অভিবাদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে আফসার অচিরেই পূর্বদিগন্তে নবসূর্য
১৬ই নভেম্বর, ভালুকা। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে গতকাল ১৭৫ জন মুক্তিযােদ্ধা ফিরে এসেছেন। তারা ভালুকা থানার মুক্তাঞ্চলে এক সমাবেশে মিলিত হয়ে ময়মনসিংহ (সদর দক্ষিণ) ঢাকা (সদর উত্তর) মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক আফসারকে অভিবাদন জানান। আফসারের এ অভিবাদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে এক বিরাট জনতা উপস্থিত ছিলেন। অভিবাদন গ্রহণ করার পর তিনি বলেন, ইনশাল্লাহ, অচিরেই পূর্বদিগন্তে নবসূর্য উদিত হয়ে রক্তিম আভা বিস্তার করবে। তিনি তাঁর ভাষণে সম্মিলিত জনতা ও মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, যে দেশের সামরিক শক্তি জনশক্তির সাথে মিশে যেতে পারে, সেদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। আবার সেদেশে সামরিক শক্তি এবং জনশক্তির দু’টি পরস্পরবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেদেশ কোনদিন শক্তিশালী হতে পারে না। বরং ধ্বংস হয়ে যায়। অতএব কোন দেশকে শক্তিশালী হতে হলে সামরিক শক্তি এবং জনশক্তির সমন্বয় আবশ্যক সুখের বিষয় এই যে, আমাদের স্বাধীনতাকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযােগ্যভাবে সাড়া দিয়েছেন। তিনি জনগণকে সক্রিয় সাহায্য ও সহযােগিতা করার জন্য তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের সহানুভূতি ও সহযােগিতার জন্যেই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে চলছে। আপনারাই আমাদের সাহস ও শক্তির মূল উৎস। আশা করি স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত আপনারা আমাদেরকে এরূপ সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে যাবেন। মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে লড়ছি। গণচীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, আলজিরিয়া প্রভৃতি দেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়নি।
ইন্শাল্লাহ, আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হবে না। আমরা জিতবােই! বৃহৎ শক্তিবর্গ যদি হস্তক্ষেপ না করে তবে তিনমাসের মাঝেই আমরা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করবাে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের চোখের জল মুছে দেয়ার জন্যে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে বহু মুক্তিবীর পশ্চিমা পশুদের হাতে শহীদ হয়েছেন। আমরা তাদের মহান ত্যাগের আদর্শকে বাস্তবায়িত করবােই। নতুবা তাঁদের শহীদী আত্ম আমাদেরকে অভিশাপ দেবে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদেরকে জনসাধারণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনারা আজ হাতে অস্ত্র নিয়েছেন; তাই বলে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করতে চেষ্টা করবেন না; তাহলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়ে পড়বে। আজ আপনার হাতে যে অস্ত্র স্থান পেয়েছে তা জনগণই তুলে দিয়েছেন। এর সদ্ব্যবহার করবেন। আর যদি এ অস্ত্রকে ব্যক্তিগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তবে জনগণ আপনাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তিনি পাকিস্তানের কিছু ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন হতেই বাংলাদেশকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আমাদের ন্যায্য অধিকারকে ওরা কোনদিনই স্বীকার করে নেয়নি।
যখনই আমরা আমাদের অধিকার দাবী করেছি, তখনই আমাদের সেদাবীকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যে ওরা চালিয়েছে সামরিক স্টিমরােলার। এবারও তারা এ পরিকল্পনাই নিয়েছিল। কিন্তু আমরা তার দাত ভাঙ্গা জবাব দেবাে। আমাদেরকে কর্তৃত্বহীন করার জন্যে ওরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আটক করেছিল। কিন্তু ওরাতাে জানতাে না যে বাংলার প্রতি মানুষ একেকজন শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের নির্দেশে বাংলার প্রত্যেকটি ঘর একেকটি দুর্গে পরিণত হয়েছে। আমরা দরকার হলে মহান নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানের জেল ভেঙে মুক্ত করে নিয়ে আসবাে। পরিশেষে রেজাকারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে, অনেকেই চাপে পড়ে রেজাকার হয়েছে। কিন্তু এখন তারা চলে এলে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দিত করা হবে। না হলে তাদেরও হবে পাকসেনাদের মতাে বিভীষিকাময় পরিণতি।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১: ৭ ২৮ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪