মুক্তাঞ্চলে যা দেখেছি – অধ্যাপিকা মীরা দে
কালিন্দী পেরােবার পর সাত মাইলের রাস্তা। ফাঁকা রাস্তা, মাঝে মাঝে ছােট দরমা দেওয়া কুঁড়ে চোখে পড়ে। বাচ্চা, মহিলাদেরও দেখা যায় কুঁড়ের মধ্যে। রিক্সাচালক বলে চলে, কিছুদিন আগেও কুঁড়ের সংখ্যা ছিল আরও বেশী। গত মে থেকে এ রাস্তা দিয়ে পথ চলা ভীড় ঠেলার সামিল ছিল। এখন কিন্তু ফাকা, কারণ বাংলাদেশ তাে মুক্ত হতে চলেছে। ওপারে বসন্তপুর কালীগঞ্জ শ্যামনগরের অনেক লোক চলে গিয়েছে। কথাটা সত্যি। কালীগঞ্জে পৌছলুম সাড়ে চারটেয়। পশ্চিমাকাশে মুঠো মুঠো সােনা তখন। নৌকার মধ্যে আলাপ হ’ল এক মুক্তি যােদ্ধার সঙ্গে। বাচ্চা ছেলে, কলেজের 1st year এর ছাত্র ছিল। নৌকা বােঝাই যাত্রী, আমরা ছাড়া সবাই ওপারের বাসিন্দা, পাকসৈন্যের তাড়ায় এসেছিলেন এখানে, এখন সবাই দেশাভিমুখী। মাঝি বলে আর সাত দিনের মধ্যেই সবাইকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেব – তাতে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাটি তেতে বলে উঠে পাঠাতে হবে না, সবাই নিজে থেকেই চলে যাবে। ইছামতী থেকে বার হয়ে আসা কপােতাক্ষের উপর দিয়ে নৌকা যাচ্ছিল। দুপাশে বাংলাদেশ। আমার জীবনে প্রথম দেখা বাংলাদেশ। এদিক ওদিক ছড়ান নৌকো – অনেকগুলি দেখলাম চ্যাটালাে। ময়ুরপক্ষীর মত। ওগুলি নাকি খুলনার। আরও একটা জিনিস চোখে পড়ার মত, দুপাশে সারি সারি বাঙ্কার। বইএ পড়া, কানে শােনা আর চোখে দেখার মধ্যে তফাৎ আছে। চিলে কোঠার ঘরের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। অনেক রক্তাক্ত ঘটনার ইতিহাস মনে পড়িয়ে দেয়।
কালীগঞ্জে নামলাম। ডাক বাংলায় ছােটখাট একটা অফিস মত রয়েছে। ওখানের যারা ছিলেন তাঁরা বললেন ক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে সামান্য জামাকাপড় আর লণ্ঠন ছিল, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য, অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ওঁরা সেগুলি নিলেন, এবং আমার সঙ্গী কিছু “বিপ্লবী বাংলাদেশ” ও New Wave কাগজ পড়তে দিলেন। তারপর আমরা ভিতরের দিকে গেলাম। পাশে দোতালা হলদে রং এর থানা, সেখানে আর দুদিন আগেও নাকি তিনজন দালাল বন্দী হয়েছিল। থানার আশে পাশের মাটি এবড়াে থেবড়াে। আমাদের পথের সঙ্গী ছাত্র মুক্তি যােদ্ধাটি মাইনের পর মাইন পোঁতার চিহ্ন দেখাতে লাগলেন। পথের পাশে, পথের মাঝে, কাচা বাঙ্কার, যেখানে নৌকো পারাবারের ঘাট আছে তার পাশে শক্ত বাঁধান। বাঙ্কার, গুণে শেষ করা যায় না। একটা অসম্পূর্ণ বাড়ী রয়েছে, তার চার থামের উপর, থামের মতই। চারটে বাঙ্কার, নদীর পাড় অনেক উঁচু করা রয়েছে। জিগ্যেস করি বিস্ময়ে ব্যাপারটা কি, এত আয়ােজন, এত অস্ত্র-মুক্তি যােদ্ধারা কি করে হঠালেন? উত্তর আসে, ঈদের দিন মুক্তি যােদ্ধারা আসছে এই খবর। আগে থেকে ওরা পায় এবং তাতে নাকি তারা পলায়ন করে ! নৈতিক কারণ ছাড়া আর অন্য কিছু আমার মনে পড়ে না। রাস্তায় এক বৃদ্ধ দাড়িয়ে, সামনে এক মহিলা, সিঁদুর দেওয়া সিঁথিতে। কোথায় যাচ্ছেন?—স্বদেশে গরুর গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছেন ওঁরা, আমরা কলকাতার লােক জেনে বললেন ওঁদের গ্রামে যেতে। বৃদ্ধের দন্তহীন হাসি এক অশেষ মুক্তির চিহ্ন-“প্রাণে খুসির তুফান উঠেছে ” সত্যিই। দুই ভদ্রলােক সাইকেল করে ভিতরের গ্রামে যাচ্ছেন। খুলনার নেওয়াবেকী গ্রামে। আমাদের ঢাকার মুক্তি যােদ্ধার পরিচিত ভদ্রলােক। নেওয়াবেকী কেন? প্রশ্ন তােলেন আমাদের যােদ্ধা। লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভদ্রলােক জবাব দেন শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছি! বিশ্বের মানচিত্র থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার শক্তি কারাে নেই। -সৈয়দ নজরুল ইসলাম
শরণার্থীদের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত কিশাের যুবক এবং মধ্যম বয়সী লােক সপরিবারে বা একাকী সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরােধ, আপনারা অবিলম্বে বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে গঠিত বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যােগাযােগ করুন এবং সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করুন।বাংলাদেশ থেকে যারা সীমান্তের ওপারে আশ্রয় শিবিরে আছেন তাদের সুব সময় স্মরণ রাখতে হবে যে এটা অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তারা ভারতে যাননি। তাদের চেষ্টা হবে সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করে মুক্তিফৌজের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে শক্রকবল মুক্ত করে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে যাওয়া। ভারতে যারা শরণার্থীদের সাহায্য করছেন তাদের উপর বােঝা হয়ে বসবার চেষ্টা করলে তা নানা কারণে আমাদের জন্য আত্মহত্যার সামিল হবে। তাই রিলিফের খাদ্যগ্রহণ করেই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা কোনক্রমেই উচিত হবে না। শরণার্থীদের ভিড়ের মধ্যে পঞ্চম বাহিনীর অনেক লােকও ঢুকে পড়েছে। তাদের দিকে নজর রাখতে হবে। প্রয়ােজনবােধে নিজ নিজ এলাকার মানচিত্র সংগ্রহ করে বা নিজ হাতে এঁকে তা মুক্তিফৌজকে দিতে হবে এবং শত্রুবাহিনীর অবস্থান সেখানে গমনের নির্ভুল রাস্তা ঘাট ও নদী নালার নির্ভুল পরিচয় দিয়েও মুক্তিফৌজকে সাহায্য করতে হবে। প্রসঙ্গত : বলা দরকার যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিফৌজের বহু ট্রেনিং শিবির চালু হয়েছে এবং সেগুলােতে হাজার হাজার তরুণ ট্রেনিং নিচ্ছেন।
জয়বাংলা (১) ১:১ ॥ ১১ মে ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪