You dont have javascript enabled! Please enable it! নিক্সন-কিসিঞ্জারের ড্রেস রিহার্সাল - সংগ্রামের নোটবুক

নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সাল

আজ ৮ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থা ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের কথায় দড়ির ফাস ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। নিক্সন-কিসিঞ্জার নিশ্চিত হন যে, আইন অনুযায়ী পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহের পথ বন্ধ। তারা জানলেন, মিত্র পাকিস্তানের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোনাে আইনগত রক্ষাকবচ নেই। প্রায় ডজন খানেক চুক্তি, সমঝােতা, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি। খুঁজে পাওয়া গেল বটে। কিন্তু সেখানে কোনাে গােপন চুক্তির ইঙ্গিত নেই। সকাল। ১১টা ১৩ মিনিট থেকে ১২টা ২ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলাে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক। সিদ্ধান্ত হলাে সিআইএ পরিস্থিতির আন্তর্জাতিক তাৎপর্য। মূল্যায়ন করবে। প্রতিরক্ষা দপ্তর কাশ্মীরে পাকিস্তানের সামরিক সামর্থ্য যাচাই করবে। পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে সামরিক সরবরাহের বিকল্পগুলাে খতিয়ে দেখবে। জর্ডানের বাদশা হােসেনের কাছে ইয়াহিয়া অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। হােসেন অনুমতি চান যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু মার্কিন আইন অনুযায়ী এই বিধানই বলবৎ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যে দেশকে অস্ত্র দিতে অপারগ, সে দেশে তার অস্ত্র তৃতীয় দেশের মাধ্যমেও প্রেরণের সুযােগ রুদ্ধ। সে কারণেই বাদশা। হােসেনকে যুক্তরাষ্ট্র অনুমতি দিতে পারেনি। ইরানের শাহের কাছ থেকেও সুখবর পায়নি ওয়াশিংটন। তেহরানে একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কূটনীতিককে শাহ জানিয়ে দেন, ইন্দো-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে তিনি ভয় পাচ্ছেন। এ কারণেই পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে তিনি সােভিয়েতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানাের ঝুঁকি নিতে নারাজ। তবে শাহ এক বিকল্প প্রস্তাবে বলেন, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র জর্ডানকে তাদের এফ-১০৪ যুদ্ধ বিমান। পাঠাতে বলতে পারে। তখন শাহ দুই স্কোয়াড্রন ইরানি বিমান জর্ডানকে দেবে।

জর্ডানের যুদ্ধবিমানগুলাে আবার সম্ভাব্য ইসরায়েলি হুমকি মােকাবিলায় ছিল। ভারসাম্যসূচক। জর্ডান তার যুদ্ধবিমান পাকিস্তানকে দিলে ইসরায়েল সুযােগ নিতে পারে। নিক্সন বললেন, আমরা সম্ভবত ইসরায়েলের কাছ থেকে এ ব্যাপারে একটা অঙ্গীকার আদায় করতে পারি। কিসিঞ্জার একমত হন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গােন্ডামায়ারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলারও পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, হেনরি, আপনি তাকে (গােন্ডামায়ার) বলবেন-এটা রুশ চক্রান্ত, তাহলেই কাজে দেবে! কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এই বিকল্পও সমর্থন করেনি। নিক্সন ও কিসিঞ্জার এ নিয়ে আজ কথাও বলেন এটর্নি জেনারেল মিশেলের সঙ্গে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জনমত বাংলাদেশের যথেষ্ট অনুকূলে থাকায় তারা জাতিসংঘ কিংবা নিরাপত্তা পরিষদকে তাদের নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেও অক্ষম থাকেন।

বিভিন্ন নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই দুই নেতাই জানতেন, তাদের পক্ষে পাকিস্তানের জন্য মুখের কথা’ (লিপ সার্ভিস) ছাড়া সামরিকভাবে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সরল সত্য তারা ইয়াহিয়াকে কখনাে অবহিত করেছেন বলে জানা যায় না। এমনকি এই সীমাবদ্ধতার কথা তারা নিজেদের একান্ত সংলাপেও কদাচিত উল্লেখ করেন।  নিক্সন ও কিসিঞ্জার আজ দিনভর আলােচনা করেন, রুশ-ভারতকে দমাতে আর কী পদক্ষেপ নেয়া যায় । কিসিঞ্জার আক্ষেপ করেন, গােড়াতেই ভারতকে দারুণভাবে ভয় দেখানাে উচিত ছিল। ওই সময় মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কিছুটা নির্ভরশীল হতে উৎসাহী ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন। দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকের একটি দিনক্ষণও ছিল আসন্ন। কিসিঞ্জার চাইলেন এ দুটো ইস্যুতে সােভিয়েতকে চাপে রাখতে। আজ নিক্সনের একটি জিজ্ঞাসা-এখন তাহলে আমরা কী করব? কিসিঞ্জারের উত্তর-আমাদের দুটো বিকল্প । যতদূর সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর হামলা থেকে ভারতকে বিরত রাখতে তাকে ভয় দেখানাে। আর দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কড়া হুঁশিয়ারি দেয়া। তবে সামরিকভাবে আমাদের এখনাে একটা আশী। ভারতকে এটা বােঝানাে যে, পরিস্থিতি কিন্তু খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর রাশানদের বলা, তােমাদের কিন্তু চড়া মূল্য দিতে হবে। এই বাক্য শেষে কিসিঞ্জারই আবার বলেন, কিন্তু মি, প্রেসিডেন্ট, এতে কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ছয় বছর ধরে সামরিক ভারসাম্যহীনতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গড়িয়েছে। এটা রাতারাতি পূরণ করার নয়। প্রেসিডেন্ট জনসন এ জন্য প্রধানত দায়ী। তা ছাড়া আমলাতন্ত্রও কম দায়ী নয়। আমরা তাে জানতাম না ‘৭১-এ যুদ্ধ হবে। কিন্তু দেখুন তাে, ইয়াহিয়াকে দেয়া। আপনার অস্ত্র সহায়তার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বছর পার হলাে ।

দুই নেতার এদিনের সংলাপে পরিষ্কার যে, তারা রাশিয়া ও ভারতকে স্রেফ ভয় দেখানাে এবং চীন, জর্ডান ও ইরানকে উৎসাহিত করতেই বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিসিঞ্জার স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হস্তক্ষেপ করার কার্যকর হাতিয়ার নেই। নিক্সন বলেন, আমরা তাে চীনা সাহায্য ছাড়া এমন কিছু করতে পারি না। এরপর দুজনেই বুদ্ধি আঁটেন চীনাদের কাছে বার্তা পাঠাতে। চীন যেন সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করে ভারতকে ভয় দেখাতে সচেষ্ট হয়। তারা দুজনেই বলেন, আমরা যদি ঝুঁকি নিয়ে জর্ডানকে যুদ্ধবিমান পাঠাতে বলি, তাহলে আমরা চীনাদেরও খবরটা দিতে পারি। এবং বলতে পারি, তােমরা যদি সত্যিই পাকিস্তানের জন্য কিছু একটা করতে চাও, তাহলে এখনই উপযুক্ত সময়। নিক্সন একমত হন আমরা এটাই করব। কথা শেষ না হতেই কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, “মি, প্রেসিডেন্ট আমার অবশ্য আপনাকে হুশিয়ার করে দেয়া উচিত যে, আমাদের এই ধাপ্পা যদি ধরা পড়ে, তাহলে কিন্তু আমরা বিপদে পড়ব।’ নিক্সন ও কিসিঞ্জার উভয়ে জর্ডানের যুদ্ধবিমান প্রেরণ, চীনের সেনা মােতায়েন ও বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানাের সম্ভাব্য উদ্যোগকে ‘ড্রেস রিহার্সেল’ বা যুদ্ধ নাটকের মহড়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রাপ্ত নথিপত্র অনুযায়ী, এ রকমের প্রতারণাপূর্ণ সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে নৌবহর প্রেরণের ধারণাটি প্রথম এবং আজই কিসিঞ্জারের জবানীতে এসেছে।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন