চীনা হুমকি ছিল কল্পনা?
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান এম খান ৫-৭ ডিসেম্বরের ঘটনাবলি সম্পর্কে তার ডায়েরিতে লিখেন, পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে পরিচালিত হামলা থেকে সুফল মেলেনি। চরমপন্থি নীতিনির্ধারকরা পড়েছেন মহা ফাপড়ে তারা বিভ্রান্ত ও বিষন্ন । প্রশ্ন তুলছেন, এখন কী হবে। এম এম আহমেদ, যিনি ইমার্জেন্সি কমিটির অন্যতম সদস্য, বললেন, জাতি সামর্থ্যের অভাব বুঝবে। কিন্তু তারা কখনােই উদ্যোগহীনতা ক্ষমা করবে না। এমন অনেকেরই মত, পরাজয় ও অন্যরূপ পরিণতি যা-ই ঘটুক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত জুড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করতে হবে। এর সপক্ষে একটি বৈঠকও হলাে। প্রেসিডেন্ট বললেন, মাঠ পর্যায়ের সামরিক অধিনায়করাই উপযুক্ত কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত। এক অপারেশনে সবকিছু বাজি ধরার কথা যারা বলে, তারা মাথামােটা ও গর্দভ।
সুলতানের বর্ণনায় চীনা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার বক্তব্য অবাক করার মতাে। তবে কিসিঞ্জার ইতঃপূর্বে নিক্সনকে যে কথা লিখিতভাবে অবহিত করেছিলেন, তার সঙ্গে এ ভাষ্যের একটা মিল রয়েছে। কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানান, চীন বলেছে পাকিস্তানই মনে করে চীনা সাহায্যের দরকার নেই। সুলতান খানের গ্রন্থে (মেমােরি অ্যান্ড রিফ্লেকশনস, দি লন্ডন সেন্টার ফর পাকিস্তান স্টাডিজ, পৃষ্ঠা ৩৬৬-৩৬৭) লেখা আছে, ইয়াহিয়া বললেন, পাকিস্তান চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হােক তা তিনি চাননি। নিউজউইক-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া আর সব উপায়ে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে এবং তারা তা করছেও। চীনা অবস্থান সম্পর্কে ভারতও মােটামুটি নিশ্চিত ছিল।
এ দিনে প্রেরিত সিআইএর এক তারবার্তা অনুযায়ী, ইন্দিরা বলেন, পাকিস্তানের প্রতি চীনের পক্ষপাত সন্দেহাতীত থাকলেও তিনি আশা করেন যে, চীন কোনাে সংঘাতে নিজকে জড়াবে না। তবে সােভিয়েত ইন্দিরাকে হুশিয়ার করে দিয়েছে যে, চীন লাদাখ ও চুম্ব এলাকায় কার্যকর হস্তক্ষেপে সক্ষম। এবং তারা যদি তা করে, তাহলে রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, তারা উপযুক্ত পাল্টা ব্যবস্থা নেবেই। লক্ষণীয়, ইন্দিরার এই মন্তব্য সিআইএ যে সূত্রে পেয়েছে, তা গত মে মাসেও যথারীতি গােপনই। রাখা হয়েছে। ইন্দিরা সম্ভবত তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের ব্রিফিং দিয়েছিলেন এবং সেই সূত্রেই সিআইএর কাছে খবর আসে। ওই বার্তায় বলা হয়, ইন্দিরা বলেন, এ মুহূর্তে ভারতের তিনটি লক্ষ্য। যথাসম্ভব দ্রুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, শুধুই কৌশলগত কারণে পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণ অংশ সাময়িকভাবে ভারতভুক্তকরণ এবং চূড়ান্ত হচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক শক্তি পুরােপুরি ধূলিসাৎ করে দেয়া। ভবিষ্যতে তারা যাতে ভারতকে আর চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।
সুলতান লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনাটা সত্যই সামরিক দিক থেকে কতটা কার্যকর কিংবা নুরা কুস্তি’ (একটি ভুয়া যুদ্ধ) লি, তা মূল্যায়ন করা যেতে পারে বিশিষ্ট ফরাসি সামরিক বিশ্লেষক জেনারেল বিআফরের মন্তব্যে। ন্যাটো বাহিনীর এই সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফকে আমরা আমন্ত্রণ জানাই। ৭ ডিসেম্বরে তিনি পাকিস্তানে পৌছে লাহাের থেকে চুম্ব পরিদর্শন করেন। তিনি সৈন্যদের শৃঙ্খলায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মুশকিল হচ্ছে, তারা তাে সবাই ব্রিটিশ ধাচে অন্ধ। এমনকি ব্রিটিশদের চেয়েও তারা বেশি ব্রিটিশ। তিনি বললেন, পাকিস্তানের মতাে উন্নয়নশীল দেশের মিলিশিয়া বাহিনী থাকার বিকল্প নেই। স্থায়ী সেনাবাহিনী থাকবে একটি নিউক্লিয়াস হিসেবে, কিন্তু শুধু তারাই দেশ রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। তিনি সম্প্রতি রাশিয়া সফরকালে এ নিয়ে রুশ জেনারেলদের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে চীনের বৃহত্তম শক্তিসাম্য হচ্ছে তার পিপলস মিলিশিয়া । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাঠানদের দমন করে তাদের ভূখণ্ড দখল করতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে বড় নজির।’
সুলতান লিখেছেন, প্রেসিডেন্টের আত্মবিশ্বাস আজও গগনচুম্বী। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হচ্ছিল। সংকট বহুদিন ধরে ঘনীভূত হলেও আমরা যুদ্ধের জন্য ছিলাম সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। ৫ ডিসেম্বর আবিষ্কৃত হয় আমাদের তেলের মজুদ প্রায় নিঃশেষিত। করাচি বন্দর ভারতীয়দের দ্বারা অবরুদ্ধ। আমি যখন প্রেসিডেন্টকে। বললাম, ভারতীয়রা যদি এখন করাচিতে ছত্রীসেনা নামায়, তাহলে আমাদের নৌবাহিনীর তেমন কিছু করার থাকবে কি? প্রেসিডেন্ট অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে হাত তুললেন, ‘আমি কী করতে পারি? আমি প্রতিটি স্থান রক্ষায় অপারগ।’ অবাক হলাম। দেশের বৃহত্তম বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ও সর্বাধিনায়ক একি বলছেন! বিমান হামলা থেকে রক্ষা পেতে তড়িঘড়ি ইয়াহিয়া তার। বাগানেই একটি বাঙ্কার তৈরি করেন। তার বালির বস্তার ছাদের নিচে আমি দুবার তার। সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলােচনা করেছি!
এ দিনে ইয়াহিয়া নিক্সনের কাছে বার্তা প্রেরণের খসড়া নিয়ে আলােচনা করেন সুলতানের সঙ্গে। এই বার্তায় ফুটে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের পতন দরজায়। মার্কিন দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে, এই বার্তায় ইয়াহিয়া নিক্সনকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়ার অর্থ হচ্ছে আসাম, বার্মা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া অঞ্চল সােভিয়েত কর্তৃত্বে চলে যাওয়া। সুতরাং ভারতকে ঠেকান। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স আজ ভারতে তাদের দূতাবাসকে গতকাল ওয়াশিংটনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝায়ের সঙ্গে তার আলােচনার বিবরণ অবহিত করেন। এতে বলা হয়, মুজিব বা তার মনােনীত কোনাে প্রতিনিধির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের গ্রহণযােগ্যতা ঝা নাকচ করেননি। বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ভারতের সাড়া নেতিবাচক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন সেই প্রতিনিধি এবং তা গ্রহণযােগ্যই বা হবে কতটুকু।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন