You dont have javascript enabled! Please enable it!

সােভিয়েত দূতের বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী

৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৪টা। স্থান হােয়াইট হাউসের ম্যাপরুম। ড. হেনরি কিসিঞ্জার ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সােভিয়েত মিনিস্টার কাউন্সিলর ইউরি এম ভরনস্তব মুখখামুখি। কিসিঞ্জারই বৈঠকের উদ্যোক্তা। ‘আমি ভরনস্তবকে বললাম, প্রেসিডেন্ট আমাকে জানিয়েছেন, মি. ব্রেজনেভকে তিনি কাল একটি চিঠি দেবেন। কিন্তু বিষয়টি এতই জরুরি যে, তিনি এর বিষয়বস্তু মৌখিকভাবে আজই আমাকে জানিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। মূল কথা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট এটা বুঝতে অপারগ যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনকে উৎসাহিত করে আবার কোন মুখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর সম্পর্ক রক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। সােভিয়েত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকবচ এবং মিসরের শার্ম আল-শেখে নিরাপত্তা পরিষদের উপস্থিতি আশা করে। তাহলে কোন যুক্তিতে তারা একই সময়ে নিরাপত্তা পরিষদকে নপুংসকে পরিণত করতে বেপরােয়া।

এর আগে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের লেখা চিঠির বরাতে কিসিঞ্জার বলেন, তিনি তাে রাজনৈতিক সমঝােতা প্রশ্নে বিরাট গুরুত্বারােপ করেছিলেন। এ ব্যাপারে আপনাদের সর্বশেষ মনােভাব কী। যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহার প্রস্তাব কার্যকর হলেই যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সমঝােতা প্রশ্নে সােভিয়েতের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবে। কিসিঞ্জার রাজনৈতিক সমঝােতা বলতে পূর্ববাংলার বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনকেই যে বুঝিয়েছেন, তাও তিনি গােপন রাখেননি।  কিন্তু এ দিন সুনির্দিষ্টভাবে বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী করেন সােভিয়েত দূত। তিনি বলেন, ‘ইন এ উইক দি হােল ম্যাটার উইল বি ওভার’ অর্থাৎ এক সপ্তাহে পুরাে বিষয়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। জবাবে কিসিঞ্জার যে মন্তব্য করেন, তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে কি না তা ভাবনা উদ্রেকের জন্য যথেষ্ট মনে হতে পারে। এ সময়ে তার যে মন্তব্য তা পরে নিক্সনও পুনর্ব্যক্ত করেন। কিসিঞ্জার বলেন, এক সপ্তাহে এর শেষ হবে না। এটা নির্ভর করছে কীভাবে ঘটনাবলির পরিণতি ঘটে তার ওপর।’ জবাবে ভরনস্তব “তিনি এ কথা অনতিবিলম্বে মস্কোকে জানিয়ে দেবেন।’ এই বৈঠকের পরপরই কিসিঞ্জার টেলিফোনে ভরনস্তবকে জানিয়ে দেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন দক্ষিণ এশিয়ার সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত সম্পর্কের এক বিভাজক রেখা হিসেবে দেখছেন। কিসিঞ্জার বলেন, আমি এইমাত্রই প্রেসিডেন্টকে আপনার সঙ্গে আলােচনার বিষয় অবহিত করেছি। এবং প্রেসিডেন্ট মস্কোর কাছে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, এক সপ্তাহ বা অনুরূপ সময়ে এটা শেষ হতে পারে। কিন্তু বর্তমানের ধারা (বাংলাদেশের স্বাধীনতা) অব্যাহত থাকলে, আমাদের দিক থেকে এর কিন্তু অবসান ঘটবে না।’ (টেলিফোন সংলাপের ট্রান্সক্রিপশন, ডিসেম্বর ৫, বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট, লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, পাণ্ডুলিপি বিভাগ, কিসিঞ্জার পেপার্স, বক্স ৩৭০)। কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথা ‘হােয়াইট হাউস ইয়ার্সে’ (পৃষ্ঠা- ৯০০) লিখেছেন, একাত্তরের ওই ঘটনাবহুল পর্বের বেশ কিছুটা সময় তৎকালীন সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আনাতলি দরিনিন মস্কোতে ছিলেন। আর সেই সুবাদেই ভরনস্তবের সঙ্গে তার সংলাপ চলে। ভরনস্তব যে কোনাে বার্তা গ্রহণ ও তা হস্তান্তরে এখতিয়ার প্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু সমঝােতার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন না।

ভরনস্তব ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের মর্যাদায় কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস সিআইএসের জন্য বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। তিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত (১৯৯০-৯৪), উপ-প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি (১৯৮৬-৯০) ও ‘৯১-তে রুশ প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮-১৯৮৩ সালে তিনি ছিলেন ভারতে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত। এদিন কিসিঞ্জার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সের টেলিফোন সংলাপে এটা স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশ সংকটে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। উদ্বিগ্ন কিসিঞ্জারের মন্তব্য : গতকাল দুপুরে একটি ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা কিছুদিন আগে চীনাদের বলেছিলাম, নিউইয়র্কে আমাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হােক। তারা এখন বলছে, এটা তারা চায় না। রজার্স কিসিঞ্জারকে ধারণা দেন, পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিস্থিতির যে বিবরণ গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে তা কিছুটা হলেও অতিরঞ্জিত । রজার্স গতকাল নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে। তার মনে প্রশ্ন, আমরা এখন কী করব? দীর্ঘ মেয়াদে আমরা কি সর্বাত্মকভাবে মােকাবিলা বা অবিকল চীনের অবস্থান নিতে চাই? নাকি এই দুই অবস্থার মাঝামাঝি থাকব? এ মুহূর্তে আমরা মনে হয় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছি। কিসিঞ্জার বলেন, আমাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে চীনের দিকেই দুই-তৃতীয়াংশ এগিয়ে আছি বলাই ভালাে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, একটি দেশ ভেঙে দিতে সােভিয়েত-ভারতীয়দের নগ্ন খেলার আমরা প্রত্যক্ষদর্শী । লক্ষণীয়, রজার্স কিসিঞ্জারকে বােঝাতে চান যে, প্রেসিডেন্টের উচিত হবে সতর্কতার সঙ্গে এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলা। কারণ এটা এমন এক ইস্যু, যা চলতে থাকলে একটি অধিকতর শান্তিপূর্ণ বিশ্বে আমাদের মর্যাদা ক্ষগ্রিস্ত হতে পারে।

আমি মনে করি প্রেসিডেন্টের এখন সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনায় আমাদের ভরসা রাখতে হবে। কিসিঞ্জার তার এই যুক্তি নাকচ করে দেন। বলেন, প্রশ্নই আসে না। তার যুক্তি, পাকিস্তান দুই টুকরাে হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে। রজার্স তাকে সতর্কতার সুরে বলেন, আমি আপনার এ কথা চ্যালেঞ্জ করছি না, তবে আমাদের কিন্তু অস্থিরতার সঙ্গে কিছু করা ঠিক হবে না। রজার্সের ইঙ্গিতটি কিসিঞ্জার ঠিকই বুঝতে পারেন। বলেন, এখনাে পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ভেবেচিন্তে তেমন কোনাে পদক্ষেপ কিন্তু নেননি। নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মধ্যকার এক টেলিসংলাপে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পােস্টের প্রথম পাতায় বাংলাদেশ পরিস্থিতির যে বয়ান আজ। ছাপা হয় তাতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রভাব ছিল। কিসিঞ্জার ও নিক্সন দুজনেই সন্তোষ প্রকাশ করেন। কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলেন, এই কভারেজে বৈরিতা ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতকেই বেশি দায়ী করা হয়েছে। এবং তারা এ পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তার একটা তালিকাও ছাপা হয়েছে। উচ্ছসিত কিসিঞ্জার বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট এটা ঠিক তেমনই, যেমনটা আপনি দেখতে চেয়েছিলেন।

নিরাপত্তা পরিষদে আনা মার্কিন রেজুলেশনে যুদ্ধবিরতি ও উভয়পক্ষের সেনা প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করে কিসিঞ্জার নিক্সনকে জানান, রাশানদের প্রস্তাবে পাকিস্তানের কাধে দোষ চাপানাে হয়েছে। আহ্বান জানানাে হয়েছে একটি রাজনৈতিক সমঝােতায়। ১১-২ ভােটে প্রস্তাবের নিষ্পত্তি ঘটেছে। ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। রুশ প্রস্তাবে তারা ছাড়া ভােট দিয়েছে শুধু পােল্যান্ড। ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিরত থাকে। চীন ভােটে অংশ নেয়নি। কিসিঞ্জার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, বড় ভুল হয়েছে। কােন মার্কেটে ওদের ঢুকতে দেয়া উচিত হয়নি।

আজ সকালে সােভিয়েত বার্তা সংস্থা তাসের মাধ্যমে রাশানরা কার্যত সম্ভাব্য চীনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দুই নেতা একমত হন যে, রুশভারতের ক্ষমতার খেলায় চীন এবং কিছুটা আমরা অবমাননার শিকার হচ্ছি’। কিসিঞ্জার নিক্সনের কাছে রজার্সের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন। বলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট সর্বদাই মুজিবের মুক্তির পক্ষে। আর এটা কার্যত রুশ অবস্থান। এ দিন দুই নেতার আলােচনায় সন্দেহাতীতভাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মতপার্থক্য ফুটে ওঠে। যেমন নিক্সন জানতে চান, তারা কি এখনাে মুজিব ইস্যু আঁকড়ে আছে? তারা কী চায়? আমাদের কী করা উচিত বলে তারা মনে করে? কিসিঞ্জার নিশ্চিত করেন, তারা আর কোনাে সুপারিশই দিতে চাইছে না। তারা চাইছে আমরা যেন আমাদের অবস্থান রিভিউ করি। এবং আমাদের তাড়াহুড়াে করা উচিত। নয়। কিসিঞ্জার নিজেদের অবস্থানের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। আমরা আসলে ধরা পড়ে গেছি। আমরা হয়তাে আরাে কঠোর হতে পারতাম। কিন্তু আমাদের কোনাে অভ্যন্তরীণ অবস্থান নেই। সে কারণে আমরা যা কিছুই বলেছি ও করেছি, কাজের কাজ কিছু হয়নি। শুধু বিড়ম্বনাই বেড়েছে। আর পাকিস্তানের বিভক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে।’

কিসিঞ্জারের এ বক্তব্যের সঙ্গে নিক্সন একমত হন। কিসিঞ্জারের কথায় এটাও পরিষ্কার হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন তাদের প্রেসটিজ ইস্যু হয়ে উঠেছিল। ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মিত্ররা পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা দেখছেন, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হচ্ছেন। আমি বুঝতে পারি না, ভারতের দিকে এখন ঝুঁকে পড়ে এ অবস্থা থেকে কীভাবে আমাদের পরিত্রাণ মিলতে পারে। আমি স্বীকার করছি, আমাদের এখন ভেঙে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা সােভিয়েতদের শ্রদ্ধা হারাব, চীনও আমাদের অবজ্ঞা করবে, অন্যান্য দেশও যা বােঝার বুঝে নেবে।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!