You dont have javascript enabled! Please enable it! মার্কিন ও সােভিয়েত নৌবহরের সমরসজ্জা - সংগ্রামের নোটবুক

মার্কিন ও সােভিয়েত নৌবহরের সমরসজ্জা

কিসিঞ্জার ১১ ডিসেম্বর নিক্সনকে এক স্মারকে জানিয়েছেন, অসমর্থিত সূত্রে এমন খবরও পাওয়া গেছে যে, সােভিয়েতের ভূমধ্যসাগরীয় নৌবহরকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও এটা সত্য যে, আফ্রিকার উপকূল থেকে এই নৌবহরের যাত্রার জন্য কিছুটা সময় লেগে যাবে। ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপণযােগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত সােভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থানরত স্কোয়াড্রনকেও যুক্ত করতে পারে। একটি গাইডেড-মিসাইল, লাইট ক্রুজার, একটি ডিজেলচালিত ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন ও একটি তেলবাহী জাহাজ গতকাল সুসিমা প্রণালী দিয়ে জাপান সাগর ত্যাগ করেছে। এর গন্তব্য সম্ভবত ভারত মহাসাগর। ক্রুজার ও সাবমেরিন যৌথভাবে বিশটি এসএস-এনএস ক্রুজ মিসাইল বহন করছে। এ ছাড়া তিনটি স্পেস সাপাের্ট জাহাজসহ ষােলটি সােভিয়েত নৌ ইউনিট বর্তমানে ভারত মহাসাগর এলাকায় মােতায়েন রয়েছে। যােগাযােগ নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত গােয়েন্দা তথ্যের ইঙ্গিত হচ্ছে, বেশিরভাগ সােভিয়েত জাহাজ শ্রীলঙ্কা ও সােকোত্রার কাছাকাছি। যদিও আরব সাগরে একটি স্পেস-রিলেটেড ইউনিট’ হয়তাে ব্রিটিশ নৌবহরের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। তবে এটা লক্ষণীয় যে, মােলটি জাহাজের মধ্যে অর্ধেকেরও কম সমরসজ্জায় সজ্জিত। নিক্সন নিজ হাতে এই দলিলে নােট লিখেছেন, “কে (কিসিঞ্জার), এসব কি পাল্টা-ব্যবস্থার লক্ষণ?  নিক্সন ও কিসিঞ্জার নিজেদের সামরিক ক্ষমতা অনুশীলনের চিন্তা বাদ দিয়ে আজ চীনের আশায় প্রহর গােনেন। আজ বেলা ৩টায় নিক্সন ও কিসিঞ্জারের আলােচনায়। এই বাস্তবতাই ফুটে ওঠে। কিন্তু আজই তারা জানতে পারেন চীন তাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। কিসিঞ্জার আমি মােটামুটি নিশ্চিত যে, চীনারা কিছু একটা করতে যাচ্ছে এবং আমরা শিগগিরই তা দেখব। আমার ভুলও হতে পারে। কারণ এ বিষয়ে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনাে গােয়েন্দা তথ্য নেই।

নিক্সন : কিন্তু তারা যে কিছু একটা করছে তার তাে কোনাে আলামত দেখছি না। কিসিঞ্জার তারা তাদের মাউন্টেন ডিভিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিডে অবস্থানরত নিক্সনের সঙ্গে। ওয়াশিংটন থেকে পুনরায় কথা বলেন কিসিঞ্জার। তিনি প্রেসিডেন্টকে জানান, রাশিয়ার কাছ থেকে কোনাে সাড়া নেই। ভুট্টো আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। কিন্তু আমি তা নাকচ করে দিয়েছি। চীনারা তাকে বলেছে, তারা কিছু করতে চায় বটে, কিন্তু আমাদের নিয়ে তাদের মনে সন্দেহ ঢুকেছে। কারণ আমরা বলতে শুরু করেছিলাম এটা এক আগ্রাসন। কিন্তু পরে তা প্রত্যাহার করেছি। তার পরে বলেছি এটা যথার্থ ছিল না’। কিন্তু পরে সে অবস্থান থেকে সরে এসে ঘােষণা দিয়েছি কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রাখার। এখন রুশরা যদি চীনাদের চাপ দেয়, তাহলে আমরা কী করব, সে বিষয়ে তারা আমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চাইছে। কিসিঞ্জার এ পর্যায়ে বলেন, আপনি বুঝতেই পারেন, আমি ভুট্টোকে সাহায্য করতে পারিনি। ভুট্টোর মতে, চীনারা বলেছে রুশরা বিশ্বের বৃহত্তম কাপুরুষ।

এদিন সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে সােভিয়েত মিনিস্টার কাউন্সেলর ইউরি ভরৎসােভ টেলিফোনে কথা বলেন কিসিঞ্জারের সঙ্গে। কিসিঞ্জার জানতে পারেন যে, সােভিয়েত উপ-পরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাসিলি কুজনেৎসভ এক মিশনে দিল্লি যাচ্ছেন। দুজনের কয়েক মিনিটের আলােচনার ট্রান্সক্রিপশন থেকে দেখা যাচ্ছে, কিসিঞ্জারের সঙ্গে ভরৎসােভের এদিনের আলােচনা ছিল হেঁয়ালিপূর্ণ। তিনি কুজনেৎসভের ভারত সফর সম্পর্কে বলেন, ‘আমার এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, আমরা যা নিয়ে আলােচনা (যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমঝােতা) করেছি নিশ্চয় এই মিশনের সঙ্গে। তার সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু সরকারিভাবে আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না।’ গত মে মাসে মার্কিন গােপন দলিল প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সম্পাদক প্যানেল ফুটনােটে এ সম্পর্কে উল্লেখ করেন যে, আজ রাত পৌনে ৯টায় কিসিঞ্জার নিক্সনকে ওই সােভিয়েত উদ্যোগের কথা উৎসাহের সঙ্গে জানান। কিন্তু নিক্সন ছিলেন সংশয়গ্রস্ত।

 নিউইয়র্কে অবস্থানরত ভুট্টোর সঙ্গে কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন থেকে টেলিফোনে কথা বলেন। কিসিঞ্জার শুরুতেই অভিমানের সুরে বলেন, মি, ভুট্টো, আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি এবং এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান হচ্ছে : প্রথমত, আমরা এ পর্যন্ত যা কিছু করেছি, তার আলােকে এটা নিরঙ্কুশভাবে আবশ্যক যে, আমরা যে পর্যাপ্ত কিছু করিনি, তা আমরা চীনা অভিযােগের নিরিখে ব্যাখ্যা করতে চাই না। কারণ অভিযােগের ধরন যদি এই হয়, তাহলে কেন আমরা কিছু করতে যাব। আমি বলতে চাইছি, আমরা আমাদের জনমতের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমরা আমাদের সমগ্র আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। ভুট্টো এ সময় বলেন, আমি পুরােপুরি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে কিসিঞ্জার তাকে বলতে থাকেন, আগামীকাল সকালের মধ্যে সােভিয়েতের কাছ থেকে আমরা যদি কিছু শুনতে না পাই তাহলে কঠোর বিবৃতি নিয়ে আমরা নিরাপত্তা পরিষদে যাব। বলব, এখন যুদ্ধ অব্যাহত রাখার অর্থ হচ্ছে এটা আগ্রাসনের এক নগ্ন দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া আমরা পাবলিক স্টেটমেন্ট’ও দেব। আর সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান নিয়ে আর সন্দেহ থাকবে না।

সম্ভবত পূর্বাংশের স্বাধীনতার অনিবার্যতার দিকে ইঙ্গিত করে কিসিঞ্জার বলেন, যা ঘটেছে তাতে আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় হচ্ছে আপনাদের অস্তিত্ব টেকানাে। কিসিঞ্জারের এই বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, এই সময়ে বাংলাদেশের চিন্তা বাদ দিয়ে তারা আসলে বিশ্বের মানচিত্র থেকে পশ্চিম পাকিস্তান/পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাম-নিশানা মুছে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিসিঞ্জার ভুট্টোকে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চীনা অবিশ্বাস নিয়ে খোটা দিলে ভুট্টো বলেন, আশা করি আপনি ভুল বুঝবেন না। আমরা চীনাদের বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমরা সন্তুষ্ট। কিসিঞ্জার তাকে বলেন, যা হােক চীনাদের এখন এটা বােঝান। যে, আমাদের সঙ্গে শক্তিশালী সমর্থক রয়েছে। আগামীকাল রাতের মধ্যে সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করবে।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন