You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৫শে জানুয়ারী, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১১ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এভাবে আর কতদিন চলবে

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টিসিবি’র কারসাজি ধরতে বেনাপোল সীমান্তে যেতে হয়েছিল। গত পরশুদিন তিনি হেলিকপ্টারযোগে আকস্মিকভাবে বেনাপোল সীমান্ত চেকপোস্ট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ভারত থেকে টিসিবি কর্তৃক আমদানীকৃত বাইশ লাখ টাকা মূল্যের কাপড় বেনাপোল সীমান্তে বহুদিন অযত্নে পড়েছিল। এবং তা মুক্ত আকাশের নীচে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় প্রায় বিনষ্ট হবার পথে। প্রধানমন্ত্রী গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এই কারচুপি ধরার অভিযানে বেরিয়েছিলেন। সংবাদে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক সচিব ডঃ এ সাত্তারের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি এ ব্যাপারে গঠন করা হয়েছে। এবং পঁচিশে জানুয়ারীর মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। জানা গেছে যে, ইতিপূর্বে ভারত থেকে আমদানীকৃত মাল সরাসরি খুলনায় নিয়ে গিয়ে এ্যাসেসমেন্ট করা হতো। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে কাস্টমস থেকে টিসিবিকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল যে—এ্যাসেসমেন্ট বেনাপোলেই হবে। টিসিবি এ চিঠির কোনো জবাবই দেওয়া প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে আমদানীকৃত মালের ব্যাপারে কাস্টমস আর টিসিবি’র মধ্যে একটা মনোমালিন্য চলছিল। ঠিক এমনি সময়ে ক্যারিং এজেন্টরা মাল এনে নো ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে রেখে চলে যায়। কাস্টমস ও টিসিবি’র মধ্যে এতোদিন যে ঠান্ডা লড়াই চলছিল তার অবসান হয়েছে গত পরশুদিন প্রধানমন্ত্রীর সরেজমিনে উপস্থিত হলো। মালগুলো এখন বেনাপোল ভেড়ে খুলনা অভিমুখে নাকি রওয়ানা হয়ে গেছে।
বস্তুতঃপক্ষে এ সকল কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করেই দেশের সাধারণ ও শিক্ষিত মানুষ আজ কর্তৃপক্ষের প্রতি চরম বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করছে। সরকারী নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রশাসনযন্ত্রের যে চরম উন্নাসিকতা রয়েছে তা এ সকল কার্যকর্মের মধ্যেই সুস্পষ্ট। টিসিবি’র প্রতি মানুষের আজ আর আস্থা নেই। এমনটি চললে আস্থা থাকার কথাও নয়। ইতিপূর্বে খুলনাতেও ঠিক এমনি একটা ঘটনাই ঘটেছিল। সেখানেও টিসিবি আমদানীকৃত কাপড় খোলা জায়গায় অরক্ষিত অবস্থায় রাখার দরুণ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া টিসিবি’র কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় একটা কিছু সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছেই। টিসিবি শুধু নয় দেশের প্রায় প্রত্যেকটি সংস্থাই আজ চুরির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনে সবাই কেমন যেন উদাসীন। সরকারও আজ পর্যন্ত এমন কোনো উদাহরণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি যাতে করে অফিসাররা দুর্নীতি করতে সাহস না পায়। বঙ্গবন্ধু নিজে কয়েকবার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক সফরে গিয়ে অব্যবস্থা দেখে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন একমাত্র সেটাই আমাদের সামনে আজ উদাহরণ। কিন্তু এভাবে একটি সরকার বা জাতি পরিচালিত হতে পারেনা। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যদি বেনাপোলে গিয়ে টিসিবি’র অযত্নে রক্ষিত মাল ধরতে হয় তাহলে সে সরকারকে বিশ্বের যেকোনো সরকারই অযোগ্য প্রমাণিত করবে। আমরা আশা করেছিলাম যদি সরকারী কর্মকর্তারা এ ধরনের কাজ প্রতিনিয়ত চালিয়েই যেতে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে যাতে করে ভবিষ্যতে অন্যরা সে ধরনের অন্যায় করতে ভয় পায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি—একটি অন্যায়ের জন্যে কোনো অফিসারের চাকরী গেলে সে আবার অন্য আর একটা বড় চাকরী পেয়ে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি দৈনিকের এ ধরনের একটি খবর আমরা লক্ষ্য করলাম। আদমজী মিল থেকে যাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল তাকে আবার অন্য বড় একটা চাকরী কর্তৃপক্ষ দিয়ে খুলনায় পাঠিয়েছেন। অতএব কোনো অফিসার অন্যায় করলে তার বিপদ তো দূরে থাক আরো ভালো সুযোগ-সুবিধা লাভের ব্যবস্থা হতে পারে। এহেন অবস্থার মধ্যে দিয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হতে পারে না। টিসিবি’র মাল করার গাফিলতি করে বেনাপোলে ফেলে রেখেছিল তাদের হয়তো ধরা হবে, এবং তাতে আমরা আশান্বিত হয়ে উঠবো। কিন্তু অন্য একদিন আমরা জানবো—যাদের ধরা হয়েছিলো তাদেরই কেউ অন্য কোনো বড় চাকরী পেয়ে গেছেন।
এ ধরনের অবস্থার আশু সমাধান হোক এটাই আমাদের কামনা। টিসিবি’র কারণে দেশে যে সকল নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে তারও আশু সমাধান আমরা চাই। আর বঙ্গবন্ধুকে কতদিন এমনিভাবে আকস্মিক সফর করে চুরি ধরে বেড়াতে হবে সেটাই জনগণের জানার আগ্রহ রয়েছে বলে মনে করি।

চীনের ক্ষেপণাস্ত্র, পাকিস্তানের ক্ষ্যাপামো

পাকিস্তানে সামরিক ক্ষ্যাপামোর আলামত দেখা দিয়েছে। রসদ যোগাচ্ছে চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের গলায় গলায় জড়াজড়ি সেই প্রেসিডেন্ট আইউব খানের আমল থেকেই জমাট হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমলেও পাকিস্তানে একনায়কত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে চৈনিক উদারতার মাহাত্ম্য আমরা অভিনিবেশ ভরে লক্ষ্য করেছি। ভুট্টো সাহেব গদিয়ান হওয়ার পর চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দহরম মহরম বেশ কয়েক ডিগ্রী তুঙ্গে উঠেছে। একাত্তরের ভরাডুবির পর পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্যে চীন কি-না করেছে। রাজনৈতিক সাহায্য বলুন আর সামরিক সাহায্যই বলুন, চীন পাকিস্তানের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি অকাতরে পূরণ করে দিয়েছে। চীন এবার ঠিক করেছে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা নির্মাণে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবে। উচ্চ পর্যায়েরর একটি চীনা সামরিক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি পাকিস্তানের হালহকিকত সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে গেলেন। বারোদিনব্যাপী পাকিস্তানে ঘোরাফেরা করার সময় চীনা সামরিক মিশনের নেতা চীনা স্থলবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ চ্যাংসাই চিয়েন মুখ খুলে বলেই ফেলেছেন যে, পাকিস্তান অচিরেই অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করবে। তক্ষশীলায় অবস্থিত ভারী যন্ত্রপাতি কারখানায়ই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল আঁচ করছেন। একাত্তরের বিপর্যয়ের পর ভুট্টো চীন সফর করলে, চীন পাকিস্তানকে তিরিশ কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সম্ভার সাহায্য করে। এইসব সামরিক সম্ভারের মধ্যে রয়েছে ৬০টি মিগ, ১৯টি জেট জঙ্গী বিমান, ১০০টি টি-৪৫ ও টি-৫৫ মডেলের ট্যাংক এবং রাইফেল, মেশিনগান এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র। চীন সমস্ত সামরিক সম্ভারই একেবারে বিনে পয়সায়, যাকে বলে দান খয়রাত করেছে। এ ছাড়া, চীন পাকিস্তানকে ১১ কোটি ডলার ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে এবং ১০০ কোটি ডলার সুদমুক্ত ঋণ পরিশোধের মেয়াদও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই না হলে কি আর ‘প্রাণের প্রাণ, জানের জান’ পরিচয় পরিব্যপ্ত করা যায়! ভুট্টো সাহেব তাই ‘তাধিন তাধিন’ করে বগল বাজাতে শুরু করেছেন। জেনারেল টিক্কাও আনন্দে একেবারে গদগদ। উপমহাদেশে সামরিক উত্তেজনা জিইয়ে রাখার জন্যে চীন যেভাবে পাকিস্তানের প্রেমে মজেছে, তাতে উদ্বেগাকুল হচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারত। সিমলা এবং দিল্লী চুক্তির পর আমরা আশা করেছিলাম উপমহাদেশে হয়তো একটা শান্তিময় ও স্বস্তিকর আবহাওয়া গড়ে উঠবে। কিন্ত যতোই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে আমরা ততেটাই অশনি সংকেতের আশঙ্কায় অধীর চঞ্চল হয়ে উঠছি। তাহলে কি ভুট্টো সাহেব শান্তির নামাবলী অঙ্গে জাড়িয়ে জল ঘোলা করার কর্দমাক্ত পথে বেছে নিচ্ছেন?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো সাহেব ঘড়েল আদমী, কুটিল রাজনীতিক। কখন যে তিনি ডিগবাজী খান আর কখন যে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, তা আমাদের বোঝার মতো মন ও মানসিকতা কোনোটাই আজ আর অবশিষ্ট নেই। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গাঁটছড়া বন্ধন আগেও ছিল, এখনো আছে। পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রশালা চীনের সহযোগিতায় যদি নির্মিত হয়-ই, আমরা অবাক হবো না। এবং বিন্দুমাত্র বিস্মিত হবো না, যদি ভুট্টো সাহেব এই নির্মিতব্য ক্ষেপণাস্ত্র কারখানার কারবার জাঁকিয়ে প্রতিবেশী দেশকে নাকে দড়ি দিয়ে নাচাতে কোশিশ করেন। পাকিস্তানকে একদিকে চীন দিচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, অপরদিকে ফ্রান্স দিচ্ছে মিরাজ কারখানা। পাকিস্তানের সমরসজ্জা যে বেশ জোর কদমেই এগিয়ে চলেছে, তা বুদ্ধিমানের জন্যে ইশারাই কাফি। প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের প্রতি চীনের এই অঢেল সামরিক বদান্যতা কেন? বৈষয়িক বুদ্ধির চেয়ে চীনের রাজনীতিক এবং সামরিক লক্ষ্যটাই এহেন তৎপরতার একমাত্র অভিষ্ট লক্ষ্য। পঁয়ষট্টি এবং একাত্তর সালের চীনের ভূমিকা এক্ষেত্রে স্মরণীয়। সেই সময়ে চীন পাকিস্তানকে মিত্রতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের মনোভঙ্গিও এখন আর অপ্রকাশ্য নেই। সব কিছুই যখন দিবালোকের মতো ফর্সা হয়ে গিয়েছে, তখন আর নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়াটা কি চীনের পক্ষে শোভনীয়? পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক গাঁটছড়া দুই দেশের সরকারই অঘোষিত রেখেছে, কিন্তু তাতে কি আসল সত্য ধামাচাপা থাকতে পারে? তাই, চীন এবং পাকিস্তান অবৈধ সামরিক সম্পর্ক পাতাতে বাধ্য হয়েছে। এই সামরিক সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের ভবিষ্যত যে কি ভয়াবহ তা বোধ হয় কোনো পক্ষই দিব্যদৃষ্টি উম্মিলন করে খতিয়ে দেখার অবকাশ পায়নি কিংবা তোয়াক্কা করেনি কোনো অশুভ ঘটনার, অমঙ্গল চিন্তার। সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে, উপমহাদেশে শান্তিকামিতার শুভাশুভ চিন্তার বিলয় ঘটতে যাচ্ছে, সামনে অপেক্ষা করছে এক অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘোর দুর্দিন। ‘শান্তি শান্তি’ বলে আমরা গলায় রক্ত তুলে যতোই চিৎকার করি না কেন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে আঁৎকে ওঠাটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি, চোরা কখনো ধর্মের কাহিনী শোনে না। ভুট্টো সাহেবের অবস্থাও হয়েছে তথৈবচ। নাগিনীরা উপমহাদেশের শান্তির বাতাসকে বিষাক্ত এবং কলুষিত না করে ছাড়বে না বলেই তো এখন বোধগম্য হচ্ছে। পাক নেতা ভুট্টো এবং টিক্কা সাহেব সমর সম্ভারের জোরে ‘তিড়ি বিড়িং’ করে যতো ইচ্ছে ততো নাচুন, কিন্তু সাবধান, ক্ষেপণাস্ত্রের গর্বে ক্ষ্যাপামো করে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতার নতুন করে আর পরিচয় দেবেন না। ‘শান্তি’ নামক সোনার হরিণ এ উপমহাদেশে একদিন ধরা পড়বেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!