You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10 31 | তেতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে কয়েকদিন - সংগ্রামের নোটবুক

তেতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে কয়েকদিন

(পর্যবেক্ষণ). মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের প্রতিহত ও পদানত করে দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড় রনাঙ্গণে দিনের পর দিন সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। বিরাট অঞ্চল জুড়ে আমাদের মুক্তি যােদ্ধারা শত্রুর মুখােমুখি ঘাটি স্থাপন করেছে। সবুজে ঘেরা বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল আমার হৃদয়ে নূতন আশার সঞ্চার করলাে। মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধারা সামরিক গাড়ীতে চড়ে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে তাদের বিজয়ের আনন্দে প্রকাশ করতে করতে চলে গেল । আমার বুক ভরে গেল সেই মােহনীয় দৃশ্যে কিছুক্ষণ পরে মনে হলাে আমার সােনার বাংলার সাড়ে ছয়কোটি ভীত সন্ত্রস্থ অবরুদ্ধ ভাইবােনদের কথা-তাহারা অহরহ জীবনের সাথে লড়াই করছে—মৃত্যুকে বুকে চেপে আছে আর দিন গুনছে কোন দিন বিজয়ের জয় টিকা পরে মুক্তি বাহিনী তাদের মুক্ত করে শত্রু সেনার শত অত্যাচারে ভীত না হয়ে বীর গেরিলাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করছে।

২৫শে মার্চের পর থেকে তেতুলিয়া হতে ভােজনপুর পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ এলাকা আগাগােড়া মুক্তি বাহিনীর দখলে। প্রশাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে চালনা করে আসছে ঐ অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা ও গণ প্রতিনিধি জনাব সিরাজুল ইসলাম। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে জানবার চেষ্টা করলাম কি করে এতবড় অঞ্চল কামান বােমা বিমান আক্রমণের হাত হতে রক্ষা পেল । তেতুলিয়া হতে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত প্রায় বিশদিন ধরে বিভিন্ন। রণাঙ্গনে যুদ্ধ চলতে থাকে শেষ পর্যন্ত বিমান হতে বােমা নিক্ষেপের ফলে ঠাকুর গাঁও পর্যন্ত প্রতিরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ১৫ই এপ্রিল পঞ্চগড় রনাঙ্গনে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাক সেনাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। | শেষে বিমান আক্রমণের মুখে দিশেহারা হয়ে যায় তবু পাকসেনা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। আমাদের মুক্তি বাহিনী প্রতিরক্ষাকে আরাে সুদৃঢ় করবার জন্য ভােজনপুরে ১৬ই এপ্রিল চলে যায় বিমান আক্রমণে প্রাণ বাঁচাবার জন্য উদ্যোগী কর্মী ও পরিষদ সদস্যরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জনাব সিরাজুল ইসলাম ভােজনপুরে কিছু সংখ্যক ই, পি, আর নিয়ে চলে আসে-বিমান আক্রমনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কর্মঠ আওয়ামী লীগ নেতা ষ্টেনগান তুলে ধরে এবং জোয়ানদের বুঝাতে থাকে দেশমাতৃকার জন্য আমরা প্রাণ দিব তবু পরাজয় বরণ করে নেব না। দেশকে রক্ষা করা, মুক্ত করা। আমাদের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু বলেছেন শত্রুর মােকাবিলা করতে। আমাদের দেশমাতা মুক্তির জন্য যতরক্ত চায় ততরক্ত দিব এবং আমাদের দেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে। এর পর মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে আর পিছনের দিকে যাব না হয় মৃত্যু নয় আমাদের সুনিশ্চিত বিজয়। মুক্তির জন্য জীবন দিব। শেষে বলেন আমি এই রণাঙ্গনে আপনাদের সাথে রণাঙ্গনে থাকবাে। খাদ্য ও রসদ আমার হাতে আছে-চিন্তার কারণ নাই।

সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দীন সাহেব ঐ সময় মাত্র ৪৮ জন ইজি আর নিয়ে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা গঠন করে এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শত শত ইজি, আর মিলিটারী আনসার, মুজাহিদ ছাত্র, শ্রমিক, প্রতিরক্ষার জন্য ভােজনপুরে এসে উপস্থিত হয়, আজ তাদের নাম হয়েছে মুক্তি বাহিনী-মৃত্যুকে ভ্ৰকুটি করে জীবন বাজী রেখে শত্রুর ব্যুহ ভেদ করে তারা এগিয়ে চলেছে সম্মুখ পানে প্রাণাধিক প্রিয় দেশকে মুক্ত করবার জন্য তাদের গতি রােধ করবে পাক সেনাদের সে শক্তি আর নেই। শতাধিক বার বিমান হামলাও কামান দেখে পাক সেনারা প্রতি বারেই পরাজয় স্বীকার করে পিছু হঠেছে—আমাদের মুক্তি  সেনারা এই কয়মাসে বিরাট অঞ্চল দখল করেছে এবং বে-সরকারী প্রশাসন চালু হয়েছে। জনাব সিরাজুল ইসলাম এম, পি, এ এখন মুক্ত অঞ্চলের প্রশাসন উপদেষ্টা মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ ভার প্রতিরক্ষা দফতর নিয়েছে। জনাব খাশারক হােসেন এম, এন, এ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন কাজে সহায়তা করছে।  হাসপাতালে যথেষ্ট আহত মুক্তি সেনা রয়েছে। তাদের দুর্জয় সাহস দেখে কেহ মুগ্ধ না হয়ে পারে | না। তারা সবাই বললাে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর আবার তারা দেশকে মুক্ত করার জন্য শত্রু নিধনে রণাঙ্গনে যাবে । তেতুলিয়া হতে ভােজন পুর পর্যন্ত মুক্তি সেনারা টহল দিচ্ছে যাতে কোন পাকিস্তানী এজেন্ট মুক্ত অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। তেতুলিয়ার জেলখানায় অনেকগুলাে পাক গুপ্তচর ধরা আছে।  হিমালয়ের পাদদেশে এই সুন্দর জায়গাটার আমাদের দ্বিতীয় রাজধানী হলে খুব ভাল হবে, সরকারী মহল ও নাকি এ নিয়ে চিন্তা করছে। বাঙলা দেশের প্রধান মন্ত্রী ও মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মুক্ত অঞ্চলে দুবার গিয়েছে, প্রতিরক্ষা কেন্দ্র ও বে-সরকারী দফতর গুলােও পরিদর্শন করেছে। অন্যান্য মন্ত্রী অধিকাংশ সময় এই অঞ্চলে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তি যােদ্ধাদের আত্মত্যাগকে অভিনন্দন জানিয়ে এমাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক বক্তৃতা দেন। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ও আমার সাক্ষাৎ হয় তাহারাও মুক্ত অঞ্চলের প্রশাসনের প্রশংসা করেন।

মুক্ত অঞ্চল দেখবার জন্য দেশী বিদেশী সাংবাদিকরা প্রায় তেতুলিয়াতে যেয়ে থাকেন ও সংবাদ সংগ্রহ করেন। সামরিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা সর্বস্তরের জনসাধারনের সঙ্গে সহৃদয় যােগাযােগ রক্ষা করছে । সেক্টর কমান্ডার বাসার সাহেব একজন অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল যুদ্ধ পরিচালক রয়েছেন সেখানে, জনাব সিরাজুল ইসলাম সাহেব সহযােগিতা করছেন বেসামরিক প্রশাসনে। মুক্ত অঞ্চলের সর্বত্র বাংলাদেশের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়ছে। সে দৃশ্যে মনে পড়ছিল আমার জীবনের বহু স্মৃতি জড়িত আবাসিক হলটির কথা যেখানে ত্রিবর্ণ পতাকাটি প্রথম উড়েছিল। সে হল আজ শত্রু সেনারা দখল করেছে গুলি গােলায় তা আজ ক্ষত বিক্ষত বিধ্বস্ত। আমাদের মুক্ত সেনারা আবার ঢাকা দখল করবে ফিরে যাবে আমার মত স্মৃতি কথার প্রিয় আবাস। আমাদের মুক্তি বাহিনীর কথা ঢাকা চল ঢাকা চল। তেতুলিয়ার মুক্ত বাতাস আজ মুক্তিকামী বাঙ্গালীর সেরা পবিত্রস্থান সে যে আমাদের দেশ আমাদের দেশের মাটি-আসবার সময় চোখে পড়লাে সবুজ ধানের শিষ বাতাসে সে আন্দোলিত হচ্ছে-সেদৃশ্যে মনে পড়লাে।  আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি তােমার আকাশ তােমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

দাবানল ॥ ১: ৪ ॥ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪