মুক্তাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসনে সরকারী নির্দেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ তার সহকর্মীদের সাথে মুক্ত অঞ্চলে সুষ্ঠু অসামরিক প্রশাসন গড়ে তােলার জন্যে ক্রমাগত আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। মুক্তাঞ্চলে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় যাবতীয় জিনিস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার সাহায্য করবেন। বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনে সহায়তা করবার জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে কিছু কর্মচারী। বাংলাদেশ সরকার পাবার আশ্বাস পেয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে এরা বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজ নিয়ে যাবেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা পুনরায় ভারতে চলে আসবেন বলে প্রকাশ। | বাংলাদেশ মন্ত্রী পরিষদ, মুক্ত অঞ্চলের প্রয়ােজনীয়তার সামগ্রিক পরিচয় না পাওয়াতে সঠিক পন্থা। গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছেন না। এ ব্যাপারে গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে যে জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে তাদের কাছ থেকে এগুলি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এ সমস্ত খবর সরাসরি পৌছতে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ। মুক্তাঞ্চলগুলাে প্রায়ই যােগাযােগ ছিন্ন।
মুক্তাঞ্চলে অগ্রাধিকার তুল্য প্রশাসনিক বিষয়গুলাে নিয়ে সরকার ইতিপূর্বেই কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল :(১) আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। (২) পাক সৈন্য ও রাজাকার বাহিনী যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে সেগুলাে উদ্ধার করা ।। (৩) ছিন্নমূল জনসাধারণকে পুনর্বাসন করানাে। (৪) পূর্ণ সরকারী প্রশাসন ও গঠনমূলক তৎপরতা চালানাে। বাংলাদেশ সরকার প্রশাসন চালানাের জন্য যে পরিমান অভিজ্ঞ অফিসারের প্রয়ােজন তার অভাব। বােধ করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার সমস্ত সরকারী অফিসারদের যেখানে তারা অবস্থান। করছেন, যে ভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব সেভাবে তারা যেন কাজে যােগ দেন। যারা এখনাে বিচ্ছিন্ন এবং আত্মগােপন করে আছেন তাদের কাছে এ নির্দেশ আশাব্যঞ্জক হবে।
এ ছাড়াও সরকার তথ্যানুসন্ধান কমিটি নিয়ােগ করেছেন। এই কমিটি লক্ষ্য রাখবেন কোন কোন অফিসার শত্রুদের হয়ে কাজ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ণ সরকারী ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য মুক্তি বাহিনীর সাহায্য অতি প্রয়ােজন। সঠিক মালিককে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে মুক্তিবাহিনীকে সরকারকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। যে লােক। নিজে থেকে অবৈধভাবে দখলীকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে না। তাদের শাস্তি দেয়া হবে। পুনর্গঠনের ব্যাপারে পরিকহাটের পথে লোক ধরে না। দোকানী দোকান খুলেছে, ব্যাপারীরা বসেছে। ঝালমুড়ি বিক্রীও বসেছে। পান আর তাল তাল চুন নিয়ে বসা দেখে তাম্বুল চর্বিত বাঙ্গালীর গল্পে স্বভাবের কথা মনে পড়ল। তবে সবই মনে পড়িয়ে দেয় এ হাট খুবই জমজমাটের ছিল। দোচালা গুলি এখনও খােলেনি। কেনা বেচা কম। দোকানে। জিনিসপত্রের কিছু অভাব। দোকানী পীর মহম্মদ দিন সাতেক হ’ল দোকান খুলেছে। তার অর্ধেক জিনিষ লুঠ। হয়েছে, Peace কমিটির লােকেরা নাকি দোকানের চাবি এবং ঘরের চাবি দুইই কেড়ে নেয়। প্রাণে মারার আদেশও ছিল, অনেক টাকা Peace কমিটিকে দিয়ে সুন্দরবনে পালিয়ে যায় স্ত্রীপুত্র পরিবারকে নিয়ে। আমরা। কলকাতার বাসিন্দা শুনে কেউ ছাড়বে না, বাড়ী নিয়ে যাবে, খাওয়াবে ইত্যাদি। সেই সন্ধ্যেয় আমাদের ফেরার কথা-হিঙ্গলগঞ্জে পৌছতে হবেই। এর পরের দুটো ঘটনা খুব মজার। কাটাখালি পাড় থেকে সাত মাইল লম্বা রাস্তার পর কালিন্দী। টেম্পােতে উঠেছি। তিনজন ভারতীয় জওয়ান সহ দুইজন হাবিলদার উঠলেন ওই টেম্পােতে। টেম্পু চলে না। জওয়ানদের ঠেলতে হল, তারপর তার চাকা চললাে। ওঁরা up.-র লােক কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলেন।
কারণ পাড়াগাঁয়ে ইংরাজীও চলে না, হিন্দীও চলে না’ বললেন হাবিলদার সাহেব। ড্রাইভারের সঙ্গে এবং conductar এর সঙ্গে খুব হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক ওদের। আমাদের নমস্কার জানিয়ে পথের মাঝে বিদায় নিলেন। আমাদের জওয়ানদের এই অমায়িক পরিচয় পেয়ে বেশ গর্ব হল। আমরা কালীগঞ্জে ভারতীয় সৈন্য একজনের দেখাও পাইনি। তারা সবাই রণক্ষেত্রে, মুক্ত এলাকায়। বাংলাদেশের মানুষ। এপার ওপারের যাওয়া আসার নিষেধ নেই। এপারে মানুষ ওপারে হাটবাজার করছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের দরদী বলে, কেউ কেউ আর্থিক দিকের কথা চিন্তা করে। আমার সেই বৃদ্ধ ও মহিলার মুখ এখনও মনে পড়ে প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’-বাংলাদেশের সর্বস্তরে। বৃদ্ধের নিমন্ত্রণ মনে আছে। বলেছিলাম, যাব, নিশ্চয় যা আপনাদের গ্রামে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ১৮ ! ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪