদিন দেখলাম কর্পোরাল আসাদকে ধরে নিয়ে এসেছে। আমার তাে চোখ বাঁধা কর্পোরাল আসাদকে আনছে, ওরা বলাবলি করছে, আমি শুনছি যে কর্পোরাল আসাদকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে, ওখানে কর্পোরাল আসাদকে ধরে নিয়ে এসেছে। Yes he is captured. খুব হাস্যকরভাবে তাকে ওয়েলকাম জানাল। পিটানাে শুরু করল ঐখান থেকেই। পিটাতে পিটাতে- ওরে বাবারে, বাবারে, বাবারে, বাবারে বলতে বলতে হঠাৎ করে শুনি তার আর কোনাে আওয়াজ নেই। কী হলাে? কেউ বলছে শালা বােধহয় মরেই গেছে। আবার কেউ বলছে না, মরার ভান করছে। তখন আরাে পিটাল। এভাবে কয়েকবার পেটানাের পরে যখন দেখলাে আর কোনাে আওয়াজ নেই তখন তারা নিশ্চিত হলাে কর্পোরাল আসাদ মারা গেছে। তখন তাকে ফেলে দিল । তাে, আরেকজনকে নিয়ে আসল, কর্পোরাল লতিফ । কর্পোরাল লতিফের ভয়েস শুনলে সবাই বুঝতে পারত এটি লতিফের ভয়েস। ওরে যখন পেটানাে আরম্ভ করল- তার চিৎকারে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম যে এটি লতিফ। (এমনিতে আমরা সবাই উলঙ্গ ছিলাম। শুধু জাঙ্গিয়া পরা ছিলাম। এছাড়া আমাদের গায়ে আর কিছুই ছিল না।) পেটাতে পেটাতে শেষ মুহূর্তে আমগাছের একটি ডাল (যেটি দিয়ে আগে অন্য কাউকে পেটানাে হয়েছিল) ওর পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হলাে। ঢুকিয়ে দিয়ে যখন মােচড়ানাে দিয়েছে তখন বাবাগাে বলে আর কোনাে আওয়াজ তার পাওয়া যায়নি। কর্পোরাল লতিফ সেখানেই মারা গেছে। এই দু’জনের মৃত্যু সম্পর্কে (আমি ওখানে যে চার-পাঁচদিন ছিলাম) জানি। টর্চার করে ওরা যে মেরে ফেলেছে সে সম্বন্ধে এটি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। | জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৭৭ সালে হ্যা, না ভােট করেছিল। হ্যা, না ভােটে যদি না ভােট কোথাও পেয়ে থাকেন সেটি ছিল বিমানবাহিনী। ক্যাম্প কুর্মিটোলা। কেননা কুর্মিটোলা ক্যাম্পে যারা বসবাস করত তারা সবাই ছিল বিমানবাহিনীর সদস্য। এরা সকলেই শিক্ষিত, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পার। করে এসেছে। এরা কখনাে চায়নি মিলিটারি দেশ শাসন করুক।

সত্যিকার অর্থে ঐদিন ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২ অক্টোবর যে ঘটনাটি ঘটেছিল এই ঘটনাটি আজও জাতি জানে না, আমরাও জানি। না। আমার প্রশ্ন সেদিন কী ঘটেছিল আমরাও জানতে চাই। এখন আমি যতই বলি আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল- কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কেননা আমি জেল খেটেছি। আমার জেল হয়েছে। বিনাদোষে কেউ কোনােদিন জেল খাটে না, এটি সাধারণভাবে মানুষ বলে। কিন্তু বিনাদোষে যে মানুষ জেলখাটে তার প্রমাণ হচ্ছি আমি নিজে। এখন জাতির কাছে, সমগ্র বিশ্বের কাছে, সমগ্র মানবসমাজের কাছে আমার একটিই দাবি সেটি হচ্ছে সেদিন কী হয়েছিল আমরা জানতে চাই। আমাদের আর কোনাে কিছু পাওয়ারও নেই, আর কোনাে কিছু চাওয়াও নেই।

নিখোজ কর্পোরাল আবদুল ওয়াদুদ

বিডি : ৪৪০৬৯৪, নােয়াখালী

এডভােকেট দেওয়ান আবদুর রহিম।

নিখোঁজ কর্পোরাল আবদুল ওয়াদুদ-এর ভাই। ১৯৭০-এ আমার বড় ভাই মাে. আবদুল ওয়াদুদ এয়ারফোর্সে জয়েন করেন। ট্রেনিংয়ের জন্য তিনি পাকিস্তান যান। তার নাম্বার বিডি-৪৪০৬৯৪। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে আসলেন। তখন উনার বয়স মাত্র ২৬ বছর। বিয়ে করেননি। ১৪ আগস্ট বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হলাে। আমার বড় বােন ভাড়া থাকেন ঢাকার নাখালপাড়ার জনাব সুজায়েত উল্লাহ সাহেবের বাড়িতে। ১ অক্টোবর। ১৯৭৭ সালে উনার বিয়ের জন্য যে পাত্রী দেখা হলাে, বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করা হলাে, সেজন্য তিনি শপিংয়ে গেলেন। শপিং সেরে বােনকে দেখালেন। রাত সাড়ে ৮টা পৌনে নয়টা পর্যন্ত তিনি থাকলেন সেখানে। খাওয়া-দাওয়া করলেন। তারপরে তিনি ঐখান থেকে চলে গেলেন। এই যাওয়াই উনার স্বজনদের কাছ থেকে শেষ যাওয়া। উনি আর কখনাে স্বজনদের কাছে ফিরে আসতে পারেননি। এরপরে কী ঘটনা, উনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন এবং উনার অবস্থা কী আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে আমাদেরকে কিছুই জানানাে হয়নি এবং আমরা কিছুই জানি না। যতটুকু জানি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রায় ২৭০০ কর্মী সে রাত থেকে নিখোঁজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন সরকারের কাছে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছি আমার ভাইয়ের সন্ধান চেয়ে কোথায় আছেন এবং কীভাবে আছেন আমাদেরকে জানানাে হােক। আমার সেই চিঠির কোনাে উত্তর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বা সামরিক শাসকের কাছ থেকে আমি পাইনি। তারপরে বিমানবাহিনীর প্রধানের কাছেও লেখা হয়েছে একই নিয়মে চিঠি। সেটিরও কোনাে উত্তর পাইনি। পাঁচ-ছয় মাস পরে দুই লাইনের ইংরেজিতে লেখা একখানা চিঠি আমাদের হাতে আসে। সেখানে শুধু এটুকু Gut 1601 Abdul wadud, BD-440694 he was missed on 2nd October 1977. কেন missed, কীভাবে missed, কি অপরাধে missed এ সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানানাে হয়নি।

আমার জানার অধিকার আছে আমার ভাই কোথায় আছে। আমার জানার অধিকার আছে আমার বাপ কোথায় আছে। আর আমার ভাই একজন He is not an ordinary person, He was an Airman, সে সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকে। সরকারি, গভর্নমেন্ট জব করে। যদি গভর্নমেন্ট না জানে সে কোথায় আছে, কীভাবে আছে তাহলে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাব। আমরা গভর্নমেন্টের কাছে জানতে চেয়েছি, গভর্নমেন্ট আমাদের জানায়নি। এই যে একটি লােক সরকারের তত্ত্বাবধানে চাকরিরত অবস্থায় ছিল এখন আমাদের বলা হচ্ছে He was missed. তাহলে আমার জিজ্ঞাস্য এখানে যদি যে একটি গভর্নমেন্টের সার্ভিস হােল্ডার আর সেই গভর্নমেন্ট যদি বলে He was missed. Without any cause. এর পেছনে কোনাে যুক্তি নেই এবং এর পেছনে তিনি কোনাে প্রকার সিভিল অর ক্রিমিনাল অফেন্স তৈরি করেননি। তিনি কোনাে প্রকার অপরাধ করেননি। সরকার বলছে He was missed. এ কথার অর্থ কী? কেন He was missed? যদি He was missed হয় তাহলে আমি কার কাছে জানতে চাইবাে সে কেন missed হলাে? কে তাকে missed করল? আমার এসকল প্রশ্নের উত্তর কে দেবে। আমার এ সকল প্রশ্নের উত্তর যদি গভর্নমেন্ট না দেয় 61909 Government fail to proper his duty.

মিসেস হােসনে আরা বেগম

নিখোজ কর্পোরাল আবদুল ওয়াদুদ-এর বােন আমার ভাই আসছে, খাওয়া-দাওয়া করছে আমার কাছে (আমার ভাই এসেছিল, খাওয়া-দাওয়া করেছিল আমার কাছে)। ওর অসুখ ছিল, ঘাড়ে ব্যথা ছিল, ঘাড়টা বাঁকা হইয়া রইছে (অসুস্থ ছিল, ঘাড়ে ব্যথা ছিল, ঘাড়টি বাঁকা হয়ে ছিল)। আমি বলছি যে থাক আইজ (আমি বলেছি আজকে থাক)। কয় না আমি যাব (বলে না। আমি যাব)। একটা প্লেন ছিনতাই হইছে (একটি প্লেন ছিনতাই হয়েছে)। ওটা টেলিভিশনে দেখাইব, আমি ওইটা দেখব (সেটি টেলিভিশনে দেখাবে, আমি দেখব)। আর আমি ডাক্তার দেখাব (এছাড়া আমি ডাক্তার দেখাব)। তােমার এখানে থাকি আমি কীভাবে ডাক্তার দেখাব (তােমার এখানে থেকে আমি কীভাবে ডাক্তার দেখাব)। এরপরে ভাই রাত ১১টার দিকে চলি গেছে (এরপরে রাত ১১টার দিকে ভাই চলে যান)। বিয়ের কিছু জিনিসপত্র কিনা নিয়া আসছিল (বিয়ের জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনে এনেছিল)। আমার ভাই আর আমার কাছে ফিরে আসে নাই (আমার ভাই আর আমার কাছে ফিরে আসেনি)। আমি ভাইরে পাই নাই এই পর্যন্ত (আমি ভাইকে এখন পর্যন্ত আর পাইনি)। ভাইয়ের কোনাে খবরও পাই নাই (ভাইয়ের কোনাে খবরও পাইনি)। সরকারিভাবে আমি কিছু জানি না, কেউ আমাকে কিছু জানায় নাই (সরকারিভাবেও আমি কিছু জানি না, আমাকে কেউ কিছু জানায়নি)। দিনের পরদিন যাইতাছে কিন্তু আমরাতাে এইটা মন থেকে ছাড়তে পারি নাই (দিনের পরদিন যাচ্ছে, কিন্তু আমরা তাে এটি ভুলতে পারবাে না)। আমার বাপ মারা গেছে, মা-ও পাগল হই বাচি রইছে এই পর্যন্ত (আমার বাবা মারা গেছেন, মা এখন পর্যন্ত পাগল হয়ে বেঁচে আছেন)।

মিসেস সিদ্দিকুন নেছা (বয়স-৮৬)

নিখোঁজ কর্পোরাল আবদুল ওয়াদুদ-এর মা ওয়াদুদ। আর কছি তুন চলি গেছে আর ১৪ দিনের দিন ধরি লই গেছে, ধরি লই গেছে (ওয়াদুদ। আমার কাছে থেকে চলে যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়)। খবর পাই না, হুনিয়ের কয় বাড়িত আইয়ের বাড়িত আইয়ের (কোনাে খবর পাইনি। শুনছি বাড়িতে আসবে)। আর আইয়ে ন (আর আসেনি)। আর দেখি ন, ছবি আনও দেখি ন (আর দেখিনি, ছবিও দেখিনি)। হেতে কন হলায়, আর লাই হলাইতে হারে না (সে খালি পালাচ্ছে, আমার জন্য পালাতে পারছে না)। আর লাই হেতারে ধরি লাই যাইবাে গােন (আমার জন্য তাকে ধরে নিয়ে যাবে)। আর লাই হেতেরে ধরি হালায় (আমার জন্য তাকে ধরবে)। দেহি ন, হেতে ঘরের ভিতরে হয় (দেখি নাই, সে ঘরের মধ্যে পালায়)। হেতে কন হলানিত আছে গাে (সে পালানাের মধ্যেই আছে)। অনও হলানিত (এখনাে পলাতক)। কোনায় হলায় (কোথায় পালাচ্ছে)।

আশা করি ন (আশা করি নাই)। কইরছি, আগে কইরছি- আর কি (আগে করেছি, আগে করেছি)। অন করি না (এখন আর করি না)। নিই মারি হালাইছে (নিয়ে মেরে ফেলানাে হয়েছে)। সরকারেই মাইরছে (সরকারে মেরেছে)। অন্য কেউ মারে ন, সরকারেই মাইরছে (অন্য কেউ মারেনি, সরকারই মেরেছে)। চাই ত, চাই ত, আনেন না, আই চাই না (তাকে দেখতে চাই, সম্ভব হলে হাজির করেন)। আর কইলজা ঠাণ্ডা হােক (আমি শান্তি পাই)। আর কইলজার মইধ্যে আগুন লাগি রইছে না (আমার মধ্যে আগুন লেগে আছে)। (চেহারার ওপর ফ্রিজ হয়ে যাবে। এরপর ফ্রিজ অবস্থাতে কর্পোরাল নূরুল ইসলামের ছবি)। এই প্রামাণ্যচিত্রটি ধারণ করার সময় আমরা কর্পোরাল আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে জেলখানায় দেখা হওয়া কর্পোরাল নূরুল ইসলামের সাক্ষাৎ পাই। নূরুল ইসলাম ধারণা করেন ওয়াদুদকে ফাসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

কর্পোরাল নূরুল ইসলাম

১৯৭৭ সালের ঘটনায় চার বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত আমি ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে জয়েন করি। ৭৪-এ গ্র্যাজুয়েশন করে নিলাম- ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। গ্র্যাজুয়েশন করে ৭৫-এ জগন্নাথ কলেজে নাইটে মাস্টার্স করছিলাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এরই মধ্যে ‘৭৭ এসে গেল- লেখাপড়া করা অবস্থাতেই, আমি আর মাস্টার্স কমপ্লিট করতে পারলাম না। ইকোনমিক্সে পড়ছিলাম তখন। ওই অবস্থায় ১ অক্টোবর এসে যায়। ছুটির দিন ছিল। ২ তারিখ ছুটির দিন ছিল, ১ তারিখ পহেলা দিন আমাদের বেতন দেয়া হয়েছিল। বেতনের টাকা নিয়ে, আমার একজন চাচাত বােনের বাসা ছিল সূত্রাপুরে, সেখানে চলে যাই। সকালের দিকে জানলাম এয়ারফোর্স মানে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে বেশ গােলমাল হয়েছে। অনেক লােক মারা গেছে। ধরাধরি হচ্ছে, এরকম বলাবলি হচ্ছিল। তারপরেও মনে করলাম ব্যারাকে ফিরে আসি। আসার পথে ফার্মগেট এসে বাস থেকে নামলাম। ওখান থেকে রিকশা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরছিলাম। কাছাকাছি (এখন যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) কয়েকজন আর্মি আমার রিকশাকে থামাল। থামিয়ে আমার পরিচয় জানল, এয়ারফোর্সের লােক। আমাকে ধরে নিয়ে গেল পুরাতন এয়ারপাের্টের ভেতরে। ঐখানে গিয়ে দেখি আমার সতীর্থ আরাে কলিগরাও অনেকেই সেখানে বসা। তারা হাফ নেকেড (অর্ধ উলঙ্গ) অবস্থায় বসে আছে, ভিআইপি লাউঞ্জের মধ্যে। আমাকেও নিয়ে ঐখানে বসিয়ে রাখা হলাে। এর মধ্যে আমার দুই একজনের কথা মনে পড়ছে।

বিশেষ করে এখন আমেরিকা প্রবাসী ফটোগ্রাফিক ট্রেডের আলতাফ সাহেব। উনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার রুমমেট একজন ছিলেন, উনি এখন নেই, উনার ফাসি হয়ে গেছে, আশরাফ-তার বাড়ি টাঙ্গাইলে। তারা আমাকে জিগ্যেস  করতে লাগল, ইসলাম সাহেব আমাদের কী হবে? এভাবে সারাদিন আমাদের  ঐখানে বসিয়ে রাখল। এয়ারপাের্ট এলাকা, আশেপাশে যাকে যেভাবে যেখানে | পেল ধরার চেষ্টা করল। সন্ধ্যার দিকে জেলখানা থেকে প্রিজন ভ্যান আসল।  ওই প্রিজন ভ্যানে করে আমাদের জেলখানায় নিয়ে গেল । ঐখানে আমরা ৬৪ জন ছিলাম। সবাইকে নিয়ে জেলখানার ৫নং বিল্ডিংয়ে রাখল । জেলখানায় ৫নং খাতা বলে। ঐ খাতায় নিয়ে রাখল। অক্টোবরের ৩ তারিখ থেকে ঐখানে লােক ডেকে আনা শুরু করলাে। পরবর্তীকালে যেটি জানি এয়ারফোর্সের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সার্জেন্ট আফসারও ৩ তারিখ পর্যন্ত ঐ খাতাতেই ছিলেন। ৭ তারিখে আমি আরাে ১০ জনসহ মােট ২০ জনকে নিয়ে শেরেবাংলা নগর এমপি। হােস্টেলে এনে রাখল। কোনাে দরজা-জানালা নেই, একটি স্টোর রুমের মতাে, ১৫ ফিট বাই ১৫ ফিটের মতাে হবে একটি রুমে আমরা ৩৫ জন ছিলাম। ১০ তারিখ আমাদের কোর্টের ট্রায়াল হলাে। কোর্টের বিচারক ছিলেন মেজর খালেক। তারসাথে আরাে বিচারকম লী ছিলেন। জুনিয়র কমিশন্ড আর্মি। অফিসারও ছিল। ট্রাইব্যুনালগুলাে কোনাে কথাই শুনত না। কোনাে কাউন্টার। কোয়েশ্চন করা বা নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনাে সুযােগই ছিল না। কোটে আমাকে প্রমাণ করতে পারেনি আমি দোষী ছিলাম। ১০ জনের মধ্যে ৬-৭ জনের হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। সেখান থেকে আর্মিরা আমাদের ছাড়ছিল না। শেরেবাংলা নগরেই আমাদের রেখেছিল। অক্টোবরের ১৯ তারিখে একটি আর্মি জিপে করে আমাদের নিয়ে কুর্মিটোলায় বুঝিয়ে দিয়ে আসল। ২০ তারিখ বিকেলবেলা দেখি আমরা সবাই এসেম্বলি করা মানে ফল ইন করা যাকে বলে। সেখানে আমার নাম এবং নাম্বার ধরে ডেকেছিল।

আমাদের সবাইকে ব্লাইন্ডফোল্ড করে অর্থাৎ চোখ বেঁধে নিয়ে আসল- চোখ বাধাবস্থায় যতটুকু বুঝতে পেরেছি কাফরুলের মতাে কোনাে একটি জায়গায়-ঐখানে আমাদের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ছিল। সেখানে সন্ধ্যায় এনে টচারিং শুরু করল। টচারিং করে ওইদিন রাখল, সারাদিন থাকলাম। সারারাত থাকার পরে পরেরদিন আমাদের সামনে কাগজ এনে দিল, পড়ার কোনাে সুযােগ নেই। কাগজের ওপরে সাইন করে দিতে হলাে। এরপর আমাদের কোর্টে নিয়ে গেল। কোটটি বসেছিল এখন সংসদ ভবনের পাশে আমাদের প্রভােস্ট ইউনিট যেখানে সেখানে। উইং কমান্ডার সাবের উদ্দিনের কোর্টে বিচার হচ্ছিল- ৩১নং কোর্ট। সেখানে আমি বললাম আমি তাে একুইটেড হয়ে এসেছি। বলল না, একুইটেড হয়ে আসলে কী হবে আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী আছে। কোর্টে চার বছরের সাজা দিয়ে আমাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিল। কাহিনী আর বলার শেষ নেই। প্রত্যেক দিনই ধরে ধরে নিয়ে ফাসি দিতে লাগল। ততদিনে বুঝে গেছি, যাদের মৃত্যুদণ্ড হয় তাদের নিয়ে যায় কনডেম সেলে আর যাদের অন্য শাস্তি তাদের নিয়ে যায় কোনাে একটি খাতার মধ্যে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তদের কথা আর না-ই বা বললাম, যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়ে। গেছে বা যাদের দেখা আমরা আর পাইনি তাদের কয়েকজনের কথা মনে পড়ছে। বিশেষ করে সার্জেন্ট মকবুল । আমার কুর্মিটোলার রুমমেট আশরাফ বলে একটি ছেলে। নােয়াখালীর ওয়াদুদ। জেলখানাতে ওয়াদুদের সাথে দেখা হয়েছে। এরকম হাজারও লােককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ফাসি দিতে গিয়ে গলা ছিড়ে পড়ে গেছে এরকম ঘটনাও আছে। লিপির আব্বা-গলা ছিড়ে পড়ে গিয়েছিল । ফাসি। বাদে কত লােক যে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিল- এটিরও কোনাে হদিস পাওয়া যায়নি।

রইসউদ্দিন আরিফ

১৯৭৭ সালে ঢাকা কারাগারে বন্দি

গণফাঁসির প্রত্যক্ষদশী

সিকিউরিটি ওয়ার্ডে, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ডিটেনশন ওয়ার্ড বলে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট যে ওয়ার্ড-এর পাশেই যে সুপারভাইজার অফিস রুম, তারই কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান ছিল সিকিউরিটি ওয়ার্ডের। বাইরের ঘটনা আমরা তখনাে বিস্তারিত কিছু জানতে পারিনি। এমনিতে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল তখন কয়েদি এবং বন্দিদের দ্বারা ঠাসা। বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিরা হাজার হাজার। এর মধ্যে একেবারে হুড়মুড় করে দেখা গেল শত শত লােক ঢােকানাে হচ্ছে। একদিন পরেই রাত ১২টার পর বিকট একটি আওয়াজ। ঘটনা কী? যেহেতু সিকিউরিটি ওয়ার্ড জেল অফিসের কাছেই, ঐখান থেকে নয়-দশ জনকে ছাগল বেঁধে নিয়ে যায় বধ্যভূমিতে জবাই করার জন্য এরকম আট-নয় জনকে হাত এবং বুক বেঁধে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে- এদের চিকার, এদের গােঙানি, এদের আহাজারির শব্দটিই, এত বিকট একটি শব্দ, এই শব্দ আমাদের কাছে একেবারে অপরিচিত। তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারলাম, এই লােকগুলােকে এই জেল অফিসে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে এবং মাত্র কয়েক মিনিটের ট্রাইব্যুনালে এদের বিচার করা হয়েছে। যাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তারপরে তাদেরকে বধ্যভূমিতে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে, এখন তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাসিতে ঝুলানাের জন্য। টলতে টলতে গেল তারা, আমাদের চোখের সামনেই ।

ফাঁসির মঞ্চ যেটি আমাদের এই সিকিউরিটি ওয়ার্ড থেকে একটু দূরে। দূরে হলেও সেখানে যে বিভিন্ন শব্দ হচ্ছে, গভীর রাত তখন নিস্তব্ধ, আর এ ঘটনার পর থেকে সমস্ত জেলখানা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার মনে হয়, তাদের এই চিৎকারের শব্দটি সমস্ত জেলখানাতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমরা ছিলাম সবচাইতে কাছে। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলাে এবং তাদের একজন একজন করে ফাসি দেয়া হলাে। ট্রাইব্যুনাল থেকে ফাসির হুকুম দিয়ে সরাসরি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গলায় রশি পরিয়ে দেয়া হয়েছে- আটজন, কি নয়জন হবে। এভাবে ফাসি হলাে। এটি হলাে প্রথম রাতের ঘটনা। এই ঘটনাটি প্রতি রাতেই ঘটতে থাকল। পরের রাতেও, রাত ১২টার পর ওই একই অবস্থা, একই দৃশ্য, কখনাে হয়তাে ছয়জন, কখনাে সাতজন একসাথে অথবা আটজন, নয়জন একসাথে । তখন আর ঘুমই হত না। দিনের বেলাও আমরা সতর্ক থাকতাম দিনের বেলায়ও এরকম ফাসি দিয়ে দেয় কিনা- এই দৃশ্যগুলাে দেখার জন্য এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক একটি ঘটনা। একজন ফাসির আসামিকে যখন টেনে নিয়ে ঝুলানাে হচ্ছিল, সে সবচাইতে বেশি প্রতিবাদী ছিল, তার যে চিৎকার এটি জেলখানার বাহিরেও মনে হয় পৌঁছে গিয়েছিল। জোর জবরদস্তি করে ফাসির দড়িতে যখন ঝুলানাে হয় তখনও সে ধস্তাধস্তি করছিল। যখন ফাসির রশি তার গলায় দিয়ে নিচের পাদানি ফেলে দেয়া হয়, তখন এত জোরে সে ব্যক্তি পড়ে গিয়েছিল যে তার গলা ছিড়ে গিয়েছিল। নৃশংসতার মধ্যেও এ ধরনের আরাে অনেক নৃশংসতার ঘটনা এখানে ঘটেছিল। এভাবে চারদিন, পাঁচদিন ধরে অবিরাম গণফঁাসি চলল।  বিচারের কর্মকাণ্ডটি ৩০ জনের এই বিচারে সিদ্ধান্ত নিতে আমার যা মনে পড়ে ১৫ মিনিটও সময় লাগেনি। একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, ফাসিতে ঝুলানাে। হবে এই সিদ্ধান্তটি নিতে আধ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। জাস্ট অর্ডার এবং আগে থেকেই অর্ডার হয়ে আছে ব্যস ঘােষণা দেয়া হলাে তােমার ফাসি হবে। একসাথে অবিরাম পাঁচদিন, ছয়দিন, সাতদিন বা এক সপ্তাহ পাঁচজন করে, দশজন করে, এগারজন করে, ফাসি দেয়ার যে ঘটনা, এই যে গণফাসি এটি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দু’শ বছরের ইতিহাসেই না শুধু সারা জীবনের জন্যই এটি একটি বিরল অভিজ্ঞতা এবং এটি নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা। এটি এতটাই লােমহর্ষক ছিল যে, আমার মনে হয় যারা ঐ সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন আজও বেঁচে আছেন তারা কবরের আগে পর্যন্ত এই লােমহর্ষক ঘটনার স্মৃতি ভুলতে পারবেন। । কোনােদিনই ভােলা সম্ভব নয়।

নিখোজ ফ্লাইট সার্জেন্ট একেএম মাইনউদ্দীন

বিডি : ৭৫৪১১

মুন্সেফবাড়ি কুমিল্লা। আ. ক. ম বাহাউদ্দিন বাহার ১৯৭৭ সাল থেকে নিখোঁজ ফ্লাইট সার্জেন্ট এ.কে.এম মাইনউদ্দীন-এর অনুজ মুন্সেফবাড়ি, কুমিল্লা।

আমার ভাই সার্জেন্ট একে এম মাইনউদ্দীন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে জয়েন করেন। আমরা পাচ ভাইয়ের মধ্যে সে তৃতীয়। আমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চার ভাই-ই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেও মুক্তিযােদ্ধা ছিল। সে পাকিস্তান এয়ারফোর্স থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে চলে এসেছিল ছুটি নিয়ে। ছুটি নিয়ে এসে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় জয়েন করে- এয়ারফোর্সে। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর জাপানি একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা এয়ারপাের্টে নিয়ে। আসা হয়। ‘৭৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে মনে হয় রােজার ঈদ হয়। ঈদের পরে সে বাড়ি থেকে যায়। এর এক-দু’দিন পরে আমরা খবর পেলাম জাপানি একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা এয়ারপাের্টে নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে আমরা খবর পেলাম (সে এয়ারফোর্সের কমান্ডাে, প্যারাট্রপার ছিল) তাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছে হাইজ্যাক প্লেনটিকে উদ্ধার করার। আমরা জানতে পারলাম এর মধ্যে একটি ব্যর্থ কু্য হয়ে গেছে (যেহেতু এয়ারপাের্টে তার ডিউটি ছিল) এবং আমরা তার সম্পর্কে আর কোনাে খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আমরা শুনতে পেলাম এয়ারফোর্সের অনেক অফিসার এবং জওয়ানদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবর পেয়ে আমরা সবাই ঢাকায় চলে গেলাম। ঢাকায় গিয়ে বিভিন্নভাবে খোঁজ করার চেষ্টা করলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে এয়ারফোর্সের চিফ এ.জি মাহমুদের সাথে যােগাযােগ করলাম।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা আসলে কোনাে সংবাদই পেলাম না। আমরা এভাবে প্রায় ২০-২১ দিন ঢাকা শহরে বিভিন্ন আর্মি লেভেলে, আমাদের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনরা বিভিন্ন প্রশাসনিক লেভেলে অনেক চেষ্টা করেও কোনাে ট্রেস করতে পারল না। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে। কিছুদিন পরে আমরা একটি চিঠি পেলাম, সরকারের পক্ষ থেকে আমার ভাইকে ডেথ সেন্টেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে যদি কোনাে অপরাধ করে থাকে অবশ্যই সে বিচারের সম্মুখীন হবে এবং পৃথিবীর সকল জায়গাতে, বিচারব্যবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ থাকে। সে কোনাে অপরাধ করলে আমরা পারিবারিক লােক আমাদের জানার সুযােগ ছিল। আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে যদি সঠিকভাবে প্রমাণ করতে না পারত সে নির্দোষ তার যে কোনাে পানিশমেন্ট আমরা মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু আমরাও জানতে পারিনি তার কী হলাে এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা আজও পর্যন্ত তার লাশটিও খুঁজে পাইনি। তাকে কোথায় দাফন করা হলাে তাও জানি না। একজন মুসলমান হিসেবে তাকে মুসলমানের রীতিনীতি অনুযায়ী দাফন করা হয়েছে কি না এ সম্পর্কেও আমরা কিছু জানতে পারিনি। আমরা ওর ডেথ সেন্টেন্স-এর চিঠিটি পেলাম কিন্তু কোনাে জেলখানায় বা কোথায় কীভাবে তার ডেথ সেন্টেন্স কার্যকর করা হয়েছে সে বিষয় সম্পর্কে আমাদের কোনাে অবগত করানাে হয়নি। আমরা আজও এর প্রতিবাদ জানাই, এভাবে মানুষকে হত্যা করে মেরে ফেলার কোনাে যুক্তি নেই।

নিখোঁজ বিমান বাহিনীর এলএসি সফিকুর রহমান

বিডি : ৮৪৫৯৪

পিতা: মরহুম শেখ আহম্মদ

স্ত্রী : আনােয়ারা বেগম গ্রাম : উত্তর দুর্গাপুর পাে:: ভরদ্বাজ হাট থানা : মিরসরাই জেলা ; চট্টগ্রাম আনােয়ারা বেগম। ‘৭৭ থেকে নিখোঁজ বিমান বাহিনীর এলএসি সফিকুর রহমান-এর স্ত্রী উত্তর দুর্গাপুর, মিরসরাই, চট্টগ্রাম ঢাকায় গণ্ডগােল হইছে, ঢাকায় গণ্ডগােল হইছে আর হেতন বাড়িত আছিল (ঢাকায় গােলমাল হয়েছিল, আমার স্বামী বাড়িতে আছিল)। ছুটিতে বাড়িত আইছিল, দুই মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িত আইছে (২ মাসের ছুটি নিয়ে তিনি বাড়িতে আছিল)। বাড়িত আইছে আর কিছুদিন ছুটি কাটাইছে, ঢাকা তুন চিঠি আইছে আর, কে দিছে, কোনে যানে, কইতে হাইরতান নাে, আবার ঢাকায় চলি গেছে (বাড়িতে এসে কিছুদিন ছুটি কাটাবার পরে ঢাকা থেকে চিঠি আসে, তিনি ঢাকায় চলে যান)। ঢাকায় চলি গেছে আর খোঁজ-খবর কিছু হাইয়ের না আর (ঢাকায় চলে যাওয়ার পরে আর কোনাে খোঁজ-খবর পাচ্ছিলাম না)। শ্বশুররে হাডাইছি, শ্বশুর ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে হারের নাে, ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে হারের নাে আর আমরা ইয়ান তুন বাড়িতে মিলাদ হরাইতেছি (আমার শ্বশুরকে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তিনি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে পারেননি, এদিকে আমরা দেশে মিলাদ পড়িয়েছি)। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসের কত তারিখে আমার মেয়ে যেদিন ভূমিষ্ঠ হইছি, হেইদিন আর্মির তুন চিঠি আইছে (জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন আমার। মেয়ে ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন ঢাকা থেকে চিঠি আসে)। মৃত্যুর চিঠি ইয়ান লই ভাইরে ঢাকায় হাঠাইছি, ভাইয়ে টোকাই, টাকাই, ফিটফাট হই গেছাে গো, কান্নাকাটি করি, ভাইয়ে চিঠিও হাজাই হালাইছে (মৃত্যুর চিঠি নিয়ে ভাইকে ঢাকায় পাঠাই, ভাই কোনাে খোঁজ-খবর করতে পারেনি, চিঠিটি হারিয়ে ফেলে, কান্নাকাটি করে)। হেই মিয়ার একখান ফটোও হাইনাে (আমার স্বামীর একটি ছবিও পাইনি)। ঢাকায় হেই মিয়ার বাসা বাড়িতে আগুন লাগাই দিছে, কাগজপত্রগুলাে কিছু হাইনাে, কয়আন রিকশা লইছিল বালুঘাট রিকশাতে রিকশাআলাগাে বাড়িত কিছু কাগজপত্র হাইছি (আমার স্বামীর ঢাকার বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, কোনাে কাগজপত্র ও পাইনি, বালু ঘাট এলাকায় তিনি কয়েকটি রিকশা কিনেছিলেন, সেই রিকশাওয়ালাদের বাসায় কিছু কাগজপত্র পাই)। এই কাগজপত্র লই চাই চাই রইছি, চোখের হানি হালাই (সেই কাগজপত্রগুলাে নিয়ে। চোখের পানি ফেলিয়েছি)।

আমার লাশ যদি হাইতাম, পৃথিবীতে আমার কোনাে দুঃখ থাকত না (আমার স্বামীর লাশ যদি পেতাম তাহলেও আমার কোনাে দুঃখ থাকতাে না। আমার লাশেরে আই মাটি দিতাম (আমার স্বামীর লাশকে আমি মাটি দিতাম)। আমার লাশ কিরলই হাইলাম না (আমার লাশ কেন পেলাম না)। ঢাকায় আইজকাল, পাকিস্তান তুন লাশ আইয়ে, আমেরিকা তুন লাশ আইয়ে, আর এই লাশ ঢাকা তুন আইলাে না (পাকিস্তান থেকে লাশ আসে, আমেরিকা থেকে লাশ আসে, আমার লাশ ঢাকা থেকে আসলাে না)। আর লাশ যখন, দুনিয়ার তুন মারি হালাইছাে গেছিগাে, আর লাশের তাে আর কোনাে দোষ নাই (আমার স্বামীকে যখন মেরে ফেলেছ সে চলে গিয়েছে, তার লাশ তাে কোনাে দোষ করেনি)। আর লাশগা তােমরা হাড়াই দিতা (আমার স্বামীর লাশটি তােমরা পাঠিয়ে দিতে)। আই আল্লার অস্তে খুশি হই আর লাশরে দাফন কাফন করতাম (আমি খুশি হয়ে লাশকে দাফন করাতাম)। আর হােলগাে একখান ছবি দেহাইতাে, আর ছবি নাই (আমার ছেলেদেরকে যে একটি ছবি দেখাবাে তারও কোনাে উপায় নেই)। আর একগা শার্ট হাইলাম না, লুঙ্গি হাইলাম না, গেঞ্জি হাইলাম না, প্যান্ট হাইলাম না (আমার স্বামীর একটি শার্ট, লুঙ্গি, গেঞ্জি, প্যান্ট কিছুই পেলাম না)। আর স্বামীর জিনিস লই বুকে চোখে লইতাম (আমার স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতাম)। হেই সরকার আরে কিছু আরে দিল না (সে সময়ের সরকার আমাকে কিছুই দিল না)। দিল না দিল না আর লাশগাও দিল না (দিল না দিল না আমার স্বামীর লাশটিও দিল না)। আই অস্তার মতাে দুনিয়াতে আছি (আমি এখন এতিমের মতাে পৃথিবীতে বেঁচে আছি)। আর ৫০-৬০ বছর বয়স অই গেছে, আই আর বাঁচমু কয়দিন (আমার বয়স ৫০, ৬০ বছর, আর কতদিন পৃথিবীতে বাঁচবাে)। হ্যা উপযুক্ত তদন্তটাও যদি করি নিতাে তাও আমার দুঃখ ছিল না (হ্যা, উপযুক্ত তদন্তটি করে নিলেও আমার কোনাে দুঃখ থাকতাে না)। ছুটিতে বাড়িত আইছিল, আর স্বামীরে বলাই লই যাই জড়িত কইরছে (ছুটিতে বাড়িতে ছিল, আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে জড়িত করা হয়েছে)।

জড়িত করার পরে দোষী সাব্যস্ত করে মাইরছে না কিরছে আই জানি না (ডেকে নিয়ে গিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে না কি করেছে আমি কিছুই জানি না)। ছুটির তুন নিই গেছে (ছুটির থেকে নিয়ে গেছে)। কই ছুটিতে আইছে তুই কিরলাই যাও, বলে যাইতাে অয়, সরকারের ওয়ার্ডার মাইনতে অয়, সরকারের ওয়ার্ডার মােতাবেকই চইলতে অনব চাকরি যখন করিয়ের (আমি বলেছিলাম ছুটিতে তুমি বাড়িতে এসেছ কেন যাচ্ছ, তিনি বলেছিলেন যেতে হবে, সরকারের অর্ডার মানতে হবে, যেহেতু চাকরি করি সরকারের অর্ডার অনুযায়ী চলতে হবে)। এখন আমি বিচার চাই (আমি এখন বিচার চাই)। আর লাশ চাইয়ের অনগা (আমি এখন আমার স্বামীর লাশ দেখতে চাই)। আর লাশের ছবি চামু আই (আমার স্বামীর লাশের ছবি চাই)। আর লাশ কোনােনতুন আনি দিব দেগ (আমার স্বামীর লাশ কোথায় থেকে সরকার এনে দেবে জানি না, আমি লাশ চাই)। আই লাশ চাই। অনগা (আমি এখন লাশ চাই)। আর হােলারা লাশ চাক (আমার সন্তানেরা তার বাবার লাশ দেখুক)। আরে লাশ দেহাইতে অইব, আই হয়তােবা লাশের বিচার চাই (আমাকে আমার স্বামীর লাশ দেখাতে হবে তা না হলে আমি লাশের বিচার চাই)। আই বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিচার চাই, এইডাই আমার শেষ কথা (আমি বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিচার চাই, এটি আমার শেষ কথা)।

নিখোজ ফ্লাইট সার্জেন্ট কবির আহম্মদ

বিডি : ৭৩৩০১ পিতা : মরহুম জাহা বক্স স্ত্রী : দেল আফরােজ। ঘাম + পো; ; তেমুহানী থানা ; মিরসরাই জেলা : চট্টগ্রাম দেল আফরােজ বেগম ‘৭৭ সাল থেকে নিখোঁজ ফ্লাইট সার্জেন্ট কবির আহম্মদ-এর স্ত্রী তেমুহানি, মিরসরাই, চট্টগ্রাম আমি ঢাকায় আছিলাম (আমি ঢাকায় ছিলাম)। আমারে একমাস আগে লইয়া। গেছে (আমি একমাস আগে থেকে ঢাকায় ছিলাম)। নেওয়ার পরে সেখানে তাদের কী গােলাগুলি হইলাে, সে কোন ন আছিল (আমার স্বামী জড়িত ছিল না)। সে বিদেশে সিঙ্গুপুরে তারে ডিউটিতে পাঠাইছে (সে সময়ে সিঙ্গাপুরে তিনি ডিউটিতে ছিলেন)। এখানে গেণ্ডগােল হওয়ার পরে, আরাে বহুত পরে সে বাসায় আইছিল (দেশে গণ্ডগােল হওয়ার বহুদিন পরে তিনি দেশে আসেন)। আইছিল আর ঘুম গেছিল (বিদেশ থেকে ফিরে বাসায় ঘুমায়)। তাদের কথা বিদেশ যাইতে যে একটা জিনিস দিছে, এই জিনিস জমা দেয়ার লাই ১০ নম্বর ব্লকে গেছে (ঘুমের থেকে উঠে ১০ নম্বর ব্লকে অস্ত্র জমা দিতে যায়)। গেছে আর বহত কিছু কথাবার্তা হইছে (সেখানে বহু কথাবার্তা হয়)। শেষরাতে আইছে এরা ১১টার ৫৫ মিনিটে অস্ত্র জমা দিবার লাই গেছে, গেছে আর বলে অ্যারেস্ট কইরছে (শেষরাতে ১১টা ৫৫ মিনিটে বাসায় এসে আবার সকালে গেলে তাকে গ্রেফতার করে)। সকালে গেছি আর বলে এই ব্যাপার। দু’দিন বাদে তারে ছাড়ি দিছে (দুই দিন রেখে ছেড়ে দেয়)। আই আবার ডিউটি কইরছে সাত, আট, দশ দিন (এসে আবার ৭, ৮, ১০ দিন অফিস করেছে)। ডিউটির পরে আরেকদিন ঘুম থেকে শেষ রাতে সিওডি লাগাই দিয়েছে (এরপরে একদিন ভােররাতে কোয়ার্টারে নিরাপত্তারক্ষীরা। আসে)। আমরা হিয়ানে চারজন আর্মি ও আমরা বিমানবাহিনীর চারজন আছিলাম, একই রুমে আটজন ফ্যামিলি আছিলাম (সেই কোয়ার্টারে আমরা বিমানবাহিনীর চারটি ও সেনাবাহিনীর চারটি মােট আটটি পরিবার ছিলাম)। তারা আই রাতে ঘুমের থেকে জাগাই শেষ রাতে কয় সাবেরে জাগাই দাও, সাবেরে জাগাই দাও।

বলি দরজা ফিডে, বন্দুক লই (রাতে বন্দুক নিয়ে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছিল আর বলছিল সাহেবকে ঘুমের থেকে জাগিয়ে দাও)। খুলি দিলাম আর এবার তুলি লই গেলিগােই (দরজা খুলে দিলাম আর ঘুমের থেকে তুলে নিয়ে গেল)। এই নিল আর আবার তাগােরে অ্যারেস্ট করি এগারােদিন হিয়ানে ফিল্ডে রাইখছে, তেজগাঁ হিয়ানে ফিল্ড আছে যে এয়ারপাের্টের হিয়ানে (নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করে ১১ দিন তেজগাও এয়ারপােটের ফিল্ডে রাখে)। হিয়ানে যাই খানা টানা লই গেছি (সেখানে খাবার নিয়েও গিয়েছি)। লই যাই কুর্মিটোলা মসজিদ আছে যে সেখানে একজন একজন করি দেখাইছে (কুর্মিটোলা মসজিদের ওখানে একজন একজন করে এনে দেখাও করিয়েছিল)। তারপরে আবার তাগােরে কুমিল্লা লই গেলাে গই (তারপরে তাদেরকে কুমিল্লায় নিয়ে যায়)। আর দেখি নাই (আর দেখিনি)। আর কোথায় নিছে, কিচছে, এই কথাও আর কইতাম হাইরতাম ন (কোথায় নিয়ে গিয়েছে, কী করেছে আর বলতে পারবাে না)। আর আর স্বামীর খোঁজ-খবরও পাইনা (এরপর থেকে আমার স্বামীর আর কোনাে খোঁজ-খবরও পাই না)। এই স্বামীর লাই দরখাস্ত দিতে দিতে, খবর লইতে লইতে হেতারা আর কোনাে খবরও দেয় না (স্বামীর জন্য দরখাস্ত দেয়া থেকে শুরু করে সকল কিছুই করেছি, কিন্তু কোনাে খবর পাইনি)।

এই দুঃখ আমার স্বামীরে কোথায় নিছে, কি করছে, লাশও দেখি নাই (আমার দুঃখ স্বামীকে কোথায় নিয়েছে, কী করেছে, লাশটিও দেখিনি)। আর লাশ কোথায় গেল বাংলাদেশের ভেতরে (বাংলাদেশের মধ্যে আমার স্বামীর লাশ কোথায় গেল)। দুইটা চিঠি দিল (দুটি চিঠি দিয়েছিল)। একটা চিঠি দিল যে সে জেলে আছে কোনাে চিন্তা কইরাে না (একটি চিঠি ছিল আমার স্বামী জেলে আছে, কোনাে চিন্তা নেই)। নয় মাস জেলে (৯ মাস জেলে ছিল)। হেও আর কাছে কইছে। ‘৭৮ সালের জানুয়ারির ১৮ তারিখের দিকে একটা চিঠি দিল যে, পিওন আনি কয় চাচী ইয়ান দিই একখান সিগনেচার দাও (১৮ জানুয়ারি ‘৭৮ সালে পিওন একটি চিঠি নিয়ে আসে, এনে বলে চাচী স্বাক্ষর করে চিঠিটি রাখেন)। সিগনেচার দিছি, বলে আমার স্বামী আর নাই (স্বাক্ষর করে চিঠি রাখি, পড়ে দেখি। আমার স্বামী আর নেই)। ওমা কিয়া কয়। এই যে তাছাড়া আর কোনাে খােজ খবর নাই (এরপরে আমার স্বামীর আর কোনাে খবর নেই)। টাকা পয়সাও পাই নাই (স্বামীর কোনাে টাকা পয়সাও পাইনি)। কোন দিকে নিছে, কোন দিক পাঠাইছে এই কথাও বলে নাই (আমার স্বামীকে কোথায় নেয়া হয়েছে, কোথায়। পাঠানো হয়েছে কিছুই জানানাে হয়নি)। আমার ঘুমের থেকে জাগাই তারা নিছে (ঘুমের মধ্য থেকে আমার স্বামীকে তুলে নেয়া হয়েছিল)। আর কোনাে খোঁজ পাইতেছি না (এখন পর্যন্ত আর কোনাে খোঁজ পাচ্ছি না)। এখন আমার লাশের। ক্ষেতিপুরণ আপনাগাে কাছে চাইতেছি (আমি এখন আমার স্বামীর লাশের ক্ষতিপুরণ চাই)। আমার লাশ কোথায় নিল, লাশ পাইলাম না, লাশ যদি দেখতাম মনেরে বুঝাইতাম এই শােকে আমি দুনিয়া হারা হই গেছি (আমার স্বামীর লাশ কী করা হােল, লাশ পেলাম না, লাশ যদি পেতাম তাহলেও সান্ত্বনা থাকত)।

রােগে শােকে বেঁচে আছি (রােগে শােকে ভুগে বেঁচে আছি)। ঘুমের তুন জাগাই দিলাম (ঘুমের থেকে জাগিয়ে দিয়েছিলাম)। একটা কথা হাইলাম না, বাচ্চারা হাইলাে না, কিছু হাইলাে না (আমার স্বামীর সাথে একটি কথাও বলতে পারলাম না, বাচ্চারাও বাবার কোনাে স্মৃতি পেল না)। দুগা বাচ্চারে বসাই ঘুমের তুন জাগা দিছি (আমার সন্তান দুটিকে বসিয়ে স্বামীকে ঘুমের থেকে জাগিয়ে দিয়েছিলাম)। হিছে হিছে যাইতে যাইতে বালুঘাট বাজার হর্যন্ত হাগল হই বারি গেছি (গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পেছনে পেছনে বালুঘাট বাজার পর্যন্ত গিয়েছিলাম)। আমার এই লাশ কোথায় নিল, কোন জায়গায় থুইল, আমার এই লাশ হাইলাম না (আমার স্বামীর লাশ কোথায় দাফন করলাে, কোথায় রাখলো, স্বামীর লাশ পেলাম)। যখন গাড়িত তুলে তখন তাকাই রেনি রইছি, চোখের পানি ভাসি গেছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাস্তার মইধ্যে কাইনছি (যখন গাড়িতে তুলছিল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, চোখের পানিতে ভরে গিয়েছিল, রাস্তায় দাড়িয়ে কাঁদছিলাম, বাবা, ভাই গিয়ে আমাকে এনেছিল)। বাপ, ভাই যাই আমারে আনছে। পুতের জন্য আমার শ্বশুরকে কইছি যে আপনার নাতিন একতরের জন্য এই ভাত দিতে হারিয়ের না (আমার শ্বশুরকে বলেছিলাম আপনার নাতিদেরকে ভাত খাওয়ানাের ক্ষমতা নেই)।

চেরা ধুই পানি খাইতেছি, সব জায়গায় কার্ফ চইলতেছে (চিড়া ভিজিয়ে পানি খাওয়াচ্ছিলাম, সকল জায়গায় কার্টু চলছিল)। আপনার পুতের সাথে আমার সাথে যােগাযােগ নাই আপনার পুতেরে অ্যারেস্ট কইরছে (আপনার ছেলের সাথে আমার কোনাে যােগাযােগ নেই, আপনার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে)। হাজার হাজার মানুষের পুত অ্যারেস্ট হইছে। (হাজার হাজার মানুষের ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে)। এই কথা যখন কইছি আমার শ্বশুর ছদর মালিথা আছে যে হিয়ানে কারে বারিয়ে আর হাের যায় পুতেরে। চাওয়ার লাই (একথা শুনে আমার শ্বশুর ছেলেকে দেখার জন্য রওয়ানা দিয়েছিল, ছদর মালিথা নামক জায়গায় গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে))। লগে লগে হরান গেছে গাে মস্তাননগরে নিছে আর (এক্সিডেন্টের পরে মস্তাননগরে নেয়ার পথে। তিনি মারা যান)। একঘরে আমার দুইজন, একইমাসে (আমার এক বাড়িতে এক মাসে দুইজন মারা গেলেন)। আইজ্জা চোখে দেখতাম যদি মনেরে বুঝাইতাম (আজকে স্বামীর লাশ দেখলেও মনে সান্ত্বনা পেতাম)। হুত, ঝিরে দেহাইতাম, একটা চিঠিও হাইলাম (ছেলেমেয়েদের দেখাতাম, একটি চিঠিও পেলাম না)। কোথায় নিল, কোথায় গেল (আমার স্বামীকে কোথায় নিল, কোথায় গেল)।

নিখোঁজ বিমান বাহিনীর ল্যান্সনায়েক শামসুল হুদা

বিডি : ৫০০০৮০ গ্রাম : দক্ষিণ সােনাপাহাড় পাে:: জোরারগঞ্জ থানা : মিরসরাই জেলা : চট্টগ্রাম আলেয়া বেগম। ‘৭৭ থেকে নিখোঁজ বিমান বাহিনীর ল্যান্সনায়েক শামসুল হুদা-এর মেয়ে দক্ষিণ সােনাপাহাড়, মিরসরাই, চট্টগ্রাম আমার নাম আলেয়া বেগম । আমার আব্বার নাম শামসুল হুদা। মুক্তিযােদ্ধা, বিমানবাহিনীতে ছিলেন। তিনি মুক্তিযােদ্ধা এবং বিমানবাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন। ১৯৭৭ সালে আমার জন্মের পরে আমার বয়স ছিল তখন নয়মাস। আমি পুরােপুরি জানি না । দাদুর মুখে, মায়ের মুখে কিছু কিছু শুনেছি। আমার বাবাকে নির্মমভাবে বিনাদোষেতে জিয়াউর রহমান ফাসি দেন। তারপরে আমার মায়ের হাতে আমি লালন পালন হই । (স্ক্রিনে লেখা- ল্যান্সনায়েক সৈয়দ শামসুল হুদার নিখোঁজ হওয়ার সময় একমাত্র সন্তান মেয়ে আলেয়া গেমের বয়স ছিল নয়মাস । দশ বছর বয়সে আলেয়ার মা অর্থাৎ শামসুল হুদার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন) আমার মা অনেক কিছু করেছেন আমার বাবার জন্য, আমি এসব কথা বলার ভাষা এখন। খুঁজে পাচ্ছি না, আপনাদেরকে বলার জন্য। আমার বাবা একজন সৈনিক ছিলেন এবং সত্য, ন্যায়, নিষ্ঠাবান, শিক্ষিত লােক ছিলেন। এখন আমার বাবাকে কোনখানে মেরেছে, কোনখানে কবর দিয়েছে, বাবার একটি কবর দেখিনি। বাবার কোনাে চিঠি দেখিনি, বাবার কোনাে ছবি দেখিনি। বাবা আমাকে আদর করেছেন, আমি বাবাকে বাবা ডাকার সুযােগও পাইনি। আমি সবার মুখে শুনি, আমি শামসুল হুদার মেয়ে, কিন্তু বাস্তবে আমি কিছুই দেখিনি। শামসুল হুদার মেয়ে আমি সবার মুখে শুনি কিন্তু বাবার কোনােকিছুই আমি পাইনি। বাবা মারা।

গেছে কিন্তু বাবার কোনাে স্মৃতিচিহ্নও পাইনি। আমার বাবার মেয়ে এটি শুনছি। মানুষের মুখে কিন্তু বাবার কোনাে কবর বা বাবার কোনাে চিহ্ন, বাবাকে কোথায় মেরেছে তার কিছুই আমি কখনাে দেখিনি। আমার দুঃখ কীভাবে আমার বাবা মারা গেল, কীভাবে আমার বাবা কোনখানে গেল আমি এগুলাে যদি একটু দেখতাম, শুনতাম তাহলেও বাবার কিছু পেয়েছি, বাবার ছোঁয়া, বাবার স্পর্শ পেয়েছি বলে মনে করতাম। কিছুই তাে আমি দেখিনি। যদি কিছু সাহায্যসহযােগিতা পাই তাহলেও আমার বাবার কিছুটা স্পর্শ পেয়েছি বলে মনে করব। বাবার কোনাে খােজ বা কিছু পেয়েছি বলে মনে করব। কোনােরকমে বেঁচে আছি। মা মারা যায় দশ বছর বয়সে। বাবা মারা যাওয়ার দশ বছর পরে মা মারা যায় । দাদু আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে এইঘরে বিয়ে দিয়ে যান। বাবার কোনাে চিঠি, বাবার কোনাে কাগজপত্র, বাবার কোনাে ডকুমেন্ট আমার হাতে নেই। মৃত্যুদণ্ডের চিঠি এসেছিল কিন্তু কেউ রাখেনি। রাখবে যে আমার কেউ নেই। এই দুনিয়াতে আমার মা, বাবা, ভাই, বােন কেউ নেই। আমি কারাে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালে আমাকে এক প্লেট ভাত দেয়ারও কেউ নেই। সবাই আমারে রেখে চলে গেছে। আমি শুধু একমাত্র শামসুল হুদার মেয়ে হয়ে দুনিয়াতে আছি। আমার কোনাে মা, বাবা, ভাই, বােন, চাচা, দাদা কেউ নেই। আমি কারাে সাড়া পাবাে যে তারাে কোনাে উপায় নেই। কোনােরকমে আমার দাদু লালন পালন করে এই ঘরে বিয়ে দিয়ে গেছেন। আমি এইভাবে বেঁচে আছি।

কর্পোরাল এম. মহিউদ্দীন

বিডি : ৪৪০৭০৮ পিতা: মরহুম দেলােয়ার হােসেন হায়দার গ্রাম ; পশ্চিম জোয়ার পাে:: করেরহাট, মিরসরাই জেলা : চট্টগ্রাম (কর্পোরাল এম, মহিউদ্দীনের বাড়ির সামনে তার আত্মীয়স্বজনদের সমাবেশে ক্যামেরার সামনে আনােয়ার কবির)।

আমি এখন যে বাড়িটির সামনে দাড়িয়ে এটি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১নং করেরহাট ইউনিয়নের জোয়ার সাহারা গ্রাম। এই বাড়িটি হলাে শহীদ কর্পোরাল মহিউদ্দীনের বাড়ি। কর্পোরাল মহিউদ্দীন ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসেন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। মহিউদ্দীনরা ছিলেন চার ভাই দুই বােন। তার বাবার নাম ছিল মৌলভী দেলােয়ার হােসেন এবং মাতা মােসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। মহিউদ্দীনের বড় ভাই নিজাম উদ্দীন, তিনি এখন নেই, মারা গেছেন ২০০৩ সালে। ১৯৭৭ সালে মহিউদ্দীনের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আর এই ভাইয়ের কোনাে সংবাদ তারা পাননি। বৃদ্ধা মা সারাজীবন ছেলের প্রতীক্ষা করে ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাবাও ছেলের শােকে একসময় মৃত্যুবরণ করেন।

মহিউদ্দীন ছিলেন মেজ ছেলে। বড় ভাই নিজাম উদ্দীন তিনি মারা গেছেন। তারপরের জন ছিলেন মহিউদ্দীন, তার পরের জন গিয়াস উদ্দীন উনি এখানে আছেন, তার পরের জন আলাউদ্দীন। বােন দু’জন নূরুন্নাহার ও কামরুন্নাহার তারা এখানে আছেন।

নূরুন নাহার, কামরুন নাহার।

নিখোজ কর্পোরাল মহিউদ্দীন-এর বােন পশ্চিম জোয়ার, মিরসরাই, চট্টগ্রাম ১৯৭৭ সালে রমযানে ঈদের পরের দিন দেখেছি। আমার স্বামীর বাড়িতে গিয়েছিল। সেখান থেকে আসার কয়েকদিন পর, চার-পাঁচদিন পরেই সে ঢাকায় ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যায়। এরপরে আর দেখিনি। ভাইজানের জন্য তাে মা-বাবা দু’জনেই চলে গেল। তিন কি চার বছর বাবা বেঁচেছিলেন। ছেলের শােকে বাবা মারা যান। মাও ভাইয়ের শােকে মারা যান। মা এক ধরনের পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। খালি উল্টোপাল্টা বকতেন।

আমার ভাইয়ের কী হয়েছে, না হয়েছে আমরা শুধু এটিই জানতে চাই। – (কামরুন নাহার) আমিও শুধু এটিই জানতে চাই। আমার ভাইয়ের কী।

হলাে না হলাে।

আলাউদ্দিন

কর্পোরাল মহিউদ্দীন-এর অনুজ। পশ্চিম জোয়ার, মিরসরাই, চট্টগ্রাম যশােরে পােস্টিং ছিল । ঐখান থেকে কিছুদিন পরে বাড়িতে আসলেন ১৯৭৭ সালে । আমাদেরকে বললেন উনি ঢাকাতে কোর্সে আছেন। আসার পরে ঈদের দুই, একদিন পরে শুনলাম ঢাকায় গণ্ডগােল হচ্ছে। এর তিন-চারদিন পরে আমার। ভাই চলে গেলেন। পরে আমরা আর উনার কোনাে খোঁজ পাচ্ছি না। খোঁজ নিতে বিমানকাহিনীর হেডকোয়ার্টারে গেলেন। বিমান বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার। কিছুদিন পরে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পরে আব্বার কাছে একটি চিঠি এসেছে। এই চিঠিতে তারা লিখেছে আমার ভাইকে ফাঁসি দিয়েছে। কী জন্য আমার ভাইরে ফাসি দিয়েছে, কী দোষ করেছে আমার ভাই, আমরা আজও এই খবর জানি না। আমার ভাইয়ের শােকে বাবা এর দুই-তিন বছর পরেই মারা গেলেন। এরপরে আমার আম্মা মারা গেছেন, পুত্রশােকে । আজ পর্যন্ত আমার ভাইকে কীভাবে মারল, কোথায় মারল, কী অবস্থা আমরা জানতে পারিনি। মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কিছুদিন পরে আরেকটি চিঠি দিয়েছে, চিঠিতে উনার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসার জন্য বলেছে। এর কিছুদিন পরে আমার আব্বা আমার এক ভগ্নিপতিকে নিয়ে সেগুলাে নিয়ে এসেছেন। কেন আমার ভাইকে মারল, কী অবস্থায় মারল, কোথায় মাটি দিল পুরাে তথ্য জানতে চাই ।

(আবার ক্যামেরায় আনােয়ার কবির)। মহিউদ্দীনের মতাে এরকম বিমানবাহিনীর শত শত সৈনিকের পরিবারও জানে আসলে তাদের কী হয়েছিল। তাদের আসলেই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল নাকি ঐ অভ্যুত্থানের রাতেই তারা মারা যান এবং পরবর্তকিালে সরকার এই মৃত্যুদণ্ড নামক একটি সাজানাে ঘটনার কথা বলে নিজেকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন।মহিউদ্দীনের বাবা যেরকম বারবার সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিমানবাহিনী প্রধানের কাছে চিঠি লিখেছিলেন তার সন্তানের অবস্থান জানতে এরকম বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রায় প্রতিটি পরিবার যারা সে সময়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন, যাদের সে সময়ে ফাসি হয়েছিল তাদের পরিবারও একই কষ্ট বুকে নিয়ে জীবনযাপন করছেন, একই কষ্ট বুকে নিয়ে তারা তাদের জীবন অতিবাহিত করছেন।

মেজর জহিরুল হক খান বীর প্রতীক (অব.)

৬নং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১০ ইস্ট বেঙ্গলে পােস্টিং হওয়ার সময়ে তখন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার সম্মুখীন আমি হই। আমার ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি হেডকোয়ার্টারের সাথে যে একটি ব্রিগেড, এই ব্রিগেডটি হলাে ৪৬ ইনফ্রেন্ট্রি ব্রিগেড। ওই ব্রিগেডে থাকে তিনটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর একটি ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল, ওইটির সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলাম আমি । ওই ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজেশ, আমি ছিলাম ওই ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড। ১৯৭৭ সালে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ২২ ইস্ট বেঙ্গলে একটি ব্যর্থ সেনাবিদ্রোহ হয়। ২২ বেঙ্গলে ব্যর্থ বিদ্রোহ হওয়ার পরে ঐখানে যারা নিহত হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাদের দুপুরে জানাযা হয়। ওই জানাজার সময় আমরা সৈনিকদের হাবভাব দেখে মনে করেছিলাম, তারা মনে হয় এখানে কিছুটা হতাশা আছে বা তারা অস্থিরতার মধ্যে আছে। এই অবস্থাটি দেখে আমরা পর্যবেক্ষণে ছিলাম। আমরা যখন বুঝতে পেরেছিলাম সৈনিকেরা, যারা চঞ্চলতার মধ্যে আছে। আমাদের যারা ইউনিট অফিসার ছিল এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আমিও আমার ব্যাটালিয়নে রাত্রিযাপন করি। আমরা তখন রিক্রিয়েশন রুমে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ রাত দেড়টার সময় বিভিন্ন দিক থেকে আমরা ফায়ারের আওয়াজ শুনি এবং টেলিভিশনে এজি মাহমুদ সাহেব এবং কিছু সংখ্যক বিদ্রোহীকে আমরা দেখতে পাই। দেখার পরে আমরা আমাদের ইউনিটে অবস্থান নিই। অবস্থান নেয়ার পরে আমরা অবশ্য বিদ্রোহী সৈনিকদের হালকাপাতলাভাবে কিছু কিছু স্লোগানও আমরা শুনি। পরে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হওয়ার পরে আমাদের ইউনিটেরও কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী সৈনিক গ্রেফতার হয়, অন্যান্য ইউনিটেরও হয়। তারপরের দিন আমাদেরকে নিয়ে সুপ্রিম কমা হেডকোয়ার্টারে এই যে ৪৬ ব্রিগেডের বিভিন্ন ইউনিটের অফিসারদের নিয়ে আমাদের একটি কনফারেন্স হয়। সেই কনফারেন্সে যাদেরকে দিয়ে এই বিদ্রোহীদের ট্রায়ালের জন্য এখানে কমিটি গঠন করা হয় বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানদেরকে ওই মিটিংয়ে উপস্থিত করা হয় ।

আমিও একটি ট্রাইব্যুনাল নং-৬ এর সভাপতি বা চেয়ারম্যান হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আমি হৃদয়বিদারক ঘটনা এইজন্য বললাম যেহেতু ৬নং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আমি ছিলাম, আমি প্রত্যক্ষভাবে এই ঘটনার সাথে পুরােটি পর্যবেক্ষণ করেছি। আমাদের ট্রাইব্যুনাল করার পরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানদেরকে নিয়ে জিয়াউর রহমান সাহেব নিজে তখন রাষ্ট্রপতি এবং সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে আমাদের মাঝে ভাষণ দেন। সেই ভাষণ আমার এখনাে মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিন ঠিক করার জন্য তাদেরকে খতম করে দাও । ইংরেজিতে সেন্টেন্সটি এই রকম ছিল- To bring the discipline of the army, slaughter them. সে অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল শুরু হয়। আমি ৬নং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলাম। প্রথম ট্রায়ালে আমার কোটে তেরােজন বিদ্রোহীকে দেয়া হয়। সেখানে কোর্ট চলাকালীন সময়ে দেখতে পাই একজনকে বাংলাদেশ বেতারের ওখান থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর বাকি বারােজনের তিনজনকে দেখা গেল ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর বাকি তেরােজনের মধ্যে আটজন তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টের, সাধারণত এয়ারফোর্সের একটি নিয়ম আছে তারা যদি বাসায় যায় বা ছুটিতে যায় তাদের লিভ সার্টিফিকেট লাগে না।

তারা শুধু তাদের উপরস্থ অফিসারকে বলেই চলে যেতে পারে। ক্যান্টনমেন্টে যখন বিদ্রোহ হলাে, ব্যর্থ বিদ্রোহ হলাে তখন তারা এই কথা শুনে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে বা আত্মীয়-স্বজনের বাসা থেকে পরেরদিন ভােরে যখন ক্যান্টনমেন্টের কর্তব্যস্থলে ফিরছিলেন তখন থার্ড গেট বা বনানী ক্যান্টনমেন্টের গেটে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। আমি যখন কোর্ট পরিচালনা করি তখন আমার সাথে আরাে চারজন সদস্য ছিল। কোট চলাকালীন সময়ে আমরা দেখতে পেলাম একজনকে রেডিও বাংলাদেশের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়, তিনজনকে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়, বাকি নয়জন যারা ছুটি থেকে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করছিল তার মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ পাওয়া যায়নি। এবং কোনাে অভিযােগও দাঁড় করানাে যায়নি, কোনাে অভিযােগ প্রমাণিতও হয়নি। সেই কারণে আমি কোর্টের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার অন্যান্য সম্মানিত সদস্যবৃন্দের মতামত জানলাম। তারাও আমার সাথে কনভিন্স হলাে যে বাকি নয়জনের কোনাে অপরাধ নেই। তারা ওই রাতে ছুটিতে ছিল। ছুটি থেকে তারা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসছিল, ইউনিটে যােগদান করার জন্য তারা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করছিল। তাই সেই নয়জন নিরপরাধ সৈনিককে আমি সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিই। আর বাকি তিনজন যাদেরকে ওই রাতে, বিদ্রোহের রাতে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে গ্রেফতার করা হয় তাদেরকে লঘু দণ্ডের সাজা দেয়া হয়। আমি হৃদয়বিদারক ঘটনা এই কারণে বললাম আমার কোটে এই নয়জন বাদে বাকি যে কোর্টগুলাে ছিল তাদের সবাইকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং ইন্সট্রাকশন ছিল আর্মির

ডিসিপ্লিন ঠিক করার জন্য সবাইকে জবাই করে দেয়া হােক। আমার এই নয়জন নিরপরাধ সৈনিকদের যেহেতু আমি ফাসি দিইনি সেজন্য আমার পরের কোর্টে আমার আরাে তেরােজন, আমার ট্রায়ালে থাকার কথা ছিল। যেহেতু আমি নির্দোষ লােকগুলােকে ছেড়ে দিয়েছি সেহেতু বাকি তেরােজনকে আমার কোর্টে আর দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পারি তেরােজনকে অন্য কোর্টে দেয়া হয়। এবং ঐ তেরােজনকেও ফাসি দেয়া হয়। মূল কথা এখানে এই যে, ট্রাইব্যুনাল ‘৭৭ সালকে আমি হৃদয়বিদারক ঘটনা এই কারণে বলেছি যে, যে কয়টি ট্রাইব্যুনাল হয়েছিল সেই ট্রাইব্যুনালগুলােতে শুধু আমার কোর্টেই নয়জনকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হয়, তিনজনকে লঘু দণ্ড দেয়া হয় এবং একজনকে ফাসি দেয়া হয়। এই নয়, তিন, বারােজন ছাড়া বাকি সবগুলােতেই ফাসি হয়েছে। এজন্য আমার কাছে এই ঘটনাটি এখনাে স্মরণ আছে। এটি সত্যিকারভাবে সেনাবাহিনী বা আর্মির জন্য বা এই দেশের জন্য সত্যিকার অর্থে এখনাে আমি মনে করি একটি বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা। ‘৭৭ সাল সম্পর্কে আমার মন্তব্য হলাে আমি ট্রাইব্যুনাল নং-৬ এর চেয়ারম্যান ছিলাম। সত্যিকারভাবে এখানে যাদের ট্রায়াল হচ্ছিল, ট্রায়াল যাদের হচ্ছিল, যাদেরকে ফাঁসি দেয়া হলাে, ফাঁসি দেয়া যে। হচ্ছে এটি কিন্তু তাদের পরিবার জানত না, এমনকি তাদের ইউনিটগুলােও জানত। তাদের ফাসি দেয়ার পরে তাদের লাশ তাদের ইউনিটে বা তাদের পরিবারের। কাছে হস্তান্তরের কোনাে ব্যবস্থা হয়নি। আর এই ট্রাইব্যুনালে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনাে সুযােগ ছিল না।

আমি তৎকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলাম এবং আমি। ‘৭৭ সালের যে ব্যর্থ সেনাবিদ্রোহ হয় ওই বিদ্রোহীদের ট্রায়ালের জন্য ৬নং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলাম। এখানে লক্ষণীয় বিষয় আমি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেও এবং ট্রাইব্যুনাল ৬-এর চেয়ারম্যান থেকে আসলে সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল তখন তা সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। এখন আমার প্রশ্ন হলাে আমি যদি সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরিতে থেকে আসলে দেশে এবং সেনাবাহিনীতে কী হচ্ছে তা যদি না বুঝে থাকি তাহলে জনগণ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থেকে কীভাবে সঠিক পরিস্থিতি, সত্য ঘটনা বুঝতে পারবে? একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আজকে আমার ভেতর একটি উপলব্ধি এসেছে, এই হিসেবে আমি একটি সুপারিশ করতে চাই সেটি হলাে বিশ্বের অনেক দেশে অনেক ঘটনারই সঠিক তদন্ত প্রথমে বের হয়নি। কিন্তু পরে জনগণের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়ার ফলে যেমন বিশ্বের অনেক জায়গায় ট্ৰথ। কমিশন গঠিত হয়েছে, তারপরে টুথ কমিশন গঠিত হয়ে সত্য ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। আমি মনে করি এবং এই দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে এবং দেশপ্রেমিক একজন নাগরিক হিসেবে আমার সুপারিশ ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে কী হয়েছে, সেনাবাহিনীতে কী হয়েছে এবং ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যার

পরে কী হয়েছে- এইগুলাে জনগণকে জানানাের জন্য, দেশবাসীকে জানানাের জন্য সারা পৃথিবীতে সত্য ঘটনা উদ্ধৃতি করে সেজন্য বাংলাদেশে ট্রুথ কমিশন গঠন করা হােক এবং আসল ঘটনাগুলাে উদঘাটিত করা হােক। আমি মনে করি। এটি করলে জনগণ, দেশ ও বহির্বিশ্ব সঠিক জিনিসটি উপলব্ধি করতে পারবে।

সার্জেন্ট আফসার

সার্জেন্ট আফসার আলী খান বিডি : ৭৯১১৩ গ্রাম : শেখ শিমুইল পাে: : কদমতলী থানা : ঘাটাইল জেলা: টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শেখ শিমুইল গ্রামে সার্জেন্ট আফসারের বাড়ি। ২ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে শত শত অনেকের মতে হাজার হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিখোঁজ, ফায়ারিং স্কোয়াড অথবা ফাসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেছিলেন অভিযােগ রয়েছে সে ব্যর্থ অভুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সার্জেন্ট আফসার। বিমানবাহিনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস’ শীর্ষক পুস্তিকায় বলা হয়েছিল সার্জেন্ট আফসারই ব্যর্থ। অ্যুথানটির নেতৃত্ব দিয়ে রেডিওতে বক্তৃতা করেছিলেন। আমরা আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি অভূত্থানের পরে সার্জেন্ট আফসার গ্রেফতার হয়েছিলেন। জেলখানায় তার সঙ্গে কর্নেল আবু তাহের-এর অনুজ বর্তমানে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ােকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আনোয়ার হােসেনের দেখাও হয়েছিল। কিন্তু সার্জেন্ট আফসারের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? ইন্টারােগেশনে তিনি কী বলেছিলেন, কেন এবং কীভাবে তিনি এই অভুত্থানের সঙ্গে জড়ালেন তার কিছুই দেশবাসী। জানে না। এখন সার্জেন্ট আফসার সে সময়ের শত শত নিখোঁজ সৈনিকদের একজন। তার পরিবারও অ্যুত্থানের পর থেকে তার কোনাে সংবাদ জানেন না।

সার্জেন্ট এম এ মজিদ

সার্জেন্ট আফসার-এর সহকর্মী, ‘৭৭ এর ঘটনায় বিমানবাহিনী থেকে বরখাস্ত সার্জেন্ট আফসার একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব, একজন বিশাল নেতা, এই মাটির একজন সূর্যসন্তান ছিলেন। পুরাে ঘটনাটি আমরা অনেকেই অনেক কিছু ভুলে গেছি। সার্জেন্ট আফসার মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করতে পারেননি। কেননা সে সময়ে তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। কিন্তু তার ভেতরে যে তীব্র বাসনা ছিল সেটির প্রমাণ বহন করে যখন ‘৭২ সালে আফগানিস্তান ভারত হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। আফসার বাংলাদেশে জয়েন করার পরেই এয়ারম্যান মেসের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়। একবার যখন তিনি এয়ারম্যান মেসের দায়িত্ব পান পরবর্তীকালে বারেবারে বলতে গেলে এয়ারম্যান মেসের দায়িত্ব নেয়াটি তার জীবনের অন্যতম অংশে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে যখন কর্পোরাল থেকে তিনি সার্জেন্ট হন, সার্জেন্ট হয়ে সার্জেন্ট মেসে আসেন তখন দেখা গেল সার্জেন্ট মেসের দায়িত্বটিও আফসারকে দেয়া হলাে। আফসার ব্যক্তিগতভাবে খুবই রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। এজন্য তিনি প্রচুর পড়াশােনা করতেন। সার্জেন্ট আফসার এয়ারফোর্সে আমার তিন মাসের সিনিয়র ছিলেন। তার ট্রেড ছিল সাপ্লাই অ্যাসিস্টেন্ট, আমার ট্রেড ছিল ক্লার্ক জিডি । সেক্ষেত্রে কর্মে যে আমাদের যােগাযােগ- সেটি ছিল না। কিন্তু একদিন আমার বন্ধু সাহাবুদ্দিন আমাকে আফসারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তার নাম আফসার, সে দেশের জন্য কিছু করতে চায় এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য চিন্তাভাবনা করছে। সে সময়ে জাসদের আবির্ভাব।

জাসদ তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের থিওরি দিয়ে এ দেশে যারা সত্যিকার অর্থে কিছু চিন্তা করত, যারা মেধাবী ছাত্র ছিল বা যাদের দেশ সম্পর্কে মােটামুটি ভালাে ধারণা ছিল সে সব ছেলেদেরকে একত্রিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে সংগঠিত করার চেষ্টা করে। পরবর্তীকালে অনেকেই জাসদ থেকে সরে আসে। আমরা তখন, প্লাটফর্মে ছিল জাগমুই বা জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়ন এবং ভেতরে আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটি। দেবেন শিকদার, সিরাজুল হােসেন খান, মাহবুব উল্লাহ, কামরুল আনাম অনেকেই সেদিন জড়িত ছিলেন এবং এরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন। সে সময়ে জাগমুইর সভাপতি ছিলেন হাজী দানেশ, এনায়েত উল্লাহ খান ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাগমুইর সাথে সম্পৃক্ত সিরাজুল হােসেন খান পরবর্তীকালে এরশাদ সরকারের পশু মন্ত্রী হয়েছিলেন, শ্রমিক নেতা আবুল বাশার, দেবেন। শিকদার এখন পরলােকগত। আরাে অনেকের নামই বলতে হয় শহীদুল ইসলাম, গফুর, কামরুল আনাম সে সময়ে তারা কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে উপরে জাগমুই ভেতরে মূলত আন্ডারগ্রাউন্ডে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করতেন। আমরা তখন বুঝতে পারি পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসিজম, লেনিনের থিওরি দিয়ে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা করছে। আফসার আমরা সবাই মিলে প্রতিনিয়ত বিশেষ করে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহে মাহবুব উল্লাহর বাসায় যেতাম অথবা জাগমুইর অফিস মতিঝিলে গিয়ে রাজনৈতিক মিটিং করতাম। আমরা যখন ব্যারাকে থাকতাম, ব্যারাকেও ছােটখাটো একটি রুমে দরজা বন্ধ করে রাজনৈতিক ছােটখাট মিটিংগুলাে সারতাম । আফসারসহ আমরা প্রতি সপ্তাহেই জাগমুই অফিসে অথবা মাহবুব উল্লাহর বাসায় যেতাম, সেখানে আমাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে কথা হত, স্টাডি সার্কেলের মতাে হত এবং সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশােনা, আলােচনা এবং আগামীতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সত্যিকারভাবে জনগণের কাছে পৌছে দেয়া, এদেশের মানুষের বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি আনতে হলে কী করতে হবে এ বিষয়ে আমাদের প্রচুর পড়াশােনা করতে হত, আমরা করতামও। আফসার থেকে যােগ্য ব্যক্তি বা যােগ্য নেতা সে সময়ে এয়ারম্যান সমাজে আসলে কেউ ছিল না। আমার মনে পড়ে ২ অক্টোবরের একটি ঘটনা। সে সময়ে এক ওয়ারেন্ট অফিসারকে যখন জিগ্যেস করা হয়েছিল তুমি কেন এই বিপ্লবে। গেলে? তখন তিনি বললেন সার্জেন্ট আফসার বলেছে সেজন্য গিয়েছি। তুমি একজন ওয়ারেন্ট অফিসার, সার্জেন্টের কমান্ড, তােমার জুনিয়র, তার কমান্ডে কেন গেলে?

তখন তার একটি বক্তব্য ছিল- স্যার সবাই তাে সার্জেন্ট আফসারকে মানে। আমি ওয়ারেন্ট অফিসার হলে কী হবে? সবাই যখন সার্জেন্ট আফসারকে মানে অতএব আমিও তার কথাই মেনেছি। সার্জেন্ট আফসার, সে সময়ে তার একটি শার্ট এবং একটি প্যান্ট ছিল। আমি সবসময় তাকে ঐটি পরতে দেখতাম এবং তারপরেও তারকাছে কোনাে পয়সা থাকত না। যদি কখনাে কোনাে টাকাপয়সা থাকত মেসের বেয়ারা বা ওয়েটার যারা ছিল তাদের কারাে বােনের বিয়ে, বাবার অসুখ, মায়ের অসুখ যতদুর পারত দিয়ে দিতেন। সে সময়ে এয়ারম্যানরা আর কতই-বা বেতন পেত? দু’থেকে তিনশ’ টাকার বেশি তাদের বেতন ছিল তার ভেতর থেকেও সহযােগিতা করতেন। আফসার তার পরিবারের কাছে। কতটুকু অর্থ পাঠাতেন তা আমি জানি না, হয়তাে সামান্যই দিতেন আর বাকি অর্থ। যারা গরিব, মেসে কাজ করত তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে সহযােগিতা করাটা যেন তার ধর্ম হয়ে দাড়িয়েছিল । | এটি সার্জেন্ট আফসারের পৈতৃক বাড়ি। এবার নিয়ে এখানে আমার তৃতীয় দফা আগমন। প্রথম আমি যখন এসেছিলাম সেটি ১৯৭৬ সালে। সে আগমনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সে সময়ে সত্যিকার অর্থে আমরা রাজনৈতিকভাবে বসার জন্য যদিও বসতাম ব্যারাকের দরজা বন্ধ করে বসতাম তারপরেও সেটি নিরাপদ ছিল না বলেই আমাদেরকে শুধু সে কারণে একবার আসতে হয়েছিল। আমরা কতিপয় বন্ধু-বান্ধব একসাথে বসে মন খুলে আমাদের রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে পারব বা আমাদের ভবিষ্যৎ পন্থা কী অবলম্বন করব সেটিও আলােচনা করার জন্যই আমি এ-বাড়িতে এসেছিলাম। সেটি আফসারের দাওয়াতেই এখানে এসেছিলাম। আমার মনে আছে আমরা রাত্রিবেলায় এ বাড়িতে এসে পৌঁছি। যাহােক আফসার জাগমুইর সাথে জড়িত ছিলেন এবং পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির যে নীতি বা যেটিকে আমরা রাজনৈতিক ভাষায়। রণকৌশল বলি সেই রণকৌশলে নিজেকে শিক্ষিত করেছিলেন। আজকে যে ব্যর্থ। অভ্যুত্থানের জন্য সার্জেন্ট আফসার সম্পর্কে এত বিতর্ক এসেছে বলা হচ্ছে সে একজন দেশদ্রোহী, কেউ বলছেন সে সত্যিকার অর্থে একজন দেশপ্রেমিক। একটি কথা আছে- Betrayer is patriot if he successful. আজকে ব্যর্থ। বলেই তিনি বিতর্কিত হয়েছেন বা অনেকেই তাকে হয়তাে দেশদ্রোহী হিসেবে।

একটি পক্ষ তাকে ফাসি দিয়েছে, তাকে হত্যা করেছে। সৈন্যবাহিনীতে তখনকার দিনে অফিসার এবং এয়ারম্যানের মধ্যে ডিফারেন্স খুব প্রকটভাবে ছিল। একশ্রেণী আরেকশ্রেণীর ওপর যে আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব সেটি যেন মনে হত প্রভু এবং দাসের যে ব্যাপার সে রকম। এটি আফসার কখনােই সহ্য করতেন না। সে সময়ে যেসব রাজনৈতিক নেতারা, আজকে জাসদের অনেক বড় বড় বা জাগমুইর। অনেকে মন্ত্রীও হয়েছেন পরবর্তীকালে। কিন্তু তারা কোনােদিন সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ বা সার্জেন্ট আফসারের নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করে পত্রিকায় একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি- এটি হলাে সবচেয়ে দুঃখজনক কথা।

আফসারের সাথে আমার শেষ দেখা ১ অক্টোবর ১৯৭৭-এ। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমি সার্জেন্ট মেসে আসি। আফসার আমাকে খাওয়ায় এবং আমাকে একটি কথা বলেছিল, কালকে বগুড়াতে হয়েছে, আজকে ঢাকায় হবে। তখন আমি তাকে বললাম ঐটিতে (বগুড়ার) জাসদ করেছে। জাসদের রাজনীতির সঙ্গে তাে আমরা সম্পৃক্ত নই। জাসদের এসব ব্যাপারে কেন আমরা সহযােগিতা করব বা কেন জাসদের রাজনীতিতে যাব। এই কথাটি বলার পরে আফসার চুপ মেরে গেলেন। পরবর্তীকালে জেনেছি ভেতরে ভেতরে কর্পোরাল আলতাফের সঙ্গে তিনি একটি যােগাযােগ রাখতেন এবং তারা আর্মির কোনাে কোয়ার্টারে গিয়ে মিটিং করতেন। কর্পোরাল আলতাফ মারা গেছেন টাঙ্গাইলের কোনাে এক সম্মুখযুদ্ধে, বাতেন গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন।

একটি ঘটনা আমি পরবর্তীকালে জেনেছি অভুথানের পর যখন সবাই পালাচ্ছিল, যখন বুঝতে পেরেছে যে অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়েছে অনেকেই পালাচ্ছিল তখন আফসার ফ্রি ছিল এবং আফসারকে বলা হয়েছিল তুমিও পালিয়ে যাও। তখন আফসার বলেছিল না, আমার নামে, আমার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা এ অ্যুথানে জড়িত হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই আজকে ধরা পড়েছে, তারা। বন্দি হয়েছে, আমি যদি তাদেরকে ছেড়ে যাই তাহলে তাদের কাছে চিরদিন আমি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত হব। এবং শুধু তাকে কেউ যেন বিশ্বাসঘাতক না বলে এটি প্রমাণ করার জন্যই আফসার পালায়নি। ইচ্ছে করলে আফসার পালাতে পারত । সার্জেন্ট আফসারের যারা রুমমেট ছিল আমার মনে আছে তার রুমমেট তার এন্ট্রিফেলাে ক্লার্কজিডি তাজুল নামে একটি ছেলে ছিল- শুধু তার কথা আমার মনে আছে। এরকম আরাে আট-নয়জন ছিলেন। প্রত্যেককে হত্যা করা হয়েছে, প্রত্যেককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কারণ তাদের একটিই দোষ তারা সার্জেন্ট আফসারের রুমে থাকতেন। কোনাে প্রকার অভ্যুত্থানে অংশ না নেয়া ছাড়াই, শুধু আফসারের একজন বন্ধু এ-কারণে এয়ারফোর্স থেকে আমার চাকরি সরাসরি ২৪ ঘন্টার নােটিশে বলা হয়েছে- Your service been no longer required. যে সকল রাজনৈতিক নেতা, যে সকল রাজনৈতিক হঠকারিতার জন্য সার্জেন্ট আফসারের এই অভ্যুত্থান বা তার যে প্রচেষ্টা সেটি যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটি জাতি

জানতে পারেনি, সেটি জাতি জানুক। আজকে ৩০ বছর পরে হলেও আফসার সম্পর্কে আমি তার বাড়িতে আসতে পেরেছি, তার সম্পর্কে দু’টি কথা বলতে পেরেছি- এটি আমার কাছে, আমার মনে একটি বিশাল তৃপ্তি।

কর্পোরাল মােনেম খান

সার্জেন্ট আফসার-এর সহকর্মী ‘৭৭-এর ঘটনায় আড়াই বছর কারাভােগী আমি প্রাক্তন কর্পোরাল মাে. মােনেম খান। ১৯৭০ সালে প্রথমে চাকরিতে জয়েন। করি, ‘৭১ সালের জুলাই মাসে ছুটিতে আসি। ছুটিতে আসার পরে মুক্তিযুদ্ধ করি। তারপরে আবার চাকরিতে জয়েন করি। আমি আফসার ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচিত হয় ১৯৭২ সালের কোনাে এক সময়। তখন তিনি আমাদের মেসের। অভার অল ইন চার্জে ছিলেন। তিনি আমাকে নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি আদর করতেন। ঘটনার দিন ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর, তার একদিন আগে আমাকে ছুটিতে আসতে, বাড়ি যেতে মানা করেন। রাতে উনি আমাকে ডেকে নিয়ে, তারপরে আরাে লােকজন নিয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি। অনেক কিছুই ঘটে যায় । সম্পূর্ণভাবে আমি আফসার ভাইয়ের সাথেই ছিলাম। আফসার ভাই যখন প্রথমে। এয়ারপাের্ট টারমার্ক বিল্ডিংয়ে এ.জি. মাহমুদ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌফিক আমিন- উনাদেরকে বাঁচায়। বাঁচানাের পরে উনাদেরকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে গমন করেন। কুর্মিটোলা যাওয়ার পরে উনাদেরকে রেখে আফসার ভাই সি,এম,এইচ-এর কাছে আসার পথে গ্রেফতার হয়ে যান। হঠাৎ সেই মুহূর্তে রাস্তা দিয়েও দেখি অনেক আর্মি টুপ সাদা ফ্ল্যাগ নিয়ে মুভ করছে। তখন আমি আমার কয়েকজন লােকসহ বিএফ বেস বাশার থেকে পূর্বদিক দিয়ে টোবাকোর ওই সাইড দিয়ে আমরা পালিয়ে যাই। পালিয়ে গিয়ে দু’দিন ঢাকাতে আত্মগােপন করে থাকি। আমাদেরকে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় আরম্ভ করে তখন। আমি ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে দেশে অবস্থান করি। দেশে শুনি আমার বিরুদ্ধে পুলিশ হয়রানি এবং ধরপাকড়ের নানারকম চেষ্টা চলছে। তখন আমি দীর্ঘদিন। প্রায় ২ বৎসর আত্মগােপন করে পালিয়ে থাকি।

পালিয়ে থাকার পরে ‘৭৯ সালে আমি বাড়ি থেকেই পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হই। তখন আমাকে নাম্বার-১ বিএনএস ইউনিটে আটকিয়ে রাখে। এভাবে আমাকে ছােট একটি সেলের ভেতরে, আমাকে কি ফাঁসি দিবে, না জেল দিবে, আমাকে নিয়ে কী করবে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দুই বৎসর আটকিয়ে রাখে। যখন আমি এয়ারফোর্স কারাগারে। তখন আমি আফসার ভাই সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানতে পারি। উনার বন্দিদশা। জীবনে উনি কী করেছেন, তারপরে কীভাবে উনাকে ফাসি দিয়েছে, কবে কোথায় উনাকে ফাঁসি দিয়েছে—এসমস্ত অনেক কিছুই জানতে পারি। তারপরে একদিন যখন এসিএস অ্যাডমিন এয়ার কমােডর হুমায়ুন সাহেব বিএনএস ইউনিট ইন্সপেকশনে আসেন তখন আমার অবস্থা দেখে উনি আমাকে আশ্বস্ত করেন ঠিক আছে আমি তােমাকে একটি ডিসপজাল, উইথইন শর্ট টাইমে তৈরি করে দেব। তখন আমাকে দুই বৎসরের সাজা দিয়ে দেয় এবং সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে আমি আমার সাজা ভােগ করি। আফসার ভাইয়ের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার অনেক কথা আছে। যেগুলাে অস্পষ্ট রয়ে গেছে- জাতি কোনােদিন জানতে পারেনি। জাতির কাছে সেগুলাে প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি। আমরা চাই তাকে কেউ যদি মিসগাইডেড করে থাকে তাহলে সেটি প্রকাশ করা হােক। আর আফসার ভাই যদি সত্যিকারের দেশের জন্য কিছু করে থাকে তাহলে সেটিও প্রকাশ করা হােক। | বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরে দেশে একটি অনিশ্চয়তা এসে পড়ে। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার লিঙ্গ এবং বিভিন্ন কারণে তখন এর প্রতিবাদ আমরাও করি। দেশে তখন শাসনতন্ত্রের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। নানান ধরনের কে ক্ষমতা নিবে, কে কী করবে এই ধরনের একটি বিশ্বাস এসে যায়। আমার চাকরি জীবনের যে সুযােগ-সুবিধা তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আমাকে ছেলেমেয়ে নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করতে হয়েছে।

মাে. লুৎফর রহমান খান কেয়া

সার্জেন্ট আফসার-এর অনুজ শেখ শিমুইল, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল আমি সার্জেন্ট আফসারের ছােটভাই লুৎফর রহমান খান। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে যখন অভ্যুত্থান হয়, এই অভ্যুত্থানের খবর শুনে আমি ঢাকা চলে যাই। চলে যাওয়ার পরে আমি বিমানবাহিনীর এয়ারম্যান মেসে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করি। তখন ঐখানে যারা ডিউটি অফিসার ছিল, তারা আমাকে বলল ঐখানে। যাওয়া যাবে না এবং আফসার কোথায় আছে তাও আমরা বলতে পারবাে না। পরে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাই। ঐখানে গিয়েও ভাইয়ের কোনাে সন্ধান করতে পারলাম না। বাড়িতে ফিরে আসলাম। ফিরে এসে আবার দুইদিন পরে গেলাম । তারপরেও ভাইয়ের কোনাে সন্ধান করতে পারলাম না। ১৯৭৬ সালে বিমানবাহিনীর আট-দশজন সদস্য আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আসার পরে উনারা এই ব্যাপারে একটি আলাপ-আলােচনা করেছিল। আমার ভাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য যােগাযােগ রক্ষা করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন যেটিকে জাগমুই বলত- সিরাজুল হােসেন খান, দেবেন শিকদার, হাজী দানেশ, এনায়েতুল্লাহ খান-এরা অনেকেই জাগমুই’র সাথে সম্পৃক্ত ছিল। জাগমুই হলাে প্রকাশ্য (ওপেন) রাজনৈতিক দল এবং তাদের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন ছিল। সেই সংগঠনের নাম ছিল

পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি। দেবেন শিকদারের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় ছিল। উনি আমাদের এখানে এসেছেনও। বাশার ভাই (শ্রমিক নেতা আবুল বাশার) উনার সাথেও আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় ছিল । বিমানবাহিনীর বিভিন্ন অফিসার, তখন শুধু বিমানবাহিনীর মধ্যে এই সংগঠনটি বিদ্যমান ছিল না, আর্মির মধ্যেও ছিল। আর্মির অনেক মেজর ভাইয়ের সাথে মিটিং করত—এ ব্যাপারেও আমি জানতাম । কিন্তু ২ অক্টোবরের যে অভ্যুত্থান, এই অভ্যুত্থান যে ব্যর্থ হয়েছে, আমাদের একটিই দাবি, আমাদের ভাই এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে। আমার ভাই অপরাধ করেছে, তার অপরাধের বিচার হােক এটিও আমরা কামনা করি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম না কী অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে এবং কোথায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে- এ ব্যাপারে আজ পর্যন্তও আমরা কোনাে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাইনি। শুধু এই কথাই শুনেছি যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। কোন কারাগারে দিয়েছে, কত সালে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আমার ভাই সবসময় আমাদেরকে বলত লেখাপড়া শেখ এবং মানুষকে ভালােবাসতে শেখ। গরিব মানুষের সাথে সবসময় ভালাে আচরণ করবে, তােদের আচরণে মানুষ যাতে কষ্ট না পায়। আমরা পরস্পর শুনেছি ঐ অভ্যুত্থানের নাকি সম্পূর্ণ নেতৃত্বই আমার বড় ভাই দিয়েছিল। সার্জেন্ট আফসার দিয়েছিল এবং উনারা রেডিও সেন্টার দখল করেছিল এবং এও শুনেছি যে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের জাতীয় নেতা ভাষণ দেবেন। ২ অক্টোবর যে অভ্যুত্থান এর এক মাস আগে ভাই বাড়িতে এসেছিল। এক মাস আগে ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। তারপরে আমাদের আর কোনাে দেখাসাক্ষাত হয়নি। এই যে অভ্যুত্থানটি হলাে কেনই-বা তারা এই অভ্যুথানটি করল- এ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনাে সঠিক তথ্য নেই।

মাে, হাশমত আলী খান

সার্জেন্ট আফসার-এর অনুজ শেখ শিমুইল, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল আজ ৩০ বছর পরে আপনারা আমার ভাইয়ের ইতিহাস, স্মৃতিটি আমাদের সামনে এনেছেন সেজন্য আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। 500745 ল্যান্সনায়েক হাশমত আলী, আমি বিমানবাহিনীর এমওডিসি শাখায় ‘৭৭-এ ১৬ জুলাই ভর্তি হই। ভাই ভর্তি করে দেন। ভর্তি হওয়ার প্রায় মাসখানেক পরে ভাই এবং কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আসার পরে বলল তােমার অ্যাপয়নমেন্ট কার্ড কয়েকদিন পরে আসবে, কোনাে চিন্তা করিস না। ‘৭৭-এর ২ অক্টোবর আমার ভাই নিখোঁজ হয়ে যান। ভাইয়ের কোনাে খোঁজ-খবর পেলাম না। এমনকি আমার চাকরির ব্যাপারেও কোনাে কিছু অ্যাপয়নমেন্ট লেটার আসলাে না। ‘৭৮-এ

পুনরায় অ্যাপয়নমেন্ট কার্ড আসে। আমি জয়েন করি। দুঃখের বিষয় কিছু সংখ্যক বিমানবাহিনীর সদস্য আমাকে চিনতেন। আমি মাঝে মধ্যে ভাইয়ের ঐখানে যেতাম। চিনে ওরা আশ্চর্য হলেন এবং আমাকে উপদেশ দিলেন তুমি কখনাে তােমার ভাইয়ের কথা বলবে না। যদি তােমার ভাইয়ের কথা বলাে তাহলে তােমাকে ট্রেনিং সেন্টার থেকে বিদায় নিতে হবে। ভাইয়ের ব্যাপারে উনারা আমাকে অনেক উপদেশ দিতেন। তুমি দাঁতে দাঁতে কামড় দিয়ে, তােমার ভাইয়ের যত দুঃখই থাক, বুকে চাপা দিয়ে ট্রেনিংটা করে যাও। ট্রেনিং করার পর তােমার হয়তাে কোনাে সমস্যা হবে না। আমি ১৫ বছর চাকরি করে এসেছি। হয়তাে দুই-এক বছর পরে ভাইয়ের পরিচয় দিয়েছি, প্রপারলি পরিচয় দিয়েছিযে আমি সার্জেন্ট আফসারের ভাই। অনেকে এই কথা শুনে, আমার ভাইয়ের কথা। শুনে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছে, ছােট ভাই হিসেবে। কেন কেঁদেছে জানি না। আফসারের ভাই বলে আমাকে সবাই আদর করত। আমার ভাই যদি আসলেই অন্যায় করতেন তাহলে বিচারের মাধ্যমে তাকে শাস্তি দিতেন। একটি লােক অন্যায় করলে শাস্তি হতে পারে। মৃত্যুদণ্ড হয়, জেল খাটতে হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড হলে তার লাশটি তাে তার পরিবারের হাতে দিতে হবে। কিন্তু আমার ভাইকে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার আসলেই মেরেছে কি না- আমরা কোনাে হদিস পেলাম না। তাহলে তার লাশটি দেয়া হলাে না কেন? সে কোথায় আছে আজ? আমাদের সংসার বড় ছিল। উনি চাকরি করতেন। আমাদের সংসারটি খুবই অস্বচ্ছল অবস্থায় ছিল, সঙ্কট ছিল। ছােট সময় পিতা মারা গিয়েছিল । আমাদের ভাই আমাদেরকে লেখাপড়া করিয়েছে। মাসিক বেতন পেয়ে হয়তাে ১০০, ১৫০ এভাবে টাকাটি দিতেন। আর বাকি টাকাগুলাে কী করেছেন, শুনেছি ভাই নিরীহ গরিব মানুষকে দিতেন।

মিসেস হাফিজা বেগম

সার্জেন্ট আফসার-এর বােন। শেখ শিমুইল, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল পাঁচ ভাই ছিল, আর তিন বােন ছিলাম। দুই বােনের ছােট আমার ভাই। সবাই তারে ভালােবেসেছে। তারপর কী করেছে সরকার, সরকারে আমরা বলতে পারবাে না, আমরা কিছু জানি না। আপনারা ভাইয়ের বিচারটা করে দিবেন? কোন দোষে আমার ভাইডারে মারল সরকার। কোথায় আছে তাও জানি না। কোন দোষে তারে কী করলাে, এটার বিচার চাই আপনাদের কাছে। আমার মায়ের তাে এখন কোনাে জ্ঞান নেই। কোনাে কিছু কইতে পারে না। অনেক দিন হলাে কানতে কানতে তার সব জ্ঞান হারাইয়া গেছে।

মিসেস জয়গন নেছা বেওয়া

সার্জেন্ট আফসার-এর মা শেখ শিমুইল, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল আমার ছেলে। লাশ কোথায় রাখছে আমি জানি না। কারাদণ্ড দিয়া থুইছে? আমার।  ছেলে, সরকার মারলাে কে? জেলখানায় ভইরা থুইত। আমার ছেলের লাশ কী। করলাে? সরকার আমার লাশ দেন লাগবাে, আমার লাশ দেন লাগবাে। আমার। লাশ কী করলাে? কতবড় অন্যায় করেছিল আমার ছেলে, তারে জেলখানায় ভইরা। থুইত, তারে জেলখানায় ভইরা থুইত, আমি দেখতাম, আমি যাইয়া দেখতাম জেলখানায় । আমারে যাবজ্জীবন ভইরা কামাই কইরা খিলাইত (খাওয়াইত)। আজকে আমি ভালাে কইরা দেখতাম। আমি যদি লাশ দেইখা মরার হারতাম, তাও শান্তি পাইতাম (আমি যদি লাশ দেখে মরতে পারতাম, তাও শান্তি পেতাম)। আমার কলিজা ঠাণ্ডা থাকত (আমি শান্তি পেতাম)। আমি লাশ দেইখা মরার হারলাম না (আমি লাশ দেখে মরতে পারলাম না)।

অধ্যাপক ড. আনােয়ার হােসেন

কর্নেল তাহের-এর অনুজ। চেয়ারম্যান, বায়ােকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়ােলজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঘটনার কথা বলছিলাম। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে যখন সাজা হলাে বারাে বছরের, তারপর ১৯৮০ সালের শেষের দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পাই। তার পূর্ব পর্যন্ত এই পাঁচ বছর আমি কারাগারে ছিলাম। এই সময়টাতে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ওই দিনগুলােতে আমি ঢাকা কারাগারে আছি। বলছিলাম সেই বিভীষিকাপূর্ণ রাতগুলাের কথা যখন এক রাতে, প্রতি রাতেই প্রায় দশ-বারােজন সাধারণ সৈনিকদের ফাঁসি দেয়া হত। আমি যে ২০ সেলে তার উল্টোদিকে ছয় সেল, ফাসির সেল, কনডেম সেল। ফাসির দুটো সেল আছে। একটি যেটিকে বলা হয় আট সেল, যেখানে কর্নেল তাহের ফাসির আগে ছিলেন। আরেকটিকে বলা হয় ছয় সেল। সেই ছয় সেলে কনডেম আসামি অর্থাৎ ২ অক্টোবরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত যাদেরকে ফাসিতে ঝুলতে হবে তারা। সেখানে ছিল। তাদের নেতা সার্জেন্ট আফসারও সেখানে ছিলেন। আমি সেটি যখন জানলাম, তখন সেই কারারক্ষীদের অনুরােধ করেছিলাম এবং আমার সেই অনুরােধে একদিন তারা আমাকে আমার সেল থেকে দিনের বেলা যখন সেল। খােলা হয়, সেখান থেকে বের করে ওই সেলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। এবং সারাদিন আমি সেই সার্জেন্ট আফসারের সঙ্গে আলােচনা করতে পারলাম। সন্ধ্যার সময় আমি আবার নিজের সেলে ফিরে আসি। এবং তার কাছ থেকে আলােচনায় ২ অক্টোবরের সেই ঘটনাগুলাের কথা আমি শুনলাম। অনেক কিছুই আমার মনে নেই। কিন্তু যে বিষয়টি আফসার সেদিন বলছিল। বলছিল সেই যে।

৭ নভেম্বরের সিপাহি অভ্যুত্থান তারই ধারাবাহিকতায় তারা এই ‘৭৭ সালের অভ্যুত্থানটি রচনা করেছিল। অর্থাৎ সেই যে অপূরণিত বারাে দফা দাবি, সেই দাবিতে অপূরণিতই রয়ে গিয়েছিল এবং সেই কারণেই অভ্যুত্থান। ইমিডিয়েটলি যে কারণটি সে উল্লেখ করেছিল সেটি হলাে বেতন নিয়ে। প্রতিশ্রুতি ছিল বেতন বাড়ানাে হবে সৈনিকদের, সে বেতন বাড়ানাে হলাে না। এবং তারই ফলে সে অভ্যুত্থানের একটি স্কুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল এবং সেখানে এয়ারফোর্সের যে ননকমিশন অফিসারেরা, যেটিতে সার্জেন্ট আফসার নিজেও ছিলেন তিনি সেখানে নেতৃত্ব দিলেন। তিনি বলছিলেন, তাদের সাথে যােগাযােগ হয়েছিল উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের যাদের অন্যতম ছিলেন মীর শওকত একজন। তখন সে নবম ডিভিশনের কমান্ডার, মেজর জেনারেল ছিলেন এবং সে জানিয়েছিল সে তাদের নেতৃত্ব দেবে। এই অভ্যুত্থান যখন শুরু হলাে এক পর্যায়ে আর্টিলারির (তার নামটি আমি ভুলে গেছি) একজন নায়েক যে সেই আর্টিলারির শেল বর্ষণ করত, সে আর্টিলারির মুখটি ঘুরিয়ে দিয়েছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিকে। সম্ভবত ৬ ইস্ট বেঙ্গল হবে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং সেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের আশ্রয়স্থলের দিকেই তারা তাক করেছিল টু ফিল্ড আর্টিলারির সেই আর্টিলারির গান। কিন্তু সে সময়ে খবর আসল অন্যরা খবর দিল মীর শওকত যােগ দিচ্ছেন এবং এটি সফল হয়ে গেছে সুতরাং এই গােলাবর্ষণের প্রয়ােজন নেই। কারণ এই গােলাবর্ষণে তাে অনেক লােক হতাহত হবে এবং সেখান থেকে তাকে বিরত রাখা হলাে।

বলছিল সেই নায়ক যে সেদিন যদি সেই একটি গােলাবর্ষণ করতাম তাহলে হয়তাে আর মীর শওকতেরও প্রয়ােজন হতাে না এবং তাদের এই অভ্যুত্থান সেটি বিফল হত না। এই ধরনের নানা উপাখ্যান, নানা কাহিনী আমি সেখানে শুনেছি। সার্জেন্ট আফসারকে আমি দেখেছি সে নিজেও কিন্তু ভীত ছিল না। তার কিন্তু তখনাে ফাসির আদেশ হয়নি, অন্যদের ফাসি হচ্ছে। কিন্তু সে নিজেই বলছিল আমি নেতৃত্ব দিয়েছি, ফাঁসি দেয়া হলে আমাকে দেয়া হােক। অন্যরা অনেকেই ছিল এই ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অনেকে আকস্মিকভাবে এটিতে অংশ নিয়েছিল। কেউ তাে অংশও নেয়নি। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। এমন ঘটনাও আছে নামের ভুলের কারণে অন্যজনকে ফাঁসি দেয়া হয়ে গেছে এবং যখন তাদের ফাঁসির মঞ্চের দিকে টেনেহিচড়ে নেয়া হচ্ছিল তখন তাদের আর্তচিৎকার এবং তাদের সে অভিশাপ আমার কানে এখনাে বাজে। তারা অভিশাপ দিচ্ছিল, আমি আল্লাহর নামে অভিশাপ দিচ্ছি তাদের ওপর গজব নেমে আসুক। আমরা নিরপরাধ, আমরা কিছুই জানি না এই সম্পর্কে, আমাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। আবার অনেকে যারা নিউকি ছিল এবং তারা স্লোগান দিতে দিতেও ফাসির মঞ্চের দিকে গেছে- এই ঘটনাগুলাে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই সময়ে।

হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুমদার (অব.)

কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দি ২২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক সৈনিক কারাগারে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকের খবর পেতে থাকি। বগুড়ায় ছিল ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সেই ব্যাটেলিয়নের আমি ছিলাম এ্যাকটিং নায়েব সুবেদার অ্যাডজুটেন্ট। সেই ব্যাটেলিয়নে ২ অক্টোবর একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। সেখানে সুবেদার মেজর ছিলেন চান মিয়া (২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উনি) ২২ বেঙ্গলের সুবেদার মেজর আর আমি ২২ বেঙ্গলের নায়েব সুবেদার অ্যাডজুটেন্ট। সে জায়গাতে উনিসহ অগণিত সৈনিকদের হত্যা করা হয়, চাকরিচ্যুত করা হয়। আজও তারা জানে না। তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে, ভাই-বােনদের সাথে দেখা হলে তারা আজও জানেনি তার লাশটি কী করা হয়েছে, তার কী অপরাধ ছিল।

মাে, আলী কামাল

‘৭৭ সালে রাজশাহী জেলে রাজনৈতিক বন্দি গণফাঁসির প্রত্যক্ষদশী রানীবাজার, ঘোড়ামারা, রাজশাহী আমি ৭নং সেক্টরের একজন মুক্তিযােদ্ধা ছিলাম। ৭৭-এ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে বহুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ডিটেনশন দিয়ে জেলে পাঠানাে হয়। তখন রাজশাহী জেলে ডিভিশন ওয়ার্ডে আমি, তঙ্কালীন এমপি জলিল ভাই, চাটমােহর পাবনার এমপি সামাজী ভাই, পাবনার প্রবীণ নেতা আমজাদ ভাই, এখানের (রাজশাহীর) কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মঞ্জুরুল ভাই এরকম বহুলােক আমরা ডিটেনশনে রাজশাহী জেলে ছিলাম। আমরা ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকাবস্থায় বগুড়ার কু-টি হয়। আমরা সকালে খবর পেলাম বগুড়ার কু-এর আসামি কিছুকে রাজশাহী জেলে পাঠনাে হবে এখানে তাদের ফাসি হবে। ফাঁসির আগে জেলে কয়েকজন গােপনে বলে গেল জল্লাদ এসেছে- আজকে এখানে ফাসি হবে। মােটামুটি শুনলাম যে ২৬ জন সেনাবাহিনীর লােক যাদের ফাসি হবে এখানে তারা রাতে আসবে। হঠাৎ করে রাত ৮ টার দিকে জেলার সাহেব তার লোকজন নিয়ে আসলেন ডিভিশন ওয়ার্ডে । বললেন আমরা তাে সাধারণ কয়েদিদের কিছু খাওয়াতে পারি না, আপনারা যদি একটু আমাদের সাহায্য করেন। এই লােকগুলাের তাে একটু পরেই ফাসি হবে, আপনারা যদি একটু পাক করে দিতেন তাহলে আমরা ওদের খাওয়াতাম ।

জলিল ভাই বললেন, কামাল তুমি যাও। উনারা বাজার-টাজার করে দিবে। আমাদের ডিভিশন ওয়ার্ডের সামনেই কিচেন ছিল। সেখানে আমরা পাক করে রাত ১১ টার মধ্যে ওদেরকে খাওয়াবার জন্য তৈরি করে দিলাম। আমার কাছে বেদনাদায়ক মনে হচ্ছিল এবং বিচারটি যে কোনােমতেই সুষ্ঠু বিচার হয়নি তার প্রমাণ স্বরূপ সেদিন ২৬ জনের ফাসি হওয়ার কথা থাকলেও সকাল হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকের ফাসি হয়নি। দশএগারােজন বাকি ছিল। এই বাকির মধ্যে সকালে জেলে একটি অর্ডার এসেছিল (পরে আমরা যেটুকু শুনেছি) একজনকে যদি ফাসি দেয়া না হয়ে থাকে তাহলে যেন দেয়া না হয়। সৌভাগ্যক্রমে ঐ ভদ্রলােকের সেদিন ফাসি হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন কোনাে মৌখিক বা টেলিফোনের নির্দেশে ফাসির আসামি মওকুফ হবে না। ফাঁসি দেয়ার আগে পর্যন্ত যদি আপনাদের কোনাে অর্ডার, লিখিত ম্যাসেজ আসে তাহলে ফাসি হবে না। পরে সেই ভদ্রলােক বেঁচে যান এবং বলেন যে, আমি ছুটিতে ছিলাম । কোনাে ফাইল না দেখে আমাকে ফাসির জন্য পাঠিয়েছে। যদি প্রথম দিন আমার ফাসি হত তাহলে আমি আজকে এই পৃথিবীর আলাে দেখতে পেতাম না। ঐখানে যে ডাক্তার ছিলেন তিনি আমার একটু আত্মীয় হতেন। ওই ফাসির ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গিয়ে এবং তাদেরকে ঐ অবস্থায় দেখে তার হার্ট অ্যাটাক করে ও কিছুদিন পরে তিনি মারা যান। তার নাম হলাে ডা, কবির (ডাকনাম), শিবগঞ্জে বাড়ি।।

সূত্র : সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ – ১৯৮১ – আনোয়ার কবির