সােভিয়েতের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা
আজ ১৬ ডিসেম্বর । বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে হেনরি কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, চীনের জন্য অবিশ্বাস্য বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেন। ‘৭১ এর এ দিনে ওয়াশিংটন সময় সকাল সাড়ে ৯টায় নিক্সন ও কিসিঞ্জারের টেলি সংলাপের ট্রান্সক্রিপশন থেকে দেখা যাচ্ছে, যখন ঢাকায় আত্মসমর্পণের তােড়জোড় চলছে, তখনাে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নিক্সন বলছেন, ভারত যদি তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে, তাহলে আমরা এমনকি দিল্লির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত নেব। আপনি কি একমত নন হেনরি? ‘আমি একমত। ইতােমধ্যেই একটি শক্তিশালী বিজয় বিবৃতি ঘােষিত হয়েছে। এবং তা চীনাদের জন্য এক অবিশ্বাস্য অভিঘাত। এর কোনােটিতেই অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই তাদের অপদস্থ করেছে।’ কিসিঞ্জার এই প্রথম নিক্সনকে। জানালেন, জর্ডান ১৭টি প্লেন পাঠিয়েছে। দুই নেতাই পশ্চিম পাকিস্তান প্রশ্নে রাশিয়ার মনােভাবে সংশয়গ্রস্ত থেকেই খুঁটিনাটি আলােচনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তান প্রশ্নে কোনাে হুমকি দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য কী ব্যবস্থা নিতে পারে তা নিয়ে তারা মতবিনিময় করেন। নিক্সনের মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের আলােচনা বন্ধ করে দিন, ইসরায়েলকে তুলে দিন অস্ত্র ভেঙে দিন সল্ট আলােচনা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পরিষদ প্রকাশ্যে এর ভয়ঙ্কর দিক সম্পর্কে বিবৃতি দিক। আমি প্রয়ােজনে আরাে বহুদূর যাব। বাণিজ্যসংক্রান্ত আলােচনা আমরা বন্ধ করে দেব। এবং আনাতলি দোবরিনিনের সঙ্গেও যে কোনাে পরিস্থিতিতে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে।’ পশ্চিম পাকিস্তানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কার্যকর না হলে নিক্সন নির্দেশ দেন বাজেট থেকে প্রদেয় ভারতের কাছ থেকে সব সাহায্য কেড়ে নিতে।
নিক্সন ১ ঘন্টার মধ্যে ভারতকে কী কী উপায়ে শায়েস্তা করা যায় তা জানাতে নির্দেশ দেন। কিসিঞ্জারের সঙ্গে এই সংলাপ শেষের অল্প পরেই ১০টা ৪০ মিনিটে কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানান, ভারত একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেছে পশ্চিম ফ্রন্টে। কিসিঞ্জার ভারতের ওপর এ লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করায় সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আজ নিক্সনকে দেয়া কিসিঞ্জারের এক স্মারকে তথ্য দেন, গত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের পাক ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টাকে সােভিয়েতরা দৃশ্যত উৎসাহিত যেমন করেনি, তেমনি গুরুত্বের সঙ্গে নিরুৎসাহিতও করেনি। এক আলােচনায় (সূত্র ডিক্লাসিফাই করা হয়নি) সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত পেগভ কথিতমতে বলেছেন, পাকিস্তানের যুদ্ধযন্ত্র ইতােমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয় হামলার দরকার ছিল না। কিন্তু তারপরও রুশ পরামর্শ উপেক্ষা করে ভারত যদি পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করে নিতে চায়, তাহলে এটা যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সম্পূর্ণ করতে হবে। এবং সে ক্ষেত্রে সােভিয়েতরা হস্তক্ষেপ করবে না’। পেগভ এবং অন্য আরেক রুশ কূটনীতিক একই দিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছেন। পেগভ বলেছেন, সােভিয়েত নৌবহরও ভারত মহাসাগরে রয়েছে। এবং তারা সপ্তম নৌবহরকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। চীনারা যদি লাদাখে আক্রমণ করে, তাহলে সােভিয়েতরা চীনা প্রদেশ সিনকিয়াংয়ে পাল্টা হামলা চালাবে। এই দলিল থেকে আরেকটি ইঙ্গিত মিলছে যে, সােভিয়েতরা ভারতের স্বপক্ষে সর্বাত্মক অবস্থান গ্রহণ করলেও তারা পাকিস্তানের সঙ্গে অবশিষ্ট সম্পর্ক নস্যাৎ করতে চায়নি। সােভিয়েত উপ-প্রধানমন্ত্রী কুজনেৎসােভ আলােচনাকালে (কার সঙ্গে তা ডিক্লাসিফাই করা হয়নি) বলেছেন, অন্তত ঢাকার পতন এবং পাক সেনাবাহিনীর কবল থেকে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না।
কারণ ইসলামাবাদের সঙ্গে তাদের যতটুকু সখ্য রয়েছে, তা তারা বজায় রাখতে চায়। এ কারণেই ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী সােভিয়েত বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সইয়ে রাজি হয়নি। এই দলিলে আরাে তথ্য দেয়া হয়েছে, সিকিম সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশের (শত্রুপক্ষের অবস্থান জানতে) প্রতিবাদে চীন শক্তিশালী প্রতিবাদ জানিয়েছে। চীন এই তৎপরতাকে ‘ভয়ঙ্কর অনুপ্রবেশ এবং তা অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানায়। কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, এটা সম্ভবত একটা অজুহাত। এর মাধ্যমে চীন ভারত সীমান্তে সীমিত সামরিক অভিযান বাজায় রাখবে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্ট থেকে ভারতের মনােযোেগ সরিয়ে রাখা। কিসিঞ্জার জানান, আমাদের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের কাছে শ্রীলঙ্কার পূর্বে অবস্থান করছে। এদিন নয়াদিল্লিতে স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটায় ইন্দিরা গান্ধী লােকসভায় ঘােষণা করেন, জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় ১ ঘন্টা আগে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। ভারত পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেছে। এবং ভারতের কোনাে ভূখণ্ডগত অভিসন্ধি নেই। কিন্তু মার্কিন নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, পাক রাষ্ট্রদূত এক ব্যাকচ্যানেল বার্তায় কিসিঞ্জারকে জানান, ব্রিটিশদের কাছ থেকে আমি এইমাত্র খবর পেয়েছি, ভারত তাদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য কার্যকর রাখবে। আমি আরাে জানতে পেরেছি, সােভিয়েতরা নিরাপত্তা পরিষদে এমন এক প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে যা বাড়তি বিতর্কের জন্ম দেবে। সুতরাং ইয়াহিয়ার উচিত হবে কালবিলম্ব না করে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়া। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করতে পারবে না। এদিন ভরােনৎসােভ সােভিয়েতের খসড়া প্রস্তাব কিসিঞ্জারকে পড়ে শােনান। নিক্সন একমত হন এ প্রস্তাব আগের চেয়ে উন্নত কিন্তু এখনাে সমর্থনযােগ্য নয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ইকবাল আখুন্দ লিখেছেন, অবজারভার পত্রিকার ১৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় গেভিন ইয়ং লিখেছেন, ইয়াহিয়া নিয়াজিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, আমেরকিান ও চীনা হস্তক্ষেপ আসন্ন। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্টে আপােস ও প্রকৃত আত্মসমর্পণ শীর্ষক। পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারতীয় দল আত্মসমর্পণের জন্য যে দলিলটি নিয়ে এলেন। তাতে বলা হলাে ভারতীয় ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কেউ কেউ আপত্তি তুললেন। বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণের কথাটিতে বাদ সাধলেন। কিন্তু ব্যাখ্যা দেয়া হলাে এই আত্মসমর্পণ আসলে ভারতের কাছে। বাংলাদেশের উল্লেখ শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। নিয়াজি ও তার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকি আপত্তি করেননি। বরং এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তারা একটি যুক্তি দেখাতে চেয়েছেন। আর তা হলাে, তারা এই ভেবে শঙ্কিত ছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের অনুগতদের যদি মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়, তাহলে রক্তপাত অনিবার্য হতে পারে। কমিশন বলেছে, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি এই ভীতি যথার্থ ছিল না। কমিশনের বর্ণনায় একজন প্রত্যক্ষদর্শীও কথিত ভীতির সত্যতা কবুল করেননি। জেনারেল জেকব পাইপ টানতে টানতে বলেছেন, এই খসড়া দিল্লি থেকে এসেছে। কোনাে সংশােধন ছাড়াই এটি সই করতে হবে। কমিশন পক্ষপাত দেখিয়েছে এই অভিযােগের প্রতি নিয়াজি ও বকরের সঙ্গে ভারতীয়দের গােপন সমঝােতা হয়। তাদের পরে বিশেষ আতিথ্য দিতে দেখা গেছে। অরােরাকে অভ্যর্থনা জানাতে নিয়াজির এয়ারপাের্ট গমন ছিল বাহুল্য!’ রিচার্ড সিশন ও লিও ই. রােজ মন্তব্য করেছেন, আত্মসমর্পণের শর্তাবলি। প্রণয়নের উদ্যোক্তা ছিলেন জেনারেল মানেকশ। ১৬ ডিসেম্বর এই দলিলটি জেনারেল জেকব হস্তান্তর করেন নিয়াজির কাছে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন