You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তাঞ্চলের জনগণের প্রতি পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের বক্তব্য

বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা বর্তমানে বীর বাংলার মুক্তি পাগল সেনারা দখল করে নিয়েছে। এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলাদের হাতে মার খেতে খেতে পাক বর্বর সেনারা দিন দিন মনােবল হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। সেদিনও হয়তাে বেশী দূরে নয় যেদিন সমস্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রূপে বিশ্বের মানচিত্রে সােনালী অক্ষরে “সােনার বাংলা” স্থান পাবে।  বাংলাদেশের যে সকল এলাকা পূর্বে মুক্ত হয়েছে, সদ্যমুক্ত এবং যে সকল এলাকার সম্মুখে শত্রুসেনাদের বিবর ঘাটি অবস্থিত, সে সকল এলাকার জনসাধারণ নানবিধ অসুবিধার মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের সুষ্ঠু জীবনধারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধ কার্যে অগ্রগতির জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রশাসন ব্যবস্থার সহিত মুক্তাঞ্চলের জনগণের সহযােগিতা একান্তভাবে কামনীয়। প্রশাসন ব্যবস্থায় যে অস্থায়ী কাঠামাে এবং কার্য বিবরণ কার্যকরী হতে যাচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।  বিচার বিভাগ জনগণ নানাবিধ সমস্যার মধ্যে জীবন যাপন করছেন। নিজেদের মধ্যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করবেন না। আপনাদের নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণরূপে সচেতন, আপনার নিকটস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির নিকট আপনার সমস্যাবলী পেশ করুন। মনে রাখবেন এ সরকার আপনার দ্বারা গঠিত আপনার জন্য। 

পুলিশ বাহিনী :-যুদ্ধ কালীন অবস্থায় নিরীহ গ্রামবাসীদের নানাবিধ দুষ্কৃতিকারী ও অশান্তি সৃষ্টিকারীদের সম্মুখীন হতে হয়। মুক্তিবাহিনী নামধারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারী জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারে। আপনার নিকটেই পুলিশ বাহিনী রয়েছে-আপনারই শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং যখনই কোন দুষ্কৃতিকারী ও অশান্ত সৃষ্টিকারী টাউটের সম্মুখীন হবেন তখনই পুলিশ বাহিনীর হাতে তাদেরকে সমর্পণ করুন।

স্বাস্থ্য বিভাগ : যুদ্ধ কালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা ও গেরিলা বাহিনী ছাড়াও মুক্তাঞ্চলের জনগণ অসাবধানতা বশত: যে কোন মুহুর্তে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আহত হতে পারে। যে যেখানেই যখনই কোনরূপ গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই তাকে নিকটস্থ বাংলাদেশ সরকারের হাসপাতালে প্রেরণ অথবা নিকটবর্তী ডাক্তারকে সংবাদ দিতে সচেষ্ট থাকবেন। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা যেমনি একজন মুক্তিযােদ্ধা তেমনি আপনিও একজন মুক্তি সংগ্রামী  সুতরাং আপনার ক্ষতি দেশের ক্ষতি। উন্নয়ন পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও সাহায্য :-দীর্ঘ আট মাস যাবত শত্রু সেনারা সােনার বাংলাকে মরণ। কামড় দিয়ে শ্মশানে পরিণত করে চলছে। তদুপরি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর যান-বাহন চলাচল এবং জনসাধারণের স্বল্প সময়ে সহজতর উপায়ে সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সহিত যােগাযােগ, এবং ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণের পুনর্বাসন ও সাহায্য করার জন্য উক্ত উন্নয়ন বিভাগের সহিত সহযােগিতা রক্ষা করে চলুন।

ক্ষতি নিরুপণ :-পাক সামরিক বাহিনীর বর্বর সেনা, বাংলাদেশের মীরজাফর গােষ্ঠির দালাল, শান্তি কমিটি ও শেষ পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালী রাজাকারেরা মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে যে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও সর্বশেষে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত আজ সর্বজন বিদিত। বাড়ীঘর লুঠপাঠ থেকে শুরু করে অগ্নিসংযােগ করতে তারা দ্বিধা বােধ করেনি। তদুপরি বর্বর বাহিনীর অসংখ্য গােলাগুলির আঘাতে আজ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল কেন, অধিকৃত অঞ্চলের দিকে তাকালেও তার পূর্বের স্বরূপ এর অংশও পাওয়া যায় না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আপনার ক্ষতি নিরুপণের দায়িত্ব উক্ত বিভাগের উপর ন্যাস্ত করেছেন। তাই অবিলম্বে আপনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে উক্ত বিভাগের গােচরীভূত করুন। ব্যবসা ও বাণিজ্য যুদ্ধ কালীন অবস্থায় সাধারণত: উৎপাদন, আমদানী রপ্তানী ইত্যাদির কাজ প্রায়ই বন্ধ। জনসাধারণ অন্যান্য জিনিষ পত্র পাওয়া দূরে থাকুক দৈনন্দিন জীবন ধারণের জন্য নিত্য। প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্র উচ্চ মূল্য দিয়েও পাচ্ছে না। তাই সরকারের তরফ থেকে জনসাধারণ যাতে ন্যায্য মূল্যে নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্র পেতে পারেন তার একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা করছেন। ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অধিক দাম দিয়ে জিনিষপত্র কিনবেন না-কালােবাজারী বন্ধ করুন। কালােবাজারীকে ধরিয়ে দিন। মনে রাখবেন কালােবাজারী-সামাজিক অপরাধী। শত্রুদের কোন পণ্য ব্যবহার করবেন না। 

সংযােগ রক্ষাকারী (বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সহিত) :-বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা ও গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা রাত দিন ব্যাঙ্কারে, বনে জঙ্গলে দিন কাটাচ্ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য শত্রু সেনাকে খতম করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাদের এই অগ্রগতির পিছনে আপনাদেরও সাহায্য। প্রয়ােজন আছে। শত্রু সেনাদের গােপন খবর আপনার নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিন। ভ্রান্তিমূলক খবর দিয়ে শত্রু সেনাদের বিপর্যন্ত করুন। গােলাবারুদ, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি। তাড়াতাড়ি সরবরাহ করে মুক্তি বাহিনীকে যুদ্ধ জয়ে এগিয়ে দিন। তারা আপনাদেরই ভাই-এ দেশ। আপনাদেরই-শত্রুকে তাড়াতেই হবে, এই পণ নিয়ে যে যেভাবেই পারুন সাহায্য করুন, এর জন্য। রয়েছে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সহিত বেসামরিক সংযােগ রক্ষাকারী-অবিলম্বে তাদের সাথে যােগাযােগ করুন, এক মুহূর্ত নষ্ট করবেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামের আপনিও একজন সৈনিক।

তথ্য ও প্রচার :-যুদ্ধকালীন অবস্থায় শত্রু সেনাদের গােপন খবর সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আপনার নিকটে যদি কোন মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর না থাকে তা হলে তথ্য ও প্রচার দফতরে সামরিক বিষয়ের গােপন খবরাদি সরবরাহ করুন। গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দেবেন না। মনে রাখবেন-দেওয়ালেরও কান আছে। জনগণের মনােবল বাড়িয়ে তুলুন। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করুন।  কৃষি ও সেচ :-দেশের অর্থনেতিক কাঠামােকে শক্ত করতে হলে প্রথমেই প্রয়ােজন কৃষিজাত দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা। বাংলাদেশের কিছু অংশ এখনও শত্রু কবলিত। অধিক পরিমাণে ধান, পাট ইত্যাদি উৎপাদনে এগিয়ে আসুন।  বেসামরিক প্রতিরক্ষা :-অসাবধানতাবশত: নিরীহ জনসাধারণ যে কোন সময়ে শত্রুর বিমান ও স্থল আক্রমণের শিকার হতে পারেন। অবিলম্বে বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের শরণাপন্ন হউন-সাবধানের মার নেই। 

শিক্ষা :-অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। অবিলম্বে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায় চালু করা হবে। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ এখনও বিবেচনাধীন। ছােট ছােট শিশুরা যাতে বই পুস্তক নাড়াচাড়া করতে পারে তাতে এগিয়ে আসুন। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।

ডাক বিভাগ :-মুক্তাঞ্চলে দ্রুত যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্য সরকার অনতিবিলম্বে ডাক বিভাগ চালু করছেন। বাংলাদেশের নতুন আঙ্গিকের ডাক টিকিট, খাম, পােষ্ট কার্ড জনগণের ব্যবহারের জন্য প্রচার করা হবে।  শুল্ক অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানী করে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করুন এবং সীমান্ত চৌকিতে শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনেতিক দিয়ে এগিয়ে নিন।  উপরােক্ত বিভাগগুলি ছাড়াও কোষাগার ও রাজস্ব বিভাগও কাজ করতে থাকবে। সময়মত জনগণের নিকট ইহাদের বিস্তারিত কার্যবিবরণ প্রচার করা হবে। মুক্তাঞ্চলের জনগণের দায়িত্ব স্বাধীনতার জন্য অনেক। তাই-যে যে ভাবেই পারেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। অংশ নিন। দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত হবেন না-কাউকে করতেও দেবেন না। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন বাঙ্গালী জাতি হিসেবে নিজেকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরবার জন্য তৈরী হউন।

আমার দেশ ॥ ১ : ১৩ ॥ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!