মুক্তাঞ্চলে নতুন জীবন গড়িতে হইবে
[নিজস্ব বার্তা পরিবেশক] আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অনেক অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে। নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হইতেছে। মুক্তাঞ্চলের মানুষ দখলদার শত্রুসেনাদের কবলমুক্ত হইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিতেছেন এবং মাতৃভূমির বাকী অংশ মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযােগিতা করিতেছেন। কিন্তু এই সঙ্গে মুক্তাঞ্চলে দেখা দিয়েছে অনেক জটিল সমস্যা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকাগুলির পুনর্গঠন, জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তােলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ জরুরী হইয়া দেখা দিয়াছে। আমাদের প্রতিনিধি সম্প্রতি রংপুর জেলার ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটগ্রাম ইত্যাদি মুক্তাঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়া এই সকল সমস্যার কথা জানাইয়াছেন।
পাকবাহিনীর পােড়ামাটি নীতি
সর্বত্রই পিছু হটার সময় পাক বাহিনী পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ করিয়া সৰ কিছু জ্বালাইয়া পুড়াইয়া ধ্বংস করিয়া দিতেছে। মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতির মুখে ভুরুংগামারী ও নাগেশ্বরী থানা ত্যাগ করার সময় হানাদার শয়তানরা গ্রামবাসীদের উপর এলােপাথাড়ি গুলি চালাইয়া তিন শতাধিক লােককে হত্যা করে, বহু বাড়ি ঘর জ্বালাইয়া দেয়, এমন কি পেট্রোল দিয়া জমির পাকা ধানে আগুন ধরাইয়া দেয়। কয়েকটি সড়ক সেতুও পাক সেনারা যাইবার সময় ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। নিজ দলীয় রাজাকারদেরও পাক সেনারা গুলি করিয়া হত্যা করিয়া গিয়াছে। এইভাবে শত্রুসেনারা পূর্ব দখলকৃত গ্রামগুলিকে যাইবার সময় শ্মশানে পরিণত করিয়াছে। মুক্তাঞ্চলে নিজ বাড়ি ঘরে যাহারা ফিরিয়া আসিতেছেন, তাহাদের আশ্রয় নাই, বস্ত্র নাই, ক্ষেতের ধান বিনষ্ট হওয়ায় খাদ্যও নাই। মুক্তাঞ্চলের জনগণকে বাঁচাইবার জন্য এখনই জরুরী ভিত্তিতে রিলিফের ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। যাহাদের ঘর বাড়ি নাই তাহাদের পুনর্বাসনের জন্য ঘর তুলিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। খাদ্য ঔষধপত্র ও চিকিৎসকের তীব্র অভাব রহিয়াছে।
অর্থনীতি
মুক্তাঞ্চলগুলি অর্থনৈতিক দিক হইতে কার্যত বদ্ধ এলাকায় পরিণত হইয়াছে। স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য নাই । এই সকল অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য পূর্বে দখলকৃত এলাকার সহিত মুক্ত থাকায় এখন সরবরাহের ক্ষেত্রে দারুণ অসুবিধা দেখা দিয়াছে। নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র অভাব, ক্ষেত্র বিশেষে দারুণ উচ্চমূল্য। লবণ, কেরােসিন, দেশলাই, আটা, চিনি ইত্যাদি প্রায় পাওয়াই যায় না। লবণ প্রতি সের কোথাও কোথাও ৫ টাকা ও কেরােসিন ৮ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। গরীব ক্ষেত মজুর, দিনমজুর ও সাধারণ কৃষকের এইগুলি ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এই শ্রেণীর জনগণের হাতে এখন কোন কাজও নাই। এই সকল এলাকায় প্রধান অর্থকরী ফসল পাট ও তামাক যাহাদের ক্ষেতে কিছু আছে। তাহারাও দাম পাইতেছে না।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, মুক্তাঞ্চলে সরবরাহ ও কিছুটা স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করার জন্য বাঙলাদেশ সরকারের উচিত প্রতিবেশী ও মিত্র ভারতের সহিত আলাপ-আলােচনা করিয়া ভারত ও মুক্তাঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য চালু করা। তবে, সেরূপ ক্ষেত্রে যাহাতে বিশৃঙ্খলা ও অবাধ মুনাফার প্রবণতা দেখা না দেয় তাহার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের প্রয়ােজনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য সরকারী নিয়ন্ত্রণে ও কো-অপারেটিভ ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত বলিয়া তাহারা মনে করেন।
প্রশাসন
মুক্ত অঞ্চলসমূহে বাঙলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু হইতেছে। আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, রংপুরের মুক্তাঞ্চলগুলিতে থানা প্রশাসন চালু হইয়াছে, অসামরিক প্রশাসনের জন্য অনেক এলাকায় আঞ্চলিক কাউনসিল গঠন করা হইতেছে, বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ও শুরু হইয়াছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কিছু কিছু খােলা হইতেছে। ভুরুংগামারী ও নাগেশ্বরী এলাকায় সরকার হাট-বাজার হইতে তােলা আদায় করিতেছেন। প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের নাম করিয়া কোন কোন স্থানে উচ্চ হারে তােলা আদায় হইতেছে বলিয়া কৃষকরা অভিযােগ করিতেছেন। এই বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া প্রয়ােজন। বর্তমান অবস্থায় শুধু স্বচ্ছল ব্যবসায়ীর নিকট হইতেই ভােলা আদায় করা উচিত বলিয়া মুক্তাঞ্চলের মানুষ মনে করেন।
প্রয়ােজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
মুক্তাঞ্চলের বহুমুখী জটিল সমসা সমাধানের জন্য প্রয়ােজন দক্ষ দুর্নীতি মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তােলা। ইহার জন্য বাঙলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধে শরিক সকল দলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়ােজন। হানাদার পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হওয়ার পর কোন এলাকায় যাহাতে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা না দেয় তাহার জন্য প্রশাসনে জনগণ ও সকল গণতান্ত্রিক দলের সক্রিয় অংশ গ্রহণ সম্ভব করিয়া তুলিতে হইবে। পুনর্গঠনের কঠিন কাজকে সম্ভব করিয়া তােলার জন্য সর্বদলীয় ভিত্তিতে প্রশাসনিক কাঠামাে দাঁড় করান প্রয়ােজন।
কিন্তু এ যাবৎ যে-সকল জোনাল, সাব-জোনাল, থানা ও ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হইয়াছে, সেগুলি কোনটিই সর্বদলীয় ভিত্তিতে গঠিত হয় নাই। শুধু অফিসারদের, বড়জোর অফিসার ও আওয়ামী লীগের লােকজন লইয়া গঠিত হইয়াছে। অথচ সব জায়গাতেই স্থানীয় জনসাধারণ দলমত নির্বিশেষে তাহাদের বিশ্বাসভাজন নেতৃবৃন্দকে এই সব প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত দেখিতে চান।
মুক্তাঞ্চলের থানাগুলিতে পুলিস ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায়শই নগণ্য। এক্ষেত্রে সকল সংগ্রামী দল ও গণসংগঠন হইতে যুবকদের নিয়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়িয়া তােলার প্রয়ােজনীয়তা মুক্তাঞ্চলের মানুষ অনুভব করিতেছেন।
পুনর্বাসন, খাদ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে-তীব্র অভাব রহিয়াছে, সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করিয়া উহার কাজের সহিত সরকারী প্রশাসনের সমন্বয় সাধন করিয়া তাহা মােকাবেলা করিতে হইবে। ইতিপূর্বে ফুলবাড়ির মুক্তাঞ্চলে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনের সংবাদ ‘মুক্তিযুদ্ধে’ প্রকাশিত হইয়াছে। এইরূপ রিলিফ কমিটি সকল মুক্তাঞ্চলে গড়িয়া তােলা দরকার।
জনগণের মনােবল অটুট আছে
আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, মুক্তাঞ্চলের সর্বত্রই বীর মুক্তিযােদ্ধাদের জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করিতেছেন। মুক্তাঞ্চলের যুবকরাও মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুকবলমুক্ত করার সংকল্প লইয়া ট্রেনিং গ্রহণ করিতেছেন এবং জনগণ মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযােগিতা করিতেছেন।
রংপুর রণাঙ্গনে পলায়নপর জনৈক পাকিস্তানী অফিসার তাহাকে নদী পার করিয়া দেওয়ার বিনিময়ে কয়েক জন গ্রামবাসীকে তের শত টাকা দিতে চায়। গ্রামবাসীরা পাক অফিসারটিকে সাহায্য করার ভান। করে এবং তাহাকে পােশাক বদলাইয়া লুঙ্গি পরিতে বলে। অফিসারটি হাতের অস্ত্র মাটিতে রাখিয়া গ্রামবাসীদের দেওয়া লুঙ্গি পরিতে শুরু করিলে এই সুযােগে তাহারা অফিসারটিকে পাকড়াও করিয়া মুক্তি বাহিনীর হাতে সমর্পণ করে। অপরিসীম দুঃখ কষ্ট ও চূড়ান্ত ত্যাগের মধ্য দিয়া লড়িয়া সাড়ে সাত কোটি মানুষ শত্রুমুক্ত বাঙলাদেশে নবজীবনের স্বপ্ন দেখিতেছেন। তাঁহাদের এই স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হইবে তাহা বুঝা। যাইবে মুক্তাঞ্চলগুলি দেখিয়া। তাই সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় মুক্তাঞ্চলগুলিকে ভবিষ্যৎ বাঙলাদেশের আদর্শ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। ইহা হইতে শত্রু কবলিত অঞ্চলসমূহের জনগণও মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিতে অনুপ্রাণিত হইবেন। মুক্তাঞ্চলের জনগণের আশা-কি জন প্রশাসন-কি অথনৈতিক-কি সামাজিক কাঠামাে-কোন ক্ষেত্রেই যেন পূর্বতন পাকিস্তানের দুর্নীতি, অসাম্য আর শােষণের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ২২ ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪