চীনের কিসিঞ্জারের সংশয়
আজ ২ ডিসেম্বর। মার্ক টালি সম্পাদিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আজ পাক সামরিক সূত্র ৫১৫ গুর্খা রেজিমেন্টের দুই ভারতীয় সৈন্যের শনাক্তকরণ নম্বরসহ আলােকচিত্র প্রকাশ করে। এই দুই সৈন্য পাকিস্তানি ভূখণ্ড জৈন্তাপুরে নিহত হন। বর্তমান যুদ্ধে ভারতীয় সম্পৃক্ততা প্রমাণের উদ্দেশ্যেই এ উদ্যোগ। গত ২৪ ঘণ্টায় বিদ্রোহীরা, সরকারি মতে দুবৃত্তরা রাজধানীর বিভিন্ন অংশে পাঁচটি বােমার বিস্ফোরণ ঘটায়। একটি বামপন্থি দলের দপ্তরে একটি বােমা ফাটে, যখন দক্ষিণপন্থি নেতা প্রফেসর গােলাম আযম ইঙ্গিত দেন, অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হতে পারে। এতে ভুট্টো থাকবেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মন জয় করতে প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে নির্বাচন করতে হবে।’
কিসিঞ্জার আজ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন, “জনশক্তি ও সরবরাহে ভারতের তুলনায় বহুগুণ বেশি পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমেই পিছু হটছে। তারা ভারতীয় বাহিনীর চাপের মুখে ইতােমধ্যেই উল্লেখযােগ্যসংখ্যক প্রাদেশিক শহর হাতছাড়া করেছে। গেরিলারা দেশের অভ্যন্তরের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছে। তারা অবাধে ঘুরছে। পাকসেনাদের এখন মূলত সীমান্ত মােকাবিলায় জড়াে করা হচ্ছে। বহু শহরে বাংলাদেশী পতাকা উড়ছে। এমনকি ঢাকা থেকে ১৭ মাইল দূরবর্তী শহরের নিয়ন্ত্রণভারও গেরিলাদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানে জাহাজ চলাচল রােধে নিজেদের বাহিনীর অংশগ্রহণে ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনী নেভি গঠন করেছে। জাতিসংঘে আপাতত স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। জাপান ও বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানে আগ্রহ হারিয়েছে। সােভিয়েত ও ভারতীয়রা এ মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় থেকে নিজেদের পন্থা খুঁজছে। জাতিসংঘে পাক রাষ্ট্রদূত অবশ্য ভাবছেন ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানে পিন্ডির কাছ থেকে তিনি নির্দেশ পেতে পারেন।”
টোকিও ডেটলাইনে রয়টার্স বলেছে, জাপান সরকার ২৭ নভেম্বর মিসেস গান্ধীর একটি চিঠি পেয়েছে। চিঠিতে বিরােধ মীমাংসার জন্য জাপানি সহযােগিতা চাওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের প্রস্তাবও নাকচ করা হয়েছে। জাপান সরকার মনে করে, পাক-ভারত সংঘর্ষে টোকিও বৃহৎ শক্তিবর্গের মতাে গভীরভাবে জড়িত না থাকায় তার পক্ষে সমঝােতার উদ্যোগ নেয়া সহজ হবে। | লক্ষণীয় যে, কিসিঞ্জার চীনের ভূমিকা সম্পর্কে নিক্সনকে আজ সতর্ক করে দেন। তিনি মন্তব্য করেন, গত দশ দিনে চীনা গণমাধ্যমে পাক-ভারত সংকট ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। ভারতীয় তৎপরতাকে ‘আগ্রাসন’ এবং ‘উসকানি’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। সােভিয়েত সম্পৃক্ততাকে সরাসরি টার্গেট করা হচ্ছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সংকটকে তার নিরাপত্তার জন্য কোনাে হুমকি বিবেচনার বিষয়টি তুলে ধরছে না। কিসিঞ্জারের কথায় পাকিস্তানের প্রতি চীনা প্রকাশ্য সমর্থনের বিষয়টি এখনাে সাধারণই রয়ে গেছে। এমনকি অন্তত একবার তারা পরােক্ষভাবে এ ইঙ্গিতও দিয়েছে যে, পাকিস্তানের সহায়তার কোনাে দরকার নেই। তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলােচনা’ চাইছে।
রয়টার্স এদিনই পিকিং ডেটলাইনে খবর দেয়, চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন নিয়েন এক অনুষ্ঠানে পাক-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ শুরুর জন্য দিল্লি ও মস্কোর কঠোর সমালােচনা করেন। এ সময় ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিশ ও ভারতীয় সামরিক অ্যাটাচে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। | প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা ভালাে তা-ই করব। বিপুলসংখ্যক সিনেটর, বিদেশী মন্ত্রী প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ঘুরে গেছেন। কিন্তু তা কি বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে? এসব বৃহৎ জাতি গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানের প্রতি কি আহ্বান জানিয়েছে? না, তারা তা করবে না। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযােগ খণ্ডন করে গান্ধী বলেন, তাদের জন্য উপযুক্ত মনে হলে তারা কিন্তু অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। চীনের মতাে দেশও অন্য জাতির বিষয়ে নাক গলিয়েছে। বলা হচ্ছে, আমরা ভারতের মাটি মুক্তিবাহিনীকে ব্যবহার করতে দিয়েছি। আমরা কীভাবে এটা প্রতিরােধ করব। পূর্ব বাংলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে, পুরাে সেনাবাহিনী মােতায়েন করলেও তাদের রােধ করা সম্ভব হবে না। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মােতায়েন করে তারা মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু তারা কি ভুলে গেছেন, সব বিধিনিষেধের দেয়াল ভিয়েতনামের গেরিলারা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। তিনি ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণের সমালােচনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “দেহ-বর্ণের গর্বে তিন হাজার মাইল দূরে বসে ভারতকে তার ইচ্ছেমতাে কাজ করার হুকুম চালানাের দিন আর নেই। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতকে আক্রমণকারী বলে ব্রিটেন ভুল করেছিল। | ডেইলি টেলিগ্রাফে ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ ঢাকা থেকে লিখেছেন-মনে হচ্ছে, ভারতীয় কোনাে অভিযানেই এ পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের (৬০০ থেকে ৮০০) সৈন্য। অংশ নেয়নি। অধিকাংশ অভিযানেই শুধু এক কোম্পানি (১২০ জন) সৈন্য অংশ। নিয়েছে। ভারতীয়রা রংপুরের কাছে গতকালই ভারী গােলাবর্ষণ শুরু করে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে কলকাতা ডেটলাইনে ডেভিড লােশক লিখেছেন, ভারতীয় হাইকমান্ডের পরিকল্পনা হলাে, যদি একবার যশােরকে মুক্ত করা যায় তাহলে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এপিপির এক রিপাের্টে বলা হয়, আম্মানের দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক আল রাই ও আল দোর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় হামলার কঠোর নিন্দা করেছে।
ইন্দিরা গান্ধীর অভিযােগের জবাবে ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসে পাকিস্তান অভিযােগ করে, কাশ্মীর সীমান্তে ভারতীয় বিমানবাহিনী আগ্রাসীভাবে তৎপরতা চালিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের আকাশসীমায় তিন-চার দিনের তৎপরতার পর আজ বিভিন্ন চৌকিতে হামলা চালায়। এদিন পাক মুখপাত্র ভারতে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি স্থগিতের মার্কিন সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাবের প্রসংশনীয় পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পিন্ডিতে সফররত মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবে মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরােধ জানালেও তা রক্ষা করা হয়নি। ইয়াহিয়াকে তিনি বলেছিলেন, মুজিব জীবিত আছেন কি না তিনি তা দেখতে চান। মুজিবের স্বাস্থ্য চমৎকার আছে-এ মর্মে প্রেসিডেন্ট তাকে অবহিত করেন। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান ওলকে আজ রাতে পিন্ডিতে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেন্টোর উদ্যোগী হওয়া উচিত। রয়টার্স ত্রিপলি ডেটলাইনে এক রিপাের্টে বলেছে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের নেতা মাহমুদ আলী লিবিয়ার গাদ্দাফির কাছে ইয়াহিয়ার চিঠি হস্তান্তর করেন। কিন্তু তার বিষয়বস্তু তিনি প্রকাশ করেননি। জানা গেছে, এই বাঙালি মাহমুদ আলী বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আজও মন্ত্রীর মর্যাদা ভােগ করছেন। সরকার আসে যায়, কিন্তু মাহমুদ আলী গাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েই চলাফেরা করেন।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন