মোহসীন মুন্সী আজান দেয়ার জন্য মিনারে উঠেছেন এবং আল্লাহু আকবর উচ্চারণ করেছেন ঠিক তখনই তাকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলি চালায়!!
“৩রা আগস্ট রাত্রি প্রায় ১১ টায় পাঞ্জাবী পুলিশ, স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান, শান্তি কমটির সদস্য ও ভি ডি পার্টির সভাপতিসহ আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং প্রবেশ করে আমাকে গ্রেফতার করে। অবশ্য গ্রেফতারের পূর্বে সমস্ত বাড়ি তছনছ করে। গ্রেফতার করে সামরিক ক্যাম্পে নিয়ে যায়। নিয়ে যাবার পর মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগকারী ওয়্যারলেস ও রিভলবার কোথায় রয়েছে তা জানাতে বলে। সদুত্তর না পেলে আমাকে পা ফাঁক করে বাঁশ দেয়। অতঃপর চাবুক দ্বারা বেদম প্রহার শুরু করে। প্রায় ঘন্টা তিনেক একের পর এক হাত বদল করে এমনি অত্যাচার চালায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। এরপর গভীর রাতে ঐ অবস্থাতেই উঠাবসা করতে নির্দেশ দেয়। হয়তো একশ বার ঐ প্রক্রিয়া চালাতে বললে ৪০ বার করার পর বলে যে পাঁচবার হয়েছে। কিছু সময় এ অবস্থা চালিয়ে অসমর্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে আমাকে লাথি মেরে উঁচু বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয়। সেখান থেকে আবার তুলে নিয়ে আসে এবং আবার উঠাবসা করায়। আবার পড়ে গেলে আবার লাথি মেরে ফেলে দেয় ও তুলে আনে। এমনি করে সকাল হয়ে গেলে ক্যাম্পের ভিতরে প্রধান রাস্তায় হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। সেখান দিয়ে যে সমস্ত সামরিক লোক চলাচল করেছে তারা সকলে আমাকে যথেচ্ছভাবে লাথি মেরে পায়ের ঝাল মিটিয়ে নেয়। সারাদিন আমি ঐ অবস্থায় ছিলাম এবং খোলা জায়গায় রোদে সমানভাবে অত্যাচারিত হয়েছি। সন্ধ্যার দিকে ঐখানেই জিজ্ঞাসা করে যে তুমি মুসলমান না হিন্দু। মুসলমান বললে আমাকে কালেমা বলতে বলে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কালেমা বলা থেকে বিরত থাকি। তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এখানের কলেজে কালেমা পড়া হয় কি না। উত্তরে না বললে আমাকে কাপড় খুলতে নির্দেশ দেয় এবং উলঙ্গ করে। উলঙ্গ অবস্থাতেই আমাকে ঘন্টা দুই রাখা হয়। অতঃপর পূর্ব পদ্ধতিতে আবার উঠাবসা করতে বলে। কিন্তু বসতে পারলেও কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না। কারণ খুব নিস্তেজ হয়ে গেছি। সে অবস্থাতেও আমাকে মারধর করা হয়। তারপর আমাকে টাঙ্গানোর নির্দেশ দেয়। তখন দু’পা উপরের দিকে বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেয়। হাত যেন কোন বাঁধার সৃষ্টি না করে সে জন্য হাত দুটিও বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর একজন সিপাইকে ডেকে চাবুক মারতে নির্দেশ দেয় এবং সেরূপ চলতে থাকে। একজন ক্লান্ত হলে আর একজন চাবুক মারত। এমনি করে তিনজন চাবুক মারার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। অত্যাচারের এক পর্যায়ে পানি পান করতে করতে চাইলে মুখে সজোরে লাথি মারে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। রাতের কোন এক সময় জ্ঞান ফিরে পাই। পুনরায় পানি পান করতে চাইলে পাহারারত দুইজন সিপাহীর একজন প্যান্টের বোতাম খুলে এবং মুখে প্রস্রাব করে দেয়। প্রস্রাব করে দিয়ে সিপাইটি তার নিজের আসনে ফিরে যায়। পরের দিন সকাল পর্যন্ত ঐ টাঙ্গানো অবস্থাতেই থাকি। এর মধ্যে মাঝে মাঝে সামান্য জ্ঞান ফিরে আসে এবং পর মুহূর্তেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সকালের দিকে আমাকে নামানো হলে বলে যে তুমি লিখে দাও, রিভলবার ও ওয়্যারলেস কোথায় আছে, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। নেতিবাচক উত্তর দিলে তারা আমাকে চড়-থাপ্পড় দেয়। তারপর আমাকে এক ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। সেদিন দিবাগত রাতে একজন মাস্টারসহ তিনজন মুক্তিফৌজকে ধরে নিয়ে আসে। রাতে তাদেরকে পিটানোর পরে তাদের কাছে স্বীকৃতি আদায় করার জন্য আমার ঘরে দেয়। রাত দুইটার দিকে জিজ্ঞাসা করলে তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) স্বীকার করেনি বলে আমি জানাই। সারা রাত তারা আমার কাছেই থাকেন। পরের দিন রাত ১২টার দিকে সেলে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় ও পায়ের জুতা খুলতে বলে এবং খুলে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় বাইরে ক্যাম্পের পিছনে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে বিকট আ…… চিৎকার ভেসে আসলো। এতে অনুমান করা গেল যে, বেয়োনেট অথবা ছোরা দিয়ে গুঁতিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
এভাবে পাঁচদিন প্রায় অভুক্ত অবস্থায় থাকার পর ৭ই আগস্ট দিবাগত রাত ৯টার সময় আমাকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেয়। শহরের বাইরে কোথাও যেতে পারব না এটাই ছিল তাদের প্রধান নির্দেশ।
২৩শে এপ্রিল {আগস্ট বা সেপ্টেম্বর হবে}শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে গোমস্তাপুরে পাক মিলিটারীরা অপারেশন করে। থানার পাশের বাজারপাড়া হিন্দু বস্তিতে গিয়ে ৩১ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে আসে। অতঃপর সমস্ত গ্রাম পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ধরে আনা লোকদের থানার পিছন দিকে মহানন্দা নদীর তীরে ১৫ জনের প্রথম দলকে দাঁড় করায় এবং গুলি করে হত্যা করে। অপর দলের ১৬ জনকেও ঐ একইভাবে হত্যা করে। হত্যা করার পর লাশগুলিকে পেট্রোল দিয়ে জ্বালাবার নির্দেশ দিলে মৃত ৩১ জনের মধ্য থেকে অমিল কর্মকার নামে এক ব্যক্তি পুড়িয়ে দেয়ার ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করে।
১৯শে অক্টোবর, রবিবার দিবাগত রাত্র প্রায় তিনটার দিকে পাঞ্জাব বাহিনীর দুটি ব্যাটেলিয়ান সীমান্তবর্তী গ্রাম বোয়ালিয়া ঘেরাও করে। মেজর ইউনুসের নেতৃত্বে ব্যাটেলিয়ান দুটি সকাল হওয়ার অল্প কিছু আগে মোহসীন মুন্সী আজান দেয়ার জন্য মিনারে উঠেছেন এবং আল্লাহু আকবর উচ্চারণ করেছেন ঠিক তখনই তাকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলি চালায়। সাথে সাথে গ্রামের উপর বৃষ্টির মত গুলিবর্ষিত হতে থাকে। এ গ্রামে তিন ঘন্টায় প্রায় ৬৫০ জনকে হত্যা করে। এদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ, যুবক ও নারীও ছিল। ১৬৮০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে। এরপর বোয়ালিয়া গ্রামসংলগ্ন নরশিরা, শাহপুরা, পলাশবোনা, দরবারপুর, কালোপুর ও ঘাটনগর বঙ্গেশ্বর গ্রামেও হামলা চালায়। এখানেও ১২০০ লোককে হত্যা করে। এ সমস্ত গ্রামও পুড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনী হামলার সময় অসংখ্য মহিলার উপর বলাৎকার ও লুটপাট করে।
পরবর্তীকালে নরপশুরা উপরোক্ত হত্যা চালায়। এরপরে বিধ্বস্ত এ গ্রামগুলি পাঞ্জাব বাহিনী ও তার তাবেদাররা সংলগ্ন থানার নিরীহ জনসাধারণকে ধরে নিয়ে এসে হত্যামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। দেশ স্বাধীন হবার পর দেখা যায় যে, সমস্ত গ্রামগুলিই বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি কুয়া নরকঙ্কালে ভর্তি। অপর দিকে গ্রামগুলিতে যে সমস্ত দেওয়াল ঘর ছিল, সেসব ঘরে জনসাধারণকে হত্যা করে দেওয়াল ভেঙ্গে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এসব গ্রামগুলির এমন বাড়ি খুজে পাওয়া যাবে না কাউকে না কাউকে সে বাড়ি থেকে হত্যা করা হয়নি। এমনও অনেক বাড়ি রয়েছে, যে বাড়ির সকলকেই পাক জল্লাদরা হত্যা করে। এমনি একটি পরিবার সেকান্দার আলী। অপর একটি পরিবার সোলেমান মিয়ার যেখানে শুধুমাত্র ছোট ছেলে বেঁচে রয়েছে। মা-বাবা, ভাইবোন সকলকে হত্যা করা হয়েছে।
স্বাক্ষর/-
ডি, এম, তালেবান নবী
প্রতিনিধি, ‘দৈনিক বাংলা’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী
Unicoded by রকিবুল হাসান জিহান