You dont have javascript enabled! Please enable it! সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা - ১৯৭৬ - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৭৬

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। এর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কতক মহলের সহায়তায় জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। সপরিবারে নিহত হন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান। নৃশংসভাবে ক্ষমতা দখলের আড়াই মাস পরে বীর মুক্তিযােদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে সংঘটিত হয় পাল্টা অভ্যুত্থান। খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থানের তিন দিন পর বীর মুক্তিযােদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের বীর উত্তমের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় সিপাহি অভ্যুত্থান। এসময়ে নিহত হন মুক্তিযােদ্ধা মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ বীর উত্তম, কর্নেল হায়দার বীর উত্তম, কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রমসহ কয়েকজন। মূলত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম  প্রধান। বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন। প্রশাসক করে নিজে সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তিনি। ৭ নভেম্বরের ঘটনার পরে ২৪ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় কর্নেল তাহেরকে। দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় তাকেসহ ৩৩ জনকে। ১৪ জুন কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে প্রেসিডেন্ট করে গঠন করা হয় বিশেষ সামরিক আদালত । কোর্ট মার্শালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার পরবর্তীকালে ১৯৮২ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে বেসামরিক চাকরি করেন। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ সালে ৫২ বছর বয়সে। মৃত্যুবরণ করেন। ২১ জুন কোর্ট মার্শাল কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করে। রায় ঘােষণা করা হয় ১৭ জুলাই বিকেল তিনটায়। রায়ে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডসহ অধিকাংশ অভিযুক্তকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং কয়েকজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ২৬ দিনে সম্পন্ন করা হয় ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালেরি কাজ। ২১ জুলাই ভাের চারটার সময় কার্যকর করা হয় কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড। কর্নেল তাহেরের ফাঁসির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিশেষ সামরিক আদালতের প্রথম শিকারে পরিণত হন তিনি।

কর্নেল তাহেরের এই বিচার নিয়ে শুরু থেকেই রয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন। অভিযােগ উঠেছিল প্রহসনের বিচারের। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত হয়েছে বিচার সংক্রান্ত বর্তমান প্রতিবেদন। প্রধান আসামি : লে. কর্নেল আবু তাহের (অব.) বীর উত্তম গ্রেফতার : ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ আদালত গঠন : ১৪ জুন ১৯৭৬ (১নং সামরিক আদালত) চেয়ারম্যান : কর্নেল ইউসুফ হায়দার কোর্ট মার্শাল শুরু : ২১ জুন ১৯৭৬ রায় ঘােষণা : ১৭ জুলাই ১৯৭৬, বিকেল ৩টা। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর : ২১ জুলাই ১৯৭৬, ভাের ৪টা

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সর্বমােট কোর্ট মার্শাল ২৬ দিন

কর্নেল আবু তাহের (অব.) বীর উত্তম সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি

লে, কর্নেল আবু তাহের ১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ সালে আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। আট ভাই তিন বােনের সংসারে তাহের ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ । মাতা আশরাফুন্নেছা । সিলেট এম.সি কলেজ থেকে তাহের বি.এ পাস করেন। বি.এ পরীক্ষা দিয়ে ফল প্রকাশ পর্যন্ত তাহের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। বি.এ পাস করে তাহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে এম.এ ভর্তি হয়। ১৯৫৯ সালে সমাজবিজ্ঞানে এম.এ প্রথম পর্ব শেষ করে সিদ্ধান্ত নেন সেনাবাহিনীতে যােগ দিবেন। সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে ১৯৬০ সালে কমিশন লাভ করেন। প্রথমে পদাতিক বাহিনী পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সাল থেকে পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ কমান্ডাে বাহিনীর ‘স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট অফিসার হিসেবে তাহের কর্মরত থাকেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তাহের শিয়ালকোট সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে মারাত্মকভাবে আহত হয়। ১৯৬৭ থেকে ‘৬৯ সাল পর্যন্ত তাহের চট্টগ্রাম।

সেনানিবাসে কমান্ডাে ব্যাটালিয়নে অবস্থান করেন। ৭ আগস্ট ১৯৬৯ সালে তাহের এক সময়ের ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা লুঙ্কা বেগমকে বিবাহ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজে সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্সে যােগ দেন।  তাহেরই ছিলেন একমাত্র বাঙালি অফিসার, যাকে “মেরুন প্যারাসুট উইং’ প্রদান করা হয়। তিনি ১৩৫ স্ট্যাটিক লাইন প্যারাজ্যাম্পের কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। এ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন শিক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়। জর্জিয়া কলম্বিয়া রেঞ্জার ট্রেনিং কমান্ড তাকে ‘রেঞ্জার টেপ’-এ ভূষিত করেছিল। ১৯৬৯-এর শেষের দিকে নর্থ কেরােলিনার স্পেশাল ফোর্সেস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে তাহেরকে অনার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এছাড়াও ২৫২ বার স্কাইজাম্প করার দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারীও ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, সে সময়ে কোনাে এলাইট অফিসার এতগুলাে কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের পর তার সাটিফিকেটে লেখা হয়, ‘এ যােদ্ধা বিশ্বের যে কোনাে জায়গায়, যে কোনাে সেনাবাহিনীর সাথে, যে কোনাে অবস্থায় যুদ্ধ করতে সক্ষম।’  ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করে। তাহের তখন পাকিস্তানের কোয়েটায় স্কুল অব ইনফ্রেন্টি এন্ড টেকটিক্সে’- সিনিয়র টেকনিকেল কোরে অংশ নিচ্ছিলেন। ২৬ মার্চ কোয়েটা সামরিক অফিসার ক্লাবে একজন পাঞ্জাবি অফিসার শেখ মুজিব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় তাহের তার প্রতিবাদ করলে তাকে বন্দি করা হয়। কয়েকবার পালানাের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ জুলাই মেজর তাহের, মেজর মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী এবং একজন সিপাহিসহ এ্যাবােটাবাদ দিয়ে ভারতের দেবীগড় সীমান্ত অতিক্রম করে তাহের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তাহের নিযুক্ত হন। ১৪ নভেম্বর তার তেত্রিশতম জন্মদিনে কামালপুর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শেলের আঘাতে তিনি তার বাম পা হারান। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাহের স্বাধীনতার পর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। যুদ্ধের মধ্যেই মেজর তাহের স্বাধীন বাংলা সরকার কর্তৃক লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন।  তাহেরের ভাই-বােনেরাও সকলে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বড় ভাই আবু ইউসুফ সৌদি আরব থেকে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন এবং যুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন। আরাে দু’ভাই ওয়ারেছাত হােসেন বেলাল ও সাখাওয়াত হােসেন বাহার বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। 

১৯৭২-এর এপ্রিল মাসে ভারতের পুনা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে নকল পা লাগিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর লে. কর্নেল তাহেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের সাথে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে লে. কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী হতে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর তাহের নবগঠিত (তত্ত্বালীন) রাজনৈতিক দল জাসদের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হন। ৭ নভেম্বর লে. কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে তাহেরকে এস.এম হল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, ২১ জুলাই ভাের ৪টায় কার্যকর করা হয় মৃত্যুদণ্ড।

হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুমদার (অব.)

মামলায় এক বছর সশ্রম কারাভােগী আমি সার্জেন্ট মেজর অবসরপ্রাপ্ত আবদুল হাই মজুমদার। আমি ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীতে যােগ দিই। আমরা কয়েকজন মিলে একটি সংগঠন করতে গিয়ে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে জাসদের গণবাহিনী তকালীন ঐ সংগঠনের সাথে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। সেখানে আমাদের সাথে ছিলেন এয়ারফোর্সের কর্পোরাল আলতাফ, কর্পোরাল মজিদ, কর্পোরাল শামছুল হক, আমাদের রেজিমেন্টের নায়েক সিদ্দিক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলেন সুবেদার জালাল, সুবেদার মাহবুব, বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন চান মিয়া, তারপরে তারু মিয়া, সুবেদার মেজর ছিলেন। অনারারী ক্যাপ্টেন হয়েছেন সুবেদার শহীদ, সুবেদার নূরুল হক- এদেরকে নিয়ে আমরা আমাদের এই দেশে যেভাবে আমরা যুদ্ধ করেছি, যুদ্ধের সময় অনেক যােদ্ধাকে হারিয়েছি, সেভাবে যাকিছু পাওয়ার জন্য করেছি, আমরা দেখলাম যে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এইভাবে আমরা একত্রিত হয়ে একটা সংগঠন করতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারব বলে বিপ্লবী। সৈনিক সংস্থা নামে এই সংগঠনটি আমরা করি। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে চায়না বিল্ডিংয়ে আজিমপুরে সেখানে উনি আমাদের নির্দেশনা দিলেন, কিছু বইপুস্তক দিলেন কীভাবে জাতির উন্নতি করা যায়, দেশের উন্নতি করা যায়, আমরা। কিভাবে দক্ষ হতে পারি, আমরা কীভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারি, সেভাবে যেন আমরা ভবিষ্যতে আমাদের অধিকার আদায় করার জন্য জাতিগতভাবে কাজ করে যেতে পারি সেজন্য আমাদেরকে এই ইন্সট্রাকশনগুলাে উনি দিতেন। সেই সংগঠন করতে গিয়ে আমরা ব্যাপকভাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, যে যেখানে ছিলাম, সৈনিকরা, যােদ্ধারা আমরা এই সংগঠন করেছিলাম। এর ভেতর সবই আমরা ছিলাম মুক্তিযােদ্ধা। আমাদের সাথে কোনাে অমুক্তিযােদ্ধা ছিল না। ১৫ আগস্টে জাতির জনককে হত্যা করা হয়। আমরা কোনােভাবেই এই হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারিনি। দেশে কোনাে রাষ্ট্রপ্রধান ছিল না। সেনাবাহিনীর ভেতরে যেভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল, এই দেখে আমরা কোনােভাবেই মেনে নিতে পারিনি।

আমরা আমাদের নেতাকে চয়েজ করলাম, কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে। আমাদের সাথে, সংগঠনের সাথে উনার সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীকালে দেশের এই অবস্থা নিয়ে আমরা উনার সাথে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে আলােচনা করেছি। আমরা এই অবস্থায় কী করব? উনার নির্দেশের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি। আমাদের সাথে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নারায়ণগঞ্জে গিয়ে উনার বাসায় আলাপ করেছি। ৪ নভেম্বর উনার ভাইয়ের বাসা, এলিফ্যান্ট রােডে—আবু ইউসুফ খান। বীর বিক্রম। উনার বাসাতে আমরা উনার সাথে আলােচনা করতে গেলে ক্যান্টনমেন্টের ভয়াবহ অবস্থা- আর্টিলারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিকে তাক করে রেখেছে, বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাক করে রেখেছে অর্ডন্যান্স-এর দিকে-অর্ডন্যান্সকে রেখেছে সিগন্যাল কোরের দিকে সিগন্যাল কোর রেখেছে ক্যাভিলারির দিকে। এভাবে অফিসারেরা কেউ এক মেস থেকে আরেক মেসে যান নি। ক্যাভিলারি রেজিমেন্টের হাবিলদার বারেক, সুবেদার জালাল, সুবেদার মাহবুব, নায়েক সিদ্দিক, হাবিলদার আবদুল বারী, অর্ডন্যান্স কোরের সুবেদার মাহবুবসহ আমরা কর্নেল তাহেরকে বললাম স্যার বর্তমানে এই অবস্থা। আমরা যদি কোনাে উদ্যোগ নেই, এত রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীন দেশ আমাদের থাকবে না। আমাদের সেনাবাহিনী উচ্ছঙ্খল, অফিসারেরা যেভাবে শুরু করেছে, এইভাবে আমরা আর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারব না। এটি আনতে হলে আমাদের একজন লিডার দরকার। তাহের আমাদের এই বক্তব্য শুনে বিচলিত হয়ে বললেন- এই দেশের জন্য একটি পা দিয়েছি, হাজার হাজার যােদ্ধা এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, ৩০ লক্ষ মানুষ এদেশের জন্য জীবন দিয়েছে, ২ লক্ষ মা-বােন ধর্ষিত হয়েছে। সেই দেশে আমরা বসে থাকতে পারি না। আমরা তােমাদের সাথে একমত হয়েছি। তাহেরের এই বক্তব্য শুনে আমরা ডিসিশন নিলাম আমাদের একটি লিফলেট বের করতে হবে-সৈনিকদের উদ্দেশ্যে। এই দায়িত্ব দেয়া হলাে ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের হাবিলদার বারেক আর অর্ডন্যান্স-এর সুবেদার মাহবুবকে। আমরা চলে গেলাম এলিফ্যান্ট রােড থেকে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে। ওয়ারেছাত হােসেন বেলালসহ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লােকজন এবং গণবাহিনীরও আরাে নেতৃবৃন্দ ছিলেন। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে আমরা সব ওখানে একত্রে বসি।

বসার পরে কর্নেল তাহের আমাদেরকে প্রশ্ন করেনআজকের অবস্থা কী? উনি নিজে দেখলেন আমরা কীভাবে লিফলেট ছাপিয়ে নিয়ে এসেছি । লিফলেট বিতরণের দায়িত্ব আমাদেরকে দেয়া হলাে। ক্যান্টনমেন্টের ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট- সেখানে ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন তৎকালীন লে. কর্নেল আমিন এবং এডজুটেন্ট ছিলেন ক্যাপ্টেন মনির। উনারা নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ মােশাররফ-এর সংগঠনকে। আমি সম্পূর্ণ খবরগুলাে জেনে কর্নেল তাহেরকে জানিয়ে দিলাম এবং জিয়াউর রহমান-এর বাসার পরিস্থিতিও। তখন সেখানে ছিল সুবেদার রইস উদ্দিন, সুবেদার সারােয়ার আরাে হাবিলদার রফিক, হারুন, আনােয়ার পাহারায় ছিলেন- এরা সবাই ছিলেন একাত্তরে যুদ্ধে আমার সাথী। ওদের কাছে ভেতরের সব খবর পেলাম। এই খবরগুলাে কর্নেল তাহেরকে দেয়ার পরে আমরা চলে আসলাম। সেই আনােয়ার সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে সিরাজুল আলম খান আসলেন। কর্নেল তাহের বললেন, যে কোনােভাবে জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করতে হবে এবং এই সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে। এই কথায় সিরাজুল আলম খান প্রশ্ন করলেন, কর্নেল Who is Zia?- কর্নেল তাহের জবাব দিলেন, আমি যা বলব। জিয়াউর রহমানও তাই বলবে, আমি যা বলছি জিয়াই তাই বলছে এবং Zia is my underfoot- সে আমার কথা রাখবেই। এই কথার পরে আমরা আলােচনায় বসে পড়ি। এরপর আমরা কে কী করব সে দায়িত্ব নিতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম সিরাজুল আলম খান আর সিটে নেই। আমরা ভাবলাম উনি বাথরুমে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম উনি সেখানেও নেই। পরবর্তীকালে আমরা ডিসিশনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা করে ডিসিশন না নিতে পেরে হাসানুল হক ইনুকে দায়িত্ব দেয়া হলাে সিরাজুল আলম খানের সাথে এই ব্যাপারে ফাইনাল করতে হবে। উনাকে গিয়ে পাওয়া গেল আগরতলা মামলার কাপ্টেন সুলতান-এর মনিপুরি পাড়ার বাসায়। উনার থেকে ডিসিশন নেয়া হলাে এই অবস্থায় আমরা কী করব। পরবর্তীকালে উনার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরেরদিন টাইম করলাম এলিফ্যান্ট রােডে। আমরা আবার কর্নেল তাহের-এর বড় ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হলাম ।

৬ নভেম্বর কর্নেল তাহের-এর বড় ভাইয়ের বাসায় আমাদের আলােচনার সিদ্ধান্ত আসল। এদিকে পুরাে ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিলি করা হলাে। ৬ নভেম্বর ক্যন্টনমেন্টে লিফলেট বিলি করার পর পরিস্থিতি আরাে ভয়াবহ হয়ে গেল। এই ব্যাপারে আমরা গিয়ে আলােচনা। করলাম। আমরা বললাম এখন এই অবস্থা হয়েছে আমরা কেউ বাঁচতে পারছি। ৫ নভেম্বর সিদ্ধান্তের পরে আমরা সময় করেছিলাম ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় এলিফ্যান্ট রােডে কর্নেল তাহের-এর বড় ভাই আবু ইফসুফ খান বীর বিক্রম-এর বাসায় আমরা আবার একত্রিত হবাে। আমরা আবার সেখানে একত্রিত হয়ে আলােচনা শেষে যে যেখানে ছিলাম সেই গন্তব্যস্থানে চলে গেলাম। ৬ নভেম্বর দুপুর ১২টায় ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল গাফফার আমাকে নির্দেশ দিলেন ব্যাটেলিয়ন কুজড, সবাইকে ফল ইন করিয়ে উনার অফিসে অফিসার, জেসিও, এনসিওদের নিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন, এই লিফলেট কারা ছেড়েছে? আমি নিজে বললাম, স্যার আমাদের ব্যাটেলিয়নের ভেতর দিয়ে অনেক সিভিলিয়ন আসা-যাওয়া করে। আমরা কিছুই জানি না। এখন থেকে আমরা সতর্ক থাকব এবং কড়া ডিউটি করব কে, কারা লিফলেট ফেলে। কিন্তু আমিই ওই লিফলেটগুলাে ফেলেছিলাম। আমাদের সাথে ছিল ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কোর-তারাও পেয়েছে। আমরাও দিলাম। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে থাকলাম । বিকেল ৫টার সময় চলে গেলাম এলিফ্যান্ট রােডে আৰু ইউসুফ খানের বাসায়। সেখানে যাওয়ার পরে আমাদের এই ব্যাপারে কর্নেল তাহের সবকিছু শুনলেন। এদিকে নায়েক সুবেদার সারােয়ার, সুবেদার মাহবুব মারাত্মকভাবে বিচলিত হয়ে গেলেন এবং বললেন আজকে রাতের ভেতর যদি আমরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত না করি তাহলে স্যার আমরাও বাঁচব না, জিয়াউর রহমানও বাঁচবে না, জিয়াউর রহমানের ফ্যামিলি’রও কেউ বাঁচতে পারবে না। আপনিও বাঁচতে পারবেন না।

এই কথা শুনে কর্নেল তাহের আমাদেরকে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলেন আজ রাতেই আমরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করব। তিনি নির্দেশ দিলেন কোনাে রক্তপাত যাতে না হয়। আমরা বললাম স্যার আমরা চেষ্টা করব প্রত্যেককে গ্রেফতার করতে এবং আপনার নির্দেশেই আমরা চালিয়ে যাব। এই নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রাত ১২টা ১ মিনিটে সুবেদার মাহবুব অর্ডন্যান্স থেকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করবে, কর্পোরাল আলতাফ এয়ারফোর্সের থার্ড গেট থেকে, নায়েক সুবেদার মাহবুব অর্ডন্যান্স থেকে, হাবিলদার বারেক ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে, আমি (আবদুল হাই মজুমদার) ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে। এভাবে আমরা কর্নেল তাহেরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত ১২টা ১ মিনিটে শুরু করে দিলাম । কর্নেল তাহের পরবর্তীকালে আমাদের বললেন-তােমরা রেডিও স্টেশনে থাকবে। আমাদের দ্বিতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর দুই ফিল্ড আর্টিলারিতে যারা ছিল, হাবিলদার বারেক তারা ঐখানে এবং হাবিলদার সুলতান থাকবে রেডিও স্টেশনে। কর্নেল তাহেরকে আমরা ঐখানেই পাব। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসার জন্য সুবেদার মাহবুবসহ উনার স্কোয়াড নিয়ে আসবে রেডিও স্টেশনে। সেখানে কর্নেল তাহেরের সাথে থেকে যুক্তি-পরামর্শ করে। জাতির জন্য ভাষণ দেবেন এবং ঐদিনই আমরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দায়দায়িত্ব। জিয়াউর রহমানকে নিয়েই করব। আর্মি হেডকোয়ার্টারে সুবেদার মাহবুবসহ আমরা সব একত্রিত হয়ে জিয়াউর রহমানের বাসায় আসি। এদিকে আমাদের সুবেদার সারােয়ার আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে তার গ্রপ নিয়ে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার বারেক, কর্পোরাল আলতাফ, কর্পোরাল মজিদ, নায়েক সিদ্দিক ২য় গােলন্দাজ বাহিনীতে জিয়াউর রহমানসহ চলে এসেছেন। সেখানে। গিয়ে দেখি জিয়াউর রহমানের এখানে আমাদের সবাই। আমি চলে গেলাম। রেডিও স্টেশনে। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমাদের ট্রপস এবং ২য় গােলন্দাজ বাহিনীর ট্রপস একত্রে ডিউটি করছে। কিছুক্ষণ পরেই ভােররাত ৫টার সময় দেখলাম খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং দ্বিতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর দু’জন ক্যাপ্টেন বসে ভাষণ দেওয়ার জন্য একটি ড্রাফট করছে।

তাৎক্ষণিক আমি চলে গেলাম সকাল ৬.৩০ মিনিটে এলিফ্যান্ট রােডে। ঐখানে গিয়ে দেখলাম কর্নেল তাহের ড্রেস পরে আসার জন্য তৈরি হচ্ছেন। এমন সময় আমি তাকে বললাম স্যার আমি রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলাম । জিয়াউর রহমান রেডিও স্টেশনে আসেননি। উনি চলে গেছেন দ্বিতীয় গােলন্দাজ বাহিনীতে । দুই ফিল্ড আর্টিলারি এবং ঐখান থেকে রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখলাম খন্দকার মােশতাক আছে সেখানে এবং দু’জন ভাষণ লিখছেন । আমার বক্তব্য শুনে কর্নেল তাহের বিচলিত হয়ে বললেন, চলাে রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখি কীভাবে আসল সে (খন্দকার মােশতাক)। তাঁর সাথে আসলেন তার ছােট ভাই ড. আনােয়ার হােসেন, ওয়ারেসাত হােসেন বেলাল-তারা আগে থেকেই রেডিও স্টেশনে মহড়া দিচ্ছিলেন। কর্নেল তাহেরসহ আমি যখন ঢুকলাম তখন মােশতাক কর্নেল তাহেরকে দেখে বসা থেকে দাড়িয়ে গেলেন। কর্নেল তাহের প্রশ্ন করলেন- কী। লেখা হচ্ছে? আপনাকে এখানে কে আসতে দিল? আপনি কেন এসেছেন এখানে? কর্নেল তাহের চার্জ করার পরে মােশতাক বললেন- আমাকে সৈনিকেরা নিয়ে এসেছে। কোন সৈনিকেরা? কেউ বলেনি। কর্নেল তাহের বললেন, ইউ আর গেট আউট। পরবর্তীকালে মােশতাক চলে গেল। গেটে এসে দেখি ওবায়েদুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী আসছেন রেডিও স্টেশনে এবং জানতে পারলাম খন্দকার মোশতাক তাদেরকে কল করে নিয়ে এসেছে। কর্নেল তাহের বললেন এরা কেন এসেছে এখানে? এরা খুনি। এই কথা বলার সাথে সাথেই আমি দৌড়ে গেলাম। আমার সাথে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যারা ছিল আমাদেরকে দেখে তারা বেত্রাহত কুকুরের মতাে রেসকোর্সের দিকে পালিয়ে গেলেন। ঐখান থেকে কর্নেল তাহেরকে তার গাড়িতে উঠিয়ে আমরা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে দ্বিতীয় গােলন্দাজ বাহিনীতে চলে আসলাম। ঐখানে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও সাধারণ সৈনিকেরা সকলে গাড়িতে করে চলে আসলেন।

সকলে মিলে তাহেরকে মাথায় উচু করে দ্বিতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর অফিসে নিয়ে গেলেন। এখানে জিয়াউর রহমান, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি, ৩৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, ক্যাপ্টেন মনির ছিলেন। এছাড়া জেনারেল খলিল, বিমানবাহিনীর এমজি তাওয়াব, নৌবাহিনীর এমএইচ খানও ঐখানে বসা ছিলেন। যে অফিসারগণ তিনদিন আগে খালেদ মােশাররফকে জেনারেল র্যাঙ্ক পরিয়েছিলেন। সবাই ওখানে। জিয়াউর রহমান সরাসরি আমাদের কাছে চলে আসলেন। এসে কর্নেল তাহেরকে আলিঙ্গন করলেন। কর্নেল তাহের বললেন আমি যুদ্ধাহত, আমার ১টি পা নেই, আমি কী করতে পারি? যা করেছে এই সৈনিকেরা করেছে। আমাদেরকে টেনে নিয়ে এসে দেখালেন। জিয়াউর রহমান আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন, হাত মেলালেন, চোখের পানি ফেললেন। এদিকে জেনারেল ওসমানি আমাদেরকে বললেন- বেটা কোনাে দিকে যেন উচ্ছলতা না হয় সেদিকে দেখতে হবে। হাজার হাজার সৈন্যরা কর্নেল তাহের, জিয়াউর রহমানের নামে স্লোগান দিচ্ছে। জিয়া-তাহের ভাই ভাই। কর্নেল তাহের আমাদের নেতা, জিয়াউর রহমান ছাড়া আমাদের কোনাে নেতা নেই। সৈনিকেরা এসকল স্লোগান দিতে লাগলেন। এসময় কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বললেন আমার করার কিছুই ছিল না, যা করেছে সৈনিকেরা করেছে। তারা কী বলে, তাদের কথা শােনেন। কর্নেল তাহেরের কথা অনুযায়ী জিয়াউর রহমান আমাদেরকে ডাকলেন। তােমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আমার কাছে আস। তােমাদের কী দাবি? কী চাও? এই কথা বলায় সকাল ৮টার সময় দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীতে কর্পোরাল আলতাফ, কর্পোরাল মজিদ, শামছুল হক, নায়েক সিদ্দিক, সুবেদার মাহবুব, সুবেদার জালাল, হাবিলদার বারেকসহ আমরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১১ জন আবার একত্রিত হই। হাবিলদার বারেক ও সুবেদার মাহবুবকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষে ১২ দফা উত্থাপন করার জন্য দায়িত্ব দেয়া। হয়। এদিকে তৰ্কালীন বিডিআর-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান উনার ব্যাজ খুলে আমাদেরকে দিয়ে দিলেন। বললেন আমরা অপারগ, তােমরা ক্ষমতা নিয়েছ, তােমরা দেশকে বাঁচিয়েছ, সেনাবাহিনীকে বাঁচিয়েছ-সে। জন্য আমি ড্রেস পরে এসেছি। এটি আমি আর পরবাে না। তােমরা এই ড্রেস এর যােগ্য।

আমি অযােগ্য। সাথে সাথে বিমান বাহিনীর প্রধান এমজি তাওয়াব। কর্পোরাল আলতাফের হাতে তার ব্যাজ ও নৌ-বাহিনীর প্রধান তার ব্যাজ খুলে দিয়ে দিলেন। তারা বললেন আমরা সব অযােগ্য হয়ে গিয়েছি, আপনারা যােগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বললাম স্যার যা। কিছু হয়েছে, আমরা যা কিছু করেছি দেশের জন্য করেছি। আপনারা এখন দেশ পরিচালনা করেন। আপনারা আপনাদের জায়গায় কাজ করেন। এই সেনাবাহিনী, নেভি, এয়ারফোর্স সবাই যেন সুশৃঙ্খলভাবে এই দেশে অধিকার নিয়ে বাস করতে পারেসেই ব্যবস্থা করুন। এই কথা বলে আমরা জিয়াউর রহমানের সামনে। গেলাম। কর্নেল তাহেরসহ উনি বললেন- ঠিক আছে। জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে বললেন সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আসেন, উনি প্রধান, উনার সাথে আমরা বসি। কর্নেল তাহের বললেন উনি এখানে আসবেন না। তখন বললেন নেক্সডম্যান কাকে নিয়ে আসবেন? নিয়ে আসেন। কর্নেল তাহের সাথে সাথে হাসানুল হক ইনু, তার ছােট ভাই ড. আনােয়ার হােসেন ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের বললেন অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমানকে নিয়ে আসতে । উনাকে নিয়ে আসা হলাে। সকাল ১১টায় কর্নেল তাহের-এর বড় ভাইয়ের বাসা এলিফ্যান্ট রােডে কর্নেল তাহের এর সঙ্গে কথা বলে আমরা বুঝতে পারলাম জিয়াউর রহমান আমাদের ১২ দফা দাবি নিয়ে আমাদের সাথে বসবেন। উনি যােগাযােগ করেছেন। আমি এখান থেকে আবার ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা দিই। পুরনাে এয়ারপাের্টের সামনে এসে দেখি আমিন আহম্মদ চৌধুরী বীর বিক্রম (তকালীন সময়ে লে. কর্নেল এবং বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের পিএসও হিসেবে কর্মরত) রঙ্ক পরে এসেছিলেন। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা কিছু বিমান বাহিনীর সৈনিক ও তাদের লােকজন উনার র্যঙ্ক খুলে ফেলেন ও উনাকে অপদস্থ করেন। আমি চিনতে পেরে উনাকে উঠিয়ে নিয়ে এলিফ্যান্ট রােডে কর্নেল তাহের-এর বড় ভাইয়ের বাসায় নিয়ে যাই। কর্নেল তাহেরকে দেখে উনি কেঁদে ওঠে বললেন স্যার আমাকে তাে ওরা মেরেই ফেলেছিল।

কর্নেল তাহের রাগান্বিত হয়ে আমাকে জিগ্যেস করলেন কারা এমন করেছে। আমি বললাম স্যার উনাকে তাে আমি উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। এয়ারফোর্সের কিছু লােকজন উনাকে ধরেছিল। আমিন আহম্মদ চৌধুরী তখন বললেন, হাই না থাকলে স্যার ওরা আমাকে মেরে ফেলত। এরপরে আমরা বিভিন্ন দিকে যােগাযােগ শুরু করলাম। জিয়াউর রহমান প্রথমে বিকেল ৫টায়, পরে সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের সময় দেওয়ার কথা বলেন। ৭টার সময় শাহবাগে রেডিও স্টেশনে এডিসি ক্যাপ্টেন আবদুল জব্বার পাটোয়ারী বীর বিক্রম ও গার্ডসহ জিয়াউর রহমান আসলেন। এখানে আমরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১১জন ছিলাম । রেডিও স্টেশনের দোতলায় কর্নেল তাহের, তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীসহ আমরা যখন আলােচনা করছিলাম তখন রেডিও টেলিভিশনে খন্দকার মােশতাক আহমদ-এর ভাষণ প্রচার হচ্ছিল। কর্নেল তাহের প্রশ্ন করলেন খন্দকার মােশতাক কিসের ভাষণ দিচ্ছে? জিয়াউর রহমান বললেন তিনি বিদায় ভাষণ দিচ্ছেন। পরবর্তীকালে আমাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার বারেক জিয়াউর রহমানের সামনে ১২ দফা দাবিনামা উত্থাপন করলেন। ১২ দফার প্রথম দফা দেখে তিনি বললেন রাজনৈতিক নেতা মেজর জলিল, আসম আবদুর রবসহ অন্যদেরকে বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হােক। জিয়াউর রহমান বললেন জলিল আমার বন্ধু মানুষ-তিনি দেশের জন্য অনেক যুদ্ধ করেছেন। রব দেশের একজন ছাত্রনেতা। সাংগঠনিক ক্ষমতা খুবই ভালাে। সে। আমার ভাইয়ের মতন। আজ রাতের মধ্যেই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে। দ্বিতীয়। দফায় সৈনিকদের ব্যাটম্যান প্রথা তুলে নেয়া হবে। তৃতীয় দফায় সৈনিকদের বেতন ৫০০ টাকা করতে হবে। জিয়াউর রহমান আপত্তি করলেন। বললেন সৈনিকদের বেতন ৫০০ টাকা করলে সিভিলিয়নদের বেতনও বাড়াতে হবে। আমরা কোথা থেকে এত টাকা দেব? দেখা যাক এটি আলােচনা করে ঠিক করা যাবে। এভাবে ৯০ দিনের মধ্যে জনগণের হাতে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া, গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়া, একটি জাতীয় সরকার গঠন করা, সৈনিকদের রেশন মেস ট্রেনিং ব্যবস্থা নিয়ে ১২ দফা সুবেদার মাহবুব, সুবেদার জলিল উনার হাতে দেন। জিয়াউর রহমান আমাদের দাবি মেনে নিয়ে, সবার সাথে হাত মিলিয়ে স্বাক্ষর করে দিলেন।

আমাদের থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, তােমাদের দাবি আমি মেনে নিয়েছি, মানব, সুশৃঙ্খলভাবে তােমরা দেশ ও সেনাবাহিনী গড়ার দায়িত্বে চলে যাও। এই সকল কথা বলে জিয়াউর রহমান বিদায় নিলেন। আমরা কর্নেল তাহেরের সাথে বসলাম। এরপর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দেখি সকল কিছু উলটপালট হয়ে গেছে। আবার কর্নেল তাহেরের কাছে আসলাম । ঐদিন রাতেই কর্নেল তাহেরের সাথে দেখা করে বললাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এখনাে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। অফিসারেরা সকলে পালিয়ে যাচ্ছে। সৈনিকদের বলছে তােমাদের দেখাব। আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন ধরনের উস্কানি দিচ্ছে। বললাম স্যার এগুলাে তাে ভালাে লক্ষণ নয়। আপনি জিয়াউর রহমানকে বলেন অফিসারদেরকে বলতে জওয়ানদেরকে যেন আর কোনােভাবে আঘাত না করা হয়। কিছু না বলে, হুমকি-ধামকি না দেয়। একথা বলার পরে কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমাকে ফোন করেন। জিয়াউর রহমান বলেছেন সুশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এদিকে রাত ১২টায় আমরা দৈনিক ইত্তেফাক-এ গেলাম। সেখানে আসাফউদ্দৌলা ও নিউজ এডিটর গােলাম সারওয়ার ছিলেন। এয়ারফোর্সের আলতাফ, আমি, মজিদ, নায়েক সিদ্দিক উনাদের রুমে গিয়ে বললাম আজ রাতের ভেতরে পত্রিকায় যেন আমাদের দাবির সংবাদটি ছাপা হয়। দেখবেন যেন বিলম্বিত না হয়। আমাদের সৈনিকদের দাবি জাতির সবাইকে জানতে হবে। কর্পোরাল আলতাফ বললেন যদি এটি প্রকাশিত না হয় তাহলে এখানে ট্যাঙ্ক উঠবে। এভাবে হুমকি দিয়ে আমরা পত্রিকা অফিস ত্যাগ করি। উনারা আমাদেরকে কথা দিলেন আপনাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা আগামীকাল পত্রিকায় পড়তে পারবেন। পরেরদিন সকালে আমরা কর্নেল তাহেরের সাথে যােগাযােগ করি। আমরা। এখন কী করবাে?

তাহের বললেন তােমরা এখন থেকে সচেতন থাকবে। যােগাযােগ রাখবে। তােমাদের যে যেখানে চাকরি করছ, ডিউটি করছ সে সেখানে কাজ করবে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যাটালিয়নে চলে আসলাম। এসে দেখি জিয়াউর রহমান পুরাে ব্রিগেড ফল ইন করালেন। ৮ নভেম্বর দুপুর ১২টায় ফাস্ট বেঙ্গল গ্রাউন্ডের পূর্বদিকে (বর্তমানে চেয়ারম্যানবাড়ি) উনি স্টেজে উঠলেন। সেই স্টেজে আমি আবদুল হাই মজুমদারও উপস্থিত ছিলাম। স্টেজে উঠে জিয়াউর রহমান বললেন আমি সৈনিক, আমি রাজনীতি বুঝি । আমরা আমাদের সৈনিকের দায়-দায়িত্ব পালন করবাে। ৯০ দিনের মধ্যে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেব। উনি সেখানে কোরান শরীফের ওপর হাত রেখে শপথ করেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। এই অবস্থায় চাপ সামলাতে না পেরে ৮ নভেম্বর বিকেলে আমরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লােকজন আবার কর্নেল তাহের-এর কাছে চলে আসলাম। কর্নেল তাহের বললেন দেখছি কী করা যায়। জিয়াউর রহমান তার কথা শুনলেন না। ৯ নভেম্বর কর্নেল তাহের-এর বাসায় গিয়ে দেখলাম রাজশাহী জেল থেকে আ.স.ম আব্দুর রব, ময়মনসিংহ থেকে মেজর জলিল আসলেন। তারা এসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য একটি ড্রাফট তৈরি করছিলেন। এদিকে বায়তুল মােকাররমে সর্বদলের একটি মিটিংয়ের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পুলিশ এলােপাথাড়ি পেটানাে শুরু করলাে।

সেখানে পুলিশের গুলিতে আ.ফ.ম মাহবুবুল হক উইন্ডেড হলেন। বিকেল ৫টার সময় গুলি খাওয়ার পরে আমরা গেলাম। যাওয়ার পরে আমাদেরকে হাই কম্যান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হলাে কোনাে মিটিং করা হবে না। বিষয়টি কর্নেল তাহেরকে জানানাের পরে বললেন ঠিক আছে যখন নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি জিয়াউর রহমানকে জিগ্যেস করবাে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে কর্নেল তাহের-এর বড় ভাই আবু ইউসুফ খান আমাকে বললেন তােমাকে নারায়ণগঞ্জে যেতে হবে। সেখান থেকে শ্রমিকদের বিশাল একটি মিছিল নিয়ে শ্রমিক নেতা ফজলে এলাহী আসছিলেন। তাকে সেখানে আরেস্ট করা হয়েছে। এলােপাথাড়ি মারা হয়েছে। আপনি গিয়ে উনাকে ছুটিয়ে নিয়ে আসবেন। এদিকে কর্নেল তাহের আমাকে বললেন-তুমি বঙ্গভবনে গিয়ে দেখ অবস্থা কী? তখন সেখানে প্রেসিডেন্টের পিএসও ছিলেন। কর্নেল আমিন আহম্মদ চৌধুরী। আমি সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে বললাম স্যার কর্নেল তাহের আমাকে পাঠিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের সাথে উনি লাইনে পাচ্ছেন না। উনার সাথে যােগাযােগ করিয়ে দেন। উনি বললেন ঠিক আছে আমি যােগাযােগ করিয়ে দেব। বঙ্গভবনে প্রায় ২০০’র মতাে গাড়ি দেখলাম। সেখানে ওবায়েদুর রহমান থেকে মাহবুবুল আলম চাষীসহ অনেককেই দেখলাম গাড়ি নিয়ে ঢুকছে। আমি প্রশ্ন করলাম স্যার এই সকল কাদের গাড়ি? কাদের মিটিং? এখানে কি কর্নেল তাহের থাকবেন? আমিন আহম্মদ চৌধুরী ২ মিনিট চুপ করে থেকে বললেন হা উনিও থাকবেন। আমি এখান থেকে কর্নেল তাহেরের কাছে এসে সকল ঘটনা বললাম। বঙ্গভবনের ভেতরে মিটিংয়ের কথাও জানালাম। জিগ্যেস করলাম স্যার আপনাকে কি জানানাে হয়েছে। তিনি বললেন আমাকে এখনও বলা হয়নি। সেখান থেকে আমি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে চলে গেলাম । শ্রমিক নেতা ফজলে এলাহীকে আনার জন্য আমি কর্নেল তাহেরের গাড়ি, কর্নেল তাহেরের ড্রাইভারকে নিয়ে এসেছিলাম। সেখানের কমান্ডের ক্যাপ্টেনকে জিগ্যেস করলাম আমরা ৭ নভেম্বর বিপ্লব করলাম, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাতিকে এতদূর এগিয়ে নিয়ে আসলাম। আর আপনারা কেন উনাকে অ্যারেস্ট করলেন? উনি বললেন শুধু উনাকে নয় আপনাকেও অ্যারেস্ট করার জন্য নির্দেশ আছে। আমাকে উনি গ্রেফতার করলেন।

আমার অস্ত্র এবং গাড়ি নিয়ে গেলেন (সেই কর্নেল তাহেরের গাড়ি)। আমার সাথে সেখানে ছিলেন কর্নেল তাহেরের ড্রাইভার, যাত্রাবাড়ীর খালেকুজ্জামান এবং ফজলে এলাহী। আমাদেরকে ৮ নভেম্বর রাত ১টায় ৪৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে আসা হয়। তখন সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী। তিনি বললেন আমার কাছে এদেরকে খাওয়ানাের মতাে কোনাে রসদ নেই । তখন বাকিদের রেখে আমাকে ৩৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নেওয়া হলাে। সেখানে আমাকে নিয়ে সিও আমিন এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে। কর্নেল আমিন বললেন আপনাকে অ্যারেস্ট করার জন্য বলা হয়েছে। আমি জিগ্যেস করলাম আমাকে অ্যারেস্ট করবেন কেন, আমি কী অপরাধে অপরাধী? উনি কোনাে জবাব দেননি। বললেন আমার কাছে নির্দেশ আছে। আমার অস্ত্র তাে আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাকে নিয়ে জিয়াউর রহমানের এডিসি আবদুল জব্বার পাটোয়ারীর রুমে রাখলেন। ভােরবেলায় আমি মেস থেকে সৈনিকদের সাহায্য সহযােগিতায় বেরিয়ে আসলাম। বাইরে এসে পােশাক বদলি করেদ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। সেখান থেকে এলিফ্যান্ট রােডে এসে সিভিল ড্রেসে কর্নেল তাহেরের সাথে দেখা করলাম। কর্নেল তাহের নির্দেশ দিলেন- এই মুহূর্তে যদি নিজেকে সেভ করতে না পার। তাহলে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুতে থাক, কি করা যাবে এই মুহূর্তে? কিছুক্ষণ। পরে সেখানে সুন্দরবনের মেজর জিয়া আসলেন। উনার সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন এভাবে তাে চলতে পারে না। জিয়াউর রহমানের সাথে এই ব্যাপারে একটি আপােস করতে হবে। এরপরে আমি আবার ব্যাটালিয়নে আসলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমাকে ২২ বেঙ্গল থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকে টর্চার করে পুলিশের কাছে দেয়া হয়। পুলিশ আবার টর্চার করে। আমার সাথের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সুবেদার মাহবুব, সুবেদার জালাল, কর্পোরাল। আলতাফ, কর্পোরাল শামছুল হক একে একে সবাইকে বন্দি করা হয়। পরবর্তীকালে সুবেদার মাহবুব, কর্পোরাল ফখরুল আলম, হাবিলদার বারেক এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন।

আমরা জানতাম না এরকম একটি ষড়যন্ত্র মামলা হচ্ছে। আমরা মনে করেছিলাম আমাদের ক্যান্টনমেন্টে বিচার করা হবে। আমাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতি অথবা দেশের জন্য বীরত্বপূর্ণ কিছু করে থাকলে প্রমােশন দেয়া হবে। এইভাবে আমাদেরকে নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হয়। সে মামলায় আমার হয়ে যায় এক বছর তিন মাস সাজা। কর্নেল তাহেরকে দেয়া হয় ফাসি। আমাদের সাথী সেই চারজন সুবেদার মাহবুব বর্তমানে জাপানে মামলায় রাজসাক্ষী করে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালীন সময়ে সপরিবারে জাপানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এয়ারফোর্সের ফকরুল আলম আছেন আমেরিকাতে। ১০ রেজিমেন্টের হাবিলদার বারেক-যার হাত দিয়ে লিফলেট লেখা, বিতরণ, স্লোগান লেখা হয়েছিল। তিনি বর্তমানে সপরিবারে লন্ডনে আছেন। আরেকজন এয়ারফোর্সের কর্পোরাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করছেন। আর নায়েক সিদ্দিক অসুস্থ হয়ে ধুকে ধুকে মরছেন। হাবিলদার বারেক একটি কোম্পানিতে চাকরি করে কোনােমতে দিনযাপন করছেন। আমি-আবদুল হাই মজুমদার সপরিবারে কোনােরকমে বেঁচে আছি। জিয়াউর রহমান ৯০ দিন না যেতেই বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন- অথচ কোরআন শরীফ শপথ।

করে তিনি বলেছিলেন ৯০ দিনের মধ্যে জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফেরত দেবেন। পৃথিবীর কোনাে ইতিহাসে আছে বলে আমার জানা নেই। একটি স্বাধীন দেশের জন্য, পতাকার জন্য যে লােকটি রক্ত দিয়েছেন, একটি পা বিসর্জন দিয়েছেন সে লােকটিকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিনের সেই সামরিক আদালতের রায় আমরা কোনােদিনও মেনে নেব না। আজকে সেই রায়কে পুনর্বিবেচনা করার জন্য দেশের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি দাবি তুলেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারগুলাে এ ব্যপারে কোনাে পদক্ষেপই গ্রহণ করছেন না। আমরা কর্নেল তাহেরকে আর কখনাে ফেরত পাবাে না, যিনি হত্যা করেছেন তাকেও আর পাবাে না; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সেদিন কর্নেল তাহের কোনাে অন্যায় করেননি-জাতির কাছে এটি একটি নিদর্শন হয়ে থাকবে। সেদিন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার পরিবারকে নতুন জীবনদান করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কোনাে নজির নেই কর্নেল তাহের ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছেন, একটি পা বিসর্জন দিয়েছেন, তাকে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাকে নয় ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকে হত্যা করা হয়েছে। আজকে জাতির জীবনে উজ্জ্বল হয়ে থাকা জিয়াউর রহমানের নির্দেশে সামরিক প্রশাসন থেকে সেদিন কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়। জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী ৭ নভেম্বরকে সংহতি দিবস হিসেবে পালন করেন, ক্ষমতায় থাকাবস্থায় দিবসটিতে সরকারি ছুটি দেন। এবং দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদ্যাপন করেন। আর আমরা যারা সেদিন উনাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এনেছি- আমাদের কাউকে কোনােদিন ডাকেন না, জিগ্যেস করেন না। আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি তার খবরও কেউ রাখেন না। অথচ আমাদের বীরত্বের ফসল উনি, উনার দল, সাথীরাই ভােগ করছেন। আর কর্নেল তাহের-এর পরিবার, সহযােদ্ধা, বিপ্লবীরা কোথায় আছেন তার কোনাে খবর কোনাে মিডিয়া, পত্র-পত্রিকা, সংগঠন। কেউই রাখেন না। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি, ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মােশাররফ, কর্নেল হুদাসহ চারজন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। কর্নেল তাহের বা আমাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কোনাে সদস্য এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কোনাে সদস্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, কর্নেল হুদা, কর্নেল হায়দারকে গুলি করেননি। সেদিন কর্নেল তাহের আমাদেরকে এরকম কোনাে নির্দেশ প্রদান করেননি।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে আমি এটি বলতে পারি। যদি কাউকে হত্যা করা হতাে, বন্দি করা হতাে অথবা অন্য কোথাও নেয়া হতাে তাহলে আমি জানতাম। কারণ, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যতবারই আমরা বসেছি, আলােচনা করেছি সবগুলােতেই আমি উপস্থিত ছিলাম। সবগুলাে কাগজপত্রে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। এই অফিসারদেরকে হত্যা করেছে পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকেরা। আমি বিশ্বাস করি কোনাে মুক্তিযােদ্ধা খালেদ মােশাররফকে হত্যা করতে পারে না। কারণ একজন যােদ্ধা আরেকজন যােদ্ধাকে। কী করে হত্যা করবে? যারা মেরেছেন তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যাননি। এখনাে দেশে আছে। তাদেরকে গ্রেফতার করা হােক, বিচার করা হােক। সেদিন ৭ নভেম্বর ১২ দফার ভেতর, দেশের বাইরে থেকে নিয়ে এসে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিচার করার জন্যও একটি দাবি ছিল। আজও আমরা কিছুই জানি না কেন কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হলাে, আমাকে চাকরিচ্যুত করা হলাে, সাজা দেয়া হলাে। আজ ৩০ বছর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত জাতি জানতে পারলাে না, দেশের কেউ জানতে পারলাে না।

মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অব.)

মামলায় ১২ বছর সশ্রম কারাভােগী ১৯৭২ সালের শেষদিকে কর্নেল তাহেরের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। উনি তখন কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভুথানে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেদিন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। তখন আমার পােস্টিং ছিল ঢাকা ডিজিএফআই-তে, সামরিক বাহিনীর ঢাকা গােয়েন্দা শাখায় । ২৪। ঘণ্টার মধ্যেই জিয়াউর রহমান তার গায়ের রং পরিবর্তন করে ফেললেন। মাহবুবুল আলম চাষী, খন্দকার মােশতাক এই চক্রের সাথে গােপন বৈঠকে জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। কর্নেল তাহের ছিলেন সিপাহি জনতার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। বিশেষ করে প্রত্যেকটি ক্যান্টনমেন্টে সিপাহিদের একটি দুর্গ গড়ে উঠলাে, এমনকি সৈনিকেরা অফিসারদের অমান্য করতে শুরু করলাে। এই সুযােগটি পেয়ে খন্দকার মােশতাক গং এবং আন্তর্জাতিক একটি চক্রান্ত কয়েকজন অফিসারকে হত্যাও করলাে-এর দোষারােপটা করা হলাে কর্নেল তাহেরকে। কিন্তু কর্নেল তাহেরের বাসায় অন্তত হাফ ডজন অফিসার অবস্থান নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন-এর প্রমাণও পাওয়া যায়। তারা এখনও বেঁচে আছেন যারা কর্নেল তাহেরের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং তাদের কোনাে ক্ষতি করা হয়নি। কর্নেল তাহের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের দিন পনের’র মধ্যে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। আমাকে বলা হলাে সুন্দরবনে বিদ্রোহ ঘটাতে- যাতে বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশ্ব সমাজ একটি ধারণা নিতে পারে, সেনাবাহিনীর কোন্দল কিংবা সেনাবাহিনীর মধ্যে। বিশৃঙ্খলা দমনে জিয়াউর রহমান ব্যর্থ হচ্ছেন এবং সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা দমনে জনপ্রিয় নেতা নন। ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হলাে। সুন্দরবনে আমরা বিদ্রোহ করলাম। বিদ্রোহ করে আমরা আমাদের পজিশনমতাে। থাকলাম । কিন্তু বাইরে থেকে যেগুলাে করার কথা ছিল সেগুলাে করা হলাে না। আর না হবার কারণে সুন্দরবনে ultimately আমরাও পরাজিত হলাম ।

আমাদের ওপরে প্রায় ১ ব্রিগেড সৈন্য এবং বিডিআর, এয়ারফোর্স, নেভি দিয়ে আমাদেরকে পরাস্ত করা হলাে। ৩ জানুয়ারি ১৯৭৬ সালে আমাকে গ্রেফতার করা হয়-সুন্দরবন থেকে। গ্রেফতারের পরে ঢাকায় নিয়ে আসা, তারপরে ঢাকা জেলখানা। ঢাকা জেলে কর্নেল তাহেরের সাথে দেখা হলাে। কর্নেল তাহের বিস্তারিত বললেন, কীভাবে জিয়াউর রহমান কথা রাখেননি। কীভাবে জিয়াউর রহমান মােশতাক এবং মাহবুবুল আলম চাষী গংদের সাথে মিলে গেলেন। তিনি সব ঘটনাই আমাকে বললেন। কর্নেল তাহের জেলখানায় আছেন আমি জানি। মাঝখানে মেজর জলিল, আ.স.ম আবদুর রব এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল-তাদেরকে পরে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসের কোনাে এক সন্ধ্যায় আমাকে ঢাকা জেলে নেয়া হয়। এর আগে জয়েন্ট ইন্টারােগেশন সেলে প্রায় দুই মাসের মতাে আমার ইন্টারােগেশন করা হয়, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সন্ধ্যার সময় জেলে ঢুকে স্থান হয় একটি ছােট সেলের মধ্যে। নতুন জেলের নতুন সেল বলা হয় একে। এই সেলের মধ্যে একটি সেল দেয়া হয় আমাকে। জেলের সেই সেলে আমার অবস্থান হলাে। এর তিন-চারদিন পরে ডিআইজি এবং জেলারকে আমি বললাম, আমি কর্নেল তাহেরের সাথে দেখা করতে চাই। কর্নেল তাহেরও ডিআইজি এবং জেলারকে বললেন যে, মেজর জিয়ার সাথে আমি দেখা করব, কথা বলব। তখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে কর্নেল তাহেরের ওখানে। কর্নেল তাহেরকে থাকতে দেয়া হয়েছিল পুরনাে জেলের একটি অংশে। যেটাকে বলা হয় হাজতখানা। জেলহাজত বলা হয়। সেখানে তাকে থাকতে দেয়া হয়েছিল। সেখানে গেলাম । দীর্ঘক্ষণ প্রায় ঘণ্টা তিন, চারেক আলােচনা হলাে। উনি খাবারের জন্য বললেন। একত্রে খেলাম  চলে আসলাম আমার সেলে।

এরপরে দু’একবার দেখা হয়েছে। মাঝখানে সরকার ক্যামেরা ট্রায়ালের জন্য, জেলখানার মধ্যে আমাদের বিচার হবে। এই অধ্যাদেশ জারি করে একটি স্পেশাল ফিল্ড মার্শাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেন। আমাদের বিচার করা হবে জেলখানার মধ্যে। জেলখানার মধ্যে বিচার হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন কোনাে সাংবাদিক, সরকার অনুমােদিত আইনজীবী ছাড়া অন্য কোনাে আইনজীবীর স্থান নেই। সেখানে আমরা ক’জন আসামি আর বিচারক তিনজন। ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কোলাবরেটর । ভদ্রলােক মরে গেছেন। জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিশেষ সখ্যতার কারণে তিনি এই মহান (!) দায়িত্ব, মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদেরকে হত্যা করতে হবে ফাসির মঞ্চে এই দায়িত্বটি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জেলখানার মধ্যে ডিআইজি’র অফিসে একটি লােহার খাঁচা বানানাে হলাে। সেই লােহার খাঁচায় আমাদেরকে পুরে বসিয়ে রাখত। বিচারকেরা এসে একতরফাভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন । আমাদের মনােনীত আইনজীবীদের প্রথমে তারা দিতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে দু’একজন দেয়া হয়। একতরফাভাবে বিচর চলছে। প্রায় ১ মাস ধরে বিচার চললাে। বিচারক বললেন ১৪ তারিখ বিচারের রায় ঘােষণা করা হবে। ১৪ তারিখ কোর্ট বসলাে না, বিচারকেরা আসলেন না, বিচারের রায় ঘােষণা করা হলাে না। ১৭ তারিখে বিচারের রায় ঘােষণা করা হলাে। আমাদের-মেজর জলিল, আমি এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলাে। সর্বশেষ রায় ঘােষণা করা হলাে, কর্নেল তাহের। বীর উত্তম- তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কর্নেল তাহের হাসলেন। আমরা সবাই স্লোগান তুললাম। পরে আমাদের খাচা থেকে বের করে স্পেশাল গার্ড দিয়ে আমাদের সেলে এবং ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। এরমধ্য থেকে হঠাৎ করে বিচারকেরা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার মতাে করলেন, মঞ্চ থেকে চলে গেলেন। আমাদেরকে স্পেশাল স্কোয়াড দিয়ে যার যার সেল কিংবা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলাে এবং রাতের বেলা হঠাৎ করে দেখা গেল বিডিআর সমস্ত জেলের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে। ঢুকে পড়েছে। এটি আন্তর্জাতিক জেল আইনের বিরােধী। জেলখানার মধ্যে কোনাে সশস্ত্র পাহারা ঢুকতে পারবে না। তাও ঢুকলাে, প্রত্যেক সেলের সামনে একজন করে অটোমেটিক রাইফেলধারী সিপাহি দাড়িয়ে গেল। পুরাে জেলখানা তারা তাদের কন্ট্রোলে নিয়ে নিল। আমরা প্রহর গুণছি কখন তাকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হয়।

ফাসির মঞ্চে মহড়া চলছে। মহড়ার পর মহড়া চলছে ফাসি কীভাবে কার্যকর করা যাবে। কারণ স্বাধীনতার পর এটিই প্রথম ফাসি। একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা বীর উত্তম, তার ফাসি হচ্ছে। ফাঁসির নিয়মকানুন, তার যে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সেগুলাে সঠিকভাবে কাজ করছে কি না- এ জন্য অন্তত পাঁচ-সাতবার ফাসির মহড়া দেয়া হলাে। আমরা বুঝতে পারলাম খুব তড়িঘড়ি করে তাকে ফাসি দেয়া হবে। ফাসির মঞ্চ থেকে আমরা যেখানে থাকতাম সে জায়গাটি ১০০ গজের মতাে দূরত্বে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ফ্লাডলাইট দিয়ে সমস্ত এলাকাটি আলােকিত করা। হচ্ছে। ২০ জুলাই ফাসির মঞ্চের কাজগুলাে আরাে ত্বরান্বিত করা হলাে এবং সমস্ত জেলখানায় একটি অঘােষিত কারফিউ। কোনাে বন্দিকে, কোনাে ওয়ার্ড থেকে, কোনাে সেল থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না এবং সামনে সমস্ত জেলখানা ঘিরে সশস্ত্র বিডিআর, বাইরে সশস্ত্র বাহিনীর লােকজন। এরকম ভুতুড়ে ভয়ার্ত পরিবেশে আমাদের সময়টি কাটছিল। ২১ জুলাই গভীর রাতে কর্নেল তাহেরকে ফাসির মঞ্চে নেয়া হয়। জেলের প্রহরী থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মচারী, কর্মকর্তা পর্যন্ত সাংঘাতিক বিমর্ষ একটি অবস্থা এবং সবাই বুঝতে পারছেন যে এধরনের একজন সম্মুখযুদ্ধে পা হারানাে মুক্তিযােদ্ধা, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। একদম অস্থির অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। গভীর রাতে কর্নেল তাহেরকে ফাসির মঞ্চে নেয়ার জন্য ডিআইজি প্রিজন, আইজি প্রিজন এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক যাদের থাকার কথা (ফাসির মঞ্চে উপস্থিত) তারা এসে হাজির। কর্নেল তাহেরকে ডাকছেন। তিনি উঠছেন না। কারণ তিনি গভীর ঘুমে নিদ্রিত, ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জানেন আজ রাত ৪টায় তার ফাসি হবে। ডাকাডাকির পরে উঠলেন। সময় কি হয়ে গেছে? | তখন জেল কর্তৃপক্ষ বললাে, স্যার আরাে কিছু সময় বাকি আছে। আপনি নিজেকে তৈরি করে নেন। তখন কর্নেল তাহের নিজেকে তৈরি করলেন।

গােসল করলেন, ভালাে করে জামা কাপড় পড়লেন। সেই হারিয়ে যাওয়া পা-যেটি একটি আর্টিফিশিয়াল পা লাগানাে ছিল, সেটি তিনি ঠিকভাবে লাগালেন। তারপরে তিনি বললেন, সময় তাে আরাে আছে? আরও একটু আম খাব । উনার কাছে দেয়া পরিবারের আম ছিল (পরিবার যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন আম নিয়ে গিয়েছিল)। উনি বসে বসে আরাে একটু আম খেলেন। আম খেয়ে তারপরে ফাসির মঞ্চের দিকে চললেন। সবাই বিষন্ন। কারাে কারাে চোখে জল । কিন্তু তিনি বলছেন, আপনারা বিষন্ন হচ্ছেন কেন? আমারতাে হারানাের কিছু নেই। জাতির জন্য আমি প্রাণ দিয়ে যাচ্ছি। জাতি একদিন মুক্ত হবে। প্রথমে সবাই চাচ্ছিল উনাকে তিনচারজন ধরে ফাঁসির মঞ্চে উঠাবেন। কিন্তু উনি নিজেই ফাঁসির মঞ্চে উঠে গেলেন। উঠে গিয়ে বললেন, একটি কবিতা আমি বলবাে। জেল কর্তৃপক্ষের একটি নিয়ম থাকে, ফাঁসির আগে আসামির কোনাে চাওয়া কিংবা ইচ্ছা আছে কি না। তখন তিনি বললেন, আমি একটি বিশেষ কবিতা পড়ে শােনাব। জেল কর্তৃপক্ষ জিগ্যেস করলেন, কবিতাটি কার লেখা? তিনি বললেন, পরে আপনারা জানবেন। কবিতাটি আসলে আমার লেখা। কোর্ট চলছে, তখন কর্নেল তাহেরকে পড়ে শুনিয়েছি। তিনি বললেন, এটি আমাকে লিখে দাও। তখন লিখে দিয়েছিলাম। সেই কাগজটা উনার পকেটে ছিল। তিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে কবিতাটি পড়লেন। কবিতাটি পড়ার। পরে বললেন, আমি এখন প্রস্তুত। এরপর ইতিহাসের যবনিকা পতন ঘটলাে। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেয়া হলাে। ৪২ মিনিট সময় লেগেছে তার মৃত্যু হতে। ৪২ মিনিট ফাসির রশিটা কাঁপছিল, এবং ডাক্তার ভােরে এসে কেঁদে ফেলেছিলেন। এই ঘটনা আমরা আর দেখিনি। একটি লােকের জীবন যেতে, ফাঁসির মঞ্চে তাকে ৪২ মিনিট ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে। সে অনেক ব্যাপার। কর্নেল তাহেরের ভাইদের নেয়া হলাে- তার লাশ দেখানাের জন্য। তারা কর্নেল তাহেরের রক্ত তাদের গায়ে মেখে এসে আমাদের গায়ে মাখিয়ে দিলেন। সারা জেলখানা স্তম্ভিত। কর্নেল তাহেরের ফাসি হয়ে গেল। আমরাও সব নির্বাক। বােবার মতাে বসে আছি। এত মহৎ এক ব্যক্তি, মহান এক ব্যক্তি, পৃথিবীর ইতিহাসে যার নাম উল্লেখ থাকা উচিত এবং থাকবে। তাকে এভাবে বিনা বিচারে, এভাবে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা কেউ মেনে নিতে পারেনি। একজন পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধা, বীর উত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযােদ্ধাকে ফাসি দেয়া হলাে। এটি বিচারের নামে ছিল একটি প্রহসন ।

এই প্রহসন জিয়াউর রহমান করলেন। জেনেভা প্যাক্টে উল্লেখ আছে, কোনাে প্রতিবন্ধী কিংবা কোনাে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত লােককে ফাসি দেয়া যায় এবং বাংলাদেশ সেই প্যাক্টে স্বাক্ষরকারী দেশ। জেনেভা প্যাক্টে বাংলাদেশেরঅবস্থান আছে। কিন্তু কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার জন্য এই প্রহসনমূলক বিচার করা হলাে এবং একজন পা হারানাে বীর উত্তম মুক্তিযােদ্ধাকে ফাসি দেয়া হলাে। একটি নিছক হত্যাকাণ্ড আর কিছুই না। কিন্তু জিয়াউর রহমানকেও একই পরিণতির মােকাবেলা করতে হয়েছে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে ২ অক্টোবর একটি ব্যর্থ অভুথান, সাজানাে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ঘটিয়ে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর প্রায় ২৫০০ সৈনিককে হত্যা করে। এই ২৫০০ সৈনিককে হত্যা করার বিচার নামক যে প্রহসন হয়েছিল সেখানে প্রত্যেকটি সৈনিককে বিচারের জন্য মাত্র ১ মিনিটেরও কম সময় দেয়া হয়েছিল। সে দোষী কি নির্দোষ তার প্রমাণ, স্বাক্ষ্য এগুলাের প্রয়ােজন ছিল না। তাদের ডেকে ডেকে ফাসির হুকুম শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। রাতের বেলা তাদেরকে ফাঁসি দেয়া হত। জেলখানায় যারা সুইপারের কাজ করে, ঝাড়ুদার, সুইপার, ড্রেন পরিষ্কার করার কাজ করে, এসে আমাদের সামনে। কান্নাকাটি করত। জেলখানার ড্রেনগুলাে রক্তে ভরে গেছে। একেক রাতে ৩০, ৪০, ৫০ জনের ফাসি হত। ফাসির পরে পােস্টমর্টেমে, ওদের রক্তগুলাে বেরিয়ে ড্রেনে। যেত এবং ড্রেনগুলাে রক্তে চুপসে যেত, রক্তে ভরে যেত। সুইপাররা এসে কান্নাকাটি করত, স্যার এসব সহ্য করার মতাে কোনাে উপায় নেই। ড্রেনগুলাের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এ হচ্ছে ইতিহাস। নির্মমতার ইতিহাস ম্লান হয়ে যাবে। মানবতার ইতিহাস ম্লান হয়ে যাবে। এটি শুরু করলেন কর্নেল তাহেরকে হত্যার মধ্য দিয়ে- যেহেতু জিয়াউর রহমান মনে করতেন সেনাবাহিনীর মধ্যে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নেতত্ব কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের চেয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় বেশি। এই একটি হিংসা এবং প্রতিশােধের জিঘাংসা নিয়ে কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়।

অন্যান্য কারণ থাকতে পারে, রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, সেনা অভ্যুত্থান, ব্যর্থ অভ্যুত্থান থাকতে পারে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ’রা বারবার জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান করেছে তাদেরকে তাে গ্রেফতার করা হয়নি, ফাসিও দেয়া হয়নি। কিন্তু জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তার জন্য সহ্য করতে না পেরে তাকে হত্যার এ ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসন মামলা, প্রহসন বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।

কারাগার থেকে স্ত্রী লুঙ্কাকে লেখা তাহেরের চিঠি

ঢাকা সেন্ট্রাল জেল ৯ই জুলাই, ‘৭৬ ভাের চারটা

প্রিয় লুৎফা ভাের চারটায় উঠে তােমাকে লিখছি, এতে তুমি নিশ্চয়ই খুবই অবাক হয়ে যাবে। জেলখানায় এসে এটা একটি বড় পরিবর্তন। ভাের চারটায় ঘুম ভেঙে যাবে। শুয়ে থাকতে ভালাে লাগে না। এ সময়টা লেখার কাজগুলাে শেষ করি। চারটা থেকে ৭টা পর্যন্ত। তুমি তাে জানাে গ্রেফতারের পর থেকে আমাকে একলা রাখা হয়। ঢাকা জেলেও সে ব্যবস্থা। নানা কাজে সাহায্য করার জন্য চারজন কয়েদি দেয়া হয়েছে। জেলখানায় এরা আমার বর্তমান অনুগত অনুসারী। ইতােমধ্যে তাই হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। আমার প্রতি এদের যত্নের বাড়াবাড়ি অনেক সময় উপদ্রব হয়ে উঠে। ব্যক্তিগত কাজগুলাে করে হালিম। ১৮ বছরের ছেলে। রাজনৈতিক দলের ছেলে। অস্ত্র আইনে দেড় বছরের সাজা হয়েছে। আমার বিছানা ছাড়ার সাথে সাথেই সে উঠে বসবে। ৭টা পর্যন্ত তিন কাপ চা-খাওয়া হয়ে যায়। ভােরের এই সময়টা ভালাে লাগে। ঢাকা জেলে কাক ছাড়া অন্য কোনাে পাখি নেই । কাক ডাকা শুরু হয় ভাের পাচটা থেকে। জেল গেটের পাশেই উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে একটি বেশ বড় জায়গায় আমাকে রাখা হয়েছে। দুটো বড় বড় কামরা। বাথরুম, কমােড রয়েছে। ভাববে না। বেড়াবার জায়গাও রয়েছে। বাগান রয়েছে। ঘরের বাইরের পানির ট্যাঙ্কে অনেকগুলাে তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছি। এদের জন্ম, জীবন, প্রেম ভালােবাসা, বংশবৃদ্ধি ও জীবন সংঘাত সম্বন্ধে ইতােমধ্যে বেশ বিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। বাগানের মাঝখানে সিমেন্ট ও পাথরের টুকরাে দিয়ে আমার চারজন অনুসারী নিয়ে তৈরি করেছি একটি পাহাড়। এটা বেশ ভালাে হয়েছে। বহুদিন থাকবে আমার ঢাকা জেলে থাকার স্মৃতি নিয়ে। বাগানটিও বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। 

জেলে এসে জীবন ও কর্মের বিচার করা যায় একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে । বাইরের নানা কাজে তা সম্ভব হয় না, কর্মজীবনের শুরু থেকে নানা ঘটনা আমাদেরকে নিয়ে গেছে একটি বৃহৎ দায়িত্ব ক্ষেত্রে। একটি দেশ, একটি জাতি ও সুন্দর সমাজ সৃষ্টির কাজে। একটি অবাক কর্মক্ষেত্র। দুর্বলতার কোনাে অবকাশই এখানে নেই। জীবনের সাধারণ দায়িত্বগুলাে যা জীবনকে সাধারণ অর্থে নিশ্চিত করে ও তাকেই আঁকড়ে থাকার মােহ দেয়, অনেক অংশে বিভ্রান্তও করে, সেই দায়িত্বগুলােকে অবহেলা করতে হয়েছে। আমার অজ্ঞতায় আমাদের ভালােবাসাকে আমি অনেক সময় সেই সাধারণ দায়িত্ব পালনের আওতায় এনেছি। অনেক ক্ষেত্রে অবহেলাও করেছি। জেলখানায় একাকী জীবনে আমাদের বন্ধনের গভীরতা আমি জানতে পেরেছি। আমার সেই অবহেলাগুলাে আমাকে মাঝে মধ্যে পীড়া দেয়। মনের গভীরে কি আমরা এক নই। | কোর্ট শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা সবাই সারাদিন একসঙ্গে থাকতে পারি। এটাই বর্তমানে বড় লাভ। এ কোর্টের বৃত্তান্ত খবরের কাগজে বের হলে আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কেউ জেলে আটকে রাখতে পারত না। সারাদেশের মানুষ ও সৈনিকরা ৭ নভেম্বরের চাইতে বহুগুণ বড় আকারে বের হয়ে আসত । সরকারি সাক্ষীরাই বলেছে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ৭ নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে সিপাহি বিপ্লব হয়। এ সাক্ষীদের দ্বারা আমাদেরকে কোনাে অভিযােগে অভিযুক্ত করতে পারবে না। এ কোর্টটি একটি আজব ব্যাপার। একে কোর্ট কোনাে অর্থেই বলা চলে না। চেয়ারম্যানের আচরণ ও ব্যবহার একটি থানার দারােগার মতাে। আমরাও তাকে সেভাবে গ্রহণ করি। তারা তাদের কাজ করে, আমরা আমাদের আলাপ-আলােচনা নিয়ে থাকি। ভাইজান ভালাে আছেন। জেলখানাকে ভাইজান কেমনভাবে গ্রহণ করেন সে জন্য আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। ভাববার কিছুই নেই। ভাইজান আমাদের সবার জন্য একজন আসল নেতা।

আনােয়ার কোট শেষে আমাদেরকে তার উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা শােনায়। তার কবিতা শােনার জন্য পুলিশ ও আর্মির লােকেরা ভিড় জমায়। জিয়া সুন্দরবনের ও শিকল পরা ছল গান গায় । * আমাদের মধ্যে একমাত্র মহিলা সালেহা তার স্বভাবসিদ্ধ সূক্ষ্ম কৌতুকে কোর্টকে ব্ৰিত করে। আমরা ভাইরা ছাড়া আর সবাই কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক সুকান্ত ও নজরুল জন্ম নিয়েছে কোট রুমের ছােট্ট বদ্ধ ঘরে। জলিল প্রতিদিনই একটি করে কবিতা লিখছে। বাংলা ও ইংরেজিতে । বেলাল সকলের অত্যন্ত প্রিয়। জেলখানায় সবাই তাকে সমীহ করে। দুপুরের খাবার। আমরা কোর্ট রুমে বসেই খাই। ভাইজান ও রব পরিবেশন করে । রব হচ্ছে। আমাদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। কার কী চাই তার দিকে তার সজাগ দৃষ্টি। মেজর জলিল আজকাল বিশেষ রাগ করে না। প্রথম দিকে একদিন বলেছিল। চেয়ারম্যানকে, ‘You are a colonel or a Dummy.’ চেয়ারম্যান বলে, I am a colonel.’ opina 2071 269, ‘I feel the tribunal and the prosecution are one piece and it my staying here and engaging a law-year is meaningless.’ এভাবেই কোট চলছে। ৭ নভেম্বর আমি রক্তপাত ছাড়া যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম, ধনিকশ্রেণী তা ব্যাহত করে তাদের জন্য তারা একটি বৃহত্ত রক্তপাত ক্ষেত্র প্রস্তুত করল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবেই । একে কেউ বাধা দিতে পারবে না। বেঈমান জিয়া আমাদেরকে জেলখানায় বিচার করতে বসে আরাে। আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করল। লাভ জনগণেরই। আমাদের জন্য তােমরা কোনাে চিন্তা করবে না। কাজের মাঝে জীবনের সার্থকতা। আমার জন্য যদি তুমি গৌরব বােধ করতে পারতা কি যথেষ্ঠ নয়? আম্মা এসেছেন কি? ডলি, জলি কেমন? আমার যিশুকে আদর দিও। সবাইকে স্নেহ দিবে। দৈনন্দিন ঘটনা দিয়ে বিষয়কে বিচার করবে না। সামগ্রিকভাবে আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। তুমি আমার অনেক আদর নিও, তােমারই তাহের

মিসেস লুত্যা তাহের

কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম-এর স্ত্রী যখনই দেশের কোনাে ক্রান্তিলগ্ন এসেছে তিনি স্বেচ্ছায় এগিয়ে গেছেন। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি তিনি কখনাে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ফারুক, রশিদ, ডালিম-রা নানাভাবে যােগাযােগ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন তােমরা সব পলিটিক্যাল লিডারদের রিলিজ কর এবং সর্বদলীয় সরকার গঠন কর। আমরা তখন নারায়ণগঞ্জে থাকি, কারণ কর্নেল তাহের ড্রেজার অর্গানাইজেশন-এ চাকরি নিয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের বাসায় সবাই আসত। ৫ তারিখ রাতে, হঠাৎ ভােরের দিকে, ৩টার দিকে হবে একটি টেলিফোন আসে। টেলিফোনের রিসিভারটি কিন্তু আমি উঠিয়ে তাহেরকে দিই। তাহেরের কথা শুনে মনে হলাে জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলছে। মাঝে কথার ফাকে লাইনটি কেটে গেল। তারপর তাহের যখন রিসিভার রাখল আমি জিগ্যেস করলাম কে? বলল জিয়া খুব আনসেফে আছে, খুব রিস্কি পজিশনে আছে। আমাকে সেভ করতে অনুরােধ করছে। তারপর থেকেই তাহের খুব চিন্তিত ছিলেন। এরমধ্যে কর্নেল তাহেরের সাথে সৈনিক সংস্থার লােকজন এবং আর্মির জেসিও, এনসিও, জুনিয়র অফিসারেরা যােগাযােগ শুরু করল। তখন নারায়ণগঞ্জের বাসায় সন্ধ্যা থেকে লােকজন আসা শুরু করল। কর্নেল তাহের অসুস্থ ছিল। সবার সাথে কথা বলতে পারেনি। কিছু কিছু লােকের সাথে কথাবার্তা বলে ৬ তারিখ বিকেল বেলা ঢাকার দিকে রওয়ানা হলাে। সঙ্গে আনােয়ার ছিল- কর্নেল তাহেরের ছােট ভাই। ঢাকায় গিয়ে এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় উঠলাে। কর্নেল তাহের সারাদিন অসুস্থ ছিল। তিনটের সময় সে বললাে, আমারতাে ঢাকায় যেতে হবে। আমি বললাম তােমার শরীরতাে খারাপ। এই রকম অসুস্থ, আবার মাঝে মধ্যে আলসারের ব্যথা হতাে।

খুব অসুস্থ হয়ে পড়ত। স্থানীয় ডাক্তার মজিবুর রহমানকে দিয়ে তার চিকিৎসা করাতাম। ৫ তারিখ ঘুমের ঔষধ খাইয়ে সারারাত ঘুম পাড়িয়েছিলাম । ৬ তারিখ তার যেতে হবে। আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বলল ভাববে না। ওখানে সবাই আছে। কর্নেল তাহেরের ভাই বাহার তিনটে দুটো’র দিকে বললাে আমরা জিয়াউর রহমানকে আনতে যাচ্ছি। ভাইজান আর জিয়াউর রহমান সেকেন্ড আর্টিলারি ফিল্ডে থাকবেন এবং সকালবেলা বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দিবেন। ভাের হয়ে আসছে। এরমধ্যে হাজার হাজার ছেলে সব আমাদের নারায়ণগঞ্জের বাসায় চলে আসল। স্থানীয় জাসদের কর্মী, সমর্থক, মুক্তিযােদ্ধা সবাই একদম স্লোগান দিতে শুরু করলাে। আর ঢাকা থেকে ট্রাকে করে সৈনিক সংস্থার লােকজন চলে আসল। এসে বললাে ভাবি আপনাদের এখানে একটি ট্যাঙ্ক এনে রাখি । আমি বললাম কেন? ট্যাঙ্কের তাে দরকার নেই। সকালবেলা রেডিও স্টেশন থেকে তাহেরের ভাই আনােয়ার, বেলাল টেলিফোন করল, তাহের ভাই এখন রেডিও স্টেশনে আছে, ভাষণ দিবে । এরমধ্যে প্রশাসন থেকে আমার বাসায় পেট্রোলের ব্যবস্থা করা হলাে। আমি তাদেরকে বললাম, আমাকে নিরাপত্তা দেয়ার দরকার নেই। আপনারা আপনাদের কাজ করেন। এরমধ্যে তাহেরের সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। ৯ তারিখ তাহের আমাকে টেলিফোন করলাে। ১২ তারিখের দিকে আমি ঢাকায় গেলাম। তাহেরের সাথে এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় দেখা । মিটিং নিয়ে অনেক ব্যস্ত। এরুমে মিটিং করেওরুমে মিটিং করে। আমার সাথে কথা বলার সময় নেই। তারপরে হঠাৎ করে বললাে আমি আমার ওয়াইফয়ের সাথে একটু সময় দিব। একটু কথা বললাম। আমি একটু অভিমান করেই বললাম, চলে আসলে, আমার কথা একটুও ভাবলে । বললাে আমি জানতাম তােমার কিছু হবে না। এসব বলে বাচ্চাদের একটু দেখল । বলল আমি খুব ব্যস্ত। আবার চলে গেল—অন্য জায়গায়। তারপর আমরা। চলে আসলাম এরমধ্যে আরেকবার তাহের টেলিফোন করেছিল। আমি এরমধ্যে জিয়াউর রহমানের বাসায় টেলিফোন করতে চেষ্টা করি। তখন আস্তে আস্তে জাসদের লােকজনকে ধরা শুরু করলাে। ২২ তারিখ টেলিফোন করলাম শাজাহান সিরাজের বাসায় (৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জেল থেকে বের হয় জলিল, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ। এরাও তখন কর্নেল তাহেরের সাথে মিটিং করছিল-কি করা যায়)। ১২ তারিখের দিকে কর্নেল তাহের যখন আমাকে টেলিফোন করলাে বলল, জিয়া এতদিন আমাদের সাথে যে কমিটমেন্টে ছিল তা থেকে মনে হয় সরে গেছে।

জিয়া আমার সাথে এখন যে বিহ্যাভটা করছে, মনে হয় জিয়া আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, দেখা যাক কী হয় । এই বলে রেখে দিল। আমি আবার এসব বােঝার জন্য কয়েক জায়গায় টেলিফোন করি। এরশাদ বললাে, কী জানি কি ভাবি, দেখি, মনে হয় পুলিশী তৎপরতা। এরমধ্যে জিয়াউর রহমানকে তাে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কর্নেল অলি, অলি বলল যে আচ্ছা আমি সবকিছু দেখতেছি ভাবি। এরমাঝে ২২ তারিখ টেলিফোন করলাম শাজাহান সিরাজের বাসায় । বলল যে ভাবি এইমাত্র তাে পুলিশ সবাইকে একসাথে ধরে নিয়ে গেল। তারপরে ২৩ তারিখে কর্নেল তাহেরের বড় ভাই আমাদের নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসেছিল। যাওয়ার পথে বাসায় নামার পরেই টেলিফোন করলাে বাসা থেকে আমাকে-তাে পুলিশে ধরে জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে। ২৩ তারিখ আমার সাথে কর্নেল তাহেরের দেখা হয়। তখন তারা সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে। তাহের অনেক কথাবার্তা, পার্টির কথাবার্তা বলে বলল চিন্তা করাে না, দেখি । মানে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করবে। কোথায় দেখা হয়েছিল? | দেখা হয় তাহের এবং তাহেরের বড় ভাইয়ের একজন কমন বন্ধু ছিল- ঐ বাড়িতে। বাড়িটি ছিল সেগুনবাগিচায়। সেখানে দেখা হয়। তখন আমার বাসায়ও নানারকম স্পেশাল ব্রাঞ্চের লােকজন আসা যাওয়া শুরু করেছে। আমি বুঝে ফেললাম আরেকটি কন্সপিরেসি হচ্ছে। তখন আমার বাসায় যে পেট্রোল ছিল উঠিয়ে নিয়ে গেল এবং আমার বাসায় কোনাে লােকজন আসতে পারে না। রাস্তা থেকে নানা ইন্টারগেশন করে ফিরিয়ে দিত। এভাবে ২৪ তারিখ তাহের টেলিফোন করলাে। আমি বলছি, তুমি কোথায়? আমি জেল গেটে। আমি বলছি জেলগেটে! বলল যে হ্যা, এস.এম হলাে থেকে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। আমি এখন জেলে। ঠিক আছে, তুমি এখন অন্যান্যরা কী অবস্থায় আছে, সবাইর দেখাশােনা, খোঁজখবর নিতে চেষ্টা কর। এভাবে জেলে যাওয়ার পরে আমার সাথে আর দেখা নেই। জেল থেকে কোথায় নিয়ে গেল? কখন নিয়ে গেল? একবার শুনি রাজশাহী জেলে নিয়ে যায়, একবার শুনি বরিশাল জেলে নিয়ে যায়। এভাবে আর কোনাে ট্রেস করতে পারি। যখনি একটু সেন্সরের মাধ্যমে দু’একটা চিঠিপত্র আসে তখনি আবার তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে করতে করতে ছয়মাস। নিয়ে গেল নভেম্বরে, তারপর জুন মাসে আমি বাসা ছেড়ে দিলাম । জুন মাসে না, আমি বাসা ছেড়ে দিলাম নভেম্বরের পরে ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে। নারায়ণগঞ্জের বাসা উঠিয়ে আমি চলে গেলাম বাবার বাসায়-কিশােরগঞ্জে। তখন সেখানে আমার ছােট ভাই সাব্বির একটি ছােট চিঠি লিখলাে- মনে হয় একটি কন্সপিরেসি মামলা শুরু হচ্ছেজাসদ এবং কর্নেল তাহেরকে নিয়ে। তুমি ঢাকায় আস। আমি তখন ঢাকায় আসলাম। এসে দেখলাম একটি মামলা হবে- সিভিল কোর্টে। সেখানে কর্নেল তাহেরকে আনছে। অস্ত্র আইনে একটি মামলা (এই মামলায় কোনাে কিছু প্রমাণিত না হওয়ায় তাহের খালাস পান)। সেখানে আমাদের দেখা হয়- জুন। মাসের শেষের দিকে।

তাহের কোর্টকে বলল, এতদিন পর্যন্ত আমি আমার ফ্যামিলির সাথে দেখা করতে পারিনি। আজকে সারাদিন আমার ফ্যামিলির সাথে কাটাতে চাই। তখন বিচারক এটি মঞ্জুর করলেন। তাহেরের মা, বড় ভাই, বােনযারা জেলের বাইরে ছিলেন দেখা করলাম। কর্নেল তাহের বললেন সিকিউরিটির লােকজন, পাহারারত পুলিশেরা সারাদিন আমাদের জন্য কষ্ট করছে, ঠিক আছে আজকে তাদের রেহাই দাও। তােমরা আজকে চলে যাও। আমরা চলে আসলাম। তাহেরও চলে গেল। তারপর তাহেরের সঙ্গে আর দেখা নেই। কয়েকদিন বিচার কাজ চলার পরে ১৭ তারিখ রােববার মামলার রায় দেয়। ১৯ তারিখ হঠাৎ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসলাে আমাদেরকে দেখা করতে দেবে- বিকেল ৩টার সময়। তখন আমরা যে যেভাবে পারি আমার ভাসুরের (কর্নেল তাহেরের বড় ভাই আরিফুর রহমান) বাসায় একত্রিত হই। আমি, তাহেরের মা, বাবা, বড় ভাই আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী, বড় ভাসুর আরিফুর রহমানের স্ত্রী, তাহেরের বােন ডালিয়া, জুলিয়া । কারণ তাহেরের বাকি সব ভাইয়েরা তখন জেলে। বাইরের বাকি সবাইকে দেখা করার অনুমতি দিল । আমাদের পর্যায়ক্রমে চারজন চারজন করে (জেলখানায় পুরাে তল্লাশি করে) পাঁচ মিনিটের জন্য নেয়া হলাে। কর্নেল তাহের আমাদের দেখে একদম উল্লসিত হয়ে উঠল। বলল জেলার সাহেব আমার স্ত্রী, মা, বাবা এসেছে বসার জন্য চেয়ার দেন। তাহের জেলের ৮নং সেলে ছিল। পরিষ্কার সেলটি। সেলের মধ্যে একটি চৌকি, নিচে তাহের বসল। আর আমরা বসলাম নিচের সিঁড়িতে। তাহের অস্থির হয়ে গেল, কেন বসার জন্য চেয়ার দেয়া হয়নি। চেয়ার আনা হলাে। তাহের বাবা, মায়ের সাথে কথা বললাে। স্বাভাবিক, একদম নর্মাল। একটি খাতার মধ্যে যে যে ঘটনা ঘটেছে, জেলখানার কত মজার ঘটনা, সাক্ষী দেয়ার সময় কে কী বলল, জবানবন্দিতে কে কী বলল, বিচারকেরা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করল—সবকিছু লেখা। সব আমাদের পড়ে পড়ে শােনাচ্ছে। এরমধ্যে জেলার তাড়া দিচ্ছে, সময় শেষ, সময় শেষ। তাহের জেলারকে বলল আপনি এসময়ও আমাকে সময় দিচ্ছেন না। জেলার বলল, ঠিক আছে কথা বলেন। তাহের বলল আমি আমার ওয়াইফ-এর সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। সবাই চলে গেল, আমি বসলাম । তাহের তখন সবার সামনে তার শেষ চিঠি যেটি বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে সবাইকে পড়ে শােনাল। বলল, খাতার মধ্যে অনেক কিছু আছে। খাতাটি এখনতাে দেবে না। তােমরা খাতাটি পাবে, খাতাটি নিয়ে নেবে। তারপরে আমি যখন একা তখন বলল তােমার তাে দুঃখ করা সাজে । আমি তাে কোনাে অন্যায় করিনি। আমি এমন কিছু করেছি, যার জন্য তুমি গর্ব করতে পার। তুমি মাথা নত করবে না। এই উপমহাদেশে ক্ষুদিরামের পরে রাজনৈতিক ফাসি আমারই রায় হয়েছে। কিন্তু ফাসির কথাটি সে বলেনি। সে নাকি জানত, আমাদের বলেনি।

জেলখানায় থাকতে এত মজার মজার ঘটনা আমাদের বলল। বলল কমােড আছে, চিন্তা করবে না। এত টুকটাক কথা বললআমরা হাসতে হাসতে বিদায় নিলাম। তাহের বলল আবার দেখা হবে। আমরাও হাসতে হাসতে বিদায় নিলাম। আমরা চিন্তাই করতে পারিনি, আজকে রাতেই ফাসি হয়ে যাবে। আমি মঞ্জুরকে টেলিফোন করলাম। জেনারেল মঞ্জুর বলল, ভাবি কালকে আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারতাম, কিন্তু কী বলবাে কিছু তাে বুঝতে পারছি না। দেখি তাহের যদি এখনাে থেকে থাকে আমি দেখব। তখন আমি আবার আমার ভাসুরের রাজিয়া সুলতানা রােডের বাসায় আসলাম। তখন জাসদের কয়েকজন ছাত্রনেতা শাহ আলম, এডভােকেট জিনাত আলী বলল ভাবি আপনার কোথাও যেতে হবে না। তখন আমি সবই বুঝলাম। জেলখানা থেকে টেলিফোন আসল লাশ নেয়ার জন্য। আমরা বললাম ঢাকায় কবর দেব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলল না। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার শাশুড়ি অনেক ঝগড়া করলেন। কিছুতেই তারা ঢাকায় কবর দিতে দেবে না। আমরা বললাম, সিকিউরিটির অভাব। কীভাবে আমরা লাশ নিয়ে যাব, কাজলা গ্রাম তাে অনেক দুর্গম এলাকায়। তখন তিন মাইল হেঁটে যেতে হতাে। বলল তারা পৌছে দেবে। তারা আমাদের কাছে লাশ দিল না। তারা জেলগেটের ভেতরে একটি ট্রাকের ভেতরে লাশ দিল। আমাদের বলল হেলিপ্যাডে যেতে । হেলিকপ্টারে উঠে এই প্রথম আমি কর্নেল তাহেরের লাশ দেখলাম। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, একজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধার এই পরিণতি! তার পা ও মাথা বেরিয়ে আছে। জেলখানার ছেড়া একটি চাদর দিয়ে তার শরীর ঢাকা। এই হেলিকপ্টারই আমাদের কাজলা পৌঁছে দিল। বাংলাদেশ আর্মিরাই কবর খুড়লাে। সেই কবরে কর্নেল তাহেরকে, পারিবারিক কবরস্থানে সন্ধ্যা ৭টায় সমাহিত করা হলাে। বাংলাদেশ আর্মিরা ২১ দিন পর্যন্ত কবর পাহারা দিল। এভাবে তাহের আমাদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলেন। | আমাদের দেখা হতাে না, জেলখানা থেকে কর্নেল তাহের মাঝে মধ্যে টুকটাক চিঠি পাঠাত। এটা হতাে খুব গােপনীয়ভাবে, যখন জেলখানায় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল চলাকালীন সময়ে-এডভােকেট জিনাত আলীর মাধ্যমে কিছু চিঠি পাঠাত। শেষ চিঠিটি কিভাবে পেয়েছিলেন? শেষ চিঠিটিও সেভাবেই পেয়েছিলাম। আমাদের কাছে জিনাত আলী ও এডভােকেট শরীফউদ্দিন চাকলাদার, যিনি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হিসেবে আছেন। এদের মাধ্যমেই চিঠিগুলাে পাই। শেষ চিঠিটি কবে পেয়েছিলেন? শেষ চিঠি রায়ের পর ১৮ তারিখে পেয়েছি। ওইদিনই চিঠিটি লেখা। চিঠিটি শরীফউদ্দিন চাকলাদার সন্ধ্যার সময় নিয়ে এসেছে। আমি তখন আমার ভাসুরের বাসায় রাজিয়া সুলতানা রােডে থাকি। খাতাটি আর পাননি?

এরমাঝে আমি অনেক চেষ্টা করেছি সমস্ত ডকুমেন্টগুলাে পাওয়ার জন্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং জেলারের কাছেও চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনাে তথ্যই আমাদেরকে দেয়া হয়নি। তাহের এই দেশমাতৃকার ডাকে যখন যেখানে প্রয়ােজন হয়েছে তখনি ছুটে গিয়েছেন। জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যােগ দিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। নিজের জীবন বিপন্ন করে ৭ নভেম্বর শােষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে একটি দেশদ্রোহীর অভিযােগে। তাহের নিজেই তার চিঠিতে বলে গেছেন, একটি মানুষের কাছে আর কতভাবে আনুগত্য চায় । যে দেশমাতৃকার ডাকে চলে এসে রক্ত দিতে পারেন, পা হারাতে পারেন, এবং শেষ পর্যন্ত সে হাসতে হাসতে ফাসির কাষ্ঠে জীবন দিয়েছে, তার কাছ থেকে দেশ আর কী আনুগত্য চায়? সে তার নিজের জীবন দিয়েছে এবং

তার শেষ জবানবন্দিতে তাও বলে গেছেন। সুতরাং আমারও প্রশ্ন- একটি মানুষ যে তার জীবনে এত ত্যাগ তিতিক্ষা- এটি দেশমাতৃকার জন্য। সে কি দেশদ্রোহী হতে পারে? কী কারণে তাকে দেশদ্রোহী করা হলাে? মামলার কী নথিপত্র? মামলায় কী অভিযােগ ছিল-সেগুলাে জানার অধিকার কি আমার নেই? কর্নেল তাহের নিজেও বলে গেছেন শেষ চিঠিতে

পরিবারের কাছে লেখা তাহেরের শেষ চিঠি

ঢাকা সেন্ট্রাল জেল

১৮ই জুলাই ‘৭৬ সাল

শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুঙ্কা, ভাইজান, আমার ভাই ও বােনেরা গতকাল বিকালবেলা ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়া হলাে, আমার জন্য মৃত্যুদণ্ড। ভাইজান ও মেজর জলিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। আনােয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়া ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা। সালেহা, রবিউল ৫ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। ড. আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ, মান্নাসহ ১৩ জনকে মুক্তিদান। সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মতাে তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করল।

হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে তিনি বললেন, ‘আমার কান্না সে জন্য যে, একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘােষণা করতে পারল।’ বােন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে যেয়ে কাঁদতে শুরু করল। সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম, “তােমার কাছ থেকে এ দুর্বলতা কখনই আশা করি না।’ সালেহা বলল, “আমি কাঁদি নাই আমি হাসছি।’ হাসিকান্নায় এই বােনটি আমার অপূর্ব। জেলখানার এই বিচারকক্ষে এসে প্রথম তার সাথে আমার দেখা। এই বােনটিকে আমার ভীষণ ভালাে লাগে। কোনাে জাতি এর মতাে বােন সৃষ্টি করতে পারে।

সমগ্র সাক্ষী, অভিযুক্তদের শুধু একটি কথা, “কেন তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। হলাে না।’ মেজর জিয়া বসে আমার উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখল। জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, ‘তাহের ভাই লাল সালাম। সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। জেলখানার উঁচু দেওয়াল এই ধ্বনিকে কি আটকে রাখতে পারবে? এর প্রতিধ্বনি কি পৌছবে না আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়? রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হঠাৎ হতবাক হয়ে গেলেন। তারা এসে আমাকে বললেন যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না, তবুও তারা সুপ্রিম কোর্টে রীট করবেন কারণ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে। সাথে সাথে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন। আমি তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম রাষ্ট্রপতির কাছে কোনাে আবেদন করা চলবে না। এই রাষ্ট্রপতিকে আমিই রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছি। এই দেশদ্রোহীদের কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারি । সবাই আমার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শুনতে চাইল। এরমধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আমি বললাম, আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লােভ-লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপনাদের মাঝে থাকি তখন সমস্ত ভয়, লােভ-লালসা দূরে চলে যায় । আমি সাহসী হই, আমি বিপ্লবের সাহসী রূপে নিজেকে দেখতে পাই। সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে প্রবেশ করে। তাই আমাদের একাকীত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সে জন্যই আমাদের সংগ্রাম । সবাই একে এক বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখ। বেশ কিছু দিন সবাই একত্রে কাটিয়েছি। আবার কবে দেখা হবে। সালেহা আমার সাথে যাবে, ভাইজান, আনােয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাদেরকে তাে আমি জানি। আমাকে সাহস দেবার জন্য তাদের অভিনয়। বেলালের চোখ ছল ছল করছে। কান্নায় ভেঙে পড়তে চায়। জলিল, রব, জিয়া আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল । এই আলিঙ্গন অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে দৃঢ় আলিঙ্গনে আমরা সমগ্র জাতির সঙ্গে আবদ্ধ। কেউ তা ভাঙতে পারবে ন । সবাই চলে গেল। আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম। সালেহা চলে গেল তার সেলে। বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি ও রাজবন্দীরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বদ্ধ সেলের দরজা জানালা দিয়ে। মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যান্যরা দেখাল আমাকে বিজয়চিহ্ন। এই বিচার বিপ্লবীদেরকে তাদের অগােচরে এক করল।  ফাঁসির আসামিদের নির্ধারিত জায়গা ৮ সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলাে। পাশের তিনটি সেলে আরাে তিনজন ফাঁসির আসামি। ছােট্ট সেলটি ভালােই, বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই তাতে লজ্জার তাে কিছুই নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতাে বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে।  নীতু, যিশু ও মিশুর কথা-সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি। কিন্তু আমার সমগ্র জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি শত সহস্র উলঙ্গ, মায়া, ভালােবাসা-বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালি জাতির জন্য উদ্ভাসিত সূর্যের আর কত দেরি? না, আর দেরি নেই। সূর্য উঠলবলে। এ দেশসৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব যা আমার জাতিকে আলােকিত করবে, উজ্জীবিত করবে- এরচাইতে বড়পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে। আমাকে কেউ হত্যা করতে পাবে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি তা করতে পারে? কেউ পারবে না। আজকের পত্রিকা এল । আমার মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্যদের বিভিন্ন শাস্তির খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা।

রাজসাক্ষিদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব ঘটে । আমার নির্দেশে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। আমার দ্বারা বর্তমান সরকার গঠন হয়। সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোনাে উল্লেখ ছিল না। এডভােকেট আতাউর রহমান, জুলমত আলী ও অন্যান্যরা যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক, চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান। ও অন্যান্যদেরকে বলবে সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে ইতিহাস তাদেরকে ক্ষমা করবে না। তােমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালােবাসা, আদর নিও। বিচারঘরে বসে। জিয়া অনেক কবিতা লেখে, তারই একটি অংশ জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম। জন্মেছি, তােদের শােষণের হাত দুটো ভাঙব বলে ভেঙে দিলাম । জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম । জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম। পাথরের নিচে শােষক আর শাসকের কবর দিলাম পৃথিবী- অবশেষে এবারের মতাে বিদায় নিলাম। তােমাদের তাহের

আবু সাঈদ আহমেদ

কর্নেল তাহের-এর অনুজ

কাজলা, নেত্রকোনা

জিয়া, মঞ্জুর আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের মতাে। তাদের বাসায় যাতায়াত, এমনকি আমার বিয়ের অনুষ্ঠানেও জিয়া- তকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং

তার স্ত্রী অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেছেন। বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বলা হয়েছে, আমার কাছে খবর পাঠানাে হয়েছে- এসব বিচার, ট্রায়াল- এগুলােতে কোনাে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (মৃত্যুদণ্ড) হবে না। এগুলাে কোনাে ব্যাপার না। তারপরে তাে এরা মুক্তিই পেয়ে যাবে। এভাবে ফাসির রায় ঘােষণা করে ২ দিনের মাথায় ফাসি কার্যকর করা, গােটা ব্যাপারটাই, গােটা জাতিকে হতভম্ব করে দেয়। তার (তাহেরের) নিকটস্থ মুক্তিযােদ্ধারা সবাই হতভম্ব হয়েছিল। কোথায় যাবে, কী করবে? তারা ভাবতেও পারেনি, এই যে ট্রায়াল, পরেরদিনই ফাঁসির রায় কার্যকর করা। তারপর তাকে (কর্নেল তাহের) নিয়ে আসা হলাে হেলিকপ্টারে । আমি তখন পলাতক । ফেরারি জীবনযাপন করি । পুলিশ আমাকে হন্যে হয়ে খোঁজে। আমি দূর থেকে দেখলাম আমাদের গ্রামের মীর হােসেন নামে একটি ছেলে তার (কর্নেল তাহের) লাশের ওপর কিছু ফুল ছিটিয়ে দিল।

হাসানুল হক ইনু

সভাপতি, জাসদ, মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাভােগী। আমরা তখন আত্মরক্ষার জন্য বিপ্লবী গণবাহিনীর জন্ম দিয়েছিলাম । আত্মরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থারও জন্ম হয়েছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সর্বাধিনায়ক হিসেবে এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল তাহের দায়িত্ব পালন করতেন। আমি হাসানুল হক ইনু, কর্নেল তাহেরের সহকারী বা আমার পদ ছিল উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতাম। | মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে অক্টোবর ‘৭২ সালে আমি যােগ দিই এবং তারপর থেকে জাসদের সদস্য হিসেবে এবং কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর বাইরে গােপনে আমি বিপ্লবী গণবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

যাহােক চক্রান্তকারীরা সুযােগ গ্রহণ করে। চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কর্নেল ফারুক, রশিদের নেতৃত্বে একগুচ্ছ অফিসার সেনাবাহিনীর বাইরে এসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তার পরিবারের সদস্যদেরকে হত্যা করে। চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্ঘটনা। একটি ট্র্যাজেডি। যখন সাংবিধানিক পদ্ধতিকে বানচাল করে দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় সদস্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-এর বিরােধিতা করেছিল। এই বিরােধিতা করার ফলে খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার পরিচালিত হয়েছিল সেই অবৈধ সরকারের ৮৩ দিনের শাসনকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর এম.এ. জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ.স.ম আবদুর রব, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজসহ প্রায় ২০ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে ছিলেন।

এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতরে সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল, সেখানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ শৃঙ্খলা আনার নামে সশস্ত্র বাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করার চেষ্টা করলেন। এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি। উনি শৃক্ষলা আনার নামে নিজেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলেন। উনি তৎকালীন সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করলেন। উনি নিজে সেনাপতি হলেন। সার্বিক এই পরিস্থিতিতে সারাদেশে যখন একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করল এবং সশস্ত্র বাহিনীর সাধারণ সৈনিকেরা অফিসারদের এই ক্ষমতার পেছনে যে উন্মাদনা প্রদর্শন শুরু করল-তাতে সবাই জীবন নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। এরকম পরিস্থিতিতে কর্নেল তাহের নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। সবাই তার শরণাপন্ন হলেন। যেহেতু আগে থেকেই সৈনিক সংস্থার সদস্যরা সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে কর্মরত ছিল, নিয়ােজিত ছিল, তারা পুরাে সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন এবং অবস্থার বিবরণ দিলেন। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল তাহের ঢাকা শহরে ৩৩৪ নম্বর এলিফ্যান্ট রােডে তার ভাইয়ের বাসায় (আবু ইউসুফ খান সাহেবের বাসা) এসে অবস্থান নিলেন। আমি ওখানে তার সঙ্গে ছিলাম । ঐখানে শত শত সৈনিকেরা এসে রিপাের্ট করলেন এবং কীভাবে এই উদ্ভূত পরিস্থিতিকে | মােকাবেলা করা যায় সেই ব্যাপারে শলা-পরামর্শ শুরু হলাে। মনে রাখতে হবে, ৩ নভেম্বর খালেদ মােশারফ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন সেই ৩ নভেম্বর, ৪ নভেম্বর, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনাে সরকার আছেকি নেই এটি টের পাওয়া যাচ্ছিল না। এই যেবিভক্ত সৈনিকেরা একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করে অবস্থান গ্রহণ করল। এরকম প্রেক্ষাপটে গৃহযুদ্ধ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য, স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফেরত যাওয়ার জন্য এবং সামরিক শাসনকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনার সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিটের সুবেদার, নায়েক সুবেদার, সুবেদার মেজর, হাবিলদার, নায়েক এবং সাধারণ সৈনিকেরা অংশগ্রহণ করে। ৭ নভেম্বর ভােররাত ১টার দিকে বিদ্রোহ সফলভাবে হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিভক্তির অবসান ঘটে এবং বন্দিত্ব থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান বেরিয়ে আসে। তারপরে এর ইতিহাস অন্যরকম। কর্নেল তাহের তখন সৈনিকদের পক্ষাবলম্বন করে দেনদরবার করছিলেন। সুতরাং ৭ নভেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর এই সময়কাল ছিল ৭ নভেম্বরের যে মূল চেতনা- একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরত যাওয়ার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঘােষণা করা, কারাগার থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া এবং বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ফেরত আনা- সেই কাজটি নিয়ে যখন কর্নেল তাহের মাথা ঘামাচ্ছিলেন, চেষ্টা করছিলেন, তদবির করছিলেন, জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কাজে মনােযােগ দিলেন। এই দ্বন্দ্ব বিরােধের | একটি পর্যায়ে ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহের গ্রেফতার হয়। আমি এবং মেজর

জলিল, আ.স.ম আবদুর রব এলিফ্যান্ট রােডে শাজাহান সিরাজের বাসভবন থেকে দিনের ১১টার সময় ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার হই। আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাই। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমি ফাসির আসামিদের যে প্রকোষ্ঠে রাখা হত সেই ৮নং সেলে আমাকে রাখা হয়েছিল এবং সেখানে পরেরদিন সন্ধ্যার | দিকে আমি দেখলাম ক্র্যাচে ভর করে খটখট আওয়াজ করতে করতে একজন মানুষ এগিয়ে আসছেন। সন্ধ্যের সময় তখন দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত। আমি দেখলাম আমার ঘরের ভেতরেই কর্নেল তাহের এবং তার বড় ভাই আবু ইউসুফ খানকে রাখা হলাে। যদিও একঘরে দু’জনকে রাখা নিষেধ ছিল। আমরা তিনজন একঘরে ছিলাম। দু’একদিন ছিলাম এবং তারপরে আমাদের হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তর করা হলাে। কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, আ.স.ম। রবসহ জাসদের এবং সৈনিকদের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একে একে তারা সবাই কারাগারে চলে আসল। পাঁচ-ছয়দিনের মাথায় আমাদের ঢাকা থেকে স্থানান্তর করা হলাে এবং সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হলাে। এমনকি জেলের যে নিয়ম সে নিয়মানুযায়ী পরিবারের সাথে দেখা করার যে আইনগুলাে ছিল, বিধানগুলাে ছিল সেই বিধানও মানা হয়নি। সমস্ত জেলখানাগুলাে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দখল করে নিল এবং অস্ত্র হাতে আমাদের পাহারা দেওয়া হলাে। আমি সিলেটে, রাজশাহীতে কর্নেল তাহের এরকম বিভিন্নজন বিভিন্ন জেলে চলে গেল। এটি পঁচাত্তর সালের নভেম্বর মাসের ঘটনা। কোনাে উচ্চবাচ্য নেই। এরমধ্যে | হঠাৎ করে আমরা শুনলাম নায়েক সুবেদার মাহবুবুর রহমান, কর্পোরাল ফখরুল | আলম, নায়েক সুবেদার জালাল, নায়েক সিদ্দিক, নায়েক কর্পোরাল শামছুল আলম প্রত্যেকেই গ্রেফতার হয়ে গেলেন এবং তাদেরকে কারাগারে নিয়ে আসা হলাে। আমরা আঁচ করছিলাম জেনারেল জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য, সামরিক শাসনকে আরাে পাকাপােক্ত করার জন্য কর্নেল তাহেরসহ আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা আঁটছে। কিন্তু পরিকল্পনা যে এত ভয়াবহ হবে এটি আঁচ করতে পারিনি। আমার এখনাে মনে আছে, এর ভেতরে জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর খবরও আমাকে পৌছানাে হয়নি। | হঠাৎ করে আমরা জানতে পারলাম, একটি মামলা হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা তখন পর্যন্ত কোনাে তথ্য পাইনি বা আমাদেরকে কেউ কিছু জানায়নি। ৭ নভেম্বরের পরে ২৩ এবং ২৪ নভেম্বর ‘৭৫ সালে আমরা গ্রেফতার হওয়ার থেকে প্রায় ৭ মাস পরে হঠাৎ করে একদিন আমাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে। | আসা হলাে। এটি ‘৭৬ সালের জুন মাস ছিল। জুন মাসে আমরা সবাই ঢাকায় আসলাম এবং আঁচ করতে পারলাম একটি কিছু চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ১৪ জুন। ১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক আদালত বিধি ১৯৭৬ অধ্যাদেশ জারি করা হয় । এই বিধির বলে সেদিনই ১নং বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠন করা হয়। এখানে ৫ জন বিচারক নিয়ােগ করা হয় । এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল ডি.এস ইউসুফ হায়দার এবং সদস্য ছিলেন উইং কমান্ডার মাে. আবদুর রশীদ ও অস্থায়ী কমান্ডার সিদ্দিক আহম্মেদ। একজন বিমানবাহিনী, একজন নৌবাহিনী থেকে। আর দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট মাে. আবদুল আলী এবং হাসান মােরশেদ। ২১ জুন ১৯৭৬ সালে মামলা শুরু হলাে। | মামলা শুরু হলাে কিন্তু আমাদের কোনাে কিছু আগেভাগে জানানাে হলাে না। মজার ব্যাপার হলাে, আমরা মনে করলাম আদালতে নিয়ে যাবে। কিন্তু আদালতে না নিয়ে গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ডিআইজি’র কক্ষটিকে আদালতে রূপান্তর করা হলাে এবং সেখানে আমাদের বিচার শুরু হলাে। বিচার যখন শুরু হলাে, উকিল নিয়ােগ করা যাবে কি যাবে না। তখন তারা বললেন উকিল আসতে পারবে কিন্তু তার আগে একটি সামরিক আইন জারি করা হলাে, এই বিধি বলে কোনাে উকিল এই মামলায় আসতে পারবেন যদি তারা এই মামলার নথিপত্র অথবা কথাবার্তা জনসম্মুখে প্রচার করেন তাহলে তিন বছর সাজা পাবেন। সুতরাং এটি একটি সামরিক গােপন আদালত তৈরি হলাে।

এই যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন হলাে, এই ট্রাইব্যুনালের উচ্চ আদালতে আপিল করারও কোনাে সুযােগ ছিল না। ২১ জুন প্রথম আমাদের ঐ আদালতে নেয়া হলাে এবং নেয়ার পরে আমাদের বলা হলাে আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ আছে। এই প্রথম আমরা শুনলাম। শােনার পরে আমরা বললাম অভিযােগটি কী? ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বৈধ সরকারকে সশস্ত্র গণঅভুত্থানের মধ্য দিয়ে সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মাঝে তৎপরতা চালানাের অভিযােগ। এটি একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ। এই অভিযােগ উনারা উত্থাপন করলেন। অভিযােগ বলার পরে ঐদিনই আটদিনের জন্য মামলার কাজ স্থগিত হয়ে যায়। এই মামলায় সরকারের পক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি যাকে বলে তিনি হলেন এটি এম আফজাল-পরে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়। মামলার সাক্ষ্য পরিচালনা করেন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুর রাজ্জাক খান এবং সহযােগিতা করেন অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী আবদুল ওহাব । আমার এখনাে মনে আছে আতাউর রহমান খান সাহেব উঠে বললেন- আপনাদের মামলার অভিযােগইতাে সুনির্দিষ্ট নয়। কোনাে নির্দিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য এই মেজর জলিল, কর্নেল তাহের সাহেবরা চক্রান্ত করেছে- সেটিতে মামলায় সরকার পক্ষ নির্দিষ্ট করে বলেননি। ৮ দিন মুলতবি হওয়ার পরে মাত্র ১৮ দিনের কার্যদিবস আমরা পেয়েছি। ১৫ দিনের মাঝে মামলা শেষ হয়ে গিয়েছে। ১৫ দিন পরে ১৭ জুলাই বিকেলবেলা মামলার রায় ঘােষণা করা হয়। সেই রায়ের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করা হয়।

মেজর জলিলসহ আমাকে- আমি ১০ বছর কারাদণ্ড, ফাইন, অনাদায়ে আরাে ২ বছর, ১২ বছর। এরকম আমার ১২ বছর সাজা হলাে। যে সামরিক আইনের বিধানে আমাদের বিচার করা হয়েছিল সে বিধানে মৃত্যুদণ্ডের কোনাে রেওয়াজ ছিল না বা বিধানও ছিল না। এই জায়গাটি সবচেয়ে দুঃখজনক ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ৩১ জুলাই ১৯৭৬ সালে একটি বিশেষ সামরিক আইনের ২০তম সংশােধনী জারি করে সেখানে সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান জারি করা হয়। পুরাে ব্যাপারটিই একটি এলােমেলাে ব্যাপার ছিল। জেনারেল জিয়ার এতই মাথা গরম ছিল উনি উনার সামরিক আইনের যে পদ্ধতিগুলাে, পর্যায়গুলাে সেগুলাে স্তরভিত্তিতে সাজাতে পারেননি। যে কোনাে সময় আদালত ফাসি দিলে, মৃত্যুদণ্ড দিলে তার অনুমােদন রাষ্ট্রপতি দেন। ২৪ ঘণ্টার ভেতর বিচারপতি সায়েম, তকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক অনুমােদন দেন। এত দ্রুততার সঙ্গে কখনাে কোনাে রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডের অনুমােদন করেননি।  বিচারের সময় যেখানে আমরা বসতাম সেখানে চেয়ার ছিল না, বেঞ্চের মতাে ছিল এবং কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল। সেই জায়গায় চোরের মতন উল্টোদিকে এসে ট্রাইব্যুনাল বসত এবং ট্রাইব্যুনাল মাথা নিচু করে থাকত। প্রশ্ন-উত্তরের কোনাে সুযােগ ছিল না। এই মামলা সাজাতে সরকারের ৬ মাস সময় লেগেছে। তারপরে ১৫ দিনের ভেতরে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিয়েছে। আমার এখনাে মনে আছে জবানবন্দি দেয়ার অধিকার দিল । একবার চিন্তা করলাম জবানবন্দি দেব , বলে লাভ কী? কিন্তু ইতিহাসের জন্য, সাক্ষী রেখে যাওয়ার জন্য, এই ঘটনাকে জানানাের জন্য আমি জবানবন্দি দিতে রাজি হলাম। এখনও মনে আছে আমাকে ৪ পাতা কাগজ দেওয়া হয়েছিল, এর বেশি কাগজ দেয়া হবে না, এর ভেতরে লেখতে হবে। আমি চার পাতার ভেতরে আমার জবানবন্দি লিখেছিলাম। যদিও কর্নেল তাহের কিছু লিখেছিলেন। কিন্তু উনাকে আর থামাতে পারেনি। উনি উনার ইচ্ছেমতন দাঁড়িয়ে উনার কথা বলে গেছেন। যেটি কর্নেল তাহেরের শেষ জবানরন্দি হিসেবে ছাপা আছে, সবাই জানেন। কর্নেল তাহের বারবার বলেছিলেন, এই মামলায় আমি সাক্ষী হিসেবে জেনারেল জিয়াকে চাই, এমজি তাওয়াবকে চাই, নৌবাহিনীর প্রধানকে চাই, জেনারেল ওসমানিকে চাই। কারণ তারা জানেন কীভাবে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান হলাে।

কীভাবে ৭ তারিখ সকাল ১০ টার সময় টু ফিল্ড আর্টিলারিতে যে বৈঠক হলাে সে বৈঠকে জেনারেল জিয়া ছিলেন, কর্নেল তাহের ছিলেন, জেনারেল ওসমানি ছিলেন, মাহবুবুল আলম চাষী ছিলেন, সেনাপ্রধানরা এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মকর্তারা ছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেই সিদ্ধান্ত ঐখানে হয়। আমি এবং ড. আখলাকুর রহমান সেই সময় বাইরে চেয়ারে বসা ছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর কর্নেল তাহের বেরিয়ে আসছিলেন, পরামর্শ নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকছিলেন। সুতরাং ঐখানেই সিদ্ধান্ত হলাে কীভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। কীভাবে রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পরেরদিন মেজর জলিল, আ,স,ম আবদুর রবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হলাে। ঐখানেই সিদ্ধান্ত হলাে কীভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্রে ফেরত যাত্রা শুরু করবে। সে মূহর্তে জেনারেল জিয়া মাথা নিচু করে কর্নেল তাহেরের সব পরামর্শ স্বীকার করে নিয়ে ৭ তারিখ সকালের সিদ্ধান্তের অনুমােদন দেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস কর্নেল তাহের সেদিন সায়েম, জেনারেল ওসমানির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে একটি অগ্রযাত্রা করার জন্য, রাজনৈতিক পন্থা তৈরি। করার জন্য যে পরামর্শ সভায় বসেছিলেন, সেই পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেন, জিয়াউর রহমান সেনাপতি হলেন এবং তারাই পরবর্তীকালে একটি প্রহসনের মামলার মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহেরকে হত্যা করল। রাজনীতির এই যে নেতিবাচক দিক, এই যে নির্মম দিক, এই নির্মম দিকের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। জিয়াউর রহমানের শাসনকাল একটি অস্থিতিশীল কাল। এখানে অশান্তি ছিল। ৭ নভেম্বরের পরদিন থেকে উনার মৃত্যু হওয়ার কিছুদিন আগে কারফিউ তােলা হয়েছিল। প্রতিদিন বাংলাদেশে কারফিউ ছিল। রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হত। জরুরি আইন ছিল। দেশে একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ছিল। সিপাহি বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বরে যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল একজন সমরনায়ক হিসেবে এই অভুত্থানে, সিপাহিদের এই বিদ্রোহকে জেনারেল জিয়া কখনাে মেনে নেননি। এই সিপাহি বিদ্রোহের পক্ষে যারা যারা ছিল তাদেরকে নির্ধ্বংশ করার জন্যে জেনারেল জিয়া-ই চক্রান্ত করেছিল।

লরেন্স লিফশুলৎস

মার্কিন সাংবাদিক, ইয়েল ইউনিভার্সিটি সে সময়ে ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’র সংবাদদাতা প্রখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস ঢাকায় ছিলেন। তিনি মামলা চলাকালে এর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে কিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তা আমরা এখন লরেন্স লিফশুলৎসএর কাছ থেকেই শুনব আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাড়িয়ে ছিলাম। একদিন আগেই চলে এসেছিলাম আমি। স্মৃতিতে ধরে রাখার মতাে একটি দিন। সেদিন ছিল ২৮ জুন ১৯৭৬।

এক সপ্তাহ আগে এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত গােপনে তাদের কাজ। শুরু করেছিল। একদিনের জন্য আদালত বসার পর একটি মামলার বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সাতদিনের সময় দিয়ে আদালত এক সপ্তাহের অবকাশে চলে যান। ছয় মাস আগে থেকেই মামলার প্রস্তুতি চলছিল। কর্নেল আবু তাহেরসহ ২০ জনেরও বেশি লােকের বিচার শুরু হয়েছিল ।

অভিযুক্তদের বন্দিজীবনের পুরাে সময়টিতে বারবার আবেদন সত্ত্বেও তাদের আইনগত পরামর্শ এবং স্বজনদের সঙ্গে যােগাযােগের সুযােগ দেওয়া হয়নি। বিচার শুরুর পর এই সংবাদদাতা হংকংয়ে দ্য ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউএ এবং লন্ডনে বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান-এ এ সংক্রান্ত খবর পাঠান। সে সময় আমি ছিলাম রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সংবাদদাতা। এসব রিপাের্ট পাঠাতে আমি বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অবশেষে একজন যাত্রী একটি আন্তর্জাতিক বিমানে করে এর কপিগুলাে নিয়ে যান। যার অর্থ দাঁড়ায় বিচারের খবরগুলাে থাইল্যান্ড থেকে পাঠানাে হয়েছিল। ফলে ঢাকাবাসী এ সংক্রান্ত প্রথম রিপাের্টগুলাে পেয়েছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের মাধ্যমে। ২৮ জুন যখন বিচার কাজ পুনরায় শুরু হয় তখন প্রধান কৌসুলি এ টি এম আফজাল, এই সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার এবং অন্যরা জেলগেটে প্রবেশ করার সময় আমি (আমি ১৯৭৪ সালের পুরাে সময় বাংলাদেশ থেকে সংবাদ পাঠিয়েছি) তাদের ছবি তােলার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাড়িয়েছিলাম । উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে বললেন এটি অতি গােপনীয় বিচার এবং আমাকে কারও বা কোনােকিছুর ছবি তুলতে দেওয়া হবে না। আমি জানাই আমি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে রিপাের্ট করছি। আমি তুলনামূলকভাবে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি এবং এ ধরনের কোনাে সরকারি নির্দেশনা আছে বলে আমার জানা নেই। যদি তারা আমাকে এ বিষয়ে রিপাের্ট করতে বা ছবি তুলতে দিতে না চান তাহলে তাদের উচিত আমাকে এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশ দেখানাে। অন্যথায় একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি নির্বিঘ্নে আমার কাজ চালিয়ে যাব। যে পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন করছিলেন এরপর আমি তার ছবি তুলি। তিনি হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলেন এবং দৌড়ে চলে যান। * সেদিন সকালে অনেক ঘটনাই ঘটে যায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারী লােহার গেট দিয়ে কালাে কোট পরা ৩০ জন ব্যারিস্টার বিচারের প্রথম অধিবেশনে আসেন।

প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযােগ ও বিচারের ঘটনা ঘটে। যখন আগের চারটি সরকার একের পর এক ক্ষমতায় এসেছিল অস্ত্রের বলে পরবর্তী সরকারকে হটিয়ে। অধিকন্তু যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর খালেদ মােশাররফের অভুথানে অংশ নিয়েছিলেন এবং সরকারি সংবাদপত্রে যাদের ভারতের এজেন্ট বলে ভৎসনা করা হয়েছিল তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য যারা তারা হলেন ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল, যিনি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়ায় যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বরের জিয়া বিরােধী অ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তারা ছিলেন মুক্ত। আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন- যে ঘটনায় জিয়া মুক্তি পেয়েছিলেন তারা বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন। সেই ২১ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে আমি যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন জেলের সুউচ্চ রংচটা হলদে বিবর্ণ প্রাচীরের ওপাশে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিচারকাজ শুরু হলাে। বাংলাদেশ অথবা পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে আগে কখনাে একটি কারাগারের চৌহদ্দির মধ্যে বিচারের ঘটনা ঘটেনি। যারা অভিযুক্তদের আইনজীবী তাদের বিচার প্রক্রিয়া অনুযায়ী গােপনীয়তার শপথ নিতে হলাে। দেশের ভেতরে মামলার সব খবরের ওপর গােপনীয়তা আরােপ করা হয়েছিল। কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল ব্যতিক্রমী; প্রতিটি প্রবেশপথের চারপাশে বালুর বস্তা সম্বলিত মেশিনগান রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই যে কর্তৃপক্ষ জেলের ভেতরে বিচারের আয়ােজন করেছিল সম্ভাব্য গােলযােগ এড়ানাের উদ্দেশ্যে। প্রকাশ্য বিচার হলে আদালতে যাওয়ার পথে এই গােলযােগ ঘটতে পারতাে। জেলগেটে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অবস্থান করার পর আমি সেদিনের মতাে একাই সেখান থেকে বিদায় নিই। বিচারকাজ কেন এরকম গােপনীয়তার সঙ্গে হচ্ছে সে ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়ার জন্য আমি সামরিক আদালতের চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম ।

কিন্তু বেলা ১১টায় আমাকে গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখা হয়। কারাগারে প্রবেশের সময় আমি যেসব ছবি তুলেছিলাম আমাকে সেসব ছবির ফিল্ম সমর্পণ করতে বলা হয় ।  আমি পুলিশ কর্মকর্তাদের এবং সেনাবাহিনীর যে লেফটেন্যান্ট আমাকে | হাজতে নিয়ে এসেছেন তাকে জানাই আমি স্বেচ্ছায় ফিলা দেব না। এরপর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এন এস আই) সংস্থা এবং সামরিক আইন সদর দপ্তরে ফোন করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ জন কর্মকর্তা এসে হাজির। হন। একজন মাত্র সাংবাদিকের জন্য এতজন নিরাপত্তাকর্মী!  একজন এনএসআই কর্মকর্তা যিনি নিজেকে শামীম আহমেদ বলে উল্লেখ করেন আমাকে জিগ্যেস করেন কেন আমি তাহেরের মামলায় আগ্রহী। আমি ব্যাখ্যা দিই গােপন বিচার আমাকে এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে, যে ধরনের বিচার স্তালিন, ফ্রাঙ্কো বা জিয়া করছেন। আমি তাকে বলি আমি একজন রিপাের্টার কাজেই মুজিবের হত্যাকারী ছয় মেজরকে যদি খালেদ মােশাররফ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে রাখতেন তাহলেও আমি সে ঘটনার রিপাের্ট করতাম। এবং যদি খালেদ জীবিত থাকতেন এবং জিয়া তাকে বিচারের সম্মুখীন করতেন তাহলেও আমি এখনকার মতাে রিপাের্ট করার চেষ্টার জন্য জেলে থাকতাম এবং এখন জিয়া তাহেরকে একটি কারাগারের ভেতরে বিচারের সম্মুখীন করেছেন যেখানে গােপনীয়তা রক্ষার শপথের কারণে আইনজীবীরা আতঙ্কগ্রস্ত আমি এর রিপাের্ট করবাে। আমি শামীম আহমেদকে জিগ্যেস করি যা ঘটছে। জনগণ তা জানলে তাতে দোষের কী আছে? তিনি আমার ক্যামেরা কেড়ে নেন।

এবং সেটা একজন তরুণ টেলিযােগাযােগ কর্মকর্তার হাতে দেন। কয়েক বছর আগে এই লােক আমেরিকান অফিস অব পাবলিক সেইফটি প্রােগ্রামের অধীনে নিউইয়র্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি ক্যামেরা থেকে ফিল্মটি ছিড়ে বের করে ফেলেন। আমি কয়েক ঘণ্টা জেলে বন্দি ছিলাম । সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এরপর কী করা হবে। সেনাবাহিনীর একজন মেজর বলেন সদর দপ্তর মনে করে একজন বিদেশি সংবাদদাতাকে আটক রাখা অস্বস্তিদায়ক হতে পারে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি তাহেরের বিচার সম্পর্কিত আরেকটি তারবার্তা পাঠাতে যাই। তারবার্তা অফিস আমার রিপাের্টটি গ্রহণ করেছিল কিন্তু পাঠায়নি।

পরদিন সন্ধ্যায় আমি আমার আবাসস্থলে ফেরার পর পাঁচজন স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ (এসবি) কর্মকর্তা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা জানান আমাকে আবারও গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রথম যে বিমানটি পাওয়া যাবে তাতে তুলে দেওয়ার। প্রথম বিমানটি ভারতে যাচ্ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা সম্পর্কে রিপাের্ট করার জন্য ছয়মাস আগে আমাকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দিল্লিতে সেই দিনগুলােতে খুব কঠোর সেন্সরশিপ ছিল এবং কোনাে বিদেশি সংবাদদাতাই এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কাজেই ভারত থেকে সাংবাদিক হিসেবে কেবল আমাকেই সসম্মানে বিতাড়িত করা হয়নি। আমার ঘটনাটি ছিল সর্বশেষ। আমি এসবি কর্মকর্তাদের ধৈর্যের সঙ্গে বললাম তারা আমাকে ভারতে বহিষ্কার করতে পারেন না। কেননা ইতােমধ্যেই সেখান থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে যাওয়ার পরবর্তী বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত আমাকে তিনদিন গৃহবন্দি করে রাখা হলাে। আমাকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে এবং তাহেরের বিচার সম্পর্কিত সর্বশেষ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ সংবাদ প্রতিবেদনের সমাপ্তি ঘটলাে। এরপর কর্তৃপক্ষ তাদের গােপনীয়তা নির্বিঘ্নে বজায় রাখতে পারল । | আমার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের উচিত প্রকাশ্যে এ ঘােষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তার মৃত্যুদণ্ড ও ভুল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের রায় ত্যাগ করা উচিত এমন একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যে তাকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল যে সরকার তারা তাহেরের নাগরিক ও আইনগত অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছিল ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়ােজন রায় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে দেওয়া এবং এই মর্মে একটি সরকারি স্বীকৃতি যে আবু তাহেরের তথাকথিত পুরাে বিচার ছিল যথাযথ আইনগত কার্যপ্রণালীর এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন । লরেন্স লিফশুলৎস তাহেরের মামলা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি “তাহেরস লাস্ট স্টেটমেন্ট : বাংলাদেশ দি আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ । গ্রন্থটি তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।

এডভােকেট গাজীউল হক

কর্নেল তাহের-এর মামলার আইনজীবী এডভােকেট গাজীউল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী। কর্নেল । তাহের-এর মামলার সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। প্রবীণ এই। আইনজীবী ২০০১ সালে হঠাৎ করে ব্রেন হেমারেজ-এ আক্রান্ত হন। এরপর। থেকে ধীরে ধীরে তার স্মৃতিশক্তি লােপ পাচ্ছে। শারীরিক এই অবস্থার মধ্যেও তিনি আমাদের কাছে তাহেরের মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন| কিলিং। এটি একটি কিলিং হলাে। জানি যে এখানে কিছু হয়নি, বিচার হয়নি। জোর করে ফাঁসি দেওয়া হলাে। মৃত্যুর ক্ষণ, তারিখ ঠিক করে একটি লােককে জবাই করা হলাে। আমাদের সামনে জেলে আসে, তিনি জেলে থাকেন, কথা। বলেন। শেষ পর্যন্ত আর দেখা গেল না। ওদের ক্ষমা কি, ওরা তাে জবাই করেছে, বিচারের নামে নির্দোষ মানুষকে জবাই করেছে। আর জেলখানার মধ্যে কী করে বিচার হবে? জেলখানার চার দেয়ালের শিকের মধ্যে, যেখানে চলাফেরা সকল কিছু বন্ধ, তারমধ্যে কী বিচার করবে তারা? কী বিচারের ক্ষমতা ছিল। তাদের? কোনাে ক্ষমতাই ছিল না, কোনাে কথা বলার। বলবাে কী, বলার কী আছে, কিছুই নেই।

এডভােকেট জেড আই খান পান্না

আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ আমি জেড আই খান, পান্না নামে পরিচিত। আমি স্কুল ছাত্রবস্থায় রাজনীতির সাথে জড়িত। আর জাসদ রাজনীতির সাথে জন্মলগ্ন থেকেই জড়িত। ‘৭৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমি গ্রেফতার হই। গ্রেফতার হওয়ার পরে কারাগারে গিয়ে যেটি দেখতে পাই, বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়-উপমহাদেশের ইতিহাসে এত রাজবন্দির গ্রেফতার আর কখনাে দেখা যায়নি। এই সময়ে কর্নেল তাহেরের মামলাটি শুরু হয়। শুরু হওয়ার সময়ে জেলের ভেতরে যে অবস্থা, সেটি অবর্ণনীয়। পার্টিকুলারলি ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে অধিকাংশ রাজবন্দিকে বিভিন্ন জেলার কারাগারগুলােতে ট্রান্সফার করা হয়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যারা ছিলেন। তাদেরকে প্রতিদিন এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে, এক সেল থেকে আরেক সেলে স্থানান্তরিত করা হত। আর জেলগেটে এই ট্রাইব্যুনালটি (এই আদালত) বসানাে হয়। বসানাের আগে পর্যন্ত আপনারা দেখবেন, দেশবাসী জানেন। জেলগেটটি ছিল লােহার গারদ দিয়ে তৈরি করা ব্রিটিশ আমল থেকে। সর্বপ্রথম ‘৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের এই ট্রায়াল করার জন্য সেই লােহার গরাদের উপরে ইস্পাতের পাত দিয়ে গেটটি ঢেকে দেওয়া হয়। সেই অন্ধকারময় প্রকোষ্ঠে কর্নেল তাহেরের এই প্রহসনমূলক বিচারটি শুরু হয়। বিচারের সময় আরাে একটি বিষয় ছিল, তখন কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দিদের যারা পাহারা দিত দেখা গেল সমস্ত জেলকোড অমান্য করে সেখানে পাহারা দিত সশস্ত্র বাহিনীর লােক। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভেতরে তাবু খাটিয়ে মেশিনগান বসানাে হলাে। সেই মেশিনগানের ব্যারেল থাকত জেলের ভেতরে বন্দিদের উদ্দেশ্যে। জেলখানার ভেতরে যারা পাহারা দিত (অস্ত্রধারী বহিরাগত পাহারাদার) তারা বন্দিদের সাথে উর্দুতে কথা বলত । এমনি এক অবস্থায় শুরু হয়েছে কর্নেল তাহেরের মামলা।

কর্নেল তাহেরের মামলার একটি অভিযােগ আমরা যেটি জানি, আইনজীবী হিসেবেও আমি যেটি বুঝি—সেটি একটি অভিযােগ দায়ের করতে হলে সর্বপ্রথমে সেটি থানায় দায়ের করতে হয়। আমি জানি না কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যে মামলা তার অভিযােগ কোন থানায় দায়ের করা হয়েছিল। আজকে পর্যন্ত তার কোনাে নথিপত্র, কোনাে ডকুমেন্ট, কোনাে থানায় আমরা খুঁজে পাইনি। তাহলে এটি দায়ের করা হলাে কোথায়? দ্বিতীয়ত, এই মামলার তদন্তকার্য কে পরিচালনা করেছে? আমরা তদন্তকারী অফিসারের নাম আজকে পর্যন্ত জানি না। তৃতীয়ত এই মামলাটি ‘৭৬ সালের ১৪ জুন কোর্ট কনস্টিটিউট হয়। ট্রায়াল শুরু হয় ২১ জুন। জাজমেন্ট হয় ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সালে এবং কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই। ১৭ জনকে এই মামলায় সাজা দেয়া হয়। অভিযােগটি কী? পেনাল কোডের ১২১-এর ক বা 121-A of Bangladesh Penal Court। আপনারা দেখলে আশ্চর্য হবেন এই ধারাতে প্রাণদ দেয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। প্রশ্ন দাঁড়ায় আদালত ১২১- এর ক ধারানুযায়ী কীভাবে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত আদালতটি কীভাবে গঠন করা হয়? গঠন করা হয় একটি Martial Law Proclamation-এর অধ্যাদেশের পর। সে অধ্যাদেশের মূল আইন Defence of India Act 1939. সেখানে সেই আদালত। গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে সে আদালতের ৯ ধারাতে বলা হয়েছে, সে আদালতের যিনি চেয়ারম্যান থাকবেন তার কোয়ালিফিকেশন হতে হবে ন্যূনতম পক্ষে হাইকোর্টের একজন বিচারকের সমান। কর্নেল তাহেরের এই মামলাটি হয়েছে ১৯৭৬ সালে।

এই মামলার কাগজপত্র আজকে পর্যন্ত এমনকি এই মামলায় অভিযুক্ত যারা তাদের কাছেও দেয়া হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায় মামলায় যারা আসামি ছিলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযােগ কি ছিল? তারা কি আইনজীবীদের সাথে তাদের মামলার বিষয় নিয়ে নির্বিঘ্নে, নির্দ্বিধায় আলাপ করতে পেরেছিলেন? বিংশ শতাব্দীতে আমরা অনেকগুলাে মামলা দেখতে পাই । তারমধ্যে আমি বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য যারা অভিযুক্ত, সেই জার্মানির নাৎসি বাহিনীর যারা অভিযুক্ত ছিলেন তাদের মামলার পর্যন্ত রেফারেন্স এবং সমস্ত কাগজপত্র আমরা পাই । অথচ কর্নেল তাহেরের মামলার কাগজপত্র আমরা আজকে পর্যন্ত পাইনি। কেন এটি গােপন করে রাখা হলাে? কার স্বার্থে গােপন করে রাখা হলাে? আমরা জোয়ান অব্‌ আর্কএর মামলার কথা জানি। জোয়ান অব আর্ককে একজন ডাইনী বলে সেদিন। বৃটিশেরা পুড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালের ইতিহাসে তাকে সেইন্ট হিসেবে ভ্যাটিক্যানের পােপ ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। নুরেনবার্গ ট্রায়ালের ঘটনা আমি আগেই বললাম। সে ট্রায়ালের কাগজপত্র আজকে পর্যন্ত পাওয়া যায় । আমেরিকাতে পঞ্চাশের দশকে রােজেনবার্গ নামে এক দম্পতিকে কম্যুনিস্টদের গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এবং সেখানে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপরেও সেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আশির দশকে পুনরায় রােজেনবার্গের মামলা তার সন্তান একজন আইনজীবী হয়ে উত্থাপন করলেন এবং রােজেনবার্গ দম্পতি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। অথচ কর্নেল তাহেরের ইতিহাস যদি আমরা দেখি- ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে একমাত্র কমান্ডার যার অঙ্গহানি ঘটেছে, পঙ্গু হয়েছেন। ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে অদম্য একমাত্র কমান্ডার যিনি এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন। ১১ জন সেক্টর কমারের মধ্যে একমাত্র সেক্টর কমা র যিনি এদেশের সেনাবাহিনীকে ব্রিটিশের শাসিত এবং ব্রিটিশের পরিকল্পিত সেনাবাহিনী হিসেবে নয় একটি গণমুখী সেনাবাহিনী হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। কর্নেল তাহেরের অপরাধও এই, অন্য কিছু নয়। 

যেখানে বিচারকার্য চলেছে, সেই বিচারকার্যের কয়েকটি বিষয় আমি তুলে ধরব। একটি হলাে আইনজীবীদের বিচারকার্য চলার সময়ে, বিচারকার্য সম্পর্কে গােপনীয়তা রক্ষা করার শপথ নেয়ানাে হয়। আদালতের আদৌ এই এখতিয়ারটি আছে কি না। আইনজীবীরা শুধু বাংলাদেশের আইনজীবী হিসেবে নয় সারাবিশ্বে একে বলা হয় প্রফেশনাল প্রিভিলাইজ, সেই প্রিভিলাইজ হলাে এই যে, সে ক্লায়েন্ট-এর স্বার্থে, মােক্কেলের স্বার্থে সমস্ত প্রাণপন দিয়ে লড়াই করবে। আদালতে এমন কী গােপনীয়তা ছিল যে জনগণকে জানতে দেয়া হবে না। যদি জনগণের স্বার্থেই কর্নেল তাহেরের বিচার হয় তাহলে জনগণকে জানতে দেয়া হবে না কেন? কর্নেল তাহেরের মামলার রায় যদি দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন বিচারক ১৫ আগস্ট এর হত্যাকাণ্ডকেও ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েই এই জাজমেন্ট করেছেন। যেহেতু আমি সে সময়ে কারাগারে বন্দি ছিলাম, আমি জানি ১৭ জুলাই যেদিন কর্নেল তাহেরের এই মামলার রায় ঘােষণা করা হয় সেদিন সেই জেলখানা ছিল পিনপতনের মত স্তব্ধ। সবাই শঙ্কিত ছিল কী হয়। একটি পর্যায়ে যখন সমস্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আদালত থেকে জেলখানার ভেতরে প্রবেশ করছিলেন তখন অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকে চিৎকার করছিলেন। সবশেষে কর্নেল তাহের বের হয়ে।

আসেন। বিচারকক্ষ থেকে জেলখানার ভেতরে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পথে একটু থমকে দাঁড়ালেন, থমকে নয় নিজেই দাঁড়ালেন। দাড়িয়ে সবার রায় কত কী সাজা হয়েছে সেটি তিনি বললেন। সবশেষে বললেন এবং এখনাে আমার ঠিক কানে ভাসে তিনি হাসি দিয়ে বললেন আমার ফাসির আদেশ হয়েছে। এরকম অকুতােভয় এক ব্যক্তি তার কথা আমাকে সেদিন জেলের যে ডাক্তার ছিলেন তিনি বলেছিলেন। উনার যখন ফাসির দিন ব্লাডপ্রেসার মাপতে যায় দেখেছিলেন সম্পূর্ণ নর্মাল এবং তিনি বলেছিলেন যে তার এই পেশাগত জীবনে কখনাে এরকম কোনাে মানুষ পাননি। কর্নেল তাহের সেদিন সেই ডাক্তারকে বলেছিলেন- ডাক্তার আমি একজন যােদ্ধা, আমি একজন মুক্তিযােদ্ধা। আর ‘৭১-এ আমার মৃত্যু হয়ে গেছে। আমার এখানে এমন কোনাে ব্লাড প্রেসারের অ্যাবনর্মালিটি তুমি পাবে না। আসলেও পায়নি। এগুলাে কিন্তু বানানাে কোনাে কথা নয়। এগুলাে নিজের কানে শােনা সেই ডাক্তারের কথা। আরেক ডাক্তার ছিলেন তার সহকারী । তিনি পােস্টমর্টেমের সময় তার কাছেই যেতে পারেননি। আপনারা শুনলে আরাে আশ্চর্য হবেন কর্নেল তাহেরের ডেডবডি ফাসিতে বেশ কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। যদিও জেলকোডে লেখা আছে মেডিক্যাল অফিসার স্যাটিসফাই না হওয়া পর্যন্ত ঝুলবে। এখানে ডাক্তারের যে ভাষ্য, সেটি ছিল কর্নেল তাহেরের জিভ মুখ থেকে বের হয়নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলেন। আজকে কর্নেল তাহের, একজন মুক্তিযােদ্ধা, একজন মেহনতি মানুষের মুক্তিকামী সৈনিক-নেতা, তিনি নেই। আজকে সবার একটি দাবি আছে, সেই দাবিটি পূরণ হওয়ার জন্য আজকে সময় এসেছে। কর্নেল তাহেরের মামলার সুনির্দিষ্ট কাগজপত্র, নথিপত্র জনসমুক্ষে প্রকাশ করা একান্ত দরকার। এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অন্যায় নয়, আমি বলব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য একদল চক্রান্তকারীর চক্রান্তসুলভ কার্যকলাপ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ সম্মান, সর্বোচ্চ খেতাব অর্জনকারী একজন মুক্তিযােদ্ধাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে। আমি বলব সারা পৃথিবীতে আইনজীবীরা যেভাবে স্বাধীনতা ভােগ করে, বাংলাদেশের যে আইনজীবীগণ কর্নেল তাহেরের মামলায় জড়িত ছিলেন, সহায়তা করেছেন অথবা সরকারকে সহায়তা করেছেন উভয়েরই আজকে উচিত, কর্তব্য এবং পেশাগত দায়িত্ব জনসমক্ষে এই মামলা সম্পর্কে তাদের মুখ খােলা। যে যে অবস্থায় থাকুন না কেন সেই আইনজীবীগণ যারা জীবিত আছেন আজকেও সময় আছে- ইতিহাসের এই কালাে অধ্যায়গুলাে জনগণের সামনে তুলে ধরুন।

এই হত্যাকাণ্ডটি, আমি হত্যাকাণ্ডই বলবাে, কর্নেল তাহেরের এই হত্যাকাণ্ডটি সুপরিকল্পিতভাবে এবং সমস্ত আইন লঙ্ঘন করে করা হয়েছে তার একটি অন্যতম উদাহরণ, মার্শাল ল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী জেলকোড সেদিন সাসপেন্ড করা হয়নি। অথচ জেলকোডের নিয়মানুযায়ী, আইন অনুযায়ী একজন ফাঁসির আসামির আদেশ জেল কর্তৃপক্ষ পাওয়ার পর ন্যূনতম পক্ষে- The date of the execution not less than 21 days, or more than 28 days.-এ ছােট্ট আইনটুকু ও তারা মানেনি। জাতিসংঘের যে সনদ, মানবাধিকারের যে সার্বজনীন সনদ জেনেভা কনভেনশন। অনুযায়ী একজন মুক্তিযােদ্ধা, একজন পঙ্গু মানুষকে ফাঁসি দেয়াতাে ভালাে সে ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়ারও বিধান আমরা কম দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই, আমার জানামতে এই পেশায় থাকাবস্থায় আমি গত একশ বছরের ইতিহাসে বিশ্বের কোথাও কোনাে পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধা, কর্নেল তাহের ব্যতীত দ্বিতীয় কোনাে ব্যক্তির ফাসি খুঁজে পাইনি।

স্ত্রী লুঙ্কাকে লেখা তাহেরের চিঠি |

ঢাকা সেন্ট্রাল জেল

১৫ই জুলাই ‘৭৬

আমার আদরের লুফা তােমার পত্র পেয়েছি। আমার পূর্বপত্রখানা পড়ে তুমি হয়তাে খুবই হেসেছ। তােমার কবিতাটি জলিল রেখে দিয়েছে। ও সবাইকে দেখায় । জিয়ার পত্র ও জলিলের কবিতা পেয়েছ নিশ্চয়ই। এরা সবাই আমাকে বিশেষভাবে ভালােবাসে। গত কয়দিন কাটল আমাদের জবানবন্দিতে । আনােয়ার শুরু করেছে ও আমি শেষ করেছি। আনােয়ারের জানবন্দি সবাইকে সম্মােহিত করেছিল। মেজর জলিল আড়াই ঘণ্টাকালীন বক্তব্যে যে শক্তি ও অনুরাগ প্রকাশ করে তা কেবল একজন বিপ্লবীর কাছ থেকেই আশা করা যায় । ইনু ও মান্নার বক্তব্য অপূর্ব, ভাষাতত্ত্ব ও নৈতিকতার দিক থেকে সালেহা সবাইকে অবাক করে। ভাইজান তার গুছানাে কথার শেষে বলেন, ‘I am a tax payer. The officers who prepared this false case against me are mainted by me. The tribunal by now realised that how corrupt and inefficient they are. I would request the Chairman of the tribunal to recommend action against them.’ বেলাল ছােট কথায় বেশ সুন্দরভাবে তার মূল কথা তুলে ধরে। ট্রাইব্যুনালের নানা বাধাবিপত্তি কাটিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা যাবত আমি আমার জবানবন্দি বলি। নানা বাদানুবাদে অপ্রিয় কথাও আসে। তােমাকে কয়েকটি শুনাই । ৭ নভেম্বরে আমার ভূমিকা বর্ণনা শেষে If this is an act of treachery I would commit that act again and again. এক পর্যায়ে কোর্ট আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে This tribunal can neither acquit me nor punish me. I do not care for this tribunal. জিয়ার বেঈমানী প্রসঙ্গে- There is only one example of such treachery in our history and that is of MIRJAFOR. CAIG 4821

রেকর্ড করতে অস্বীকার করে। এতে আমাকে বলতে হয় চেয়ারম্যানের TWC- I have seen many small people in my life but never one smaller than you. 07461327163 16 – Fortunately for us today is not 1957. Today is 1976. We have the revolutionary soldiers- We have the revolutionary people to frustrate the evil design of a conspirator like Ziaur Rahman. জেলখানায় আমাদের প্রতি ব্যবহারের কথায়- I am a free man. I earned my freedom through my deeds. The high walls of the jail, solitary confinement, chains in my hand cannot take away my freedom. | ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গে- A law is not a law unless it is a good law aiming at the good of the people and good of the country. So is an ordinance. This courtroom was prepared before the promulgation of the trial ordinance. This tribunal was constituted before the promulgation of the ordinance. The ordinance was promulgated to suit evil design of the government. It is a bad ordinance, a black ordinance. It has no legal or moral sanction. This tribunal has no moral sanction or legal sanction to try me. | ট্রাইব্যুনালের কার্যকলাপ প্রসঙ্গে- ‘This tribunal has put to shame to what all human civilization achieved through constant endeavor from the very beginning till today.’ Come : I am the soul of my nation. I would urge you to be the soul of your nation- so that you may serve and protect your nation as you would like to serve and protect your soul. I warn this anti-people reactionary govt. and warn this tribunal. I warn our evil gentry do not ever dare to intimidate me, do not ever dare to tempt me, in doing that you will hurt the soul of your nation. Victory to the Revolution Victory to the People Long live Bangladesh কোর্টের অনেক কথা শুনালাম । চাকলাদারের কাছে আনােয়ার ভাইজান ও আমার পুরাে জবানবন্দি আছে। তােমাদের আর্থিক সঙ্কট নিরসনের জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিদিন কোর্ট ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরান হচ্ছে বলে যােগাযােগ করা। যাচ্ছে না। তুমি বিশেষ শঙ্কিত বলে মনে হয় । জনগণের জয়যাত্রা ইতােমধ্যে শুরু হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই, জলিল আধ্যাত্মিক জ্ঞানসমৃদ্ধ হচ্ছে। কয়দিন হলাে আমার সম্বন্ধে তার স্বপ্ন-‘চারিদিকে হাজার হাজার উৎসাহ ভরা সৈনিকের মাঝে সাদা হাতিতে চড়ে আমি যাচ্ছি।’ এরকম অবস্থাতে বেশ মজাই হয়। কিন্তু সাদা হাতি ব্রহ্মদেশ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিকল্প ব্যবস্থা অনুযায়ী হাতির গায়ে সাদা কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে।

গতকাল ছিলাম ছয় সেলে। আনােয়ার, বেলাল ও রবিউল আমার পাশের সেলে ছিল। ভাইজান ছিলেন ২৬ সেলে। সবচাইতে ভালাে জায়গা। গত সন্ধ্যায় আমাকে আনা হয়েছে ২৬ সেলে। ভাইজানকে সরান হয়েছে। আমাদের কয়েকজনকে প্রতিদিনই এমনিভাবে সরান হয় যাতে বাইরে থেকে কেউ এসে সহজে আমাদেরকে খুঁজে পাওয়া না যায়। কী বুদ্ধি। জেলখানার ভেতরে আর্মড পুলিশ আনা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে। সেলের সামনে বন্দুক নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। সরকার ভীত সন্ত্রস্ত। ফল হয়েছে সবাই আমাদের আরাে সম্মান করে ও ভালাে চোখে দেখে। আমি তােমাকে বােধহয় আমার মনের কথা বােঝাতে পেরেছি। নীতু, যিশু ও মিশুর কথা ও অন্য বাচ্চাদের কথা কি আমি ভাবি না। কিন্তু ভাবনাকে একটি ভীতিকর পর্যায়ে নিয়ে যাবার কী প্রয়ােজন। তাতে লাভই বা কী। আমাদের ভাগ্য জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এসাে, আমরা সেদিনের দিকে তাকাই যে দিনের চিত্রগাথা আমাদের চিন্তায়, ভাবনায় । জনগণের জয়যাত্রা তাে শুরু হয়ে গেছে নভেম্বর থেকে। মৃত্যুর মুখােমুখি দাড় করিয়ে ও কেউ আমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। যে বিরাট অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন শুরু হয়েছে কেউ তা রুখতে পারবে না। জিয়াকে আস্তাকুড় থেকে তুলে এনে তাকে দিয়েছিলাম সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান, কিন্তু সে আস্তাকুড়ে ফিরে গেছে। ইতিহাস আমার পক্ষে। আমাদের জীবনে নানা আঘাত দুঃখ এসেছে তীব্রভাবে। প্রকাশের অবকাশও নেই। ভয় যদি সেই প্রকাশ কোনাে সহকর্মীকে দুর্বল করে, ভয় যদি কেউ আমাকে সমবেদনা জানাতে আসে আমাকে আমার জাতিকে ছােট করে। তাই মাঝে মধ্যে মন ব্যাকুল হয়। তােমাকে পেতে চাই নিবিড়ভাবে, তােমার স্পর্শ, তােমার মৃদু পরশ, আমাকে শান্ত করুক। আমার আদর নিও। তােমারই তাহের।

অধ্যাপক ড. আনােয়ার হােসেন

কর্নেল তাহের-এর অনুজ, মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাভােগী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী শক্তি ক্ষমতাসীন হয়েছিল এবং বলতে কি আমাদের এই বাংলাদেশকে একটি দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করেছিল তার বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল একটি বড় প্রতি-আক্রমণ । এর মধ্য দিয়ে আমরা যেটি চেয়েছিলাম, ৭ নভেম্বরের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, কর্নেল

তাহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এটিকে সহায়তা করেছিল এবং অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকেরা এটিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। জাসদে তার (কর্নেল তাহের) নাম ঘােষণা করা হলাে না। কারণ তখন জাসদের রণনীতি ঠিক করা হয়েছিল আমাদের এখানে একটি সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানমূলক রণনীতি গ্রহণ করা হবে। তাহের এটি চাইলেন এবং বঙ্গবন্ধু তখন জেনারেল ওসমানীকে নির্দেশ দিলেন তাহেরকে জানাতে এবং সেভাবেই তাহেরের চাকরি হলাে পরিচালক হিসেবে ড্রেজার অর্গানাইজেশনে। সেই কথাটি অবশ্যই আজকে আমার এখানে বলা প্রয়ােজন। বঙ্গবন্ধুর কিন্তু সেই ঔদার্য ছিল এবং সে কারণেই আমি বলি তিনি বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাহেরের নাম ঘােষণা করা হলাে না যাতে তাহের সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে জাসদের যে একটি গণ-অভুথানমূলক রণনীতি, যেখানে সেনাবাহিনীর একটি বিরাট ভূমিকা থাকবে-তা যেন করতে পারেন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ফোর্সেস উইথইন ফোর্সেস, প্রতিক্রিয়া শক্তির ভেতরে যে বিপ্লবী শক্তি তাকে তৈরি করা এবং সেটির দায়িত্ব দেয়া হলাে তাহেরকে। গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন তিনি এবং তার অন্যতম কাজ হিসেবে সেনাবাহিনী, সশস্ত্রবাহিনীর ভেতরে তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সংগঠনের, গােপন সংগঠন গড়ার দুরূহ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের নেতৃত্ব দেন। আর বাইরে তিনি আছেন ড্রেজার অর্গানাইজেশনে। এভাবে কাজ চলল এবং তাকে করা হলাে যেটি গােপন রাখা হলাে সেটি হলাে জাসদের তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেছি লেকচারার হিসেবে। আমার যে বিভাগ প্রাণ রসায়ন ইংরেজিতে বায়ােকেমেস্ট্রি সেখানে লেকচারার হিসেবে আমি জয়েন করেছি। তাহেরের যেমন ছিল, তিনি ডিরেক্টর এবং এটি ছিল একটি কাভার বা আবরণ।

এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেও কিন্তু আমি একটি বড় আবরণ তৈরি করতে পেরেছিলাম এবং আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ঢাকা শহরের গণবাহিনীর অধিনায়কের পদ, অধিনায়কত্ব করার জন্য। তাহেরের নেতৃত্বে এবং জাসদের সহযােগিতায় ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়ােজন। বন্দি জিয়াউর রহমান খবর পাঠিয়েছিলেন তাহেরের কাছে, তাকে উদ্ধারের জন্য এবং প্রথমত তিনি ফোনও করতে পেরেছিলেন, তাকে যখন বন্দি করা হয় তার ফোনের মূল কানেকশন সেটি বিচ্ছিন্ন করেছিল অভ্যুত্থানকারীরা | কিন্তু আরেকটি প্যারালাল কানেকশন ছিল। সেই প্যারালাল কানেকশন ছিল বলেই জিয়া সরাসরি তাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পেরেছিলেন এবং বলেছিলেন, তাহের সেভ মাই লাইফ । এই কথাটুকু বলার পর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরেও একজন বাহকের মারফত জিয়া তার জীবন রক্ষার জন্য তাহেরকে বলেছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী যে জিয়াউর রহমান, তার যে আবেদন, তাতে তিনি সাড়া দিয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন এই মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটিকে রক্ষার মধ্য দিয়ে তাহের তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং অন্তত কৃতজ্ঞতাবশে হলেও সে কোনাে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছিল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যারা অভ্যুত্থানী, যারা আগে কু করেছিল তারা পরাজিত হয়েছিল। সাধারণ সৈনিকেরা রাস্তায় অস্ত্রসহ বেরিয়ে এসেছিল। জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়েছিলেন। জেলখানা খুলে দেয়া হয়েছিল। বেতার, টেলিভিশন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যে অস্ত্রাগার সবকিছু আমাদের দখলে এসেছিল। এই সবগুলাে ছিল সাময়িক সফলতা। অন্যদিকে বিফলতার দিকগুলাে কী? বিফলতার কথা বলতে গেলে জাসদের কথা বলতে হয়। জাসদ নেতৃত্বের কথা বলতে হয়। জাসদ নেতৃত্ব তাহেরকে এই অভুথানে নেতৃত্ব দেয়ার নির্দেশ এবং অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সাথে সাথে তাহেরকে বলা হয়েছিল এই যে অভ্যুত্থানে। সাধারণ সৈনিকেরা তাদের সঙ্গে যােগ হবে আমাদের জাসদের শ্রমিক সংগঠন, জাসদের ছাত্র সংগঠন, জাসদের শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠন, জাসদের সবচাইতে সক্রিয় অংশ বেসামরিক গণবাহিনী অথাৎ যেমন আমার নেতৃত্বাধীন ঢাকা শহরের ৬০০ সদস্য তারা সবাই যুক্ত হবে সেই সৈনিকদের অভ্যুত্থানের শক্তির সাথে । অভ্যুত্থানী শক্তির সশস্ত্র সৈনিকেরা অস্ত্র যােগান দেবে তাদের। সেই কাজটি জাসদ করতে ব্যর্থ হয়। জাসদ করতে ব্যর্থ হয় এটি না বলে আমি বলব জাসদ সেই কাজটির দিকে এগিয়ে যায়নি। জাসদ নেতৃত্ব তা করেননি। আরেকটি কাজ জাসদ করেনি সেটি হলাে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাহের সুতরাং প্রথম সুযােগেই বেতার এবং টেলিভিশনে সেটি প্রচার করার প্রয়ােজন ছিল। তাহের যদি সেখানে সেটি প্রচার করতেন এটি গণবাহিনী জাসদের উদ্যোগে, সহযােগিতায় অভ্যুত্থান হচ্ছে এবং সেখানে সবাই যােগ দিবে এবং সেখানে তাহের নিজেই নেতৃত্ব দিবেন এই বিষয়গুলাে যদি প্রথম সুযােগেই প্রচার করা হত। তাহলে ঘটনাটি হত সম্পূর্ণ অন্যরকম, সেটিও করা হয়নি।

৭ নভেম্বরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়, সেটি তাহেরের এবং জাসদ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের ঠিক পরের ঘটনা। আমাদের গণবাহিনীর ৬ সদস্যের একটি টিম সে টিমে আমার ছােট ভাই বাহার নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং আমার আরেক ভাই বেলাল ও আরাে ৪ জন সেই টিমের সদস্য ছিল। তারা তাহের এবং জাসদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করার জন্য সেদিন অভিযান চালিয়েছিল ভারতীয় দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে জিম্মি করতে। সেই অভিযানটি ব্যর্থ হয় এবং অভিযানের যে মূল লক্ষ্য সমর সেনকে জিম্মি করে সরকারকে বাধ্য করা যেন জাসদ নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করা এবং ৭ নভেম্বরের যে ১২ দফা দাবি তার তার ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আদায় করা। কিন্তু সে অভিযান ব্যর্থ হবার ফলে সেখানে আমাদের ৪ জন সৈনিক শহীদ হন, অভিযানের অধিনায়ক সাখাওয়াত হােসেন বাহার এবং কয়েকজন সদস্য শহীদ হন, দু’জন সেখানে আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। তারমধ্যে আমার ছােটভাই। বেলাল ছিল এবং পরবর্তীকালে ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ঢাকা কারাগারে আমাদের যে বিচার হয় সেখানেও সে একজন অভিযুক্ত ছিল। তাহের তার কাজটি করেছেন, বাকি যাদের কাজ ছিল- ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব, জাসদের অন্যান্য নেতৃত্ব তাদের এগিয়ে আসা এবং সে অভ্যুত্থানে সামিল হয়ে যাওয়া যথাসময়ে সেটি করতে তারা পারেননি। এবং এই ব্যর্থতার কারণেই মুক্ত জিয়াউর রহমানের চারপাশে তখন জড়াে হতে পেরেছিল। প্রতিক্রিয়া শক্তি, সেই পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া শক্তি। এবং তারা তাকে বাধ্য। করেছিল অথবা তিনি তাদের পক্ষে নিজেই চলে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় জিয়াউর রহমানকে দিয়ে সেই প্রতিক্রিয়া শক্তি একটি প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করতে সমর্থ হয়েছিল।

সেই প্রতিবিপ্লবের অংশ হিসেবে, প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার সমস্ত অঙ্গীকার থেকে তিনি সরে গিয়েছিলেন। জাসদ নেতৃবৃন্দ এবং পরবর্তীকালে তাহেরকেও তিনি গ্রেফতার করেছিলেন। অবশ্যই বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঝুঁকি নিয়ে যদি বলেন একটি জুয়াখেলার মতন সেই জুয়াখেলায় তিনি জিতে গিয়েছিলেন। তাহের পরাজিত হয়েছিলেন। জিতে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং পরাজিত হয়েছিলেন তাহের ও জাসদ। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি কারা অভ্যন্তরে করলেন একটি গােপন বিচার, বিচারের প্রহসন। সেই গােপন বিচার যেটিকে বলা হয় একটি ক্যামেরা ট্রায়াল । তারজন্য জিয়াউর রহমান গঠন করলেন একটি ট্রাইব্যুনাল, মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল। তার চেয়ারম্যান করলেন ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার। কে এই ইউসুফ হায়দার? ইউসুফ হায়দার একজন বাঙালি অফিসার ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই বাংলাদেশেই ছিলেন এবং পাকিস্তানের হয়ে লড়াই করেছেন। সেই ধরনের একজন অফিসারকে চেয়ারম্যান করা হলাে মুক্তিযুদ্ধের দু’জন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের ও মেজর জলিল এবং তাদের সহযােগী আরাে গুরুত্বপূর্ণ সব মুক্তিযােদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একটি ট্রায়াল সেটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করা একজন অফিসার ইউসুফ হায়দার। জুন মাসে সেই ট্রায়াল শুরু হলাে, কারা অভ্যন্তরে এবং সেই ট্রায়ালে আমি নিজেও একজন অভিযুক্ত ছিলাম। আমার কথাটি একটু বলি ৭ নভেম্বরে আমার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ঢাকা শহর গণবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের একটি ছেদ ঘটিয়েছি। আমার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরােয়ানা ছিল। আমি পলাতক ছিলাম। এবং তারই একটি পর্যায়ে  যখন ‘৭৬-এর মার্চে মার্চ মিছিল করছিল তার আগে আগে আমি গ্রেফতার হয়ে  যাই। আমাকেও সেনাবাহিনীর ডিজিএফআই-এর তাকে বলে সেফ হলাে নিরাপদ গর্ত সেখানে রাখা হয় এবং ট্রায়াল শুরুর আগে আগে ঢাকা কারাগারে স্থানান্তর। করা হয় এবং সেখানে এসে আমি প্রথম জানতে পারি এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমান এই বিচারের নামে একটি প্রহসন সাজিয়েছেন এবং যেখানে জাসদ নেতৃবৃন্দ, তাহের এবং সেনাবাহিনীর যারা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তাকে মুক্ত করেছে, তার জীবন বাচিয়েছে সেই সেনানায়কদের, সেই প্রকৃত নায়কদের তিনি বিচারের সম্মুখীন করেছেন। বিচারের নামে একটি প্রহসনের সম্মুখীন করেছেন। সেই ট্রায়াল শুরু হলাে। আমাদেরকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে সেই ট্রায়ালে আনা হত।

একটি খাচায় ডিআইজি’র যে অফিস কক্ষ সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পশুর মতাে আমরা কিছু লােক বসে থাকতাম। এবং তার ভেতরেও আমরা শৃঙ্খলিত। সেই অবস্থায় আমাদের ট্রায়াল শুরু হয়েছিল। আমাদের বাংলাদেশের প্রখ্যাত কিছু আইনজীবী সেদিন সাহস করে। এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের ওথ (শপথ) নিতে হয়েছিল, তাদের এই প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল এবং সেখানে সই করতে হয়েছিল এটি একটি গােপন বিচার, তিন বছরের আগে এই বিচার সম্পর্কে কেউ মুখ খুলতে পারবেন না। যদি করেন তাদের সাজা হবে। সেভাবে বিচারকার্য, বিচারের নামে প্রহসনটি সংগঠিত হয়েছিল। যাদেরকে রাজসাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছিল আমরা বুঝতে পারছিলাম কি প্রবল চাপে, অত্যাচারে তাদেরকে রাজসাক্ষী করা হয়েছে। তাদের সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল-এই রাজসাক্ষীরা তাদের হাতিয়ার মাত্র। এভাবেই সেই বিচারের একটি পর্যায়ে ১৭ জুলাই আমাদের রায় ঘােষিত হলাে। তাহেরের রায় ঘােষণা করা হলাে সবার শেষে। এতবড় একটি বিষয়, সেই রায় ঘােষণা হলাে। কয়েক মিনিটের মধ্যে। মনে হলাে যেন অতিদ্রুত রায়টি ঘােষণা করেই তারা পালিয়ে গেল। তাহের বলছিলেন বেত্রাহত কুকুরের মতাে পালিয়ে গেলেন তারা। আমার নিজেরও সাজা হয়েছিল ১০ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা অনাদায়ে আরাে দু’বছর। সেভাবে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলাম আমরা। আমাদের আইনজীবীরা, তারা তাহেরকে বললেন যদিও সেখানে আপিল করার কোনাে সুযােগ নেই তারপরেও রাষ্ট্রপতি তখন আরেকজন বিচারক তিনি জাস্টিস সায়েম, জাস্টিস সায়েমের কাছে একটি মার্সিপিটিশন প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হবে। তাহের সাথে সাথে ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন আমি সেই প্রাণভিক্ষায় সই করবাে না। এই লােকটিকে আমি ক্ষমতায় বসিয়েছি, জিয়াউর রহমানকে। এখানে একজন মীরজাফর ছিল ব্রিটিশ আমলে। আর এই হচ্ছে। দ্বিতীয় মীরজাফর এই জিয়াউর রহমান। তার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইবাে? কিংবা তার যে ক্রীড়নক প্রেসিডেন্ট? প্রশ্নই আসে না। তিনি চাইলেন না।

১৭ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত সময়ের কথা বলি। আমাদের বিভিন্ন মেয়াদের। কারাদণ্ড হয়েছে। আমরা ঢাকা কারাগারে বিভিন্ন সেলের মধ্যে আছি। ইতােমধ্যে তােড়জোড় শুরু হয়েছে, ফাসি কার্যকর করার। এরমধ্যেই একদিন জেনারেল মীর শওকত নিজে কারাগারের ভেতরে এসে পরীক্ষা করে গেলেন ফাসির দড়ি, ফাসির মঞ্চ সব ঠিকঠাক আছে নাকি। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না এটি কোনােভাবেই তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তারপরেও গােটা সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন যারা জিয়াউর রহমানের আশেপাশে জড়িত হয়েছিল তারা তখন মরিয়া হয়ে গিয়েছিল কীভাবে কত দ্রুত তাহেরকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায়। ২০ তারিখ আমাদের তিনভাইকে একে এক করে (তাহের ছাড়াও আমরা তিন ভাই তখন কারাগারে ছিলাম) নেয়া হলাে। বলা হলাে শেষ দেখা। ফাঁসির আসামির সাথে শেষ দেখা এবং আমাকেও একটি পর্যায়ে নেয়া হলাে। তাহেরের সাথে সেই মুহূর্তগুলাের কথা আমার সব মনে আছে। যাতে আমি তার সাথে একটু লম্বা সময় কাটাতে পারি সেজন্য প্রহরীদের তিনি বারবার নানা কিছু চা তৈরি কর, আম কেটে দাও আনােয়ারকে, এগুলাে বলছিলেন। এবং তিনি জানতেন তিনি বললেন, মীর শওকত তাে এসেছিলেন তিনি নিজেই ফাঁসির মঞ্চ পরীক্ষা করে গেছেন এবং আজকে রাতেই ফাসি হবে। কিন্তু তার চেহারার মধ্যে (কী সুন্দর চেহারা দেখেছিলাম) কোনাে শঙ্কা ছিল না, কোনাে খেদ ছিল না। আমি যখন তাকে বলেছিলাম যে, আমি নিউ ২০ সেলের সামনে দিয়ে আসার পথে জানালা ধরে দাড়িয়েছিলেন মেজর জলিল এবং তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, আনােয়ার তাহেরকে বলাে মার্সিপিটিশনে সই করতে, তাকে আমরা হারাতে পারি না, হারাতে চাই না। তার বেঁচে থাকা দরকার। কিন্তু আমি জলিল ভাইকে সেখানেই বলে এসেছিলাম তাহের ভাইকে আমি এটি বলতে পারব না এবং তাহের ভাইয়ের এটি করাটা ঠিকও হবে না। আমি সেই কথাগুলােই তাহেরকে আবার বললাম। তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন এবং বললেন তােমার কাছ থেকে আমি সেটিই আশা করি।

আসলে কার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইবাে এবং তিনি বললেন সেই কথাগুলাে একটি দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির ব্যাপারটি অনেক বড়। তার জন্য আত্মত্যাগের প্রয়ােজন আছে। বহু মানুষ আত্মত্যাগ করেছে, আমাকেও আত্মত্যাগ করতে হবে। কিন্তু আমি সেই দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চাই সাধারণ মানুষের কাছে, গণমানুষের কাছে। তারা জানবে তাদের নেতা, সাধারণ মানুষের নেতা, সিপাহিদের নেতা মাথা নত করেনি। কোনাে আপােস করেননি তিনি এবং প্রাণভিক্ষা চাননি তিনি। আমি সেভাবেই মৃত্যুবরণ করতে চাই এবং আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে একটি অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হবে, দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে, যার ওপর নির্ভর করে, সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মানুষ নিশ্চয়ই এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। যে স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারিনি, আমরা তাে পরাজিত হয়ে গেছি। কিন্তু মানুষের সামনে একটি দৃষ্টান্ত থাকুক, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকুক, তাদের এমন একজন নেতা থাকুক যার পথ অনুসরণ করে মানুষ আবার সংঘবদ্ধ হবে এবং মুক্তির পথে এগিয়ে যাবে। সেই কথাগুলাে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। সেই রাতে ২০ জুলাই দিবাগত রাতে তখন ২১ জুলাই চলে এসেছে। ভাের রাত, ৪টায় ফাঁসি কার্যকর হয়। আপন মহিমায়, সাহসে তিনি দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিলেন ফাসির মঞ্চে। মাথায় কালাে টুপি পরেননি, তার চোখ আবদ্ধ করতে পারেনি, ফাসির দড়ি অন্যকে স্পর্শ করতে | দেননি। নিজেই ফাসির দড়ি নিজের গলায় লাগিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন আমি প্রস্তুত, তার আগে তিনি সেই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যেটি রচনা করেছিলেন আমাদের অপর সহযােদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন।

‘৭৬-এ সেই ঢাকা কারাগারে ডিআইজি’র কক্ষের আমাদের সেই বিচারালয় । সেই বিচারালয়ের দিনগুলাের কথা মনে পড়ছে। বিচার যেদিন শুরু হয় সেদিন আমাদের এক এক করে নিয়ে আসা হয় সেই কাটাতার দিয়ে ঘেরা এজলাসে এবং সেখানে প্রথমে যেটি আমরা লক্ষ্য করলাম রাজসাক্ষীদের চিনিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের প্রত্যেককে এবং খােলাখুলি সবার সামনে আমাদের নামগুলাে বলা হচ্ছে। এবং রাজসাক্ষীদের দেখানাে হচ্ছে যে উনি অমুক এরকমভাবে। সেক্ষেত্রে এক এক করে আমাদের নাম বলছিল, আমাদের উঠে দাড়াতে বলছিল এবং রাজসাক্ষীরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমাদের একজন সহ-অভিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান। বলা হলাে আখলাকুর রহমানের বাসায় একটি মিটিংয়ে সেখানে একটি ফোন এলাে এবং সেই ফোনটি করেছিলেন কর্নেল তােরা। ভােরা কে? তিনি একজন মিলিটারি অ্যাটাচে, ইন্ডিয়ার এবং তাহেরের সাথে তার কথা হলাে টেলিফোনে এবং সেই টেলিফোনের মাধ্যমে বােঝা গেল এটির সাথে একটি ভারতীয় যােগাযােগ আছে, এই অভ্যুত্থানের সাথে । এরপরেই তাে সাথে সাথে আমরা পেলাম যে, এবার তাে ধরা যাবে কারণ সেসময় ড, আখলাকুর রহমানের বাড়িতে কোনাে ফোন ছিল না। কিন্তু তারা বলে দিয়েছে যে, ফোনে কথা বলেছে। আমরা যখন সেকথা উল্লেখ করলাম, যখন মামলা চলছে তখনাে কিন্তু কোনাে ফোন নেই এবং দেখা গেল যে হ্যা সত্যি সেখানে কোনাে ফোন নেই। | আমাদের ট্রাইব্যুনালের একজন মেম্বার ছিলেন এয়ারফোর্সের উইং কমান্ডার রশীদ এবং পরে এই রশীদ সাহেবের ছেলে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল, আমাদের এই বাসায়ও অনেক সময় এসেছে। তার কাছে আমি শুনলাম উইং কমান্ডার রশীদ দ্বিমত পােষণ করেছিলেন।

সে কারণে জিয়াউর রহমান তাকে চাকরিচ্যুত করে এবং পরে তিনি হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে অনুশােচনায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা এখনাে দাবি জানাই তাহেরকে যে হত্যা করা হলাে বিচারের নামে, আমরা তাে চাচ্ছি একটি রিট্রায়াল, একটি পুনঃবিচার। সমস্ত নথিপত্র প্রকাশ করা হােক এবং সেখান থেকে প্রয়ােজনে আবার বিচার করা হােক । তাহের যদি দোষী হন এবং তার যে সহযােদ্ধারা ছিলেন তারা যদি দোষী হন পুনঃবার তাদের অভিযুক্ত করা হােক। কিন্তু দেখা হােক আসলেই তারা দোষী ছিলেন কি না। আমি তাে মনে করি সেই সাউথ আফ্রিকার উদাহরণ আমরা নিতেপারি। সেখানে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে টুথ কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং সেখানে যে কালাে অধ্যায় সেই বর্ণবৈষম্যের দিনগুলােতে, সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার সেখানে কালাে মানুষদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল এবং যেটি জনচক্ষু মানুষের চোখের আড়ালে ছিল, বিস্মৃতির আড়ালে পড়েছিল, যে অত্যাচারগুলাে হয়েছিল সেগুলােকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য টুথ কমিশন হয়েছিল এবং তারফলে দোষীরা শাস্তি পেয়েছিল। যারা অত্যাচারিত হয়েছিল তারা অন্তত এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে তাদের বিষয়গুলাে আবার সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে, পৃথিবী জানতে পেরেছে। আমাদেরও সেই অধিকার আছে। প্রত্যেকটি বিয়য়ে আজকে আবার অনুসন্ধান হােক এবং টুথ কমিশনের মধ্য দিয়ে সেই সত্যগুলাে বেরিয়ে আসুক, দোষীরা শাস্তি পাক এবং যারা এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন ইতিহাসে যথাযােগ্য মর্যাদায় তারা পুনর্বাসিত হােক।

সূত্র : সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ – ১৯৮১ – আনোয়ার কবির