বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৯ই ডিসেম্বর, রোববার, ২৩ শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
সময়োচিত সিদ্ধান্ত
আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অঙ্গনে পাট বা পাটজাত দ্রব্যের মূল্য বা তার ভূমিকা সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। কারণ, এ আমাদের দেশের এমন একটি মহামূল্যবান সম্পদ যা বিদেশে রপ্তানী করে আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। এজন্য একে অন্য কথায় ‘সোনালী আঁশ’ ও বলা হয়। অথচ, এমন একটি মহামূল্যবান সম্পদ উৎপাদনে বা তার সুযোগ্য রক্ষণাবেক্ষণে, বা তার রপ্তানি বাণিজ্য থেকে প্রকৃত ও প্রয়োজনীয় সুযোগ গ্রহণে আমাদের সরকারি দপ্তরসমূহের মধ্যে এতকাল যে ঘাপলা, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অব্যবস্থা, অনীহা ও পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার অভাব ছিল তাও আমাদের কারোরই অজানা নেই।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যৌথ কর্তৃত্বাধীনে এমন একটি মহামূল্যবান সম্পদকে অংশে অংশে ভেঙে রাখায় প্রায়ই নানা রকম গোলযোগ ও অব্যবস্থা দেখা দিয়ে রপ্তানী ব্যহত হয়ে দেশের প্রভূত অর্থকরী ক্ষতি সাধিত হয়েছে, অথচ কাউকেই এ জন্য হাতে-নাতে দায়ী করে শাস্তি দেয়া আজো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
কারণ নিজের ঘাড়ে দোষ বর্তাতে কেউই রাজি নয়। এবং যখনি এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন উঠেছে তখনি সবাই শুধু একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পচা পাট কেনা হোলো কেন? কিংবা কার ইশারায় তা অনুমোদন পেলো? কিংবা কার্ড চক্রান্তে বিদেশে চুক্তি ভঙ্গ করে নিম্নমানের পাট রপ্তানি করা হোলো? কিংবা বিপুল পরিমাণ পাট পচে গেল কেন? কিংবা কার অবহেলায় বিপুল পরিমাণে পাটজাত দ্রব্য শিপমেন্ট না পেয়ে গুদামজাত হোলো বা ডেমারেজ দিল?- এ অপরাধীকে আজো পর্যন্ত ধরা সম্ভব হয়নি। কারণ, পাটের রাজ্যে বহু মাতবর। ফলে, সহজেই অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজে গা বাঁচিয়ে নেয়া যায়।
যেমন, কৃষি পর্যায় উৎপাদন পর্যন্ত পাট হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এরপর, মিল পর্যায়ে গেলে তা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পাট কেনার দায়িত্ব পাট দপ্তরের। অথচ পাট রপ্তানি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এইভাবে, একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাটের মতো একটি মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ন্ত্রিত থাকার ফলে পাটের রাজ্যে বেশ কয়েকটি স্তর ও গোঁমর সৃষ্টি হয়ে রীতিমতো এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। ফলে, দিনের পর দিন অর্থনৈতিক কাঠামো পঙ্গু থেকে পঙ্গুতর হয়ে চলেছে। সুখের বিষয়, আমাদের সরকার পাট রাজ্যের এই নৈরাজ্য দূরীভূত করে দেশের অর্থনীতিকে একটি সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত পথে পরিচালনা করার জন্য সম্প্রতি পাটকে একটি সম্পূর্ণ একক ও স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখি যে, এখন থেকে পাটের ক্রয়, উৎপাদন ও রপ্তানী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আমরা আর পুরনো লাল-ফিতের দৌরাত্ন্য অভিশাপে জ্বলবোনা।
একই মন্ত্রণালয়ের অধীন এর বিভিন্ন দিকে কেন্দ্রীভূত করায় বর্তমানে আগের চেয়েও বহু উন্নত পারস্পরিক সহযোগিতা ও সুফল আমরা ভোগ করতে পারব বলেই আশা রাখি।
শুধু তাই নয়, সরকারের এই সময়োচিত সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরা বলবো, একনিষ্ঠভাবে ও আরো ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে বর্তমানের পাট মন্ত্রণালয় আমাদের দেশের এমন একটি মূল্যবান ও অর্থকরী সম্পদের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করবেন এবং বিদেশে আমাদের এই সোনালী আঁশের বাজার, চাহিদা ও রপ্তানী বৃদ্ধি করে আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের আয় আগের চেয়েও আরো আকর্ষণীয়ভাবে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলে আমরা বিপুল প্রত্যাশা রাখি।
বিশ্বশান্তির স্বার্থে শান্তি এলাকা
ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার জন্য জাতিসংঘ অবশেষে বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ভারত মহাসাগরের বুকে বৃহৎ শক্তিবর্গের সামরিক উপস্থিতির ফলে, এ অঞ্চলকে ‘শান্তি এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই, বেশ কিছু দিন ধরেই ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা ঘোষণা করার দাবি ক্রমাগত জোরদার হয়ে উঠছিল। কিছুদিন আগে বিশ্বের চৌদ্দটি দেশ জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কূর্ট ওয়াল্ড হেইমের কাছে এক যৌথ আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন যে, ভারত মহাসাগরের বুকে যেন কোন বৃহৎ শক্তিই সামরিক পায়তারা আর করতে না পারে। নামটি ভারত মহাসাগর ঠিকই, কিন্তু এর পরিধি সুদূর বিস্তৃত। এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই দরিয়া প্রসারিত থাকাতে ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আতঙ্ক ও শংকাবোধ করছে। ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোর উদ্বিগ্নতা এবং ব্যাকুলতার কারণ এখানেই নিহিত। তাই, এ মহাসাগরকে সামরিক তৎপরতা মুক্ত করার জন্য বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলো নানারকম উদ্যোগ না নিয়ে পারেনি।
ভারত মহাসাগরকে সামরিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়ার ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিবর্গ যাতে কোন রকম সুযোগ না পায়, সেজন্যেই প্রধানতঃ বিশ্বের চৌদ্দটি দেশ সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার জন্য আনীত প্রস্তাবের ওপর সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটে ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে স্বীকৃতিদানের সপক্ষে ৯৫টি ভোট পড়েছে এবং বিপক্ষে একটি ভোটও পড়েনি।
সাধারণ পরিষদে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি। প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাস হয়ে যাওয়ার পর প্রস্তাবটি কার্যকরী করার বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করার জন্য রাজনৈতিক কমিটির ১৫ জাতি এডহক কমিটির দায়িত্ব দিয়েছে। বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যে, তারা যেনো ১৫ জাতি এডহক কমিটিকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করে। জাতিসংঘ ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা ঘোষণার যে আহ্বান জানিয়েছে তাতে বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোকে অবশ্যই সাড়া দেয়া উচিত এবং বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিগুলোও যাতে ঐক্যমতে পৌছে এই দরিয়ায় সাময়িক দাপাদাপি বন্ধ করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেয় সে দিকে একবার দৃষ্টি ফেরাতে হবে। বৃহৎ শক্তিগুলো এব্যাপারে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তার ওপরই নির্ভর করছে, ভারত মহাসাগরের বুকে শান্তি আসবে কি আসবে না। ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর উদ্বিগ্নতা কমানোর জন্যে এই মহাসাগরকে শান্তির মহাসাগর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া একান্ত দরকার। বিশ্বশান্তির স্বপক্ষেই ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকারূপে চিহ্নিত করতে হবে।
সত্য উদঘাটনে পুলিশকে সচেষ্ট হতে হবে
আজিমপুরে মনিরা হত্যাকাণ্ডের অষ্টম দিন পার হয়ে যাবার পরও পুলিশ এই হত্যাকান্ডের প্রকৃত নায়ক সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। যদিও ঘটনার দিন এবং পরদিন পুলিশ বিভাগ ‘শিগগিরই খুনীর পরিচয় পাওয়া যাবে, খুনি হাতের কাছেই’ ইত্যাকার আশার বাণী শুনিয়েছিলেন তথাপি গত পরশু গোয়েন্দা পুলিশ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ‘ঘটনা জটিল।’
দিনের বেলা পূর্বাহ্নে হত্যাকাণ্ড নিঃশব্দে সংঘটিত হয়ে গেছে তার নিঃসন্দেহে একটি জটিল ব্যাপার একথা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়। কিন্তু সেই জটিলতার কথা মনে রেখে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রকৃত খুনীর পরিচয় পাওয়ার আশ্বাস পুলিশ প্রথমে দিয়েছিলেন কিনা জানি না। আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছিলাম, পুলিশ বিভাগ এতদিনে নিশ্চয়ই অত্যন্ত কর্মতৎপর হয়ে উঠেছেন এবং সে কারণেই এমন জটিল বিষয় সম্পর্কে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একটা সঠিক তথ্য দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ক্রমান্বয়ে এই হত্যাকান্ডের মোড় যে ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত কিভাবে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে সে ব্যাপারে দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও সন্দিহান না হয়ে পারছি না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে স্বাধীনতার পরে দুষ্কৃতিকারী ও চরমপন্থীদের চোরাগুপ্তা আক্রমণের ফলে যত্রতত্র শত শত নিরীহ মানুষের মৃত্যু নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালক সাহিত্যিক জহির রায়হান, অধ্যাপক হুমায়ুন, বলিষ্ঠ চলচ্চিত্রাভিনেতা রাজু আহমেদ, চিত্রশিল্পী শিউলি, সেলিনা, নারী শিক্ষা মন্দির হাবিবুর, ওয়াপদার আপার ডিভিশন ক্লার্ক শফিউল্লাহ এবং আরো কয়েকজনের হত্যাকান্ড কিছুটা ব্যতিক্রম বৈকি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ এবং লজ্জার কথা যে অদ্যাবধি পুলিশ বিভাগ এই সব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি এবং প্রত্যেকটি ঘটনাই আজও তদন্তসর্বস্ব হয়ে রয়ে গেছে।
সাবেক পাকিস্তান আমলে দেখা গেছে মনিরা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত চালিয়েছেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ঘটনারই চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হতে পারেননি।ফলে তা তদন্ত সর্বস্ব হয়ে ধামাচাপা থেকে গেছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে বৈদেশিক চক্রান্ত সক্রিয় থাকতে পারে এবং সে কারণে নানা জটিলতা ও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে সে সব ঘটনার চূড়ান্তে পৌঁছাতে অসুবিধা থাকতে পারে; কিন্তু অধ্যাপক হুমায়ূন, শফিক, মরিয়ম ইত্যাদির হত্যাকাণ্ডের ন্যায় ঘটনাগুলো তদন্তসর্বস্ব হয়ে থাকার কারণ কি তা আমরা বুঝতে পাচ্ছি না। মনিরা হত্যাকান্ড সম্পর্কে কোন কোন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে ঘটনাটিকে চেপে যাবার একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানিনা এই ইঙ্গিত কাদের এবং তার ক্ষমতা কতটুকু।
কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমরা এবং দেশবাসী সবাই মনিরা হত্যাকাণ্ডের ন্যায় অতীতের সকল হত্যাকান্ড সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে চাই। এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করি। এবং এ ব্যাপারে পবিত্র দায়িত্ব রয়েছে পুলিশ বিভাগের ওপর। কিন্তু তারা যদি নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্য ব্যাপার দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন, তাহলে জননিরাপত্তার পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। আইন শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষাকারী পুলিশের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললে তা দেশের জন্য যে কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে সেকথা বলাই বাহুল্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক