বাস্তুত্যাগীদের নিয়ে ঢাকা বেতারের অপপ্রচার
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)। হানাদার শত্রু কবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশে আসা নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা প্রচার চালানাে হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম দিকে বিশেষ একটি প্রচারণা ছিল ভারতে চলে যাওয়া লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশ প্রত্যাগমনের জন্য আবেদন নিবেদন, অনেকদিন যাবত একটানা প্রচার করা হয়েছিল পাকিস্তানী সামরিক কর্তারা বাস্তুত্যাগীদের জন্য বিভিন্নস্থানে অভ্যর্থনা শিবির (Reception Camp) খুলেছেন এবং সেই সাথে প্রচার মাহাত্ম দিয়ে। প্রতিদিনই যে হাজারে হাজারে বাস্তুত্যাগীরা স্বদেশ ফেরার পথে ঐ সকল অভ্যর্থনা শিবিরে আগমন করছেন সেই খবরও জৌলুস সহকারে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু বিদেশী সাংবাদিকরা এবং পরবর্তী পৰ্য্যায়ে রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণ কমিটির কর্ণধার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগাখানের সফরের পর পাক বেতারের মিথ্যা প্রচারণার খােলস খুলে পড়েছে। বিদেশী সাংবাদিকদের জবানীতেই জানা যায় বাংলাদেশের যেখানে প্রতিদিন অব্যাহতভাবে মানব নিধন যজ্ঞ ও বাড়ীঘর, গ্রামকে গ্রাম পাইকারী হারে লুঠপাট ও পােড়ানাে চলছিল এবং সর্বত্র তল্লাসী চালিয়ে ধরপাকড় আর বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল এবং সর্বোপরি হাজারে হাজারে বাঙ্গালীরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেখানে হানাদার কবলিত অভ্যর্থনা শিবির তথা নিশ্চিত মৃত্যু শিবিরে ফিরে যাবার কোন প্রশ্নই আসে না। ফলে শেষ পৰ্যন্ত ঐ ধরনের অভ্যর্থনা শিবিরগুলি স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ হয়ে যায় ।
এবার ঢাকা বেতারের কর্তা ব্যক্তিরা প্রচারের ঢং বদলিয়ে অন্য সুর ধরেছেন। এখন বলা হচ্ছে বাস্তুত্যাগীরা দেশে ফেরার জন্য খুবই উদগ্রীব শুধু ভারত সরকার তাদের স্বদেশে ফিরতে দিতেছেন না। সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলিতে মহামারী লেগেছে এবং প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার শরণার্থী প্রাণ হারাচ্ছেন। কিন্তু আমরা শুধু ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের নিকট একটি মাত্র প্রশ্নের জবাবই চাইব যে বাস্তুত্যাগীদের জন্য যে ‘মার চেয়ে মাসীর দরদের মত দেখানাে হচ্ছে, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের বিভিন্ন লােভজনক টোপ। ফেলা হচ্ছে-তার আগে কি ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ জবাব দেবেন- বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি অধিবাসীকে কোন অপরাধে আত্মহারা স্বজনহারা আর সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাড়ীঘর ছেড়ে শুধুমাত্র প্রাণ ভয়ে ভারতের মাটির দিকে ছুটে চলে যেতে হয়েছিল? ২৫শে মার্চের রাতের আঁধারে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল এবং এখনও কেন সেটা বন্ধ হয়নি? বেতার কর্তৃপক্ষ অথবা তাদের পরিচালক সামরিক চক্রও কি এতই অবােধ শিশু যে, তারা বুঝতে পারছে না যত রংঢং দিয়েই প্রচার চালানাে হউক না কেন-সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিয়ে এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ভারতে চলে যাওয়া বাস্তুত্যাগীরা আর। দেশে ফিরে আসবেন না। আমরা এটাও জেনেছি-বাস্তুত্যাগীদের একমাত্র বক্তব্যই হলাে “আমাদের। নেতা বঙ্গবন্ধু যেদিন আমাদেরকে স্বদেশ ফেরার আহ্বান জানাবেন ঠিক তখনই আমরা স্বদেশ পানে ছুটে যাব এবং আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই সকণ্ঠ আহ্বানের প্রত্যাশাতেই আছি এবং থাকবাে।
বাংলাদেশ (১) ॥ ১: ২২ ॥ ২২ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪