You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থীরা বাঁচতে চায়

রণজিৎ কুমার সেন অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল ভাই বােনেরা রক্তে রঞ্জিত লাল পিচ্ছিলপথ বেয়ে এসেছে। ভারতে বাঁচার জন্য। ওরা আজ সর্বহারা, রিক্ত, পথের ভিখারী। গােলা ভরা ধান, গােয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ আজ তাদের কাছে স্বপ্ন। শান্ত স্নিগ্ধ ঘেরা কুটিরের বদলে ওরা আজ বাঁশের ডেরায় আস্তানা নিয়েছে। রৌদ্র, বৃষ্টি প্রচন্ড সূর্যের দহনে ওদের চামড়াগুলাে যেন পুড়ে খাক হয়ে যায়। আবার রাত্রি বেলা সেই খরতপ্ত দেহের উপর পড়তে থাকে শিশিরের জল। বৃষ্টি আসলে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেই কাটিয়ে দেয় অনিদ্রার। সকাল হতে হতেই চাল আর ডাল সংগ্রহের জন্য ক্যাম্প অফিসের সামনে বিরাট লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। সারাদিন এমন কি রাত পর্যন্ত হয়ে যায় লাইনে দাঁড়িয়ে। বুভুক্ষ আর তৃষ্ণার্ত দেহটাকে নিয়ে তবুও দাঁড়িয়ে থাকে আহার্য সামগ্রী নিয়ে ঘরে ফেরার জন্য। ঘরে হয়তাে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই উনুন ধরিয়ে বসে আছে -কখন ফিরে আসবে সাহায্যের থলি নিয়ে? শত অভাব অনটনের ভিতরও ওরা আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যেমনি করে হউক বাংলার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতেই হবে। কিন্তু আর কতদিন? আর কতদিন তাদের এমনি অপেক্ষা করতে হবে? সেই প্রশ্নের জবাব কয়েক জন শরণার্থী আমার কাছে চেয়েছিল কিন্তু আমি তাদেরকে সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারি নি।

যারা আজ শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে এসেছে তারা যে সবাই এক একটি সৈনিক। ওরা বর্বর। শাহীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবরের ডাকে স্বাধীকারের পক্ষে ওরা ভােট দিয়েছিল।  বর্বর ইয়াহিয়ার চামুন্ডারা গণতন্ত্র বিশ্বাসী জনগণকে সহ্য করতে পারল না। তাই শান্তিপ্রিয় নিরীহ গণতন্ত্র কামী মানুষদের উপর জঙ্গীশাহীর উদ্যত রাইফেলগুলাে একসাথে গর্জে উঠলাে। ওদের আর্তনাদে বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলাে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলাে গণতন্ত্র বিশ্বাসী বঙ্গবাসীদের ঘর বাড়ী। নিরুপায় হয়ে দলে দলে বঙ্গবাসীর কুলবধূ থেকে আরম্ভ করে অশিতপর বৃদ্ধ পর্যন্ত পাড়ি জমাতে লাগলাে এপারের উদ্দেশ্যে তারাই এ বিপদের দিনে চুপ করে রইলেন না, দু’হাত-প্রসারিত করে বক্ষে তুলে নিলেন ওদেরই প্রতিবেশী ভাই বােনদেরকে। আর যুবক ছেলের দল মুজিবনগরে গিয়ে মুক্তি যােদ্ধার ট্রেনিং নিতে লাগলাে।

ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিতেই নিরীহ নিষ্পেষিত অভাগা বাঙ্গালীদের নাম হলাে শরণার্থী। কিন্তু দেশের জন্য তাদের যে আত্মত্যাগ তা কি একবার কেউ চিন্তা করে দেখেছেন? ওদের মনােবল অটুট রাখার জন্যে, শােকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে আমাদের বুদ্ধিজীবি, সাহিত্যিকদের কি এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়? কোলকাতায় বিলাস ব্যসনে না কাটিয়ে, নিজেকে নিজে ব্যস্ত না রেখে, এগিয়ে চলুন শরণার্থী ক্যাম্পে। ওদেরকে দুটো মিষ্টি কথা বলুন। বাংলার যুদ্ধের অগ্রগতির খবর শুনান, পতিহারা বিধবাকে সান্ত্বনা দিন,-পুত্রহারা জননীকে বুকে তুলে নিন, নিষ্পাপ, নিস্কলঙ্ক শিশুগুলােকে আবার আগের মত পড়া শুনা করার মত পরিবেশ সৃষ্টি করে নিল। ওদেরকে নিয়ে সভা করুন। আপনি কি কোন সময়ে শরণার্থী ক্যাম্পে যাননি? না গিয়ে থাকলে আজই ঘুরে আসুন। দেখবেন, ওদের ঘর না থাকলেও ওরা আপনাকে কি ভাবে অভ্যর্থনা করে। ওরা যে আপনাদের মত লােকের একটু সাহায্য চায়। তাই ওদেরকে এ ন্যায্য অধিকারটুকু থেকে বঞ্চিত করবেন না।

দাবানল ॥ ১; ৪ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!