মস্কোর জবাবের অপেক্ষায় ওয়াশিংটন
আজ ১৩ ডিসেম্বর। স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের দুই পরাশক্তি বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রশ্নে এক বিরল গােপন আলােচনায় যােগ দিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। ওয়াশিংটন নিশ্চিত হতে চাইছে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়তাে অবশ্যম্ভাবী। তারা এটুকু মানতে রাজি কিন্তু ভারতকে কোনাে অবস্থাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর হামলা চালাতে দেয়া যাবে না। আজাদ কাশীর দখলের কোনাে আশা থাকলে তা তাদের ত্যাগ করতে হবে। ভারত যদিও বলেছে, পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের কোনাে ভূখণ্ডগত উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু তাতে ভরসা পাননি নিক্সন ও কিসিঞ্জার। আর সে কারণে মস্কোর সঙ্গে মধ্য ডিসেম্বরের এই দিনগুলােয় ওয়াশিংটনের হটলাইন সক্রিয়। ওয়াশিংটনের কাছে গােপন সূত্রে এমন একটি খবর ছিল, যাতে ভারতের একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিক বলেছেন, কাশ্মীর করায়ত্তের এই সুযােগ হাতছাড়া করা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, মস্কোর সঙ্গে হটলাইন স্থাপনের কারণেই সপ্তম নৌবহরের অগ্রযাত্রা শ্লথ করা হয়। দুই পরাশক্তিই ভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পায়, তারা পাক-ভারত ইস্যুতে আর যা-ই হােক, যুদ্ধে। জড়াবে না।
প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার আজ প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপসহকারী জেনারেল হেগের কাছে এজোর্স দ্বীপ থেকে প্রেরিত এক তারবার্তায় পাক-ভারত সংকট সম্পর্কে তার সর্বশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন। তিনি আজ স্পষ্টই জানিয়ে দেন, যা কিছুই ঘটুক না কেন, সপ্তম নৌবহরকে অবশ্যই ভারত মহাসাগরে পৌছাতে হবে। কিন্তু তাই বলে তাকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নেয়ার দরকার নেই। কিসিঞ্জার প্রশ্ন রাখেন-সপ্তম নৌবহরকে। আমরা এক দিনের জন্য কি সিঙ্গাপুরে রাখতে পারি? তিনি বিষয়টি নিয়ে নিক্সন, রজার্স। ও কোনালির সঙ্গে আলােচনার পরামর্শ দেন। কিসিঞ্জার আরাে উল্লেখ করেন যে, আমার সুপারিশ হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদে যদি অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে অথবা সােভিয়েতরা আবারও ভেটো দেয়, তাহলেও আমাদের উচিত হবে যুদ্ধবিরতি ও পরে। সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব সমর্থন করা। এমনকি সােভিয়েতের কাছ থেকে কোনাে সাড়াশব্দ না পেলেও এটাই হবে আমাদের অবস্থান। পাক পররাষ্ট্রসচিব সুলতান লিখেছেন, “আজ যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে বৈরিতা বন্ধ এবং ভারত ও পাকিস্তানি সৈন্যদের পরস্পরের ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়া সংক্রান্ত এক প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিমালার আওতায় উদ্বাস্তুদের স্বেচ্ছাপ্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত শর্তও জুড়ে দেয়া হয়।
এই প্রস্তাবেও সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। আসলে উভয় পক্ষই এভাবে চাইছিলেন কালক্ষেপণ। নিক্সন প্রশাসন আজও সােভিয়েতের কাছ থেকে প্রত্যাশিত জবাব পায়নি। তবে মস্কো থেকে নিক্সনের কাছে এই বার্তা পৌছায় যে, আমাদের মধ্যে যে গােপন মতবিনিময় চলছে, তার ভিত্তিতে আমরা আপনাকে এটা জানাচ্ছি যে, ভারতের সঙ্গে পুরাে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। আমাদের এই প্রচেষ্টার ফলাফল কোনাে বিলম্ব ছাড়াই আপনাকে অবহিত করব।’ এই বার্তার সঙ্গে যুক্ত থাকা একটি হাতে লেখা নােট থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, বার্তাটি এদিন ভাের ৫টায় ওয়াশিংটনে পৌছায়। হটলাইনে আসা এই বার্তাটি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানাে হয় ৭টা ৩৭ মিনিটে। এ সম্পর্কে হেগের মন্তব্য সন্দেহ নেই আমরা এখনাে পর্যন্ত না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায়। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব জাতিসংঘের মাধ্যমে কীভাবে কার্যকর হবে, তা নিয়ে ইয়াহিয়া ও নিক্সনের নীতিনির্ধারকরা ব্যস্ত ছিলেন। বিকেল ৪টা ৭ মিনিটে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে হেগ এক ব্যাকচ্যানেল বার্তায় জানান, ‘সােভিয়েতের সঙ্গে একটা আপােস ফর্মুলায় পৌছাতে ভুট্টো নিউইয়কে রাষ্ট্রদূত বুশের সঙ্গে কথা বলেছেন। এতে আমাদের আনীত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সংশােধনের সুপারিশ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের প্রতি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানাে হচ্ছে। এই সমঝােতায় অবিভক্ত পাকিস্তানের মধ্যে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার আশু স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।’
জেনারেল হেগ ১৩ ডিসেম্বরে এসে ভুট্টোর অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রস্তাবের নাজুক দিক সম্পর্কে ফারল্যান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হেগ লিখেছেন, ‘এই পর্যায়ে এমন প্রস্তাব উত্থাপন আমাদের অবস্থানকে দ্রুত জলাঞ্জলি দিতে পারে। সােভিয়েতরা অবিভক্ত পাকিস্তান কথাটিতে ভেটো দেবে এবং তার পরিণতিতে সৃষ্টি হবে অচলাবস্থা। রাজনৈতিক প্রশ্নে বিতর্ক শুরু করলে তা অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে পৌঁছে দেবে শূন্যের কোঠায়। হেগ ফারল্যান্ডকে দ্রুত জানাতে বলেন যে, ভুট্টোর এই প্রস্তাবে ইসলামাবাদের নীতি প্রতিফলিত হয়েছে কি না? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তার ভিত্তি কী? যােশেফ ফারল্যান্ড বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন পাক পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খানের সঙ্গে। তিনি তাকে নিশ্চিত করেন যে, ভুট্টোর ওই উদ্যোগে ইয়াহিয়ার অনুমােদন রয়েছে। ওদিকে জাতিসংঘের কাছে জেনারেল রাও ফরমান আলীর ইতঃপূর্বের “আত্মসমর্পণ’ বার্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পাকিস্তানে নিযুক্ত সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত উদ্যোগ নেন। সুলতান খান তার “মেমােরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশন্সে’ লিখেছেন, যুদ্ধবিরতির জন্য রাও ফরমান আলীর প্রস্তাবে সরকারের সায় রয়েছে কি-সােভিয়েত দূতের এই প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, জেনারেল ফরমান আলী তার অধিকারের সীমা অতিক্রম করেছেন। ঢাকার জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে তার ওই বার্তা পাঠাননা ঠিক হয়নি।
এদিকে কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে আজ জানিয়েছেন, রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড জানিয়েছেন যে ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপদ এলাকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর ও জাতিসংঘের দুটি বিমান ভারতীয় হামলায় ধ্বংস। হয়ে গেছে। বিমান দুটি পাকিস্তানি বিমান থেকে পৃথক এলাকায় রাখা ছিল। আমাদের প্রতিরক্ষা প্রতিনিধি ইতােমধ্যেই নিশ্চিত যে, ভারত দুটি বিমানই পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে। এ ঘটনার পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা-কে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনাে জবাব দেয়নি। ঝা যুক্তি দিয়েছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে নিরপেক্ষ কোনাে দেশের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা শনাক্তকরণ সমস্যার কারণে দুর্ঘটনাবশত ঘটেছে বলে ঝা উল্লেখ করেন। রজার্স অবশ্য ঝাকে বলেছেন, জাতিসংঘের বিমানটির রঙ ছিল সাদা। সুতরাং ভুলবশত এটা। ঘটেছে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানান, আমি এ ব্যাপারে আর কোনাে পদক্ষেপ না নিতে বলেছি।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন